ভিডিও EN
  1. Home/
  2. শোকাবহ আগস্ট

বাঙালির আওয়ামী লীগ

এমএম নাজমুল হাসান | প্রকাশিত: ০৩:২৯ পিএম, ২৩ জুন ২০২৪

ইতিহাস নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখে যে কর্ম বা রাজনৈতিক দল তার ভূমিকা অনবদ্য। তেমনি ইতিহাস নিয়ন্ত্রণে রাখার কাজটি করেছে বঙ্গীয় রাজনীতির ভূমিপুত্রখ্যাত সংগঠন আওয়ামী লীগ। এই বদ্বীপের সমতা ও ন্যায্যতা নিয়ে জন্মলগ্ন থেকেই সংগ্রাম করা একমাত্র রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ।

বদ্বীপের রাজনীতি ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে আওয়ামী লীগের ভূমিকা ঐতিহাসিক। উর্দু আওয়াম থেকে আওয়ামী লীগের নামকরণ, যার অর্থ জনগণের দল। ২৩ জুন দিনটি শুধু আওয়ামী লীগের জন্য নয়, বাংলাদেশের ইতিহাসে গৌরবময় দিন। দেশের প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে আওয়ামী লীগ ছিল অগ্রভাগে। সময়ের পরিক্রমায় আওয়ামী লীগ এখন পরিণত ও পুরোনো রাজনৈতিক দল।

ভ্রান্ত দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে সাতচল্লিশে দেশ ভাগের পর পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। এসময় পূর্ব বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগণ পাকিস্তানের সঙ্গে একীভূত হয়। দেশ ভাগের পূর্বে ভারতবর্ষে প্রধান দুই দল কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত ছিল। এরই ভিত্তিতে কংগ্রেস নেতারা ভারত এবং মুসলিম লীগ নেতাদের পাকিস্তানের দাবিতে দুটি আলাদা রাষ্ট্রের জন্ম হয়।

মুসলিম লীগ নেতারা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখলেও গণতন্ত্র ও পাকিস্তানের দুই অংশের জনগণের মৌলিক অধিকারের সমতায় কোনো কাজ করেনি। বরং পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ববঙ্গের জনগণের ন্যায়সংগত অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে বিভিন্ন কূটকৌশল অবলম্বন করতে শুরু করেন পশ্চিম পাকিস্তানি নেতারা, যা এদেশের সচেতন নাগরিকদের নিকট প্রতারণা হিসেবে ধরা দেয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার টিকাটুলির কেএমদাস লেনের কাজী হুমায়ুন রশীদের রোজ গার্ডেনের দ্বিতীয় তলায় ক্ষমতায় থাকা মুসলিম লীগের বাইরে নতুন রাজনৈতিক দল হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের আত্মপ্রকাশ ঘটে। সময়ের পরিক্রমায় দলটির নাম পরিবর্তন হয়ে আজ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।

আওয়ামী লীগের পূর্বাপর
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব বাংলার জনগণ উপেক্ষিত হওয়ায়, মুসলিম লীগের প্রগতিশীল কর্মীরা নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠনের কথা ভাবতে শুরু করেন। এরই প্রেক্ষিতে রাজনীতিবিদ শওকত আলীর ১৫০ নম্বর মোগলটুলির বাড়িতে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু দল গঠনের জন্য সভা করার কোন মিলনায়তন পাওয়া যাচ্ছিল না। তখন কাজী হুমায়ুন রশীদ তাঁর টিকাটুলির রোজ গার্ডেনে সভা করার ব্যবস্থা করেন। সেখানে ২৩ জুন প্রায় তিনশ’ লোকের উপস্থিতিতে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি ও যুবনেতা শামসুল হককে সাধারণ সম্পাদক করে ৪০ সদস্যের পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করা হয়। নতুন গঠিত দলে জেলখানায় বন্দী যুবনেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে করা হয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। সেই সঙ্গে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করা হয়, যার সভাপতি করা হয় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে।

পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের পর প্রথম জনসভা করা হয় আরমানিটোলা মাঠে। যেখানে প্রায় চার হাজার লোকের সমাগম ঘটেছিল। জনসভাটি ভণ্ডুল করতে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের নেতারা স্থানীয় ক্যাডারকে (বড় বাদশাহ) পাঁচশ’ টাকা দেয়। পরে বড় বাদশাহ তার ভুল বুঝতে পেরে আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগদান করেন।

বদ্বীপের রাজনীতি ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে আওয়ামী লীগের ভূমিকা ঐতিহাসিক। উর্দু আওয়াম থেকে আওয়ামী লীগের নামকরণ, যার অর্থ জনগণের দল। ২৩ জুন দিনটি শুধু আওয়ামী লীগের জন্য নয়, বাংলাদেশের ইতিহাসে গৌরবময় দিন। দেশের প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে আওয়ামী লীগ ছিল অগ্রভাগে। সময়ের পরিক্রমায় আওয়ামী লীগ এখন পরিণত ও পুরোনো রাজনৈতিক দল।

নতুন স্বপ্ন নিয়ে রাজনৈতিক দল গঠন করার পরে কার্যালয়ের প্রয়োজনীয়তা অনুভব হয়। সেসময় ইয়ার মোহাম্মদ খানের কলতাবাজারের ১৮ নম্বর কারকুন বাড়ি লেনের বাড়িটি আওয়ামী মুসলিম লীগের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করা শুরু হয় (ছাত্রাবস্থায় আমি নিজেও আওয়ামী মুসলিম লীগের ব্যবহৃত প্রথম কার্যালয়ের বাড়িটির নিকটবর্তী ১৭/৪ কারকুন বাড়ি লেনে দীর্ঘদিন থেকেছি কিন্তু বাড়িটির ইতিহাস জানতে পেরেছি অনেক পরে)। এরই মধ্যে আওয়ামী মুসলিম লীগের কার্যালয় কারকুন বাড়ি লেন থেকে ৯৪ নবাবপুর রোডে স্থানান্তরিত হয়।

জেলখানা থেকে ছাড়া পান তরুণ আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। দল গঠনের পরে সারাদেশে কমিটি গঠনের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু প্রথম পর্যায়ে দলটি মাত্র তিনটি জেলায় কমিটি করতে সক্ষম হয়। এরমধ্যে যশোরের খড়কীর পীর ও অ্যাডভোকেট হাবিবুর রহমান একটি কমিটি করে। তাদের সাহায্য করেন মশিউর রহমান ও আব্দুল খালেক। ফরিদপুরে আব্দুস সালাম খানের নেতৃত্বে একটি কমিটি হয়। এছাড়া চট্টগ্রামে এম এ আজিজ ও জহুর আহমেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে অপর আরও একটি জেলা কমিটি গঠিত হয়। এসব কমিটি করার জন্য সারাদেশে সাংগঠনিক সফর করেন শেখ মুজিব।

১৯৫০ সালের ১৮-১৯ মার্চ লাহোরে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সভাপতিত্বে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের কর্মী সম্মেলন হয়। এ সময় প্রায় ২৬ মাস কারাগারে অন্তরীণ থাকার পর ১৯৫২ সালের এপ্রিলে ছাড়া পান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৫২ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক অসুস্থ হয়ে পড়লে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান শেখ মুজিবুর রহমান। পরের বছর ঢাকার মুকুল সিনেমা হল বর্তমানে আজাদ হলে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্মেলনে তাঁকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয় এবং ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন।

তৎকালীন সময়ে হিন্দু এবং মুসলিম আসনে পৃথকভাবে নির্বাচন হতো। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের সময় একটা সমঝোতা হয়েছিল যে, দলটি একটি অসাম্প্রদায়িক দল হবে। ওই নির্বাচনে ২৩৭টি আসনের মধ্যে ২২৩টি আসন পায় যুক্তফ্রন্ট, যা পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সঙ্গে কৃষক শ্রমিক পার্টি, পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল, পাকিস্তান খেলাফত পার্টি আর নেজামে ইসলামী পার্টির সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল। আওয়ামী মুসলিম লীগ পেয়েছিল ১৪৩টি আসন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বিজয়ের পর ১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিলে দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেয়া হয় এবং আওয়ামী লীগ নামকরণ করা হয়।

এরই মধ্যে পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে মতপার্থক্যের কারণে ১৯৫৭ সালের ১৮ মার্চ আওয়ামী লীগ সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। এরপর ২৫ জুলাই ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করেন তিনি । এসময় দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হন মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ। ১৯৬৪ সালের কাউন্সিল সভায় মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশকে পুরোপুরি সভাপতি নির্বাচিত করা হয় এবং শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ সম্পাদক থেকে যান।

এরপর ১৯৬৬ সালের মার্চে আওয়ামী লীগের সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমানকে সভাপতি ও তাজউদ্দীন আহমদকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। তাঁরা দায়িত্বে ছিলেন ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের সময় কাগজপত্রে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের পরিবর্তে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নাম ব্যবহার করা হতো।

১৯৪৮ থেকে মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সব অর্জনে ’৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ’৫৪ এর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ’৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬ এর ছয় দফা, ’৬৯ এর গণ অভ্যুত্থ্যান, সত্তর এর নির্বাচন, ১৯৭১ এ মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সব অর্জনে জড়িয়ে আছে আওয়ামী লীগ। আর জাতিকে এ গন্তব্যে পৌঁছানোর কাজটি করেছেন বাঙালি জাতি রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

স্বাধীনের পর সংস্কৃতি ও সভ্যতার ধারক এবং বাহক আওয়ামী লীগ দেশ পুনর্গঠনে কাজ শুরু করে। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন। ইতিহাসের এ নির্মম ও জঘন্য হত্যাকাণ্ডের পর কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করার নীল নকশা চলে।

নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের সম্মেলনে শেখ হাসিনাকে সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। দীর্ঘ ছয় বছর নির্বাসন কাটিয়ে ১৯৮১ সালের ১৭ মে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দেশে ফেরেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণতান্ত্রিক অধিকার পুনরুদ্ধারে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সংগঠিত করতে বাংলার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত চষে বেড়িয়েছেন তিনি।

আন্দোলন সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়া দলটির পঁচাত্তরের বিয়োগান্তক ঘটনার পর ঘুরে দাঁড়াতে প্রায় ২১ বছর সময় লাগে। ১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় ফিরে আসে আওয়ামী লীগ। এরপর ২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় দলটি। বর্তমানে দলটির সভাপতি শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

এ বছর দলটি ৭৫ বছরে পূর্তি করে যেন পরিণত আওয়ামী লীগে পরিণত হয়েছ। দারিদ্র্য, বেকারত্ব, অশিক্ষা আর পশ্চাৎপদতার হীনম্মন্যতা থেকে মুক্তি দিয়ে আধুনিক স্থিতিশীল ও স্মার্ট দেশ বিনির্মাণের কারিগর হিসেবে আর্বিভাব বাঙালির আওয়ামী লীগের। আর এতে অগ্রসেনানী হিসেবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনা।

লেখক: প্রতিবেদক, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)।

এইচআর/জিকেএস