ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ফোনালাপ

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ | প্রকাশিত: ০৫:০৬ এএম, ০৮ মে ২০১৬

মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল। গলাটা শুকিয়ে যাচ্ছিল। অন্ধকার হাতড়ে খাটের কোণায় পানির বোতলের অস্তিত্ব টের পেলাম। ঢকঢক করে গলা ভিজিয়ে নিলাম। চোখ বন্ধ করলাম আবার। ঘুমানোর চেষ্টা করছি। ঘুম আসছে না। চোখ বুজে আছি। মনে মনে বলি, ‘আয় ঘুম আয়...’

কিন্তু স্বপ্নটা আমার পিছু ছাড়ছে না। ফোন করলাম রবীন্দ্রনাথকে।
_ হ্যালো, রবিঠাকুর!
_ হ্যাঁ বৎস! বল।
_ তুমি গুরু মরিয়া প্রমাণ করিলে তুমি মর নাই। কাদম্বিনী রোজ রাতে আমার ঘুম নষ্ট করে দেয়। আমাকে ঘুমোতে দেয় না। কখনো কখনো আনমনে হেঁটে চলে যাই পুকুর পাড়ে। জোছনা নেই। কেবলি অন্ধকার। আমিতো কাদম্বিনীকে খুঁজে পাই না।
_ ও তাই। আর...
_ গোরা প্রতিনিয়ত ভর্ৎসনা করে। আমাদের নোংরা রাজনীতির জন্য তার সে কী খিস্তিখেউর।
_ তুমি কী বল?
_ আমি আর কী বলব। আহাম্মকের মতো সব শুনি। মুখ বুজে থাকি। কোনো উত্তর নেই।
_ তুমি আসলে কী কর?
_ বছরখানেক হলো, একটা ডিগ্রি কলেজে বাংলা পড়াই।
_ ভালো ভালো, তো।
_ কীসের ভালো? সমস্যা তো ওখানেই।
_ কী সমস্যা?
_ ‘হৈমন্তীর এত কষ্ট কেন?’ ‘অপু কেন বাবার আচরণের প্রতিবাদ করে না?’ নানাবিধ প্রশ্ন শিক্ষার্থীদের।
_ তুমি কী বল?
_ তৎকালীন সমাজব্যবস্থার দোষ দিই। তা শুনে ছাত্রীরা প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। বলে, ‘আমরা তখন থাকলে দেখিয়ে দিতাম।’
_ তুমি কী বিবাহিত?
_ নারে বাবা। তোমাদের মতো অল্প বয়সে বিয়ে করার সাধ থাকলেও সাধ্য নেই। এন্ট্রান্স পড়লেই বাবা বিয়ে দেবেন- এমন ভাগ্য আমাদের নেই। সতের বছরের হৈমন্তী, বয়সে দাদি-নানিকে হার মানালেও বাংলাদেশ সরকার আঠারো বছরের আগে মেয়েদের বিবাহ নিষিদ্ধ করেছে।
_ সে যাই হোক। যখন যে নিয়ম। আমাদের সময় আট বছরে বিয়ের নামে ‘গৌরীদান’ করা হতো। বিয়ে না করতে পার প্রেম তো নিশ্চয়ই কর। ওটাতে তো আর বয়সের বালাই নেই।
_ হা-হা-হা। তা বলতে পার। ডজনখানেক তো হবে। জলের মতো আসে আর যায়। তবে এ ক্ষেত্রে তোমার গানগুলো বেশ সহায়ক।
_ যেমন?
_ কাউকে দেখলেই গেয়ে উঠি- ‘আমারও পরানও যাহা চায়’ কিংবা ‘ভালোবাসি-ভালোবাসি...’
_ তাতে কাজ হয়?
_ হবে না মানে। রবীন্দ্রনাথকে কে না জানে। তার গান কে না শোনে। তবে মাইন্ড করলে বলি, তোমাকে কিছু বলিনি। রবীন্দ্রসংগীত গাইছিলাম।
_ হা-হা-হা। ভালো তো। দারুণ বুদ্ধি তোমার।
_ তোমার চেয়ে কমই।
_ অনেক দিন পরে হাসলাম। তুমি আমাকে হাসালে!
_ কেন?
_ ফটিকের জন্য মন খারাপ হয়। আমার ফটিকরা কেমন আছে?
_ আগের মতোই দুষ্টু। খালি ছুটির জন্য অস্থির হয়ে ওঠে।
_ তা না হয় মানলাম। তুমি লেখালেখি কর নাকি?
_ চেষ্টা করি। হয় কি না জানি না। তবে প্রেমিকার উদ্দেশে দু-চার লাইন। হাতে হাতে দিতে পারি না। ফলে পত্রিকায় পাঠাই। সম্পাদক মহাশয় সদয় হলে প্রকাশ হয়। পত্রিকার কপিটা নিয়ে ভালোবাসার মানুষটির হাতে দিই। হাতে পেয়ে বলে, ‘বাহ! চমৎকার কবিতা তো।’ কিন্তু মাঝেমধ্যে কষ্ট হয়- যার জন্য লিখলাম সে বুঝল না। আর প্রেমে পড়ল কি না অন্যজন। বল, এটা মহামুশকিল না?
_ চালিয়ে যাও। একদিন বুঝিবে বাছাধন। আমার ‘শেষের কবিতা’ পড় নাই?
_ আরে মহাশয়! সে তো কয়েকবার পড়েছি। কিন্তু আমার বাবারও সাধ্য নাই বোঝার। না বুঝলেও শেষের কবিতাটা কয়েকবার আবৃত্তি করেছি। শ্রোতারা বড্ড হাততালি দেয়।
_ তাই নাকি? তুমি আবৃত্তি কর? আমি না ভালো আবৃত্তি করতে পারতাম না। মিনমিনে কণ্ঠ ছিল তো।
_ হ্যাঁ, তা ঠিক বলেছ। তোমার কণ্ঠে ‘সোনার তরী’ শুনে আমি অনেক হেসেছি। কেমন কাতর-কাতর কণ্ঠ। মেয়েলি-মেয়েলি ভাব।
_ তুমি আমাকে অপমান করছ?
_ দুঃখিত, সে স্পর্ধা আমার নেই। ক্ষমা করবেন জাহাঁপনা! তবে আপনার ‘হঠাৎ দেখা’, ‘বাঁশি’, ‘দেবতার গ্রাস’, ‘দুই বিঘা জমি’, ‘সোনার তরী’, ‘অপমানিত’ ও ‘রক্ত করবী’র অংশবিশেষ বহুবার আবৃত্তি করেছি। পুরস্কারও পেয়েছি।
_ বাহ-বাহ! তোমরাই তো আমাকে বাঁচিয়ে রাখলে। তা না হলে কবেই পঁচে যেতাম। মিশে যেতাম মাটির সঙ্গে।
_ কী বলেন? আপনি আছেন বলেই তো আমরা আছি। আজো বাংলা সাহিত্য আছে। বিশ্বসাহিত্যের দরবারে বাংলা সাহিত্য স্থান করে নিয়েছে। ‘নোবেল’ পাওয়ার গৌরব অর্জন করেছি আমরা।
_ ও কথা আর বলো না। পেলাম একটা নোবেল। তা নিয়ে কত সমালোচনা। শেষমেশ আবার নোবেলটা চুরিও হয়ে গেল। হায়রে কপাল আমার।
_ দুঃখিত! অনাকাঙ্ক্ষিত এ ভুলের জন্য।
_ না থাক, ঠিক অছে। তবে আমার একটা অনুরোধ। সাহিত্যটাকে কলুষিত হতে দিও না। বিখ্যাত হওয়ার বাসনা নিয়ে লিখতে বসো না। বরং লিখে বিখ্যাত হও। সহজ-সরল পাঠককে ঠকিও না। তোমরা লিখে যাও। তাতেই আমি বেঁচে থাকব। বাংলা সাহিত্য বেঁচে থাকবে। মানুষ বেঁচে থাকবে। সর্বোপরি মানুষের জন্য কিছু কর।

‘আজি ঝড় ঝড় মুখরও বাদর দিনে’- গানের সুরে হঠাৎ মোবাইলের রিংটোন বেজে উঠল।
ঘুম ভেঙে গেল। সঙ্গে স্বপ্নটাও। মোবাইল স্ক্রিনে ‘অনিন্দিতা কলিং’ দেখে রাগটা সামলে নিয়ে ঘুম ঘুম চোখে ফোন রিসিভ করলাম।
_ হ্যালো, রবিঠাকুর!
অনিন্দিতা বলল, ‘পাগল নাকি? রবিঠাকুর এলো কোত্থেকে?’
_ ও তাই তো, তুমি অনিন্দিতা। আসলে এতক্ষণ রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কথা বলছিলাম তো।

অনিন্দিতা হাসল।
_ তোমার মাথা একেবারে খারাপ হয়ে গেছে। আমার মনে হয় কী জান? কালতো রবীন্দ্রনাথের জন্মবার্ষিকী। তুমি হয়তো ভাবছিলে কিছু লিখবে। কিন্তু কী লিখবে খুঁজে পাচ্ছিলে না। তাই ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছ। আর অমনি ঘুমের ঘোরে রবীন্দ্রনাথকে ফোন করেছ। হা-হা-হা।

ফোন কানে ধরে আছি। অনিন্দিতার হাসির লহরি বেজে যাচ্ছে অবিরাম। আর কর্ণকুহরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের ফোনালাপ। আসলে রবীন্দ্রনাথ আমাকে স্বপ্ন দেখায়। রবীন্দ্রনাথ আমাকে বাঁচতে শেখায়।

তুমি কেন চলে গেলে রবীন্দ্রনাথ? আর কিছুদিন থাকতে পারলে না? কিংবা আবার কেন ফিরে আস না!

এসইউ/এমএস

আরও পড়ুন