পেঁয়াজের মূল্যে ডাবল সেঞ্চুরি
আর কী কী খাওয়া বাদ দেবো?
‘... কথা দিচ্ছি, পেঁয়াজ কিনব না আপাতত কয়েকদিন। আপনারাও কথা দেন! দেখি তারা পেঁয়াজ নিয়ে বসে থাকে কি না!’
খাওয়া বাদ দেন। জনতার সিন্ডিকেটই সবচেয়ে বড় সিন্ডিকেট। ধারাবাহিকভাবে বাজারে আসা এ ধরনের সর্বশেষ বিজ্ঞমত এটি।
এর আগে আমাদের বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন, জনগণের সিন্ডিকেট সবচেয়ে শক্তিশালী। ভোক্তাদের সচেতন ও প্রতিবাদী হতে হবে। সাধারণ মানুষ ঐক্যবদ্ধ হলে কোনো শক্তিই টিকতে পারবে না। এ উদ্যোগ মানুষকে সচেতন করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। (জাগো নিউজ, ২৫ নভেম্বর ২০২৩)।
প্রায় এক যুগ আগে আমাদের তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খানও বলেছিলেন প্রায় একই কথা। ২০১১ সালের ৪ আগস্ট প্রকাশিত বিডিনিউজের খবর থেকে জানা যায়, বাণিজ্যমন্ত্রী সেদিন দ্রব্যমূল্য নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘আমি বললে তো আপনারা রাগ করবেন। কম খান।’
এরপর এটি এক ধরনের ‘ফ্যাশনে’ পরিণত হয়। যখনই কোনো কিছুর দাম বাড়ে, তখনই এ বয়ান নিয়ে হাজির হন এক শ্রেণির বিজ্ঞজন। সব কিছুতে তারা সমাধান বের করেন কম খেয়ে, বয়কট করে। এ নিয়ে রীতিমতো ক্যাম্পেইনও শুরু করেন কেউ কেউ।
ডিমের দাম যখন রাতারাতি প্রায় ১০০ শতাংশ বেড়ে ৮ টাকা থেকে ১৫-১৬ টাকায় ঠেকলো, তখনো এ ক্যাম্পেইন আমরা দেখেছি। বলা হতে থাকলো, ডিম পচনশীল পণ্য। ১ সপ্তাহ ডিম খাওয়া বন্ধ রাখেন। তারা হাতে পায়ে ধরে দাম কমাবে।
একই ভাবে বাড়লো মুরগির দাম। সমাধানও দিতে দেখলাম একই পথে। দাম যখন বাড়লো আলুর, তখন বেচারা গোল আলুকেও হাঁটানো হলো একই পথে।
প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা এভাবে আর কী কী খাওয়া বাদ দেবো?
জিনিসপত্রের দাম কেন রাতারাতি বাড়ে, সূর্য ডুবে আবার ওঠার আগেই কেন আপনার বাজারের পরিকল্পনা বদলে ফেলতে হয়, সেটি নিশ্চয় কাউকে নতুন করে বলে দিতে হবে না।
স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য বলা যায়, বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন-এর নেতারা সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ করেছেন, ১৫ দিনে দেশে মুরগির বাচ্চা, ডিম ও মাংসের মুরগির দাম বাড়িয়ে ভোক্তা ও ক্ষুদ্র খামারিদের কাছ থেকে ৫২০ কোটি টাকা লুটে নিয়েছে পোল্ট্রি খাতের বৃহৎ কোম্পানিগুলো। (জাগো নিউজ, ২০ আগস্ট ২০২২)
এ হিসাব থেকে খুব সহজেই বুঝে নেওয়া যায়, ১৫ দিনে শুধু ডিম-মুরগি থেকেই যদি ৫২০ কোটি টাকা লুটে নেওয়া যায়, তাহলে মজুতদাররা লাখ টন পেঁয়াজ আটকে, হাজার হাজার টন আলু হিমাগার-বন্দি করে কত হাজার কোটি টাকা বের করে নেন।
শিশুরাও বুঝতে পারে, চাল ওঠার মৌসুমেও কেন চালের দাম বাড়তে থাকে। বুঝতে অসুবিধা হয় না, স্বয়ংসম্পূর্ণতার পরিসংখ্যান যখন আমরা পাই, তখনো কেন হু হু করে বাড়তে থাকে মাছ-সবজির দাম। রেকর্ড উৎপাদন হওয়ার পরও কেন বাড়ে লবণের দাম, সেটি বোঝা কারো জন্যই কষ্টকর নয়।
যেকোনো নিত্যপণ্যের দাম যখন বাড়ে তখন আমরা দেখি খুচরা দোকানিদের কিছু জরিমানা করা হয়। কিন্তু আপনার-আমার পকেট সাবাড় করে দেওয়া রাঘব-বোয়ালদের ধরতে আমরা দেখি না কখনো।
বাজারে প্রচলিত আছে, দেশে যতগুলো তামাকবিরোধী সংগঠন আছে সবগুলোকে নাকি তামাক কোম্পানিগুলোই চালায়। এর মাধ্যমে তাদের এমন সব কথা বলানো হয়, যাতে করে তামাক কোম্পানির মূল ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। তামাক কোম্পানিগুলো নাকি এর মাধ্যমে নিশ্চিত করতে চায়, এমন কোনো প্রতিবাদ যাতে মাঠে গড়ে না ওঠে যাতে ব্যবসা লাটে উঠবে। নিশ্চিত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই, তবে সন্দেহ করি, পকেট সাবাড় করা রাঘব-বোয়ালরাই হয়তো ‘খাইয়েন না’ বয়ান হাজির করান কাউকে দিয়ে।
আমরা না খেলে নিশ্চয় বাজারে প্রভাব পড়ে। কিন্তু তারও আগে প্রভাব পড়ে আমাদের পকেটে, আমাদের শরীরে। আমরা না খেয়েই যদি সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করবো, তাহলে ‘কর্তৃপক্ষ’ নামে যারা আছেন, তাদের আসলে কাজটা কী?
লেখক: সাংবাদিক।
এইচআর/এমএস