খুনিদের বিচার প্রক্রিয়া
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কিছুসংখ্যক বিপথগামী সেনা কর্মকর্তা ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাসভবনে স্বাধীনতার স্থপতি, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এবং সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে।
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত ১২ আসামির মধ্যে পাঁচজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয় ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি মধ্যরাতে। বাকিরা পলাতক এবং একজন মারা গেছেন।
পলাতক আসামিরা হলেন- খন্দকার আব্দুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম, রাশেদ চৌধুরী, নূর চৌধুরী, আব্দুল মাজেদ ও রিসালদার (ক্যাপ্টেন) মোসলেহ উদ্দিন।
তাদের গ্রেফতারে ইন্টারপোলের পরোয়ানা রয়েছে। দণ্ডিত অপরজন আবদুল আজিজ পাশা পলাতক অবস্থায় জিম্বাবুয়ে মারা গেছেন।
আত্মস্বীকৃত পাঁচ খুনি
বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফাঁসির রায় কার্যকরের জন্য উন্মুখ ছিল পুরো জাতি। ইতিহাসের জঘন্যতম ও নৃশংস ওই হত্যাকাণ্ডের ৩৪ বছর পর ঘাতকদের দণ্ড কার্যকরের মাধ্যমে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে মনে করে সর্বস্তরের মানুষ।
২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর ঐতিহাসিক এক রায়ে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ আসামির আপিল খারিজ করে হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। ৩ জানুয়ারি ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আবদুল গফুর আসামিদের মৃত্যু পরোয়ানা জারি করেন। পরবর্তীতে সেটি কার্যকর হয়।
ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে অতর্কিত হানা দিয়ে শিশু রাসেল, স্ত্রী ফজিলাতুন্নেছা মুজিবসহ সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়। ঘটনার ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে মামলা হয়। বিচারিক আদালত এ মামলায় ১৫ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেন। আপিল বিভাগ ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়া শেষে ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়।
মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক রহমান প্রাণভিক্ষার আবেদন করলেও সিদ্ধান্ত হয় জাতির পিতাকে হত্যার মতো জঘন্য অপরাধের আসামিকে প্রাণভিক্ষা দেয়া যায় না। রিভিউ আবেদন খারিজের পর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অন্যতম আসামি কর্নেল (অব.) ফারুক রহমান রাষ্ট্রপতির কাছে ইংরেজিতে লেখা আবেদনে তিনটি কারণ উল্লেখ করেন।
কারণগুলো হলো- প্রথমত. তার অবর্তমানে তার বৃদ্ধ মা মাহমুদা রহমানকে দেখার কেউ নেই। দ্বিতীয়ত. তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতার পর দেশ পুনর্গঠনে কাজ করেছেন; তৃতীয়ত. ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘটে যাওয়া ঘটনার জন্য তিনি দুঃখিত।
কারা কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিকভাবে ওই আবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠালেও সেটি নাকচ হয়ে যায়।
১৯৭৫ সালের ন্যক্কারজনক ওই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ১৯৯৬ সালে প্রথম মামলা হয়। সেখানে আসামি করা হয় ২৪ জনকে। তখন থেকেই ফারুক রহমান, শাহরিয়ার রশিদ খান ও মহিউদ্দিন আহমেদকে গ্রেফতার করে কারাগারে রাখা হয়।
১৯৯৮ সালে অপর আসামি বজলুল হুদাকে গ্রেফতার করে কনডেম সেলে রাখা হয়। সর্বশেষ বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় পলাতক অপর খুনি একেএম মহিউদ্দিন ল্যান্সারকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে গ্রেফতার করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়।
এর আগে ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর বিচারিক আদালত ওই মামলায় ১৫ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেন। রায়ের বিরুদ্ধে আপিল হলে হাইকোর্ট ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন।
প্রথম রায়
১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর তৎকালীন ঢাকার দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল মামলার রায়ে ১৫ জনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে রায় ঘোষণা করেন।
দ্বিতীয় রায়
নিম্ন আদালতের এ রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের আপিল ও মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিতকরণের শুনানি শেষে ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ বিভক্ত রায় দেন। বিচারপতি এম রুহুল আমিন ১৫ আসামির ১০ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। খালাস দেন পাঁচ আসামিকে। অপর বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ১৫ আসামির সবার মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন।
তৃতীয় রায়
২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল হাইকোর্টের তৃতীয় বেঞ্চের বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। খালাস দেন তিনজনকে। এই ১২ আসামির মধ্যে একজন মারা যান, ছয়জন পলাতক। অপর পাঁচজন কারাগারে আটক ছিলেন।
দীর্ঘ ছয় বছর পর বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে আপিল বিভাগে বিচারপতি নিয়োগ দেয়ার পর ২০০৭ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগের বিচারপতি মো. তাফাজ্জাল ইসলামের নেতৃত্ব তিন বিচারপতির বেঞ্চ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ আসামির আপিল শুনানি গ্রহণ করেন।
চতুর্থ রায়
প্রায় দুই বছর পর ২০০৯ সালের ২৪ আগস্ট আপিল শুনানির জন্য রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি ওই বছরের ৫ অক্টোবর শুনানির দিন ধার্য করেন। আপিল শুনানির জন্য তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এমএম রুহুল আমিন ৪ অক্টোবর পরবর্তী প্রধান বিচারপতি মো. তাফাজ্জাল ইসলামের নেতৃত্বে পাঁচ বিচারপতির বিশেষ বেঞ্চ গঠন করেন। আপিল বিভাগ গত ৫ অক্টোবর থেকে টানা ২৯ কর্মদিবস শুনানির পর ১৯ নভেম্বর চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করেন। এরপর আসামিদের করা রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন খারিজ করে দেন আপিল বিভাগ।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী) ও তার ছোট বোন শেখ রেহানা সেই সময় বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান।
এফএইচ/এএইচ/এমএআর/আরআইপি