আহমেদ ফারুক সাংবাদিকদের আদর্শের নাম
শুধু ছোট্ট ফরিদগঞ্জ উপজেলা নয়, সিকি কোটি মানুষের ইলিশ নগরী চাঁদপুর নয়, ৫২ হাজার বর্গমাইলের গোটা বাংলাদেশের সাংবাদিক অঙ্গনেই আহমেদ ফারুক হাসান এক অমর ব্যক্তিত্বের নাম। কর্মে, কর্মের ধর্মে, নিজস্ব গড়িমায়, একাগ্রতায়, সততায় তিনি মানুষের মাঝে বেঁচে ছিলেন, আজো আছেন। তার কর্মই তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
যতদিন যুগান্তর থাকবে, যতদিন ভোরের কাগজ নামের মত প্রকাশের এই বস্তুনিষ্ঠ মাধ্যমগুলো থাকবে ততদিনই বেঁচে থাকবেন প্রয়াত সাংবাদিক আহমেদ ফারুক হাসান। কেননা এ পত্রিকাগুলো আর আহমেদ ফারুক হাসান ছিলেন একই সুতোয় গাঁথা। একজন কলম সৈনিক যে কতটা কর্মক্ষম হতে পারে তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ ফরিদগঞ্জের এই কৃতি সন্তান।
ডাকাতিয়ার তীর ঘেঁষেই শৈশব কাটে তার। ফরিদগঞ্জের সুচিকিৎসক ডা. মো. খলিলুর রহমানের জৈষ্ঠ পুত্র এই আহমেদ ফারুক হাসান। ভালো নাম এবিএম ফারুখুল ইসলাম। যার পূর্ণরূপ আবুল বাসার মোহাম্মদ ফারুখুল ইসলাম। বাবার কর্মসূত্রে তার শিক্ষা জীবনের সূচনা চাঁদপুর সদরেই ঘটে। প্রাথমিক পর্যায় শেষে মাধ্যমিকেরও সিংহভাগ কাটে সেখানে।
১৯৭৪ সালে নবম শ্রেণিতে এসে ভর্তি হন ফরিদগঞ্জ এ. আর. পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে। মূলত এখান থেকেই তিনি তার জন্ম স্থান ফরিদগঞ্জের মাটি ও মানুষের রস আস্বাধন করেন। ছাত্র জীবনে আহমেদ ফারুক হাসান একেবারেই আর দশ জনের মত ছিলেন না। সকলের সঙ্গে হৈহল্লুর করে সময় কাটালেও তার ছিল ভিন্ন একটি জগৎ। যেখানে অন্যকারো প্রবেশাধিকার নেই। তার নিজস্ব মেধা, বিচক্ষণতা, দক্ষতা আর কাজ করার অদম্য মানুষিকতাই তাকে আবুল বাসার মোহাম্মদ ফারুখুল ইসলাম থেকে কালক্রমে প্রখ্যাত আহমেদ ফারুক হাসানে পরিণত করেছে।
১৯৭৬ সালে এসএসসি পাশ করার পর আবারো ফিরে যান তার শৈশব কাটানো প্রিয় চাঁদপুর শহরে। একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির জন্য তিনি বেছে নেন চাঁদপুর কলেজকে। (বর্তমান চাঁদপুর সরকারি কলেজ)। সেখানে তার প্রতিভা আরও জাগ্রত হয়েছে। বিকশিত হয়েছে সৃজনশীল মেধার। পড়ালেখার পাশাপাশি ডিবেটিং ক্লাব, বিজ্ঞান ক্লাব, সাহিত্য অঙ্গন, চিত্রাঙ্গন, কবিতাঙ্গনসহ এমন কোনো বিভাগ ছিলনা যেখানে আহমেদ ফারুক হাসানের পদচারণা ছিল না।
ইন্টারমিডিয়েটের রেজাল্ট ঘোষণার পর তিনি কোন লাইনে পড়ালেখা করবেন তা নিয়ে পরিবার ও তার মধ্যে মতানৈক্য চলতে লাগলো। তার বাবা খুব মনে প্রাণেই চাচ্ছিলেন তিনি বড় হয়ে একজন চিকিৎসক হবেন। পরিবারের অন্য সদস্যদের ইচ্ছা ছিল ইঞ্জিনিয়ার বানানোর। কিন্তু সাহিত্যে আর লেখালেখির টানে তিনি কারো কোনো কথা গ্রাহ্য না করে সোজা গিয়ে ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে।
মূলত তখন পর্যন্তও আহমেদ ফারুক হাসান ছিলেন একজন উদিয়মান কবি। তার কবিতার হাত যে কতটা শক্ত ছিল তা তার ব্যক্তিগত পাণ্ডুলিপিগুলো ঘাটলেই দেখা যায়। একাত্তর ও একাত্তর পরবর্তী দুর্ভিক্ষ, আমাদের স্বাধীনতা, বাংলার মাঠ ও প্রকৃতি নিয়ে তার বিভিন্ন ছোট কাগজে প্রকাশিত কবিতাগুলো সে ইঙ্গিতই দিচ্ছিল। যদিও সাংবাদিক জগতের প্রতি আকস্মিক পদচারণ আর তার প্রতি প্রবল আসক্তিই চির ধরায় তার কাব্য জগতে। কবিতার জগতে লেগে থাকলে তৎকালিন আশির দশকের কাব্য জগতে আহমেদ ফারুক হাসানের নাম যে বেশ পাকাপোক্তভাবেই বসে যেত তা তার অনেক সহপাঠিদের কণ্ঠেও উচ্চারিত হয়েছিল।
আশির দশকের শেষের দিকে সমাজ সংস্কারের প্রত্যয়ে কবিতার নেশা ছেড়ে কলম পত্রিকার হাল ধরেন শক্ত হাতে। প্রচলিত নিয়ম ভেঙে ১৯৯০ সালে ‘আজকের কাগজ’ নামক প্রতিকাটি যে আধুনিক সাংবাদিকতার যাত্রা শুরু করেছিল তার প্রথম বার্তা সম্পাদক আহমেদ ফারুক হাসান। সেই থেকে শুরু দৈনিক যুগান্তরে এসে শেষ। যেখানে যেভাবে কাজ করেছেন কাজের প্রতি ছিল তার উদার মানুসিকতা। তার জীবনে ছিল না ‘ফাঁকি’ নামক শব্দটি। কাজের ফাঁকে ফরিদগঞ্জে যখনই আসতেন তখনই তাকে নিয়ে চলত সহপাঠি আর সতির্থদের গল্প আর আড্ডার এক একটি সমাবেশ। অনেক বেশি মিশুক ছিলেন প্রয়াত এই মানুষটি। খ্যাতির সর্বোচ্চ চূড়ায় উঠেও কখনই তিনি নিজেকে মনে করেননি সাধারণ মানুষের চাইতে আলাদা কেউ। দৈনিক যুগান্তরে কর্মক্ষেত্র থাকাকালিন হঠাৎ করেই সবাইকে বিদায় জানানোর অশুভ বার্তাটি দিলেন এই জীবন্ত কিংবদন্তি। হঠাৎ করেই বুকের ব্যথা অনুভব করলেন তিনি।
অবস্থান অবনতি হওয়ায় তাকে দ্রুত নিয়ে যাওয়া হলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে, কর্তব্যরত ডাক্তার জানিয়ে দিলেন আর কোনদিন আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন না এমন কর্মক্ষম মানুষটি। আর লেখবেন না সমাজ সংস্কারে। রাত জেগে কাজ করবেন না, প্রতিদিনকার ঘটনা প্রবাহ নিয়ে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে তার লাশ নিয়ে যাওয়া হল দৈনিক যুগান্তর কার্যালয়ে। সেখান থেকে তার নিথর দেহ স্ত্রীসহ পরিবারের সদস্যদের দেখাতে নিয়ে যাওয়া হল মনিপুরি পাড়ার বাসায়, সেখান থেকে রাখা হলো হিমাঘরে। পরদিন জানাজা অনুষ্ঠিত হলো প্রেসক্লাব প্রাঙ্গনে। আর সেখানেই ঘটল বিষ্ময়কর এক ঘটনা। এযাবৎকাল পর্যন্ত পৃথিবীর কোনো মুসলিম সাংবাদিকের নামাজে জানাজায় একসঙ্গে কয়েক শত ইমাম অংশ নিয়েছেন বলে জানা যায়নি। সেই সৌভাগ্যের অংশিদার হতে পেরেছিলেন আহমেদ ফারুক হাসানই।
ওই দিন প্রেসক্লাবে বাংলাদেশের শীর্ষ স্থানীয় কয়েক শত ইমামের প্রশিক্ষণ থাকার সুবাদে তার জানাজায় অংশ নেয় তারা সকলেই। হয়তোবা সততার সঙ্গে কাজ করে যাওয়া আহমেদ ফারুক হাসানের জন্য সততার স্বীকৃতি স্বরূপ এ উপহারটিই রেখে ছিলেন স্রষ্টা। অতপর পারিবারিক কবরস্থানে শেষ জানাযা শেষে দাফন করা হয় এই মহান পুরুষকে। অশ্রুসিক্ত নয়নে ফরিদগঞ্জের হাজারো মানুষ চিরকালের জন্য বিদায় জানিয়েছেন তাদের এই প্রিয় মানুষটিকে। তাইতো তার এই প্রয়ান দিবসকে ঘিরে শুধু যে তার পরিবার পরিজন দোয়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন তা নয়।
প্রতি বছর চাঁদপুর জেলার শ্রেষ্ঠ সাহিত্য সংগঠন ফরিদগঞ্জ লেখক ফোরাম আয়োজন করে থাকেন আহমেদ ফারুক হাসানের স্মরণে শোক সভা। আলোচনা করা হয় তার প্রকাশিত ‘শত বছরের শত কথা’ গ্রন্থটি নিয়ে আলোচনা। এ আলোচনার মাধ্যমেই নতুন প্রজন্ম নতুন করে জানছে এক কিংবদন্তি সাংবাদিকের গল্প।
এমএএস/আরআইপি