‘এই ক্ষমতা সুখের নয়, বড় কষ্টের’
‘এই ক্ষমতা সুখের নয়। এ বড় কষ্টের, বড় কণ্টকাকীর্ণ এই ক্ষমতা।’ সপরিবারে হত্যার আগে জাতীয় সংসদে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেয়া বক্তব্যে এমনই আক্ষেপ ফুটে উঠেছিল। এ সময় তিনি আরও বলেছিলেন, ‘ভিক্ষুক জাতির নেতৃত্ব করতে আমি চাই না। আমি চাই আমার দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হোক এবং সেজন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। শৃঙ্খলা আনতে হবে এবং শৃঙ্খলা দেশের মধ্যে অক্ষুণ্ন রাখতে হবে।’
১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী বিল পাসের দিন এই বক্তব্য দিয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। এটিই ছিল সংসদে দেয়া তার শেষ বক্তব্য। এই সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদীয় শাসন পদ্ধতির পরিবর্তে রাষ্ট্রপতিশাসিত শাসন পদ্ধতি চালু হয়। বহুদলীয় রাজনীতির পরিবর্তে একদলীয় রাজনীতি প্রবর্তন এবং বাকশাল গঠন করা হয়। এ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী থেকে রাষ্ট্রপতি হন তিনি।
বঙ্গবন্ধু হত্যার আগে ১৯৭৫ সালের ২৩ জুন থেকে ১৭ জুলাই সংসদে বাজেট অধিবেশন হয়। কিন্তু তিনি ওই সময় রাষ্ট্রপতি থাকায় কোনো বক্তব্য দিতে পারেননি।
জাতীয় সংসদের লাইব্রেরিতে থাকা জাতীয় সংসদের কার্যবিবরণী থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
বঙ্গবন্ধু সংসদে তার শেষ বক্তব্যে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অর্থনীতি, যোগাযোগ, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের করুণ চিত্র তুলে ধরেন। তার বক্তব্যে অনেক হতাশাও ফুটে ওঠে। অবাধে দুর্নীতি হচ্ছে আর সেই দুর্নীতির সঙ্গে শিক্ষিত শ্রেণি জড়িত তাও অবলীলায় স্বীকার করেছেন তিনি। এমনকি বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানি করার জন্য জাহাজের ভাড়াটাও ছিল না সরকারের কাছে।
বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বড় দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে যে, আজকে আপনি (স্পিকার) জানেন, এই সংসদের চারজন সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে। আর যারা গণপরিষদের সদস্য ছিলেন, তাদের মধ্য থেকেও কয়েকজনকে হত্যা করা হয়েছে। গাজী ফজলুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে। নুরুল হককে হত্যা করা হয়েছে। মোতাহার মাস্টারকে হত্যা করা হয়েছে। এমনকি আমরা যা কোনোদিন শুনি নাই- ঈদের নামাজের জামাতে এই সংসদের একজন সদস্যকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। কাদের হত্যা করা হয়েছে? হত্যা করা হয়েছে তাদের, যারা স্বাধীনতার মুক্তিযোদ্ধা’।
এসব ব্যক্তির হত্যাকারীদের প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেছিলেন, ‘কোনো রাজনৈতিক দল- যাদের আমরা অধিকার দিয়েছিলাম- কোনোদিন একটা কনডেম (নিন্দা) তারা করেছে এদের বিরুদ্ধে? না, তারা কনডেম (নিন্দা) করেনি’।
‘তারা মুখে বলেছে অধিকার। তারা মিটিং করেছে, সভা করেছে। পার্টি করতে তাদেরকে দেয়া হয়েছে। কিন্তু কী করছে তারা?’..... তারা অস্ত্র জোগাড় করেছে- সেই অস্ত্র, যে অস্ত্র দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করা হয়েছে। আমাদের লোকদের কাছ থেকে আমরা অস্ত্র নিয়ে নিয়েছি। আর তারা সেই অস্ত্র দিয়ে ঘরে ঢুকে শৃগাল-কুকুরের মতো মানুষকে হত্যা করছে।’
বিদেশি দান-খয়রাত আর ঋণে কোনোরকম দেশ চলছিল। কিন্তু এভাবে আর কতদিন চলতে পারে তা নিজেই প্রশ্ন করেন তিনি। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি কোথায় পাব বৈদেশিক মুদ্রা? ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতে হবে? না... আমাদের ইনকাম করতে হবে, স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে। যে মানুষ ভিক্ষা করে তার যেমন ইজ্জত থাকে না, যে জাতি ভিক্ষা করে তাদেরও তেমন ইজ্জত থাকে না। ভিক্ষুক জাতির নেতৃত্ব করতে আমি চাই না। আমি চাই আমার দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হোক এবং সেজন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। শৃঙ্খলা আনতে হবে এবং শৃঙ্খলা দেশের মধ্যে অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে।’
শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘সংবিধানের এই সংশোধন কম দুঃখে করি নাই, স্পিকার সাহেব। যারা জীবনভর সংগ্রাম করেছে- একথা কেউ যেন মনে না করে যে, জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে গেছে। নো, জনগণ যা চেয়েছে, এখানে সেই সিস্টেম করা হয়েছে। তাতে পার্লামেন্টের মেম্বারগণ জনগণের দ্বারা ভোটে নির্বাচিত হবেন। যিনি প্রেসিডেন্ট হবেন, তাকেও জনগণের ভোটে নির্বাচিত হতে হবে। জনগণের ভোটাধিকার আছে।’
জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল প্রথম বক্তব্য দেন। ১৯৭০-এর নির্বাচনে পাকিস্তানের জাতীয় ও পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত সদস্যরা এই বাংলাদেশ গণপরিষদে শপথ নেন। সেদিন স্বাধীনতা ঘোষণা সম্পর্কে বক্তব্য দেন তিনি। সেদিন গণপরিষদের স্পিকার নির্বাচিত না হওয়ায় সভাপতিত্ব করেন গণপরিষদ সদস্য মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ।
স্বাধীনতা প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে নুরুল হক বক্তব্য দেন। এর জবাব দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ... ‘পাকিস্তানের সরকারকেও বলা হয়েছে আমাদের লোকদের ফিরিয়ে দাও। আর যারা এ দেশে থাকতে চায় না, তাদের ফিরিয়ে নাও, আমি তাদের ফিরিয়ে দিচ্ছি। তবে যারা যুদ্ধাপরাধী, তাদের বিচার বাংলার মাটিতে হবে’।
স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘সেনাবাহিনী (পাকিস্তান) যদি যুদ্ধ ঘোষণা করত, তবে আমরা সেই যুদ্ধের মোকাবেলা করতে পারতাম। কিন্তু তারা অতর্কিত ২৫ শে মার্চ আমাদের আক্রমণ করল। তখন আমরা বুঝতে পারলাম যে, আমাদের শেষ সংগ্রাম শুরু হয়ে গেছে। আমি ওয়ারলেসে চট্টগ্রামে জানালাম বাংলাদেশ আজ থেকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। এ খবর প্রত্যেককে পৌঁছিয়ে দেয়া হোক, যাতে প্রতিটি থানায়, মহকুমায়, জেলায় প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে উঠতে পারে। সেজন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশও দিয়েছিলাম। এ ব্যাপারে আত্মসচেতন হতে হবে। দেশবাসী জানেন একই তারিখে দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু হয়েছিল। যদি কোনো নির্দেশ না থাকত, তবে কেমন করে একই সময়ে, একই মুহূর্তে সব জায়গায় সংগ্রাম শুরু হলো’?
১৯৭৩ সালের আগে বাংলাদেশ গণপরিষদ ও পরে জাতীয় সংসদে বিভিন্ন সময় নানা বিষয় নিয়ে বক্তব্য রেখেছেন শেখ মুজিবুর রহমান। প্রথম গণপরিষদ অধিবেশনের দ্বিতীয় দিনই বিশেষ অধিকার প্রশ্ন নিয়ে তিনি বলেন, ‘ স্পিকার সাহেব, আপনার মাধ্যমে অনুরোধ জানাচ্ছি যে, ভবিষ্যতে আমার এই মাইকটি একটু উঁচু করে দেবেন, আমি মানুষ একটু বেশি লম্বা।’ এরপর তিনি সকলকেই রীতিনীতি মেনে চলার অনুরোধ জানান। কেউ বক্তব্য রাখলে অন্যরা যেন বাধা না দেন এরও অনুরোধ করেন।
বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘মেম্বারদের আর একটা বিষয়ে হুঁশিয়ার করতে চাই। স্পিকার যখন কথা বলেন, তখন আর কোনো মেম্বারের অধিকার নাই কথা বলার। বললে আপনি মেহেরবানি করে তাকে পরিষদ থেকে বের করে দিতে পারেন।’
১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর সংবিধান বিল-এর (গৃহীত) ওপর বক্তব্য দিতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন বঙ্গবন্ধু। এসময় তিনি উল্লেখ করেন, এই শাসনতন্ত্র শহীদের রক্তে লেখা। ২৫ মার্চের ভয়াল রাতের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘... যখন আমি বুঝতে পারলাম আর সময় নেই এবং আমার সোনার বাংলাদেশকে চিরদিনের মতো ছেড়ে যেতে হচ্ছে, তখন আমার মনে হলো, এই বুঝি শেষ। তখন আমি চেষ্টা করেছিলাম, কেমন করে বাংলার মানুষকে এ খবর পৌঁছিয়ে দেই এবং তা আমি পৌঁছিয়ে দিয়েছিলাম তাদের কাছে। সেদিন আমি লাশ দেখেছি, রক্ত আমি দেখেছি। সেই রক্তের উপর দিয়ে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়, সেই রক্তাক্ত মানুষের লাশের পাশ দিয়ে আমাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয়’। (এ পর্যায়ে তিনি কেঁদে ফেলেন)।
তিনি বলেন, ‘মানুষ যে এত পশু হতে পারে, স্পিকার সাহেব, দুনিয়ার ইতিহাসে দেখা যায় না। হালাকু খাঁর গল্প পড়েছি, চেঙ্গিস খাঁর গল্প পড়েছি, হিটলারের গল্প পড়েছি, মুসোলিনীর গল্প পড়েছি, কিন্তু মানুষ যে এত পশু হতে পারে তা দেখিনি।’
১৯৭২ সালের ১৫ ডিসেম্বর। শুক্রবার। গণপরিষদ ভেঙে দেয়ার দিন ছিল সেদিন। এ উপলক্ষে তিনি বক্তব্য দেন। পরের বছর ৭ মার্চ প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু দেশজুড়ে গুপ্তহত্যা, অরাজকতা থেমে থাকেনি। দুর্নীতি হয়ে ওঠে দুর্নিবার। বঙ্গবন্ধু ওই বছরের ৭ এপ্রিল এ নিয়ে সংসদে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘গোপন হত্যা দেশের জন্য মঙ্গল বয়ে আনে না’।
এছাড়া সংসদে তিনি বিরোধীদলীয় নেতা ও দল নিয়েও কথা বলেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষ্য হলো- ‘বিরোধী দল যদি ২৫ জনের কম হয়। সংসদীয় রীতি অনুযায়ী তাদের বিরোধী দল বলা যায় না। সংসদে একজন বিরোধী দলের আর চারজন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য আছেন। এই পাঁচজন নিয়ে অপজিশন দল হয় না। অপজিশন গ্রুপও হয় না। অপজিশন গ্রুপ হতেও দশ জন লাগে। তাই বিরোধী দলের একজন আতাউর রহমান তাদের নেতা হতে পারেন না। এটা আমরা গ্রহণ করতে পারি না’।
এইচএস/জেডএ/আরআইপি