ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

প্রকৃত কবির কবিতা একসময় আলোচনায় আসবে: গোলাম কিবরিয়া পিনু

সাহিত্য ডেস্ক | প্রকাশিত: ০১:৪৪ পিএম, ২৭ আগস্ট ২০২৪

গোলাম কিবরিয়া পিনু মূলত কবি। প্রবন্ধ, ছড়া ও অন্য শাখায়ও তার বিচরণ চোখে পড়ার মতো। গবেষণামূলক কাজেও যুক্ত তিনি। জন্ম ১৯৫৬ সালের ৩০ মার্চ গাইবান্ধায়। এই শহরেই তার শৈশব-কৈশোর কেটেছে। পড়েছেন শহরের মধ্যপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। মাধ্যমিক গাইবান্ধা সরকারি উচ্চ বালক বিদ্যালয়। পরে গাইবান্ধা সরকারি কলেজ হয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক (সম্মান) এবং স্নাতকোত্তরসহ পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।

১৯৮৩ সাল থেকে ঢাকায় বসবাস। লিখছেন চার দশকের বেশি। ১৯টি কবিতার বই, ছড়া-প্রবন্ধ-গবেষণা মিলে ৩২টি গ্রন্থ বের হয়েছে। তার কবিতা, ছড়া, প্রবন্ধ, কলাম নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। ইংরেজি, ফরাসি, ডাচ, হিন্দি ও অন্য ভাষায় অনূদিত হয়ে বিভিন্ন দেশে প্রকাশিত হয়েছে। তার তিনটি বই ‘লাইব্রেরি অব কংগ্রেস’ ও ‘World cat member libraries worldwid’-এ স্থান পেয়েছে। এ ছাড়া ভারত ও বাংলাাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতেও স্থান পেয়েছে।

শিশু-কিশোর সংগঠন খেলাঘরসহ ছাত্র ও রাজনৈতিক সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধেও তার রয়েছে ভূমিকা। বর্তমানে বাংলা একাডেমির জীবনসদস্য ও এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশের সদস্য। ১৯৮৭ সালে জাতীয় কবিতা পরিষদ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই জাতীয় কবিতা পরিষদের নির্বাহী কমিটির সদস্য, বিভাগীয় সম্পাদক, ১০ বছর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও শেষে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে বাংলাদেশ প্রগতি লেখক সংঘের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। দেশ ও দেশের বাইরের বিভিন্ন সংগঠন থেকে পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। পেশাগত প্রশিক্ষণ ও অন্য প্রয়োজনে ভারত, নেপাল, শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, আমেরিকা, বলিভিয়া, নেদারল্যান্ডসসহ কয়েকটি দেশ ভ্রমণ করেন।

২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আন্তর্জাতিক মিডিয়া বিষয়ক সংস্থা ‘ফ্রি প্রেস আনলিমিটেড’র সঙ্গে কাজ করেছেন। এর আগে এফপিএবিতে উপপরিচালক (অ্যাডভোকেসি), ফোকাল পয়েন্ট ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এফপিএবি থেকে প্রকাশিত মাসিক ‘সুখী পরিবার’র সম্পাদক হিসেবে ১৯৮৩ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। বিসিসিপি ও অন্য প্রতিষ্ঠানেও যুক্ত ছিলেন। পেশাগতভাবে বিভিন্ন সময়ে সাংবাদিকতা, কলাম লেখা, সম্পাদনা ও অ্যাডভোকেসি বিষয়ক কর্মকাণ্ডে যুক্ত থেকেছেন।

সম্প্রতি সাহিত্যের নানা দিক নিয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন এই গুণী কবি, প্রাবন্ধিক ও গবেষক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তরুণ কবি ও গবেষক বঙ্গ রাখাল—

জাগো নিউজ: শুরুতেই লেখালেখির বিষয়ে জানতে চাই? কবে থেকে শুরু হলো এই সন্ন্যাস জীবন?
গোলাম কিবরিয়া পিনু: মুক্তিযুদ্ধের এমন এক পরিবেশের মুখোমুখি আমরা তখন, একদিকে বিধস্ত অবকাঠামো ও স্বজন হারানোর বেদনার্ত সময়, আর অন্যদিকে নতুন করে গড়ে উঠবার উদ্দীপনা ও স্বপ্নের আন্দোলিত প্রেষণা। এমন সময়ের কণ্ঠলগ্ন হয়ে কিশোর বয়সের জীবন ছিল তখন। পড়ালেখার পাশাপাশি শিশু-কিশোর সংগঠন খেলাঘর করছি, করছি ছাত্র সংগঠন, অংশ নিচ্ছি সাহিত্য-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে। যাচ্ছি পাবলিক লাইব্রেরিতে নিয়মিত। এমন পরিবেশ নিয়ে ছোট শহর গাইবান্ধায় বেড়ে উঠছি। তখন বের হতো স্থানীয় পর্যায়ে বিশেষ দিবস উপলক্ষে বহু সংকলন। আর এসব সংকলনে প্রথম দিকে আমার কবিতা ছাপা হতে থাকে। হতো নিয়মিত সাহিত্যসভা ও অনুষ্ঠান। এগুলোর সংগঠক ও অংশগ্রহণকারী ছিলাম আমিও। আর কবিতা রচনা প্রতিযোগিতায়ও পেয়ে যাচ্ছিলাম পুরস্কার। পাঠ্য-পুস্তকের বাইরে প্রথমে কোন কবিতার বই পড়েছি, তা মনে নেই। তবে শৈশবকাল থেকেই নিয়মিত দৈনিক পত্রিকা ও ম্যাগাজিন পড়ার সুযোগ পেয়েছি। ফলে এসবে ছাপা কবিতার আগ্রহী পাঠক আমি তো ছিলাম। গাইবান্ধার পাবলিক লাইব্রেরি ও তথ্যকেন্দ্রের ছিলাম একনিষ্ঠ পাঠক। এই দুই প্রতিষ্ঠানের সব কবিতার বই পড়েছি তখন, পড়েছি কত ধরনের বই। এই দুটি প্রতিষ্ঠানে যেতাম নিয়মিত। আর ছিল গাইবান্ধা রেল স্টেশনের বুকস্টল আর পত্রপত্রিকার দোকান, নিয়মিত যাতায়াতের ঠিকানা। এমন সামাজিক পরিবেশ পেয়েছি, যা সাহিত্যচর্চার অনুকূলে ছিল। বাড়িতে বাবা-মা ও ভাইবোনদের সঙ্গ অনেক সময় পাইনি কিশোর বয়সে, বাবা-মা ও ভাইবোন থেকে আলাদা থাকতে হয়েছে তখন। তারা থাকতো বাবার সাথে চাকরিসূত্রে অন্য জায়গায়, আমি থাকতাম নানা বাড়িতে, গাইবান্ধা শহরের মোমেনান রোডে। তবে সাহিত্য পরিবেশ ছিল গাইবান্ধা শহরে, এই পরিবেশের বাসিন্দা ছিলাম আমি বেশ নিবিড়ভাবেই।

এমন অনুকূল পরিবেশ পেয়ে কবিতা ধরা দিতে শুরু করে। গাইবান্ধা থাকাকালীন জাতীয় পত্রপত্রিকায় লেখা ছাপা শুরু হতে থাকে, এছাড়া দেশের বিভিন্ন এলাকার লিটল ম্যাগাজিনেও। প্রথম দিকে নিজের লেখা প্রকাশ হতো কিশোর বয়সে, তখন এক ধরনের উন্মাতাল আনন্দ পেতাম। পোস্ট অফিসের খামে মফস্বল শহর থেকে কবিতা পাঠিয়ে যখন অপেক্ষার পর কবিতা ছাপা হতো; তখন মনে হতো আমি এক দিগ্বিজয়ী বীর। তখন তো এত পত্র-পত্রিকা ছিল না, ছিল না এত রকমের গণমাধ্যম। কবিতা ছাপা হলে স্থানীয় পর্যায়ে সাহিত্য-মহলে এক ধরনের সাড়া পড়ে যেত, মর্যাদাও বাড়তো, শুধু সাহিত্যমহলে নয়—পাঠকদের মধ্য থেকেও সাড়া পাওয়া যেত, এক ধরনের গৌরববোধ হতো, সমীহ ও মর্যাদা পাওয়া যেত।

পরে শুধু কবিতা লিখবো—সাহিত্যের সাথে যুক্ত থাকবো বলেই—রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অনার্সে ভর্তি হই। তখন আরও কবিতা লেখায় উদ্দীপিত হতে থাকি। কবিতার সাথে তখন সম্পর্ক আরও নিবিড় হয়ে ওঠে। জাতীয় পত্রপত্রিকায় তখন আরও কবিতা ও অন্যান্য লেখা ছাপা হতে শুরু করে। এমন ভাবেই কবিতা ও লেখার সাথে সম্পর্ক দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হতে থাকে।

আমিও বুঝেছি কিশোর বয়সেই—কবিতা লেখাই আমার ভবিতব্য। শুধু কবিতা লিখবো বা লেখালেখি করবো এটাই ছিল জীবনের মূল লক্ষ্য। কিশোর বয়সেই অন্ধকারের দিগন্ত চিড়ে বুঝতে পেরেছিলাম, অনেক পথই হাতছানি দিচ্ছে, কিন্তু সেইসব হাতছানি পরিহার করে কবিতার পথেই থাকতে হবে আমাকে। এই তো এখন মাঝে মাঝে শুনতে হয় আমার জীবনসঙ্গীর কথা: ‘তুমি যদি কবিতা না লিখতে, তাহলে আরও বেশি বেতনের চাকরি করতে পারতে, টাকা-পয়সা হতো, গাড়ি-বাড়ি-ফ্ল্যাট, আরও অনেক কিছু! না, তুমি এসবের দিকে তোমার যোগ্যতা থাকার পরও মনোযোগ দিলে না, সময় দিলে না!’ এক ধরনের হতাশা তার মধ্যে কাজ করে কি-না, জানি না। তবে আমি মনে করি শুধু কবিতা লেখার জন্য দৃঢ় মনোবল নিয়ে জিদ নিয়ে ধারাবাহিকভাবে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়েছে সেই কিশোর বয়স থেকেই। বহু কিছু ছাড় দিয়ে নিঃসঙ্গ হয়ে একাকী অনেক গলিপথ-ঘুরপথ ঘুরে-ফিরে নিজেকে কবিতার জন্য রক্ষা করতে হয়েছে। কখনো কখনো উন্মাতাল সময়ের মুখোমুখি হয়েছি, কত রকমের মনস্তাত্বিক যুদ্ধ করতে হয়েছে কিশোর বয়স থেকে আজ অবধি। দর্শন-নৈতিকতার শিক্ষা অবলম্বন হিসেবে ছিল, ছিল কবিতার শক্তি আর সাহস।

জাগো নিউজ: আপনি নারী লেখকদের নিয়ে কাজ করেছেন। তাদের নিয়ে কাজ করার কারণ কী?
গোলাম কিবরিয়া পিনু: আমার পরিবার, আত্মীয়-স্বজন ও আশেপাশের নারীদের কষ্ট-বঞ্চনা ও বিভিন্নমুখী অধিকার হারা হয়ে তাদের যন্ত্রণা ছোটবেলা থেকে পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতায় শুধু আসেনি, বিভিন্নমুখী প্রশ্নেরও মুখোমুখি দাঁড় করে দিয়েছে। পরবর্তী সময়ে লেখাপড়া ও পেশাগতভাবে নারীদের বিষয়ে আরও জ্ঞান লাভ করি। এমন ধারাবাহিকতায় নারীদের বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে বিশেষত নারী লেখকদের জীবন ও তাদের সাহিত্যকর্ম নিয়ে উৎসাহী হই।

গাইবান্ধা শহরে বসবাসকারী দৌলতননেছা খাতুন (১৯২২-১৯৯৭) সম্পর্কে আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার শুরুতেই দীর্ঘ লেখা লিখি ও প্রকাশ করি। সেই সময়ে তাঁকে পাদপ্রদীপের আলোতে নিয়ে আসি। তিনি ছিলেন পঞ্চাশ দশকের কথাসাহিত্যিক ও লেখক, সেইসাথে রাজনীতিক। তাঁর জীবিত থাকাকালীন তিনি একেবারে অন্তরালে চলে গিয়েছিলেন। তখন তাঁকে নিয়ে লেখালেখি শুরু করি। বিশ শতকে বাংলার নারী জাগরণ তথা বাঙালি মুসলিম নারীর চেতনাগত বিবর্তনের হদিশ যদি কেউ খুঁজে পেতে চায়, তাহলে দৌলতননেছা খাতুনের জীবনকাহিনি ও লেখার কাছে যেতে হবে। তাঁর মৃত্যৃর পর ১৯৯৯ সালে বাংলা একাডেমি থেকে আমার লিখিত দৌলতননেছা খাতুনের জীবনীগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। পরে তাঁকে নিয়ে আরও লেখা প্রকাশিত হয়, সেইসাথে অন্য নারী লেখক ও অন্যদের নিয়েও।

আরেকটি ঘটনার কথা বলি—আমার জন্মের পর, পাকিস্তান আমল ও বাংলাদেশের ১৯৮০ সাল পর্যন্ত আমি দেখেছি নানাদের বৃহৎ পরিবার। নানারা ছিলেন দুই ভাই ও দুই বোন। আমার নানার তিন মেয়ে ও এক ছেলে, নানার ভাই মতি নানার ১৩ ছেলে-মেয়ে, শেষ সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় মতি নানার স্ত্রী মারা যান, সেই বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে, ১৯৭০ সালের ২৫ নভেম্বর। মতি নানার বিপত্নিকাল ছিল বহু বছর, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আর বিয়ে করেননি। মতি নানার স্ত্রীর নাম ছিল নূরজাহান। মতি নানা তাঁর স্ত্রীকে খুবই ভালো বাসতেন। শেষ সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় মতি নানার স্ত্রী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স খুবই কম ছিল, সে-সময়ে প্রসূতির মৃত্যুর হার অনেক বেশি ছিল, মাতৃ মৃত্যুহারও। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিও ছিল ভিন্ন। বিভিন্ন ধরনের সামাজিক অবরোধ, কুসংস্কার ও শিক্ষার অভাবের কারণে যুগ যুগ ধরে বাঙালি নারী সমাজ সন্তানের জন্ম ও তার লালন-পালন, পতিসেবা ও গৃহকর্মের মধ্যেই বৃত্তাবদ্ধ হয়ে থাকেন। ফলে নারীর সামাজিক মর্যাদা ও জীবনের বিকাশ বর্তমান সময়ের মতো তখন এতটা ত্বরান্বিত হতে পারেনি, অন্যদিকে নারী তখন নতুন জীবনবোধ নিয়ে অনেক ক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার সাহস ও শক্তি অর্জন করতেও পারেননি। রাষ্ট্রের আইন, সামাজিক বিধিনিষেধ, ধর্মীয় বিবেচনা ও অর্থনৈতিক কারণে নানাভাবে বৈষম্যের শিকারও হন তাঁরা। সেই পরিবেশ-প্রতিবেশে ও চিকিৎসার সীমাবদ্ধতার কারণে মতি নানার স্ত্রীর মৃত্যু এক কালিক-ট্রাজেডি। মতি নানার স্ত্রী আমাকেও বেশ স্নেহ করতেন। তাঁর এই ট্রাজিক মৃত্যুর কথা আমি কখনো ভুলতে পারিনি, এই মৃত্যুটা পরিবেদনার ভেতর দিয়ে বিভিন্ন সংকেত ও বোধ মনের গভীরে অন্তরস্থ হয়ে থাকে। পেশাগতভাবে ও অন্যান্য আয়োজনে প্রশিক্ষণ-সেমিনার ও আলোচনা সভায় এই নানীর মৃত্যুর ঘটনাকে দৃষ্টিপথে টেনে এনেছি যে কতবার! আরও অনেক ঘটনা ও অভিজ্ঞতা নারী বিষয়ক লেখা লিখতে উদ্বুদ্ধ করে। ২০১০ সালে বাংলা একাডেমি থেকে আমার ‘বাংলা কথাসাহিত্য: নির্বাচিত মুসলিম নারী লেখক ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’ (গবেষণা) বইটি বের হয়। এরপরও নারীদের আরও একটি প্রবন্ধগ্রন্থ বের হয়। নারীদের ওপর লিখে প্রশংসা ও সম্মান পেয়েছি। ‘বাংলাদেশের সাহিত্য’ নামের গ্রন্থে অধ্যাপক মাহবুবুল আলম বলেছেন, ‘বাংলাদেশের প্রবন্ধসাহিত্যে ড. গোলাম কিবরিয়া পিনু (১৯৫৬) একটি উল্লেখযোগ্য আসনের দাবীদার। তিনি এদেশের কয়েকজন মহিলার সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে আলোচনা করে তাঁদের বিশেষ অবদানের যে গুরুত্বের কথা বলেছেন তা একটি ব্যতিক্রমধর্মী উদ্যোগ। তিনি বাঙালি মহিলাগণের সংগ্রাম-অধিকার-জাগরণ এবং বাংলা সাহিত্যে তাঁদের ভূমিকা নিয়ে মূল্যবান গবেষণা করে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন।’

জাগো নিউজ: কবি হিসেবে প্রেম বলতে কী বোঝেন?
গোলাম কিবরিয়া পিনু: প্রেম মানুষের মস্তিষ্কজাত অনুভূতি ও আবেগের মিথষ্ক্রিয়া। এর অনেকটা প্রহেলিকাময়, তবুও তা শারীরিক ও স্নায়ুবিক সম্পর্কের বহু বিস্তৃত রহস্য নিয়ে মানুষের জীবনে উপস্থিত। প্রেমের উপাদানগুলো জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন সম্পর্কের সাথে সংশ্লিষ্ট। জৈব বিবর্তনের সাথে সাথে প্রেমের অর্থ ও ব্যঞ্জনা বিকশিত হয়। প্রেম বাসনা-কামনা, বিবেক-বুদ্ধি ও বিভিন্ন প্রণোদনায় চালিত হয়। প্রেম সামাজিক পরিবেশ, সংস্কৃতি ও বিধি-নিয়মের সম্পর্কজাত এক বন্ধন। মানুষের অন্তর্গত জীবন ও প্রবণতা নিয়ে প্রেম ভিন্নমাত্রা ও দৃষ্টিভঙ্গি নির্ভর হয়ে বিভিন্নভাবে প্রকাশিত হয়ে থাকে।

জাগো নিউজ: কবিতার বিষয় বা উপকরণ কোথা থেকে সংগ্রহ করেন?
গোলাম কিবরিয়া পিনু: কতভাবে যে আমার কবিতা রচনার পটভূমি সূচিত হয়েছে—তার সীমা নেই! কখনো একটি ঘটনা, কখনো একটি ছবি, কখনো একটি সংবাদ, কখনো একটি অনুচিন্তা, কখনো একটি কল্পনা, কখনো কারো অভিব্যক্তি, কখনো কোনো সাময়িক ঘটনা, কখনো কোনো অবলোকন, কখনো কোনো ইন্দ্রিয়ানুভূতি, কখনো কোনো দৃশ্য, কখনো কোনো ইশারা, কখনো কোনো কৌতূহল, কখনো কোনো প্রজ্ঞান, কখনো কোনো ভাবুকতা, কখনো কোনো জিজ্ঞাসা, কখনো চৈতন্যের কোনো এক অনুরণন, কখনো কোনো কিছুর ব্যবচ্ছেদ ও সুলুকসন্ধানসহ আরও বহুবিধ সংকেত কবিতা রচনায় ঘোর তৈরি করে—যা থেকে আমার কবিতার অস্তিত্ব রচিত হয়, কবিতা পরিব্যাপ্ত হয়।

আমি কবি হিসেবে বহু ধরনের কবিতা লিখেছি এবং সেগুলো বিভিন্ন নিরীক্ষাপ্রবণতায় সংশ্লিষ্ট বলে মনে করি। আমার কবিতায় জীবন আছে, সমাজ আছে, প্রকৃতি আছে, মানুষ আছে, দেশ-সময়কাল আছে এবং আছে প্রতীকের ব্যঞ্জনাও। আছে রূপক, আছে ছন্দের বিভিন্নমুখী ব্যবহার, অনুপ্রাসের নতুনমাত্রা, মিলবিন্যাসের নীরিক্ষা ও অন্যান্য সূক্ষ্ম কারুকাজ। একেক কাব্যগ্রন্থ একেক বৈশিষ্ট্য নিয়ে উজ্জ্বল বলে আমি মনে করি। প্রথম কবিতার বই ‘এখন সাইরেন বাজানোর সময়’ থেকে ‘সূর্য পুড়ে গেল’ কিংবা ‘কে কাকে পৌঁছে দেবে দিনাজপুরে’ কাব্যগ্রন্থের কবিতার বিষয়-আঙ্গিক ও বোধের জায়গা বদলিয়েছে, আবার ‘আমরা জোংরাখোটা’ কাব্যগ্রন্থ পেয়েছে ভিন্নমাত্রা। ‘সুধা সমুদ্র’ কাব্যগ্রন্থ লেখা হয়েছে মানুষের অন্তর্গত জীবন ও প্রবণতা নিয়ে, যেখানে প্রেম ভিন্নমাত্রা ও আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি নির্ভর হয়ে ধরা দিয়েছে। ‘ও বৃষ্টিধারা ও বারিপাত’ পুরো কাব্যগ্রন্থটি বর্ষা-বৃষ্টি-প্রকৃতির অনুষঙ্গ ভিন্ন আঙ্গিকে ও ছন্দে ভিন্ন ব্যঞ্জনা নিয়ে উপস্থিত। ২০১৪ সালে প্রকাশিত ‘উদরপূর্তিতে নদীও মরে যাচ্ছে’ কাব্যগ্রন্থটি পূর্বের কাব্যগ্রন্থগুলো থেকে পুরো আলাদা, ভিন্ন আঙ্গিক ও বিষয়-চেতনার ভিত্তিতে সচেতনভাবে লেখা হয়েছে। ‘ফুসলানো অন্ধকার’ নামের কাব্যগ্রন্থে রয়েছে বেশ ক’টি দীর্ঘ কবিতাসহ ভিন্নধারার কবিতা। ১৯১৯ প্রকশিত ‘ঝুলনপূর্ণিমা থেকে নেমে এলো’ বইটির কবিতা তুমিমার্কা শীতাতপনিয়ন্ত্রিত স্যাঁতসেঁতে নয় বলে এসেছে—কিশোর বিদ্রোহ থেকে রোহিঙ্গা, পাশের দেশের ত্রিপুরার মানুষের আর্তস্বর থেকে দেশের বিভিন্ন অভিঘাত, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা থেকে কালজ্ঞ শক্তির উপস্থিতি, নারীর শৃঙ্খল মুক্তি থেকে কবির আত্মসম্মান, সুন্দরবন বাঁচানোর আকুতি থেকে জীবনের বিভিন্ন পরিধির জিজ্ঞাসা। ২০২১ সালে আমার ১৬টি কাব্যগ্রন্থের কবিতা নিয়ে ‘নির্বাচিত কবিতা’ প্রকাশিত হয়। শেষে ২০২৩ সালে ‘মানুষ পোশাক পরলেও উলঙ্গ মনে হয়’ এবং ‘ওখানে আমার পছন্দের কেউ নেই’ নামের দুটি কবিতাগ্রন্থ বের হয়। দুটি কবিতার বইয়ের কবিতায় চৈতন্যের বহুতল ও স্তর উন্মোচন হয়েছে, যা পাঠককে নিয়ে যাবে সেই স্তরে ও তলের গভীরে।

উল্লিখিত বিবেচনায় বলবো—সচেতনভাবেই আমার কাব্য-পথচলা বিভিন্ন সময়ে বাঁক নিয়েছে—একরৈখিক থাকেনি—বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়েই সম্মুখবর্তী হয়েছে। আমার কাব্যের মানচিত্রটি হয়তো কারো চোখে পুরো দৃশ্যমান নয়, হয়তো কারো চোখে খণ্ডিতভাবে ধরা দিয়েছে, হয়তো কারো চোখে হঠাৎ এক দৃশ্য নিয়ে উপস্থিত হয়েছে! একজন কবিতার পাঠক ও কবি হিসেবে আমার কবিতার প্রতি আমারও মূল্যায়ন রয়েছে—পর্যবেক্ষণ রয়েছে, ঠিক তেমনই অন্য কবি ও কবিতার প্রতিও। তুলনামূলক বিবেচনা আছে বলেই আমিও জানি—আমার কবিতা কোনখানে দাঁড়িয়ে আছে। আরও জানি—আমার কবিতার নিজস্ব শক্তি কী? কতটা ব্যতিক্রম ও বহুবর্ণিল।

জাগো নিউজ: ছড়া ও কবিতার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য কী বলে মনে করেন?
গোলাম কিবরিয়া পিনু: ছড়া ও কবিতার মধ্যে পার্থক্য তো আছে। কবিতার সব শিল্পশর্ত ছড়ায় নিয়ে আসা যায় না। তবে কবিতা ও ছড়ার ছন্দ একে অপরের পরিপূরক হতে পারে। সাধারণত ছড়ার বক্তব্য সরাসরি, খোলাখুলি হয়ে থাকে, আবার প্রতীকী-ব্যঞ্জনায় দৃঢ়ও হতে পারে, রূপক আশ্রিত হয়ে বক্তব্যও উচ্চকিত হতে পারে। তবে কবিতার মতো উপমা-উৎপ্রেক্ষা ও অন্যান্য অর্থালংকার ও শব্দালংকার ব্যবহার হয় না। তবে অনেক কবি ছড়ার আদলে অনেক ভালো কবিতাও লিখেছেন।

জাগো নিউজ: বাংলা কবিতার ধারা কোন দিকে প্রবাহিত হচ্ছে?
গোলাম কিবরিয়া পিনু: এই সময়ে—টিভির বিভিন্ন চ্যানেলের ছবি ও অনুষ্ঠানের মাদকতায় টেনে নিচ্ছে মানুষকে, নেশাগ্রস্ত করে তুলছে। আবার আধুনিক হয়ে ওঠার দৌড়ে কম্পিউটার-ইন্টারনেট ও বহুবিধ যোগাযোগব্যবস্থায় পর্ন-মানসিকতাও সৃষ্টি করছে, অন্যদিকে সংবাদপত্রও পাঠক টানার কৌশলে যৌনতা, রাজনীতি, খুনখারাবি ও বিভিন্ন স্টোরির নামে ভেদবুদ্ধির চালচিত্র গেলানোর জন্য মেতে উঠেছে। এসব কর্মকাণ্ডে রুচিতে একধরনের বাণিজ্যিক চাহিদা ও উপযোগিতা তৈরি হচ্ছে—যাতে কবিতার অবস্থান দূরবর্তী ব-দ্বীপের মতো হয়ে পড়ছে অনেকটা।

বর্তমানে কাব্যচর্চার ক্ষেত্রে একধরনের স্বেচ্ছাচারিতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, এর জন্য শুধু কবিরা দায়ী নয়। এ-জন্য পরিবেশ-পরিস্থিতি ও অন্য কারণও আছে, তবুও সচেতনভাবে কবিদের জন্য এই সংকট কবিদেরই মোকাবিলা করতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে কিছু কবি বিশেষভাবে দায়ী—তারা ভাবেন, তারাই একমাত্র কাব্যবোদ্ধা! যে ভাবেই কবিতা লেখেন না কেন, আর সেই কবিতায় কোনো শিল্পশর্ত পূরণ হোক না হোক বা ধারাবাহিক অভিজ্ঞতায় সামঞ্জস্য থাক বা না থাক কিংবা কবিতার প্রাণ প্রতিষ্ঠা না হোক—তবুও এভাবে কবিতাকে একধরনের শূন্যতায় নিক্ষেপ করতে তারা ভালোবাসেন। এদের ভূমিকায় আজ কবিতা ও পাঠকের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হচ্ছে।
পাঠক হিসেবে লক্ষ্য করি—বর্তমানে কোনো কোনো কবি আধুনিকতার নামে ও পরিবর্তনের নামে কবিতাকে উদ্দেশ্যহীনভাবে বিভ্রান্তিমূলক পর্যায়ে নিয়ে যেতে সচেষ্ট। কোনো কোনো কবি পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে বিপর্যয়েরও সৃষ্টি করছেন। ফলে কবিতা হয়ে উঠছে কবিতার নামে খণ্ডিত এক পদ্ধতিমাত্র। শুধু বাঁক পরিবর্তনের ইচ্ছে নিয়ে চলার নাম একধরনের স্বাধীনতা হতে পারে কিন্তু আধুনিকতা মূর্ত নাও হতে পারে—কবিতায়। আধুনিকতা সমাজবিচ্ছিন্ন বিষয় নয়: সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়নির্দেশক দর্শন-চেতনা। শুধু পরিবর্তনের স্থূল চালচিত্র নিয়ে আধুনিকতা চিহ্নিত হতে পারে না। কবিতা সমকালীন হলেই—তা আধুনিক হবে, তা ঠিক নয়। শুধু কবিতার আঙ্গিক পরিবর্তন হলেই—আধুনিক কবিতা হয়ে ওঠে না—এরসাথে চেতনাগত বিষয়টিও যুক্ত। সমাজের মানসিকতা পরিবর্তনের ফলে কবিতার পরিবর্তন হয়, তবে কবিরা-সমাজের অগ্রসর মানুষ হিসেবে বিবেচিত হন বলেই তারা পরিবর্তিত চেতনাকে কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে টেনে নিয়ে মানুষের চেতনাকে সমৃদ্ধ করেন বা নতুনভাবে মানুষের ভাবনাজগতকে নির্মাণ করেন বা মানুষের বোধকে ভিন্ন দ্যূতিতে উজ্জ্বল করেন।

কবিতায় একধরনের অস্পষ্টতা থাকতে পারে, তাই বলে এমন দুরূহতা আনা কি সমীচীন, যা শুধু সংকেতহীন সান্ধ্যভাষা হিসেবে বিবেচিত হবে, যা থেকে কোনো পাঠক কোনো কিছুই উদ্ধার করতে পারবে না। প্রচলিত আছে যে, নতুন কবিতা পাঠকের কাছে দুর্বোধ্যতা নিয়ে উপস্থিত হতে পারে, পরবর্তীকালে পুনঃ পুনঃ পঠন ও আগ্রহের ফলে সেই কবিতা আর দুর্বোধ্য থাকে না। এই ধরনের পরিস্থিতি যুগে যুগে কবিতার বাঁক বদলের সময় হয় তো লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু বর্তমানে অর্থ-সঙ্গতির সামঞ্জস্যে অনেক কবিতা পাঠকের সাথে সংযোগ স্থাপনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হচ্ছে। এ কারণে কবিতার পাঠক কমে যাচ্ছে কিংবা পাঠক কবিতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। সব যুগে হয়তো কবিতার পাঠক সীমিত থাকে। কিন্তু পূর্বের যুগ থেকে বর্তমান যুগে মানুষের শিক্ষা-জ্ঞান ও অন্যান্য অনেক কিছুর অগ্রগতির ফলে পাঠককে আগের সময়ের চেয়ে আরও বুদ্ধিহীন ও কবিতার রস আস্বাদনের ক্ষেত্রে একেবারে তাচ্ছিল্যের পর্যায়ে টেনে আনা ঠিক নয়। অনেক দেশে কবিতার পাঠক বেড়েছে, আমাদের দেশে কবিতার পাঠক কমার কারণ কী? বিষয়টি ভেবে দেখা জরুরি। বাংলা কবিতার একটি উজ্জ্বল ও সমৃদ্ধ ধারাবাহিকতা রয়েছে, যে ধারাবাহিকতায় রয়েছে চিরকালের কবিতা ও কবিতার ঐশ্বর্য।

জাগো নিউজ: আপনি কবিতা ও প্রবন্ধের মতো গুরুত্বপূর্ণ শাখা নিয়ে কাজ করেন—কীভাবে নিজেকে প্রস্তুত করেছেন?
গোলাম কিবরিয়া পিনু: আমি যখন থেকে কবিতা লিখতে শুরু করি; তখন থেকে প্রবন্ধ ও অন্য গদ্য লেখা শুরু করি। কবিতা ও প্রবন্ধ হাত ধরাধরি করে চলে। কবিতা কীভাবে তাড়িত করে, তা অন্য প্রশ্নের উত্তরে বিস্তৃতভাবে এসেছে। এই উত্তরে শুধু গদ্যের কথাই বলি। নব্বই দশকে প্রচুর কলাম দৈনিক পত্রিকায় লিখি, বিশেষত যখন ‘আজকের কাগজ’ জনপ্রিয় হয়ে প্রকাশিত হয়েছিল, তাতে। সেই সময়ে ছদ্মনামেও নিয়মিত গদ্য লিখেছি সাপ্তাহিক পত্রিকায়। সাহিত্য বিষয়ক গদ্য তো আছেই উল্লেখযোগ্যভাবে। বিনীতভাবেই বলি—কিশোর বয়স থেকে সমাজ, ইতিহাস, রাজনীতি, সংস্কৃতি, সাহিত্য, মনস্তত্ব ইত্যাদি বিষয়ে আগ্রহ জন্মে, এসব সম্পর্কিত বই ধারাবাহিকভাবে গোগ্রাসে পড়ি, পাশাপাশি নিজস্ব পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতার কারণেও বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন বোধ আমার ভেতর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় জাগে, সেইসব বোধ অন্যের মধ্যে জাগিয়ে তোলার জন্য গদ্য লিখি। আমার সংহত গদ্যে সুচিন্তা, প্রতিবোধ, কল্পনা, অভিব্যক্তি, অবলোকন ও নিরীক্ষা সহযোগে চৈতন্যের বহু স্তর উন্মোচন করতে পারি, সেই চেষ্টা করে আসছি।

জাগো নিউজ: সাহিত্যচর্চায় অবদানের জন্য নানা স্বীকৃতি আছে—এটিকে কীভাবে দেখেন?
গোলাম কিবরিয়া পিনু: ইদানিং সাহিত্যচর্চার চেয়ে নানা সংগঠনের অনুষ্ঠান ও পুরস্কার প্রদানের আধিক্য বেশ চোখে পড়ছে। এর অনেক কারণই আছে। আমরা আনুষ্ঠানিকতা ও প্রদর্শনবাদীতায় আগের সময়ের চেয়ে বেশি উৎসাহিত হয়ে পড়ছি—সেটাও একটা কারণ। অন্যদিকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নেওয়া-দেওয়ার ক্ষেত্রে সাহিত্যকে মূল বিবেচনায় না রেখে নিজের সংকীর্ণ ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারের হাতিয়ার হিসেবেও তা ব্যবহার করছি। সবার ক্ষেত্রে ঢালাওভাবে তা বলা যাবে না, যেখানে রুচিবোধ আছে, বিবেচনাবোধ আছে এবং সাহিত্য রচনায় উৎসাহিত করার মানসিকতা আছে, তা যত ছোট পরিসরে হোক, তাকে অনুমোদন করা যেতে পারে।

আমাকে টেনে নিয়ে কিছু কথা বলি—আমাকে নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা হয়নি—হয়েছে যৎসামান্য; আমিও তা স্বীকার করি। আমার অর্জনের সামান্যই তা স্পর্শ করেছে; তাও ঠিক। তবে আমি আলোচনার পানে না তাকিয়ে থেকে নিবেদিত হয়ে ধারাবাহিকভাবে কবিতা লেখার চেষ্টা করেছি। তা সমালোচক বা অন্যের দ্বারা মূল্যায়ন হোক বা না হোক—সেদিকে তাকিয়ে সময় নষ্ট করিনি। তবে কারো কারো মতামত পাই, পাঠকেরও প্রতিক্রিয়া পাই কবিতা লিখে, তাতে একধরনের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা পাই। সেটাও কম না। আর কিছু কবিতাপ্রেমি নিজ উদ্যোগে আমার কবিতার আলোচনাও করেছেন, বইয়েরও। তাঁদের সবার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তবে আলোচনা কম হওয়ার জন্য বেদনা হয়তো আছে কিন্তু মর্মাহত হইনি, মুষড়ে পড়িনি কখনো। আমিও আমার পর্যবেক্ষণ ও বিবেচনা থেকে জানি এবং বুঝি—প্রকৃত কবির কবিতা একসময়ে আলোচনায় আসবে—হয়তোবা তা দেরীতে। আমি এজন্য খুব ভাবিত হইনি। এমনিতে এদেশে কবিতার সমালোচকের অভাব, তারমধ্যে সৎ সমালোচকের আরও অভাব। শুধু কবিতাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে নৈর্ব্যক্তিকভাবে আলোচনা-সমালোচনা হওয়ার বিষয়টি এখনো অনেক কম। এসব জেনেও আমি আশাবাদী। আমি আমার সম্মান খুইয়ে আত্মমর্যাদা বন্ধক রেখে কখনো কাউকে দিয়ে আমার কবিতা বা সাহিত্য নিয়ে আলোচনার জন্য উদগ্রীব হইনি কিংবা এমন কোনো কুকৌশলে উদ্যোগ গ্রহণ করিনি, যাতে কেউ আমার বিষয়ে আলোচনায় ইচ্ছের বিরুদ্ধে কৃত্রিম উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তবে সব সময়ে ভেবেছি লেখাটা কবির মুখ্য হওয়া উচিত। প্রকৃত সমালোচকরা কবিকে আবিষ্কার করেন, কবিকে চিহ্নিত করেন, টেনে তোলেন কবিকে অন্ধকূপ থেকে, দেদীপ্যমান করেন নতুন আলোয়। অন্য কোনো ব্যক্তি-লোভে আর সুবিধা আদায়ের হাতিয়ার হিসেবে ‘তথাকথিত সমালোচনা’ ব্যবহার করেন না—কোনো সৎ সমালোচক।

জাগো নিউজ: কবিতায় নন্দনতত্ত্ব কতটা দরকারী বলে মনে করেন?
গোলাম কিবরিয়া পিনু: আজ তো স্বভাব কবির যুগ নয়, যারা স্বভাব কবি, তাঁরা সব সময়ে অস্থির, তাঁদের নেই গভীর পঠনপাঠন, নেই আধুনিক জীবন—দৃষ্টিভঙ্গি, নেই সমাজ নিয়ে বিস্তৃত অভিজ্ঞতা, নেই বৈজ্ঞানিক স্বচ্ছ ধারণা ও সভ্যতার প্রতি মনোযোগ। তাঁরা ভাবেন কবির ক্ষমতা অলৌকিক! এখনকার যুগ—স্বভাব কবির যুগ নয় বলে আমরা মনে করি।

মোটা দাগে বলতে পারি—কবিতায় আবেগ, অনুভূতি, কল্পনা, বিশেষ পর্যবেক্ষণ, অভিজ্ঞতা, ছন্দ ও বিবিধ অলংকার থাকে। কবিতার চারিত্র্য বিভিন্নমুখী হয়ে থাকে, অর্ন্তমুখীও হতে পারে, বহির্মুখীও হতে পারে। কবিতা গদ্যের মতো স্পষ্ট হতে পারে, না-ও হতে পারে। কবিতায় একটিমাত্র অর্থ খোঁজা সমীচীন নয়, একই কবিতার বহু অর্থ, বহু রকমের দ্যোতনা থাকতে পারে। কবিতায় ইঙ্গিত থাকবে—চিন্তা, কল্পনার বহুবিধ দিগন্তও থাকবে। একটি কবিতার অনুভব ও ব্যাখ্যা—বিভিন্ন রকমের পাঠকের কাছে ভিন্ন ভিন্ন হয়—রুচি, শিক্ষা ও অন্য সামাজিক অবস্থানের কারণে।

শিল্প বা কবিতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে সেই পুরোনো তিনটি জিজ্ঞাসা এখনো গুরুত্বপূর্ণ, একধরনের দিশা খুঁজতে সাহায্য করে।
১. কী ভাবলাম?
২. কেমন করে বললাম?
৩. আর কেন বললাম?
আমরা জানি, শিল্পসৃষ্টিকে অনুভব করেন—ভোক্তা, শিল্পের সাথে ভোক্তার যোগসূত্র তৈরি হয়, সেই শিল্পবোধে তিনি কবিতাকে গ্রহণ করেন। শিল্প বা রচনার ভিত্তিমূলে থাকে—আঙ্গিক ও ভাষাশৈলী, থাকে ভাববস্তুর গভীরতা ও শিল্পের অন্য সৌকর্য। থাকে লেখক ও শিল্পীর নিজস্ব সৃজনশীলতা।

জাগো নিউজ: বর্তমানের কবিরা নিজেদের উত্তর-আধুনিক হিসেবে দাবি করছেন; এ দাবি কতটা যৌক্তিক?
গোলাম কিবরিয়া পিনু: বর্তমানের কবিরা নিজেদের উত্তর-আধুনিক হিসেবে দাবি করতেই পারেন। তবে উত্তর-আধুনিকতা নিয়ে বহু ধরনের মত ও ব্যাখ্যা আছে। বাংলাদেশের লেখক ও ভাবুকদের মধ্যে এ-বিষয়ে বোঝাপড়ার ভিন্নতা আছে। পাঠক হিসেবে আমরা লক্ষ্য করি—বর্তমানে কোনো কোনো কবি উত্তর-আধুনিকতার নামে ও পরিবর্তনের নামে কবিতাকে সংকীর্ণ উদ্দেশ্য পূরণের হাতিয়ার হিসেবে বিভ্রান্তিমূলক পর্যায়ে নিয়ে যেতে সচেষ্ট। ফলে কবিতা হয়ে উঠছে কবিতার নামে খণ্ডিত এক পদ্ধতিমাত্র। সে যা-ই হোক—এ বিষয়ে আরও ব্যাখ্যা ও আলোচনার অবকাশ আছে।

জাগো নিউজ: বর্তমান সমাজ কাঠামোর প্রেক্ষাপটে কবিতার জন্য কী ভূমিকা নির্ধারণ করতে চান?
গোলাম কিবরিয়া পিনু: লেখকের জীবন ও মন সমাজের নানা নিবিড়ি সূত্রে সম্পর্কিত, তা উপলব্ধিতে এনে সমাজের জীবনপ্রবাহ, তার গভীর তলবাহী নানা স্রোত ও ধারার সংঘাতের সাথে লেখকরা বিচ্ছিন্ন হতে পারেন না বলেই লেখকরা একাধারে সমসাময়িক এবং যুগধর্মী এবং যুগান্তকারী। তবে লেখকরা-সমাজের অগ্রসর মানুষ হিসেবে বিবেচিত হয় বলেই তারা পরিবর্তিত চেতনাকে কাঙ্ক্ষিত পর্যায় টেনে নিয়ে মানুষের চেতনাকে সমৃদ্ধ করেন বা নতুনভাবে মানুষের ভাবনাজগতকে নির্মাণ করেন বা মানুষের বোধকে ভিন্ন দ্যূতিতে উজ্জ্বল করেন।
আমরা মনে করি না—কবিরা নক্ষত্রালোকের বাসিন্দা, তারা দূর নক্ষত্রালোক থেকে আসা কোনো প্রাণী! তারা তো এই সমাজের মানুষ, এই সমাজের মানুষের বোধ, স্বপ্ন-আশা, আকাঙ্ক্ষা, জীবনের দ্বন্দ্ব, মানুষের সভ্য হয়ে ওঠার ক্রমাগত সংগ্রামকেই অন্বেষণ করেন।

জাগো নিউজ: পাঠকের জন্য আপনার ভাবনা কী? চিন্তার বিবর্তন পাঠক কীভাবে নেয় বলে মনে করেন?
গোলাম কিবরিয়া পিনু: কবিতার তো বিভিন্ন ধরনের ভূমিকা থেকে যায়—কল্পনা শক্তি বাড়ায়, বোধ জাগ্রত করে, আনন্দ দেয়, মনের বিভিন্ন দিগন্ত প্রসারিত করে, স্বপ্ন জাগায়, ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে টেনে আনে, মননশীলতা ও জীবনী শক্তি বাড়ায় ইত্যাদি। কবিতা নিছক আনন্দের বিষয় নয়, চৈতন্যের বহু স্তর উন্মোচিত করে। জীবনের খণ্ড খণ্ড অনুভূতির মধ্য দিয়ে জীবনের তাৎপর্য উন্মুক্ত করতে পারে কবিতা। এসব কারণে কবিতার সঙ্গে পাঠকের সম্পর্ক যতই ঘনিষ্ঠ হবে, ততই মানব সভ্যতার বিকাশ উজ্জ্বল হবে।

এসইউ/জিকেএস

আরও পড়ুন