পাঁচটা টাকা হবে?
এক.
শীতের দিন। বেলা এগারোটা বাজলেও শীত এখনো জেঁকে আছে। এদিকে আম্মু গেছে গ্রামের বাড়িতে, ধানের কাজ করতে। খুব ক্ষুধাও পেয়েছে। আম্মু যাওয়ার আগে রান্না করে ফ্রিজে রেখে গেছে। কিন্তু সেগুলো বের করে যে গরম করে খাবো, ক্ষুধার জ্বালায় সে তরও সইছে না। গেলাম বাহিরে খেতে। স্টেশনে সায়েদের চায়ের দোকান। তার দোকানে এ সময় গরম গরম পুরি পাওয়া যায়। বিশেষ করে পুরির সাথে ডাল। ডালটা এত চমৎকার যে, শুধু ডাল খাওয়ার জন্যই ওখানে পুরি খেতে যাই।
খাওয়া শেষ করে বের হতেই একটা লোক সামনে এসে বললো, ‘ভাইয়া, পাঁচটা টাকা হবে?’ আমি তার দিকে ফিরে তাকালাম। সুঠাম দেহের অধিকারী, মুখে চাপ দাড়ি। কথাও একদম শুদ্ধ। পরনে শুধু লুঙ্গি, খালি গা। কনকনে এই শীতে তিনি খালি গায়।
আবারও লোকটা বলে উঠলো, ‘ভাইয়া, হবে পাঁচটা টাকা!’ আমি পকেটে হাতায়ে দেখি পাঁচ টাকা নেই। ২০ টাকার একটা নোট। সেটাই এগিয়ে দিলাম। সে বললো, ‘ভাইয়া পাঁচ টাকা লাগবে। বিশ টাকা না।’ খুচরা না পাওয়ায় তাকে আর টাকা দেওয়া হলো না।
দুই.
পড়াশোনার সুবাদে এখন ঢাকায়। প্রায় পাঁচ কি ছয় মাস পর বাড়ি যাচ্ছি। সব সময় ট্রেনেই যাই, রাতের ট্রেনে। সোনাতলা স্টেশনে নামি সাতটায়। স্টেশনে নেমেই দেখি লোকটা। পরনে তার সেই লুঙ্গি, গায়ে কিছু নেই। তবে চুলগুলো আগের চেয়ে বেশ উসকোখুসকো। মুখে দাড়িও বেশ বড় হয়েছে। খালি গায়ে প্লাটফর্মে শুয়ে আছে।
স্টেশনের প্লাটফর্মে দেখলাম, আম্মু আর ছোট ভাই। এসেছি শুনলেই তারা স্টেশনে এগিয়ে আসবে। সব সময় ঘড়ি দেখবে কখন আসবে ট্রেন।
‘আম্মু, তোমাকে বারবার নিষেধ করি স্টেশনে আসা লাগবে না। তা-ও এত সকালে স্টেশনে কেন আসো, আসার দরকার কী? তোমাকে নিষেধ করলে শোনো না কেন? আর বাসা কি স্টেশন থেকে খুব দূরে! দুই মিনিটের পথও না।’
আম্মু বললেন, ‘সকালে নামাজ পড়ে ভাবলাম তুই আসবি, তাই স্টেশনে আসলাম। আসলে সমস্যা কী? সকালে স্টেশনে আসলে হাঁটাও হয়। হাঁটা তো ভালো।’
‘ফজরের নামাজ শেষ ভোর পাঁচটারও আগে। আর এখন সাতটা বাজে। তার মানে তুমি এখানে তখন থেকে দাঁড়িয়ে?’
আম্মু আর কথা বাড়ান না, বাসার দিকে চলতে থাকেন। ছোট ভাই আমার কাঁধ থেকে ব্যাগ নিয়ে হাঁটতে থাকে।
বাসা গিয়ে দেখি আমার প্রিয় ছোট মাছের চচ্চড়ি, দুই-তিন পদের ভর্তা, আর ডাল। বিশ্রাম না নিয়েই ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নিই। খাওয়া শেষ করেই আশরাফ স্যারকে ফোন দিলাম। স্যারকে আগেই বলেছি, ‘বাড়ি আসতেছি। এবার জমিয়ে আড্ডা হবে।’
স্যারকে ফোন দিতেই, ‘শান্ত সাহেব, আর এক ব্যাচ বাকি। পড়ানো শেষ করেই আসতেছি। তুমি সায়েদের চায়ের দোকানে আসো।’
সায়েদের দোকানে গেলাম। প্রায় ১৫ মিনিট পরই স্যার ঢুকলেন। সকালের খাবার খাওয়া সত্ত্বেও আবারও পুরি আর ডাল খেলাম। সেই সাথে চলছে আড্ডা। হঠাৎ স্যার বললেন, ‘দেশীয় আলোচনা বাদ। চলো এবার আন্তর্জাতিক আলোচনা করি।’
আমি হেসে বললাম, ‘আচ্ছা, স্যার।’
প্রায় ঘণ্টাখানেক আড্ডা চললো। আড্ডা শেষে বের হতেই দোকানের সামনে দেখা পেলাম, লুঙ্গি পরা সেই লোককে। লোকটা আমাদের বলে উঠলো, ‘ভাইয়া, মোবাইল আছে?’
বললাম, ‘কেন?’
তিনি বললেন, ‘গুগলে একটু সার্চ করে দেখেন তো আমেরিকা ১৭৭৬ সালে স্বাধীন হয়নি?’
আমি স্যারের মুখের দিকে তাকালাম, স্যারও আমার দিকে। আমরা জানি, ১৭৭৬ সালেই আমেরিকা স্বাধীন হয়েছে। তা-ও তার কথা রাখতে স্যার গুগলে সার্চ করলেন। তাকে দেখালেন, তার ধারণা সঠিক। তখন লোকটির মুখে এক আনন্দের হাসি।
স্যার ট্রেনে গাইবান্ধা যাবেন, ট্রেন এখনো আসেনি। স্টেশনে অপেক্ষা করতে লাগলাম। স্যারকে বললাম, ‘স্যার লোকটা কে? ঢাকা যাওয়ার আগেও একদিন দেখেছিলাম। আজকে ঢাকা থেকে আসার সময়ও দেখলাম স্টেশনে। আগে তো দেখি নাই। লোকটা কে, জানেন?’
স্যার বললেন, ‘আমিও কয়েক মাস ধরে দেখছি। কিন্তু জানি না লোকটা কে? পাগল হবে হয়তো।’
আমি বললাম, ‘পাগল হলেও স্মার্ট পাগল। দেখছেন না, কিভাবে গুছিয়ে, সুন্দর ব্যবহার করে কথা বলছে? আবার গুগলও চেনে, আমেরিকার স্বাধীনতা কত সালে সেটাও জানে?’
স্যার বললেন, ‘ভাবনার বিষয় তো।’
ট্রেন চলে এলো, স্যার চলে গেলেন। আমিও বাসায় গেলাম। সারারাত জার্নি করে এসেছি। এখনো বিশ্রাম নিইনি। তাই দ্রুতই বাসায় ফিরলাম। বাসায় ফিরে দিলাম এক ঘুম।
তিন.
ঘুম থেকে উঠে দেখি একদম সন্ধ্যা। রাতে জার্নি করে এসেছি দেখে আম্মুও ডেকে দেননি। আম্মু খেতে দিলেন। খেয়ে গেলাম স্টেশনে। বাড়িতে এলে আমার আড্ডা দেওয়ার জায়গা একটাই। তা হলো স্টেশন। তাই আবারও সেখানে।
দিলিপ দাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘দাদা, ওই লুঙ্গি পরা লোকটা কে? ঢাকা যাওয়ার আগেও দেখলাম, ফিরে এসেও দেখলাম।’
দাদা জানালেন, ‘লোকটা পাগল। কয়েক মাস ধরে স্টেশনেই থাকে। চেয়ে-চিন্তে খায়। মাঝে মাঝে লোকটার মা এসে খাবার দিয়ে যায়। সাথে নিয়ে যেতে চাইলে যেতে চায় না, অনেক জোরাজুরি সত্ত্বেও যায় না।’
‘তবে যা-ই বলেন দাদা, তাকে দেখে কিন্তু পাগল মনে হয় না?’
দাদা বললেন, ‘হ্যাঁ, লোকটা ইংরেজিও ভালো জানে, জ্ঞান আছে অনেক। শুনলাম ওর পাগল হওয়ার পেছনে নাকি একটা কাহিনি আছে।’
বললাম, ‘কী কাহিনি?’
দাদা বললেন, ‘লোকটি নাকি একটা কোম্পানিতে চাকরি করতো। অনেক টাকা বেতন পেতো। জমিজমাও ছিল অনেক।’
বললাম, ‘তারপর?’
দাদা বললেন, ‘এরপর আর কি! পরিবারের অমতে ভালোবেসে বিয়ে করেছে। বাবা-মাকে না দেখে শুধু বউ আর বউ করে গেছে। কিছু জমি বউয়ের নামেও লিখে দিয়েছে। বেতনের টাকা-পয়সা বাবা-মাকে একটুও না দিয়ে শুধু বউকে দিয়ে গেছে। বউ সেগুলো ব্যাংকে জমিয়েছে।’
একটু থেমে আবার বললেন, ‘লোকটা ঢাকায় চাকরি করে খেটে মরে দিন-রাত। আর বউ এদিকে নতুন ন্যাং ধরেছে। সেই ন্যাঙ্গের জন্য লোকটার জমিজমার দলিল, টাকা-পয়সা, সব নিয়ে ভেগে গেছে। তারপর থেকেই নাকি লোকটা পাগল।’
দাদা পরক্ষণে আরও বলে উঠলেন, ‘ঠিকই আছে, ঈশ্বর বিচার করেছে। জন্মদাত্রী মাকে না দেখে শুধু বউ বউ করে গেছে। শেষে বউটাও ভেগে গেলো। লোকটাও পাগল হলো। লাভ হলো কি!’
আমি লাভের আর কোনো হিসেব খুঁজে না পেয়ে চলে এলাম বাসায়।
এবার ১৫ দিন থাকলাম বাড়িতে। এখন ঢাকায় ফেরার পালা। রাতের রংপুর এক্সপ্রেস ট্রেনে ঢাকায় ফিরবো। টিকিট আগেই কেটে রেখেছি।
বারবার নিষেধ করার পরও আম্মু আবারও আমার সাথে স্টেশন পর্যন্ত এলেন। ট্রেন আসতে এখনো ঢের দেরি।
আম্মুকে বললাম, ‘রাত অনেক হইছে, বাসায় যাও।’
আম্মু বলেন, ‘না। ট্রেন আসার পর তোকে তুলে দিয়ে যাবো।’
‘একা যেতে পারবো, তুমি যাও।’ অনেক জোরাজুরি করাতে শেষ পর্যন্ত চলে গেলো।
প্রায় ৪৫ মিনিট পর ট্রেন এলো। ট্রেনে উঠতে যাবো, এমন সময় ওই লোকটা বলে উঠলো, ‘ভাইয়া, পাঁচটা টাকা হবে?’ ট্রেনে ওঠার তাড়া থাকায় আর খুচরা টাকা না থাকায় আজও তাকে পাঁচ টাকা দিতে পারলাম না।
চার.
করোনা মহামারি চলছে। কলেজ বন্ধ থাকলেও লকডাউনের কারণে ঢাকাতেই আটকা। বাড়ি যাই না, প্রায় ৮-৯ মাস হবে। খুব বাড়ি যেতে মন চাচ্ছে। এদিকে আম্মুও খুব দুশ্চিন্তা করছে। এরই মধ্যে লকডাউন উঠলো। হুট করে চলে এলাম বাড়িতে। এসে দেখলাম করোনার তেমন বালাই নেই। সবাই যে-যার মতো ঘুরছে, ফিরছে। সামাজিক দূরত্বও মেনে চলছে না। মোটরসাইকেল নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে-ফিরে সময় কাটাতে লাগলাম।
হঠাৎ মনে পড়লো, ‘কিরে ওই লোকটাকে কেন জানি চোখে পড়ছে না! কয়েকবার স্টেশনে গেলাম, তাকে দেখলাম না। তিনি গেলো কই?’
ভাবলাম, এবার লোকটার সাথে দেখা হলেই পাঁচ টাকা দেবো। অনেকক্ষণ কথা বলবো, আড্ডা দেবো। কারণ এর আগে দুইবার পাঁচ টাকা চেয়েছে, দিতে পারিনি। ভাবতেই লজ্জায় পড়ে যাই। এবার এজন্য আগে থেকেই পকেটে পাঁচ টাকার কয়েকটি নোট ও কিছু কয়েন রেখেছি। কিন্তু পাঁচ-সাত দিন পার হলেও চোখে পড়লো না লোকটাকে। ভাবছি, গেলো কোথায় লোকটা? ভালো হয়ে বাড়িতে গেলো নাকি?
স্টেশনে আবারও দিলিপ দার কাছে গেলাম। বললাম, ‘দাদা কেমন আছেন? শরীরের অবস্থা কী?’
দাদা বললেন, ‘চলছে ভালোই। তা দাদা এবার অনেকদিন পর যে!’
বললাম, ‘লকডাউনে আটকা পড়েছিলাম দাদা, আসতে পারিনি।’
দিলিপ দা হেঁসে উঠলেন। বললেন, ‘লকডাউন আবার কী? এলাকায় তো এসব লকডাউন-ফাকডাউন নেই।’
দাদার মুখে ‘ফাকডাউন’ কথা শুনেই হেসে উঠলাম। বললাম, ‘দাদা, ফাকডাউন আবার কী?’
দাদা বললেন, ‘ওই হলো।’
এরপর এলাম আসল কথায়। দাদাকে বললাম, ‘দাদা কয়েকদিন হলো আসছি। অই লোকটাকে তো দেখছি না?’
দাদা বললেন, ‘কোন লোক?’
বললাম, ‘ওই যে বউ চলে যাওয়ায় পাগল হয়েছে। এর আগের বার আপনি যার কথা বললেন। ওই লোকটি কোথায়?’
দাদা বললেন, ‘ওই লোক তো মারা গেছে। প্রায় ২০-২২ দিন হবে মারা গেছে। কখন মারা গেছে জানি না। দুপুরের দিকে একজন টের পেলো তিনি ঘুমাচ্ছেন না, মারা গেছেন।’
এক মুহূর্তে আমার হাসি মুখ কালো হয়ে গেলো। মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না আর। একদম নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছি।হঠাৎ কানে বেজে উঠলো, ‘ভাইয়া, পাঁচটা টাকা হবে? ভাইয়া, হবে পাঁচটা টাকা?’
এসইউ/জিকেএস