ভিডিও EN
  1. Home/
  2. গণমাধ্যম

পত্রিকায় এমন কোনো কাজ নেই যা আমি করিনি: আজাদী সম্পাদক

মিজানুর রহমান, নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম | প্রকাশিত: ০৮:১৫ এএম, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২২

দৈনিক আজাদী। চট্টগ্রাম থেকে বাংলায় প্রকাশিত একটি জনপ্রিয় দৈনিক সংবাদপত্র। ১৯৬০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর এটি প্রথম প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটির বর্তমান প্রচলন বা সার্কুলেশন সংখ্যা ৫৬ হাজার। আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও প্রকাশক ছিলেন আবদুল খালেক। প্রথমদিকে পত্রিকাটির মূল্য ছিল দু’আনা (১২ পয়সা)। খালেকের মৃত্যুর পর ১৯৬২ সালে সম্পাদকের দায়িত্ব নেন অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ। তার মৃত্যুর পর ২০০৩ সালে পত্রিকাটির দায়িত্ব নেন এম এ মালেক। তারপর থেকে তিনিই চালাচ্ছেন বন্দর নগরের পাঠকপ্রিয় এ সংবাদপত্র।

সাংবাদিকতায় অনবদ্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ এম এ মালেক সম্প্রতি রাষ্ট্রের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন। জাগো নিউজের সঙ্গে একান্ত আলাপে উঠে এসেছে বরেণ্য এই সাংবাদিকের পেশাগত দীর্ঘ পথচলার নানা চড়াই-উতরাইয়ের গল্প।

জাগো নিউজ: একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন। কেমন লাগছে?

এম এ মালেক: অনুভূতি বলতে আসলে পাওয়াটাই সবচেয়ে বড় কথা। সরকার আমাকে দিয়েছে এবং তাও একুশে পদক। কারণ একুশের সঙ্গে কিন্তু আমরা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আপনি নিশ্চয় জেনে থাকবেন, যেহেতু সাংবাদিকতায় আছেন; ১৯৫২ সালে যখন ভাষা আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তখন কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী একটা কবিতা লিখেছিলেন, ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’। সেই কবিতাটা কিন্তু আমার বাবা আমাদের কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস থেকে ছেপে দিয়েছিলেন। সেজন্য আমাদের প্রেসটা কয়েকদিন বন্ধ করে দিয়েছিল সরকার। আমাদের ম্যানেজারের জেল হয়েছিল, তিনি আমাদের আত্মীয়। তিনি (প্রশাসনকে) বললেন, আমার সাহেব (আবদুল খালেক) কিছু জানেন না। আমি নিজে ছাপছি এটা। প্রায় ছয় মাস জেল খাটার পর যখন যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠিত হলো, তখন তাকে রিলিজ (মুক্ত) করা হলো।

সুতরাং ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে আমরা ওতপ্রোতভাবে তখন থেকেই জড়িত। আমি পত্রিকার সঙ্গে আজ ৬২ বছর ধরে জড়িত। আমি পত্রিকায় করিনি, এমন কোনো কাজ নেই। আমি হকারি করেছি, মানে আমি কাগজ বিলি করেছি। আমি ফটোগ্রাফি করেছি। আমি সংবাদ লিখেছি। আমি বিভিন্ন সেকশন পরিচালনা করেছি। ষাটের দশকে আপনি জানেন লোকজন কম ছিল। আমাদের অর্থকড়ির দিক থেকেও যথেষ্টই ছিল এবং বিজ্ঞাপন বলতে কিছুই ছিল না।

জাগো নিউজ: সাংবাদিকতার সঙ্গে কোন কাজটা দিয়ে শুরু?

এম এ মালেক: শুরু পত্রিকা বিলি করা দিয়ে। আমি আপনাকে আরেকটা কথা বলি, প্রায় ৪৫ বছর ভোর ৪টা থেকে দিনের ৮টা পর্যন্ত হকারদের আমি নিজে কাগজ দিয়েছি। সুতরাং বুঝতেই পারছেন। এই কাগজ আমার জীবন বলতে পারেন। সবকিছুই বলতে পারেন। আমার একটা মিশন ছিল, বাবা একটা কাগজ করেছেন, এটা চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।

পত্রিকায় এমন কোনো কাজ নেই যা আমি করিনি: আজাদী সম্পাদক

একুশে পদকপ্রাপ্ত বিশিষ্টজনদের হাতে রোববার পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়েছে

জাগো নিউজ: পত্রিকা বিলি থেকে শুরু করে আপনি একটা পত্রিকার সর্বোচ্চ পর্যায় অর্থাৎ সম্পাদক পদে বসেছেন। এটাকে কীভাবে উপভোগ করছেন?

এম এ মালেক: যদি কোনো একটা বিষয় আপনার পছন্দে থাকে, সেটা আপনি সবসময় উপভোগ করবেন। কিন্তু আপনি যদি মনে করেন, এটা আমার জব বা অন্য কিছু, তখন কিন্তু সেটা উপভোগ করার কোনো সুযোগ থাকবে না। হ্যাঁ উপভোগ করবেন কিন্তু জব হিসেবে। জব হিসেবে উপভোগ করা আর নিজের জিনিসের সঙ্গে একাত্ম হয়ে কাজ করার মধ্যে কিন্তু অনেক পার্থক্য। সেখানে আপনার সবকিছু স্বতঃস্ফূর্তভাবে আসবে, আপনার এটা করতে হবে, ওটা করতে হবে। এই যে আমি প্রায় প্রতিদিন জানি আমার হেডলাইন কী হচ্ছে। কারণ সহকর্মীরা যাওয়ার আগে আমার সঙ্গে কথা বলেন। আমি কথা বলি। আগে তো এখানে রাত ১২টা পর্যন্ত থাকতাম। এখন সকাল ১০টা থেকে রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত থাকি। রাতে যখন সহকর্মীরা হেডলাইন করেন, এটা-সেটা করেন, তখন সেটা আমাকে হোয়াটসঅ্যাপে দেখান। না হলে মোবাইলে কথা বলেন।

জাগো নিউজ: ৬২ বছর ধরে সাংবাদিকতায় আছেন। একটা স্মরণীয় ঘটনা বলবেন।

এম এ মালেক: স্মরণীয় ঘটনা অনেক আছে। কারণ বিভিন্ন সময় তো বিভিন্ন ঘটনা হয়। তবে আমার একটা খুব স্মরণীয় বিষয় হলো, ড. মুহাম্মদ ইউনূস যখন নোবেল পুরস্কার পেলেন, তিনি আমার দুই বছরের সিনিয়র ছিলেন। তার নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আনন্দটা অনেক বেশি ছিল। সেদিনের যে কাগজ, সেখানে লেখা আছে ‘আঁরার ইউনূস নোবেল পাইয়ে’, হেডলাইনটা আমি করেছিলাম।

জাগো নিউজ: কী কী প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছেন?

এম এ মালেক: একটা নিউজপেপার বিজ্ঞাপন ছাড়া চলতে পারে না। এই চট্টগ্রামের সব বিজ্ঞাপন কিন্তু ঢাকায় ছিল, পাকিস্তান আমলে ছিল করাচিতে। সুতরাং চট্টগ্রাম পর্যন্ত আসা একটু অন্যরকম ব্যাপার ছিল। শুরুতে আমাদের লোকসান দিয়ে কাগজ বের করতে হয়েছে। তখন বলবেন আপনি লোকসান দিয়ে কাগজ বের করছেন, এত পয়সা পেলেন কোথায়? আমার বাবা আমাকে একটা জায়গা দিয়ে গেছেন, আমি বর্তমানে যেখানে থাকি। সেটা আমি ব্যাংকে বন্ধক রেখেছি। আমি জীবনে কারও কাছ থেকে এক টাকা ধার করিনি। কারণ আমি একটা জিনিস বিশ্বাস করি যে, আমার যতটুকু আছে ততটুকুর মধ্যে চলার চেষ্টা করাটা হলো বড় জিনিস। আমি যখন কলেজে পড়ি তখন একজনের একটা লাইন, যেটা আমি এখন পর্যন্ত মনে রাখি, সেটা হলো- আমার সামর্থ্যের মধ্যে যদি আমি চাই তাহলে সেটা আমি পেয়ে যাবো।

জাগো নিউজ: বাংলাদেশে সাংবাদিকতার কী অবস্থা? কোনো প্রতিবন্ধকতা আছে কি না?

এম এ মালেক: না, সে ধরনের কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। আসলে হয়েছে কী জানেন? আগে সংবাদপত্রগুলো যারা বের করেছেন তাদের একটা মিশন ছিল যে, এখানে জনগণের যে সুখ-দুঃখ আছে, এটাকে জনগণের কাছে তুলে ধরা। কিন্তু এখন সেটা একটু চেঞ্জ হয়েছে। এখন বড় বড় করপোরেট কোম্পানি এর মালিক হয়ে গেছে। তারা সেটাকে অনেক সময় তাদের সেফগার্ড হিসেবে ব্যবহার করেছে। তারা যে খুব খারাপ কাজ করছে তাও নয়। অনেক সময় তারা এটাকে শিল্ড হিসেবে ব্যবহার করে। যারা ব্যবসা করে তারা তো এটা করবেই। তারা তো এখানে বিনিয়োগ করছে।

পত্রিকায় এমন কোনো কাজ নেই যা আমি করিনি: আজাদী সম্পাদক

দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক

জাগো নিউজ: বাংলাদেশে সাংবাদিকতার ভবিষ্যৎ কেমন দেখছেন?

এম এ মালেক: এ পর্যন্ত কোনো অসুবিধা আমি দেখছি বলে তো মনে হয় না। তবে আমরা এখন ডেভেলপিং কান্ট্রি। অনেক রকম কাজ আমরা করছি। এখানে যদি শুধু সরকারের সমালোচনাই করি, তাহলে তো সেটা কোনো কথা হলো না। চট্টগ্রামের দুঃখটা আমি তুলে ধরবো। কিন্তু সেজন্য সরকারকে গালি দিয়ে তুলে ধরবো, সেটা নয়। আমার কাজ হলো তুলে ধরা। বাকিটা এখানে সিটি করপোরেশন আছে, সিডিএ আছে। সরকারের এতগুলো সংস্থা আছে, তাদের আমি দেখিয়ে দেবো, তারা সেটা করবে। বড় বড় দুর্নীতি সংবাদপত্রে আসছে। যদিও দুদক আছে, তারাও তাদের কাজ করছে। কিন্তু সংবাদপত্র যখন দেয়, লোকে সেটাকে অথেনটিক মনে করে। আপনাকে দেখতে হবে মূলধারার যে নিউজপেপার আছে সেগুলো কী করছে। সেগুলো কিন্তু ইরেসপন্সিবল জার্নালিজম করতে পারবে না। তাহলে তাদের ওপর জনগণের আস্থা থাকবে না।

জাগো নিউজ: আপনার অবর্তমানে আজাদীকে কেমন দেখতে চান?

এম এ মালেক: আমার ছেলে আছে। তাকে লন্ডন থেকে প্রিন্ট প্ল্যানিং এবং প্রোডাকশনের ওপর তিন বছরের ডিগ্রি করিয়ে এনেছি। বাংলাদেশে আর কেউ এই লাইনে বাইরে থেকে কিছু করে আসছে বলে আমি জানি না। আমার এইটা যেন চালু রাখে। আমার বাবার একটা জিনিস যেন নষ্ট না হয় সেজন্য আমি যতটুকু পেরেছি ততটুকু করেছি। ভবিষ্যৎ তো ভবিষ্যৎ, আমি জানি না। আমি সব সময় একটা কথা বলি, আমাদের জীবনকে যদি একটা নোটবুক হিসেবে মনে করি, সেই নোটবুকের প্রথম পাতা ও শেষের পাতাটা লিখিত হয়ে গেছে। আমার জন্ম-মৃত্যু কিন্তু অলরেডি লেখা হয়ে গেছে। কিন্তু নোটবুকের মধ্যখানের পাতাগুলো কিন্তু খালি আছে। আমি যদি ভালো কাজ করি তাহলে ভালোটা লেখা থাকবে। সুতরাং চেষ্টা করতে হবে যে খালি পেজটা আছে, সেখানে ভালো কাজটা যেন বেশি হয়।

জাগো নিউজ: এক সময় সাংবাদিকতা শুধু কাগজে সীমাবদ্ধ ছিল। এখন সেটা অনলাইনে হচ্ছে। অনলাইন সাংবাদিকতা কীভাবে মূল্যায়ন করছেন?

জাগো নিউজ: আমাদের কাগজ বা পুরোনো একটা কাগজের সঙ্গে অনলাইনের তুলনা করলে কিন্তু হবে না। কারণ আজাদীটা আজ ষাট বছর। যেই বাড়িতে আজাদী রাখে সেটা কিন্তু সাবস্ক্রাইব করে সে। দাদা পড়ছে বলে বাবা পড়ছে। বাবা পড়ছে বলে ছেলে পড়ছে। আপনি ঢাকায় গিয়ে সব কাগজ পড়ে ফেলেন, তবু মনে হবে যে কী একটা মিস করছি। এগুলো কিন্তু বাস্তবতা। জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

জাগো নিউজ: বর্তমানে যারা সাংবাদিকতা করছে তাদের উদ্দেশে কিছু বলবেন?

এম এ মালেক: উপদেশ দেওয়ার মতো জ্ঞান আমার নেই। তবে এটুকু বলতে পারি সৎ সাংবাদিকতা। আমরা অনেক সময় বলি বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ হতে হবে। আসলে বস্তুনিষ্ঠ কোনো সংবাদ নেই। বস্তু তো বস্তুই। মানুষ ছাড়া কোনো সংবাদ হয় না। আমি বলি, আপনার সংবাদটা সত্যনিষ্ঠ হতে হবে, বস্তুনিষ্ঠ নয়। বস্তু কোনোদিন কোনো সংবাদ তৈরি করতে পারে না।

জাগো নিউজ: ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ নিয়ে আপনার স্বপ্ন কী?

জাগো নিউজ: ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ সবসময় থাকবে। অনেকে বলে যে বাংলাদেশ চিরজীবী হোক। কিন্তু আমি এটার বিরোধিতা করি। চিরজীবী হবে কেন? তার মানে আমার মনে সন্দেহ আছে। পৃথিবী যতদিন থাকবে ততদিন বাংলাদেশ থাকবে। সুতরাং আমি ওটাতে দ্বিমত করি।

এইচএ/জেআইএম