ভিডিও EN
  1. Home/
  2. শোকাবহ আগস্ট

বুদ্ধিজীবী হত্যা

৭ মার্চের ভাষণ প্রচারের জন্য মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় শেখ আবদুস সালামকে

সম্পাদকীয় ডেস্ক | প্রকাশিত: ০২:০৯ পিএম, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৩

মো. মাহমুদুল হাসান (মাহমুদ)

জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান, শহীদ বুদ্ধিজীবী, যার কথা বলছি তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবদুস সালাম। অজস্র পরাণের গহীন ভিতর রাজসিক আসন তাঁর। তাঁকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা ৷আমাদের প্রিয় মানুষ, বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ক্ষণজন্মা পুরুষ, বিদায়ী একজন নেতা, একজন অভিভাবক যার অভাব কোনোদিন পূরণ হওয়ার নয়।

তিনি চির অম্লান হয়ে আছেন ও থাকবেন নড়াইলবাসী তথা বাঙালির হৃদয়ে। তিনি ছিলেন সত্যিকার অর্থে সমাজের প্রাজ্ঞজন। উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত, নড়াইল জেলার সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সন্তান। শহীদ শেখ আব্দুস সালাম একজন উদারমনা, অসাম্প্রদায়িক, ধর্মপরায়ণ, সমাজের সব পঙ্কিলতার বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রামী একজন মহান মানুষ। তাঁর সম্পর্কে দুটি কথা লিখতে বসেছি। স্বল্প পরিসরে সম্পূর্ণরূপে তাঁকে প্রকাশ করতে পারবো কি না জানি না তবু আন্তরিক এই প্রয়াসটুকু নড়াইল জেলার একজন গুণীজন সম্পর্কে জানতে নতুন প্রজন্মকে সাহায্য করবে আশা করি।

উল্লেখ্য চিত্রা, মধুমতি, আঠারোবাঁকি, নবগঙ্গা, কাজলা বিধৌত একটি অতি ঐতিহ্যবাহী জেলা নড়াইল। বহু বিশিষ্ট ব্যক্তির গৌরবগাথায় রত্নখচিত সমুজ্জ্বল নড়াইল। এ জেলারই রত্নখচিত একটি নাম শহীদ বুদ্ধিজীবী, বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ আব্দুস সালাম। তিনি ছিলেন একাধারে সুবক্তা, আলোচক, প্রাবন্ধিক, সাহিত্য-সংস্কৃতি কর্মী ও রাজনীতিবিদ।

বাংলাদেশের মহান স্থপতি, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্নেহধন্য শেখ আবদুস সালাম ১৯৪০ সালের ১২ জুলাই নড়াইল জেলা শহরের কালিয়া থানার অদূরে একটি ছায়াঘেরা নিবিড় গ্রাম বিলবাওচে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম শেখ আবদুল গফুর এবং মাতা ফুলজান নেছা। এলাকায় জনশ্রুতি আছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শহীদ শেখ আবদুস সালামকে ভালোবেসে ‘আমার কালোমানিক’ বলে জনসভায় সম্বোধন করতেন।

শেখ আবদুস সালাম ১৯৫৬ সালে কালিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ১৯৫৮ সালে নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। তিনি ১৯৬০ সালে বিএল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ দৌলতপুর, খুলনা থেকে বিএ পাস করেন। পরে খুলনা আইন কলেজ থেকে এলএলবি এবং ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে বিএড ডিগ্রি লাভ করেন।

পারিবারিক জীবন ও রাজনীতির কারণে তাঁর ধারাবাহিক শিক্ষাজীবনে কিছুটা ছেদ পড়লেও এর মাঝে তিনি শিক্ষাব্যবস্থা, ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে কোর্স সম্পন্ন করেন। এখানেও তিনি প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন। ১৯৬৯ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে এমএ ক্লাসে ভর্তি হন। ১৯৭০ সালে ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে তিনি এমএ প্রথম পর্বে উত্তীর্ণ হন। ১৯৭১ সালে শেষ পর্বের পরীক্ষা চলাকালে মুক্তিযুদ্ধের কারণে পরীক্ষা স্থগিত হয়ে যায়।

শেখ আবদুস সালাম ১৯৬০ সালে কালিয়ার নওয়াগ্রাম ইউনাইটেড একাডেমির প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। পরে তিনি বেন্দা ইউনিয়ন ইনস্টিটিউশন এবং বড়দিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি কালিয়া বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নিযুক্ত হন।

তিনি এই সময়ের মধ্যেই চারটি স্কুল ও একটি কলেজের এফিলিয়েশন করাতে সক্ষম হন। কালিয়াবাসী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এখলাস উদ্দিন আহমেদের সহযোগিতায় তিনি কালিয়া মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। শেখ আবদুস সালাম ওই কলেজের প্রতিষ্ঠাকালীন অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ স্বাধীনতার পর কলেজটির নামকরণ করা হয় ‘শহীদ আবদুস সালাম মহাবিদ্যালয়’। বর্তমানে কলেজটি সরকারি ডিগ্রি কলেজে উন্নীত হয়েছে।

শেখ আবদুস সালাম ছাত্রাবস্থা থেকেই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি কালিয়া থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। কালিয়ার মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক হিসেবে জনসভায় পাকিস্তানের পতাকা পুডিয়ে ফেলে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। মহান স্বাধীনতা আন্দোলনে কালিয়ায় তাঁর নেতৃত্বেই প্রথম অস্ত্র সংগ্রহ, ডিস্ট্রিবিউশন ও প্রশিক্ষণসহ মুক্তিবাহিনী গঠিত হয়, যা সালাম বাহিনী নামে পরিচিত ছিল। কালিয়ায় কয়েকটি প্রতিরোধ যুদ্ধ ও যশোরের ঝুমঝুমপুর যুদ্ধে কালিয়ার নেতৃত্ব তিনিই দেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি ১৯৬৯ সালে আইয়ুববিরোধী গণআন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এস এম (সলিমুল্লাহ মুসলিম) হলের ৮৯ নম্বর রুমে থাকতেন। রাজনৈতিক তৎপরতার কারণে ১৯৭০ সালে শেখ আবদুস সালামসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়। সেই মামলায় তিনি সামরিক সরকার কর্তৃক কারারুদ্ধ হন এবং তিনিসহ তার সহযোগীদের যশোর কারাগারে রাখা হয়।

উল্লেখ্য, জাতীয় পরিষদের নির্বাচনের পর যশোর জেল থেকে শেখ আবদুস সালামকে মুক্ত করা হয় এবং প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনী প্রচারে তিনি অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে অসহযোগ আন্দোলনে শেখ আবদুস সালাম সংগঠকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।

আবদুস সালাম সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। লোকমুখে জানা যায় স্বাধীনতার সময়ে তাঁর একটি রেডিও ও টেপরেকর্ডার ছিল। সেই টেপরেকর্ডারে তিনি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ রেকর্ড করেছিলেন, যা কালিয়ার বিভিন্ন এলাকায় মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করতে বাজিয়ে শোনাতেন এবং পাকিস্তানিদের শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে জনগণের উদ্দেশে জ্বালাময়ী ভাষণ দিতেন। কালিয়ার আপামর জনসাধারণ সেই ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বাধীনতাযুদ্ধের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।

কালিয়ায় যুদ্ধ শুরু হলে প্রতিরোধযুদ্ধে তিনিই প্রথম নেতৃত্ব দেন। কিন্তু তাঁদের সেই প্রতিরোধযুদ্ধ বেশি দিন টেকেনি কারণ যুদ্ধে সক্রিয় নেতৃত্ব দেওয়ায় কারণে পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। অল্পদিনের মধ্যেই তিনি পাক আর্মির হাতে গ্রেফতার হন। ধরা পড়ার পর যশোর সেনানিবাসে শেখ আবদুস সালামের ওপর মধ্যযুগীয় কায়দায় নৃশংস নির্যাতন চালানো হয়।

১৯৭১ সালের মে মাসের প্রথমদিকে রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তানি সৈন্যরা শেখ আবদুস সালামকে গ্রেফতার করে। যশোর ক্যান্টনমেন্টে কয়েকদিন নির্যাতনের পর ১৩ মে তাঁকে হত্যা করা হয়। তাঁর ওপর চলা নির্যাতনের ঘটনা পরে জানা যায় বেঁচে যাওয়া দুজন প্রত্যক্ষদর্শীর মাধ্যমে। তাদের একজনের নাম আলিমুজ্জামান। তিনি পরবর্তী সময়ে যশোরের সিভিল সার্জন হয়েছিলেন। তিনিও শেখ আব্দুস সালামের সঙ্গে আটক ছিলেন। আরও অনেকে সেখানে আটক ছিলেন।

আলিমুজ্জামানের ভাষ্যমতে জানা যায়, পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাঁদের প্রহসনমূলক বিচার শুরু করে। বিচারকালে বিচারক তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিল, তিনি আওয়ামী লীগ করেন কি না? বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ প্রচার করেছেন কি না? শেখ আবদুস সালাম নির্ভীকভাবে উত্তর দিয়েছেন, তিনি আওয়ামী লীগ করেন। কারণ, আওয়ামী লীগ তো বেআইনি দল নয়। তারপর তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে স্মরণ করে তাঁর জন্মস্থানে ‘সালামাবাদ ইউনিয়ন পরিষদ’ গঠন করা হয়। তাঁর নামে বাংলাদেশ সরকারের ডাকবিভাগ স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করে। নৈতিক জীবন আদর্শ, মানবতাবাদ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার সাধক পুরুষ, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান এই বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ আব্দুস সালামসহ বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে জীবন উৎসর্গকারী সব বীর শহীদকে স্মরণ করছি। আমরা যেন তাঁদের মহান আত্মত্যাগকে ভুলে না যাই।

সবশেষে আমার বিনীত স্বীকারোক্তি যে, বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবদুস সালাম বিষয়ে পড়াশোনা বা তেমন কোনো গবেষণা আমার নেই, ছোটবেলা থেকে এই অকুতোভয় সৈনিকের অনেক গল্প শুনেছি একান্ত মনোযোগী শ্রোতা হয়ে (আমার পরিবারের কাছে) তা ছাড়াও তাঁর অনেক সহযোদ্ধা ও শুভাকাঙ্ক্ষীর কাছ থেকে যেসব গল্প শুনেছি, সেসব মতামত ও সামান্য কিছু পড়াশোনা থেকে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আমি আমার মতো করে জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তান, বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ বুদ্ধিজীবী শেখ আবদুস সালামকে নিয়ে লিখছি।

বিদগ্ধ ও পণ্ডিতজনের কাছে অনুরোধ, আপনাদের কাছে যদি অতিরিক্ত কোনো তথ্য থাকে তা জানিয়ে লেখাটি সমৃদ্ধ করতে ভুলবেন না, কেননা জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পরিচয় করিয়ে দিতে আমাদের অনেক দায় আছে।

উল্লেখ্য, শেখ আবদুস সালাম এক পুত্র ও তিন কন্যার জনক। পুত্র শেখ মিজানুর রহমান, প্রকৌশলী, সুইডেন প্রবাসী। বড় কন্যা শেখ তাসলিমা মুন, আইন বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরে স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করেছেন তুলনামূলক আন্তর্জাতিক আইনে, সুইডেন প্রবাসী, সেখানে সরকারি কর্মকর্তা।

দ্বিতীয় কন্যা ড. শেখ মুসলিমা মুন উপসচিব, তথ্য ও সম্প্রচার-মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। তিনি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টর অব ভেটেরিনারি মেডিসিনে স্নাতক ও এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, থাইল্যান্ড থেকে জেন্ডার অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজে স্নাতকোত্তর করেন l নারীর ক্ষমতায়ন বিষয়ে তিনি পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগ থেকে l কনিষ্ঠ কন্যা ড. শেখ সালমা নার্গিস, সরকারি কর্মকর্তা, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। স্ত্রী মরহুমা বেগম মনোয়ারা সালাম ছিলেন একজন শিক্ষক, সমাজসেবক ও জয়িতা জননী।

তথ্যসূত্র: ‘রাজু’, বাংলাপিডিয়া ও অন্যান্য।

লেখক: গবেষক।

এইচআর/এমএস