বাংলাদেশের ছড়াসাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা
ফারজানা অনন্যা
ছড়া আবহমান বাংলার লোক অনুষঙ্গের প্রত্নশিল্প। লোকসাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শনের মধ্যে ছড়া অন্যতম বলে কোনো কোনো ফোকলোরবিদ মনে করেন। লোকজ জীবনের নানা প্রসঙ্গ, আচার-অনাচার, অভ্যাস, অসংগতি, স্বপ্ন বা কল্পনা ছড়ার ছোট্ট জমিনে বাঙ্ময় হয়ে ওঠে। ছড়ায় সব সময় সমাজসত্য গভীরভাবে প্রকাশ পেয়ে এসেছে। বিশেষত স্বপ্নময় শিশু-কিশোরের জীবন আমাদের ছড়াসাহিত্যে অসাধারণভাবে প্রতিফলিত। তবে আধুনিককালে ছড়া আর শুধু শিশু-কিশোর জীবন পরিধির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। ব্যক্তিক, সামাজিক, রাজনৈতিক প্রতিবাদের ভাষা হিসেবেও ছড়ার বিষয় বিস্তৃতি ঘটেছে। আমাদের জাতীয় জীবনের নানা আন্দোলন, সংগ্রাম এবং লড়াকু বজ্রব্যক্তিত্বের অধিকারী ব্যক্তিদের নিয়েও আমাদের ছড়াকাররা সাজিয়েছেন শিল্পনিপুণ শাণিত শব্দগুচ্ছের বুননে চমৎকার সব ছড়ার ডালি।
বাঙালি বিপ্লব পাগল জাতি। এই জাতিকে কখনো দমননীতি, অন্যায় আর শোষণের জাঁতাকলে আবদ্ধ রাখা যায়নি। যুগে যুগে বিদ্রোহী হয়ে স্বাধীনতা সূর্যকে ছিনিয়ে এনেছে তাঁরা। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর আমাদের জাতীয় রাজনৈতিক পর্যায়ে যতগুলো আন্দোলন ও অভ্যুদয় হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায় নিঃসন্দেহে মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৭১ সালে সংগঠিত এই মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানি শোষক গোষ্ঠীর কাছ থেকে বহুল কাঙ্ক্ষিত মুক্তি এনেছে এই বীর জাতি। স্বাধীনতা সূর্যের দিকে উন্মুখ সেই বাংলাদেশ বিশ্বের মানচিত্রে সার্বভৌম জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। তাই স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলা সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় এই গৌরবময় অধ্যায়ের কথা চিত্রিত হয়। গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ছড়াসহ সাহিত্যের প্রতিটি শাখা সমৃদ্ধ হয় এই গৌরবময় অর্জনের দ্বারা।
অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের উপকরণ নিয়ে ছড়া লিখেছেন এবং মুক্তিযুদ্ধের ছড়ার বই সম্পাদনা করেছেন। তাদের একক ও সম্পাদিত গ্রন্থগুলো শৈশব থেকে আমাদের নতুন প্রজন্মকে সচেতন নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে অনন্য ভূমিকা পালন করতে পারে। বাংলাদেশের ছড়াসাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ রূপায়িত হয়েছে বহুবর্ণিল বহুমাত্রিক চেতনায়। কখনো পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও নেতৃবর্গদের ব্যঙ্গবিদ্রুপ করে, কখনো পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম হত্যা-লুণ্ঠন-নির্যাতন; বিশেষত নারী নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে, কখনো গেরিলা বাহিনীর দুর্বিনীত সাহসিক আক্রমণের জীবন্ত বর্ণনায়, আবার কখনোবা যুদ্ধ শেষে ফিরে না আসা বাবা কিংবা ভাই হারানোর বেদনায় অশ্রুসিক্ত মা-বোনের আহাজারির করুণ চিত্রকে সাজিয়ে আমাদের ছড়াকাররা রচনা করছেন বাস্তব শিল্পসফল পঙ্ক্তিমালা।
বাংলাদেশের ছড়াসাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিফলনকে মোটাদাগে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়:
ক. হানাদার বাহিনীর হত্যা, লুণ্ঠন, নির্যাতন ও নির্মমতার চালচিত্র।
খ. পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর বীরোচিত প্রতিরোধ।
গ. সমগ্র দেশবাসীর সামষ্টিক প্রতিরোধ ও দেশপ্রেম।
ঘ. মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি আলবদর, আল শামস, রাজাকারদের বিশ্বাসঘাতকতা।
ঙ. যুদ্ধ থেকে না ফেরা বাবা, ভাইদের জন্য স্বজনদের সজল আহাজারি।
চ. মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান এবং
ছ. যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের নৈরাজ্য, প্রত্যাশা ও প্রাপ্তিতে স্বপ্নভঙ্গ প্রভৃতি রূপায়িত হয়েছে সচেতন শিল্পপ্রয়াসে।
- আরও পড়ুন
- প্রকৃত কবির কবিতা একসময় আলোচনায় আসবে: গোলাম কিবরিয়া পিনু
- ছাত্র আন্দোলনে প্রেরণা জুগিয়েছে যাদের গীতি-কবিতা
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে ঢাকায় যে পাশবিক নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল; তার চালচিত্র আছে লুৎফুর মুকুলের ছড়ায়, ‘একাত্তরের পঁচিশে মার্চ/ নিকষ কালো রাতে/ পাকহানারা হত্যা চালায়
রাজাকারের সাথে।/ অপারেশন সার্চে তারা/ হত্যা চালায় শুরু/ ঢাবি মারে বুদ্ধিজীবী/ দেশ জাগানি গুরু।’ কিংবা পাকিস্তানি হানাদারদের প্রধান লক্ষ্যবস্তু ছিল শিক্ষক ও ছাত্রসমাজ। যাদের নিশ্চিহ্ন করতে পারলেই বাঙালির প্রতিবাদী সত্তা মিয়ম্রাণ হবে বলে তাদের ধারণা ছিল। কিন্তু বাঙালি ছাত্রসমাজ যে ফিনিক্স পাখির মতো বারবার ছাইভস্মের ভেতর দিয়ে জেগে ওঠে, এটা তারা বুঝতে পারেনি। ইকবাল হল, রোকেয়া হলের ছাত্রসহ ঢাকার সব স্তরের নিরীহ মানুষকে তারা নির্বিচারে হত্যা করেছিল, তারই চিত্র আছে ছড়াটির পঙ্ক্তিমালায়। পাকিস্তানি বাহিনী শহরের পাশাপাশি গ্রামের পর গ্রামের পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছিল। তাদের নৃশংসতার হাত থেকে রেহাই পায়নি গ্রামের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা। তারই একটি খণ্ডচিত্র আমীরুল ইসলামের ছড়ায়, ‘এমন দিনে শত্রু সেনা আসল সেই গ্রামে/ ভয়াল রাতের অন্ধকারে গভীর হয়ে নামে/ মেঘনা তীরে জ্বলল আগুন পুড়ল বাড়িঘর/ শত্রুসেনা বধ করতে অস্ত্র তুলে ধর।’
হানাদারদের নৃশংসতাকে রুখে দিতে অস্ত্র ধরে বীর বাঙালি। মুক্তিযুদ্ধে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সহযোগিতা, মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব, আত্মত্যাগ, গেরিলাযুদ্ধ প্রভৃতি জীবন্ত হয়ে উঠেছে শব্দকারিগরদের কলমের ছন্দময় পদচারণায়। ওবায়দুল গণি চন্দনের ছড়ায়, ‘শত্রু দেশে হানা দিলো একাত্তরের মার্চে/ বীর বাঙালি দুঃসাহসে যুদ্ধে মাতে/ বন্দী হয়ে থাকতে কে চায়?/ মরাও ভালো তার’চে।’ কিংবা ফারুক নেওয়াজের ছড়ায় সম্মুখ সমরের বর্ণনা, ‘বিনোদপুরের যুদ্ধে মুকুল শত্রুর মুখোমুখি/ লড়াই করতে নিয়েছে জীবনের বড় রকম ঝুঁকি/ একাই মেরেছে বহু রাজাকার, অসংখ্য পাক সেনা/ শেষকালে সেও শহীদ হয়েছে আর কভু জাগবে না।’ কিংবা যুদ্ধপাগল তরুণদের যুদ্ধে যাওয়ার অদম্য প্রেরণার শব্দগুচ্ছ পাওয়া যায় সুজন বড়ুয়ার ছড়ায়, ‘কোথায় আমার ঢাল তলোয়ার কোথায় ধনুক তীর/ মাগো আমি যুদ্ধে যাব সাজব তিতুমীর।’
আমরা যে স্বপ্ন, আশা আর আকাঙ্ক্ষা নিয়ে মুক্তির মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম, মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর দেখা গেলো কাঙ্ক্ষিত সেই মুক্তি বা স্বাধীনতা এখনো আসেনি। সামাজিক ও অর্থনৈতিক শোষণ থেকে মুক্তি আমাদের তখনো মেলেনি। স্বাধীনতা পরবর্তী স্বপ্নভঙ্গের বেদনা নিয়েও বাংলাদেশের ছড়াকাররা চমৎকার সব পঙ্ক্তিমালা বারুদের তেজের মতো ছড়িয়ে গিয়েছেন। ফুটিয়ে তুলেছেন প্রকৃৃত সত্যকে। স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়েও যারা সত্য উচ্চারণে ভয় পাননি। আসাদ চৌধুরীর কলমে, ‘আগুন ছিলো মুক্তিসেনার/ স্বপ্ন ঢালের বন্যায়/ প্রতিবাদের প্রবল ঝড়ে/ কাঁপছিলো সব অন্যায়/ এখন এসব স্বপ্ন কথা/ দূরের শোনা গল্প/ তখন সত্যি মানুষ ছিলাম/ এখন আছি অল্প।’
বাংলাদেশের ছড়াসাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ রূপায়িত হয়েছে বহুবর্ণিলতায়। আবহমান বাংলার লোকজ উৎস থেকে ছড়ার জন্ম হলেও স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের ছড়াসাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধের বিষয় ও প্রসঙ্গকে শিল্পমাত্রা দিয়ে ছড়াসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে তুলেছেন সাহসী ছড়াকাররা।
এসইউ/জিকেএস