মুকিদ চৌধুরীর নাট্যোপন্যাস
গোমতীর উপাখ্যান: পর্ব-০৪
গোমতীর স্রোত: কতরং
অন্ধকার ধীরেআস্তে প্রসারিত হয়
লজ্জায় মুখ লুকিয়ে থাকে নিলয়
গৃহটি নিতান্ত সামান্য নয়, তবে আসবাবপত্র তেমন নেই। ভগ্ন, মলিন দুটি হাতলভাঙা চেয়ার, একটি টেবিল, দুটি তক্তপোশ (অন্য ঘরেও একটি রয়েছে)—সমস্ত সামগ্রী দারিদ্র্যব্যঞ্জক—দরিদ্র গৃহালংকার। চৌকাঠও ঘুণপোকার দখলে। দরজার পাশে একটি প্রদীপ শুধু জ্বলছে। এই প্রদীপের পাশ দিয়ে পার্থ গৃহে প্রবেশ করে দেখল, দেওয়ালে রাধাকৃষ্ণের পট ঝোলানো থাকলেও তার পাশে ঝুল। মাকড়সা, টিকটিকি স্বাধীনমতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটি দুইজনের শোবার মতো পালঙ্কে শ্রী পরমেশ্বর দাস শুয়ে আছেন। মাথার বালিশ চটকানো, বেঁকে রয়েছে একপাশে। কাঁথা নেই, পা দিয়ে ঠেলে খাটের তলায় মাটিতে ফেলে দিয়েছেন। চাদরটাও একপাশে পুঁটলি পাকানো। শ্রী পরমেশ্বর দাসকে দেখে মনে হয়, তার অন্তিমকাল উপস্থিত। চোখ ম্লান, নিশ্বাস প্রখর, ঠোঁট কম্পিত।
বিকেল থেকেই শুরু হয় প্রচণ্ড ছটফটানি, পাগলের মতো দুমড়ে-মুচড়ে, ছিঁড়ে-ছুড়ে যাচ্ছে শরীরটি; এরকম ঘণ্টাখানেক চলে; তারপর আস্তেধীরে কোঁকড়াতে কোঁকড়াতে স্থির হয়ে আসে। এখন যেখানকার হাত-পা সেখানেই পড়ে আছে, শুধু ধুকধুক নিশ্বাসটাই বয়ে চলেছে; যে কোনো মুহূর্তে এই নিশ্বাসটুকুও বন্ধ হয়ে যাবে। মুখ, কপাল, গলা ভেজা। মাথার চুল আঁচড়ানো হয়নি; তাই এলোমেলো, জটপাকানো; ভীষণ কোঁকড়ানো দেখাচ্ছে।
তক্তপোশের পাশে গৃহচ্যুত ইটখণ্ডের ওপর আর-একটি মৃন্ময় প্রদীপ জ্বলছে, অবশ্য তাতে তেলের অভাব। শ্রী পরমেশ্বর দাসের জীবনও এই প্রদীপের মতো। তার শিরোদেশে অনিন্দিতগৌরকান্তি স্নিগ্ধজ্যোতির্ময়রূপিণী সুশীলা বসে থেকে-থেকে গুমরে কেঁদে উঠছে। তার পিঠে ছড়ানো একঢাল মেঘকালো চুল। পাদদেশে মাথানত করে বসে আছে তারই ভাই মিথুন, সেও নিশ্চুপে অশ্রুবর্ষণ করছে। অল্পতেলসিক্ত প্রদীপের জ্যোতি অপ্রখর বলেই হোক, কিংবা গৃহবাসী তিনজন দুশ্চিন্তায় প্রগাঢ়তর বিমনা থাকার কারণেই হোক, পার্থের প্রবেশ কেউই লক্ষ্য করেনি। পার্থের অস্বস্তি হচ্ছিল। শ্রী পরমেশ্বর দাসের জামাকাপড় একটু ঠিক করে দিলে ভালো হতো। একবার ভাবল, মিথুনকে বলবে জামাকাপড় একটু ঠিক করে দিতে, কিন্তু পারল না। নিজেই এগিয়ে এসে একপাশে পুঁটলি-পাকানো চাদরটি হাতে নিয়ে কোমর পর্যন্ত ঢেকে দিলো। সঙ্গে সঙ্গেই লাথি মেরে সরিয়ে দিলেন শ্রী পরমেশ্বর দাস, ফলে আরও অনাবৃত হয়ে গেল শরীরটা।
তক্তপোশ থেকে পড়ে যাওয়ার ভয়ে প্রথমে ভূশয্যায় শুইয়ে দিয়েছিল সুশীলা ও মিথুন তাদের পিতাকে। চারদিক থেকে সারি বেঁধে পিঁপড়েগুলো জড়ো হচ্ছিল, তাই আবার তাঁকে তক্তপোশে তুলে আনে তারা। সেই থেকে জামাকাপড়ের এই অবস্থা। ধুতিটা কোমরে আলগাভাবে জড়ানো। বুক উন্মুক্ত। সন্ধ্যা পর্যন্ত পাড়াপ্রতিবেশীরা এখানে ছিল। বেশক্ষণ পর্যন্ত বসে ছিল শ্রী পরমেশ্বর দাসকে ঘিরে। হাউমাউ না-করলেও অনেকেই কেঁদেছিল। সকলেই জানে, তিনি তাদের কত ভালোবাসতেন।
শ্রী পরমেশ্বর দাসের চোখের পাতা বন্ধ। ঘোরে আছেন, না গাঢ় ঘুমে—বোঝা যাচ্ছে না। মাথার কিছু চুল কপালে ঘামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। পার্থ খুব আলগাভাবে শ্রী পরমেশ্বর দাসের হাত ছুঁয়ে নাড়ল সামান্য। হাতে হাত ছোঁয়ানোমাত্রই চমকে উঠল পার্থ। এত ঠান্ডা! এত ঘাম! মনে হচ্ছে, প্রবল এক জ্বর এসেছিল আগে, এখন সেই জ্বর দরদর ঘাম দিয়ে ছেড়ে যাচ্ছে। এত ঘাম না মুছে দিলেই নয়। খুব সাবধানে পাশে রাখা একটি গামছা নিয়ে চেপে চেপে মুখ-গাল মোছাতে গিয়ে পার্থ দেখল, শ্রী পরমেশ্বর দাসের মুখ-গাল তুবড়ে গিয়েছে, মরা মাছের আঁশের মতো চামড়ার রং। আজকের মতো এত হতশ্রী, শীর্ণ ও রুগ্ন এর আগে শ্রী পরমেশ্বর দাসকে কখনো দেখেনি সে। কিছুক্ষণের জন্য দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে আবার শ্রী পরমেশ্বর দাসের মুখের ওপর নিক্ষেপ করল পার্থ। ঠোঁট নড়ছে সামান্য। শুকনো, কোঁচকানো, বিবর্ণ, নিরক্ত। দেখল, কোনো গাছ মরে আসার সময় যেমন শুকনো হতশ্রী কৃশ হয়ে আসে—সেই রকমই হয়ে আছে ঠোঁট দুটি। তিনি এখন মৃতপ্রায় এক মানুষ। চাদরটি মাটি থেকে তুলে নিয়ে ঢাকা দিলো শরীরটি আবার। এবার শ্রী পরমেশ্বর দাসের কোনো সাড়াশব্দ নেই। স্থির। ঘুমিয়ে পড়েছেন হয়তো।
কোনো দিকে না তাকিয়ে ও কোনো কিছু না বলেই পার্থ কোনার দিকের তক্তপোশটার ওপর গিয়ে বসল। তার ঋজু বলিষ্ঠ দেহ; বর্ণ গৌর; মুখে বুদ্ধির দীপ্তি। এমন করে সে মাটিতে পা ফেলে চলে যেন পৃথিবীর যাবতীয় প্রতিকূলতা আর বিমুখতা সে অতীব অবজ্ঞার সঙ্গে দুই পা দিয়ে মাড়িয়ে চলছে। মানুষের সঙ্গ বা সাহচর্যের যেন তার কোনো প্রয়োজন নেই; সহানুভূতির সে ধার ধারে না। এ-ই তার বাহ্যিক মূর্তি, কিন্তু অন্তরটা অন্য রকম—শ্রান্ত, অতিশয় পরমুখাপেক্ষী। পার্থ তক্তপোশে বসে বসে ভাবছে। ভাবনার আদ্যন্ত নেই; কী ভাবছে তারও বিশেষ দিকনির্দেশ নেই, তবে ভাবনাটি মাঝেমধ্যে থেমে গিয়ে হতাশার সুরে হা-হা করে শূন্যে উঠে যাচ্ছে, যেমন: প্রদীপের শিখা ঊর্ধ্বের অন্ধকারের অঙ্গে সূক্ষ্মতম রেখায় বিদ্ধ হয়ে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু দাহ তার ঠিক থাকেই।
তক্তপোশের মাথার দিকটায়—দেওয়াল ঘেঁষে—একটি সাবেকি আলমারি। তার পাশে আলনা। উভয়ই এখন আবছা অন্ধকারে নিমজ্জিত। পার্থ সেদিকে তাকিয়ে থাকে, মুখে কোনো কথা নেই। বুকের ভেতরটা দারুণভাবে তার মোচড় খাচ্ছে, শ্রী পরমেশ্বর দাসের চরমকালীন কষ্টের কথা ভাবতে ভাবতে। এই তিনজন, পিতা ও তার দুই সন্তান, এখন সম্পূর্ণভাবে নিঃসহায়। একদিন তাদের প্রচুর অর্থসম্পদ ছিল। লোকজন, ভৃত্যবৃন্দ, সহায়সৌষ্ঠব সবই ছিল, কিন্তু সেসব একে একে হারিয়ে গেছে। দারিদ্র্যপীড়নে পুত্র-কন্যার মুখমণ্ডল—হিমনিষিক্ত পদ্মবৎ—এখন পরাজিত ও ম্লান। অবশ্য তার আগে গৃহলক্ষ্মী চিতা গ্রহণ করেন। তার চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই গৃহকর্তাও ঝিমিয়ে পড়েন। মিথুন ছিল তার মায়ের চক্ষুমণি, আর এখন পিতার ভরসা। মিথুনের ওপর নির্ভর করেই সুশীলা এই ভগ্নগৃহে বসবাস করছে। সুশীলার বিয়ের বয়স হয়েছে, কিন্তু সে শ্রী পরমেশ্বর দাসের অন্ধের যষ্টি, এই সংসার-বন্ধনের একমাত্র গ্রন্থি। তার ইচ্ছে থাকলেও তিনি কন্যাকে পরহস্তে সমর্পণ করতে পারেননি। “আর-কিছু দিন! এখন সুশীলাকে পরহস্তে বিলিয়ে দিলে আমার কী হবে? ওকে ছাড়া কী নিয়ে থাকব?”—সুশীলার বিবাহপ্রস্তাব এলে তিনি এইভাবেই বলেন। যদিও এটি তার মনের কথা ছিল না, তিনি জানেন যেদিন তার ডাক পড়বে, সেদিন মিথুন ও সুশীলাকে কোথায় রেখে যাবেন? বিপর্যয়ের সম্ভাব্য চিত্র আঁকতে মানুষ কেন যে এত ভালোবাসে! অথচ ভবিষ্যতে কী হবে, কেমনভাবে হবে—এসব কেউই স্পষ্টভাবে বলতে পারে না, তবুও মানুষ তার চারপাশে একটি সতর্ক দেওয়াল নির্মাণ করে জীবনটাকে এক নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ রাখতে চেষ্টা করে।
তৃষ্ণা পেল পার্থের। টেবিলের এক পাশে একটি জলের কলসি। পাশেই জলের ঘটি। জল খেলো। শ্রী পরমেশ্বর দাস একবার কেঁপে উঠলেন। বারকয়েক বিড়বিড় করলেন। সুশীলা গঙ্গাজল মুখে ছোঁয়াল। অকস্মাৎ যমদূত এসে শয্যার পাশে দাঁড়াল। তিনি তো চললেন, কিন্তু মিথুন ও সুশীলা কোথায় দাঁড়াবে? এই গভীর অনিবার্য যন্ত্রণা শ্রী পরমেশ্বর দাসের প্রতিটি নিশ্বাসে ব্যক্ত হতে লাগল। অবিরল মুদ্রিতোন্মুখনেত্রে অশ্রুধারা ঝরছে কেবল।
শিরোদেশে প্রস্তরময়ী মূর্তির মতো সুশীলা স্থিরদৃষ্টিতে মৃত্যুমেঘাচ্ছন্ন পিতৃমুখের প্রতি দৃষ্টিনিবদ্ধ করে রয়েছে; আর শ্রী পরমেশ্বর দাস বর্তমান ভুলে, ভবিষ্যৎ ভুলে, শুধু গৃহের ছাদের প্রতি তাকিয়ে আছেন। ক্রমে তার নিশ্বাসস্ফূর্তি অস্পষ্টতর হতে থাকে। এক সময় কণ্ঠাগত হলো। চোখ নিস্তেজ। অবশেষে ব্যথিত প্রাণ কষ্ট থেকে নিষ্কৃতি পেল। পার্থ সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারল, মানুষটি আর নেই। বুক কেঁপে উঠল। ঠান্ডা কী যেন ঠেলে গলার কাছে উঠল। মেরুদণ্ড অসাড়। শীতল। তবুও পার্থ শ্রী পরমেশ্বর দাসের শয্যার পাশে এলো। দেখল, বুক নড়ছে না। শ্বাসপ্রশ্বাসের কোনো লক্ষণ নেই। তার নাকের কাছে হাত রাখল। না, হাতে শ্বাসপ্রশ্বাসের অতিমৃদু বাতাসও লাগছে না। শেষে বুকে কান পাতল। শব্দহীন। হৃৎপিণ্ড থেমে গিয়েছে। পার্থ উচ্চারণ করল: ওঁ দিব্যান্ লোকান্ স গচ্ছতু। নিভৃত ঘরের স্তিমিতপ্রায় প্রদীপের পাশে সুশীলা ও মিথুন পিতার মৃতদেহ ক্রোড়ে নিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে।
রাত্রি ঘনান্ধকারে আবৃত। বাইরে বৃক্ষলতাপাতায় বিন্দু বিন্দু বৃষ্টি। বৃষ্টি কখন যে এসেছে তা টের পায়নি একজনও। আস্তেধীরে বাতাসও গর্জে ওঠে। ভগ্নগৃহের দ্বারদেশে উন্মাদ-বাতাস বেসামালভাবে ধাক্কা দিতে থাকে। সুশীলার শাড়ির আঁচল উড়ছে, খোলা চুলও। গৃহের মধ্যে নির্বাণোন্মুখচঞ্চল ক্ষীণ প্রদীপের আলো, একবার শবের মুখে, পরক্ষণে অন্ধকারবৎ হতে থাকে। তখনই পার্থ নিঃশব্দে ভগ্নগৃহ থেকে অপসৃত হয়।
সময় চলে যাচ্ছে সময়ের মতো করে। সব দায়িত্ব যেন পার্থের। তার অনুরোধে এবং আনুকূল্যে গ্রামের লোকজন মৃতের সৎকারের আয়োজন করে। শ্মশানযাত্রা, মৃতদেহ বয়ে নেওয়ায় সস্তা পলকা খাট, বিছানাপত্র, বাসী ফুল—সব ব্যবস্থাই করে নিলো তারা।
পার্থ এসে বসল মিথুনের কাছে। বিড়ি হাতে নিলো। ধরানোও হলো, কিন্তু টানতে ইচ্ছে হলো না। মিথুন আবার কেঁদে উঠল। পার্থ বলল: কী করবে! মা-বাবা তো চিরদিন থাকে না। এখন তুমি প্রস্তুত হও। তোমাকেই মুখাগ্নি করতে হবে।
আমাকে?
তুমিই তো একমাত্র ছেলে। আমি গঙ্গামণিকে জিজ্ঞেস করে এসেছি। তিনি শেষ কাজগুলো করবেন। ঘৃত, মধু, তিল, তুলসী... আর কী কী যেন বলল।
দিদি করবে না?
মেয়েমানুষের নিয়ম নেই। এই কাজ তোমাকেই করতে হবে।
মিথুন চুপ করে গেল। কোথা থেকে কী হয়ে গেল সে যেন এখনো ভালো করে বুঝতে পারছে না। গত বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত সকল ঘটনা কখনো পরপর, কখনো এলোমেলোভাবে মনের মধ্যে ভেসে ওঠে। ভাসছে চোখের তলায়, আবার ধোঁয়ার মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে যাচ্ছে।
মৃতদেহটিকে বস্ত্র দ্বারা আবৃত করে এবং মালা-চন্দন দ্বারা বিভূষিত করে শ্মশানযাত্রার জন্য বলো হরি, হরি বোল চিৎকার শুরু হয়ে যায়। মৃতের জামাকাপড়, খাট থেকে অগুরুর গন্ধ উঠছে। পিতার শেষযাত্রায় সুশীলাও সঙ্গী হলো, অবিরত রোদন করতে করতে। মিথুনও রোদন করতে করতে শব নিয়ে অগ্রসর হতে লাগল। পার্থের বন্ধু অমিতও পথে যোগ দিলো।
পার্থ বলল, অমিত, গঙ্গামণিকে পেলি?
হ্যাঁ, বলল, ঘৃত, মধু, তিল, তুলসী...
পকেট থেকে টাকা বের করে পার্থ বলল, তাহলে এসবের আয়োজন কর।
অমিত চলে গেল। সুশীলা তখনো কেঁদে চলেছে, শব্দ করে নয় অবশ্য।
শ্মশানে মৃতদেহ এসে উপস্থিত হওয়ার পর, শবের মাথাটি দক্ষিণদিকে রেখে তাকে কুশের ওপর শয়ন করানো হয়। দাহের অধিকারী কেবল মিথুন। সে প্রথমে স্নান করে এসে মৃতদেহের গায়ে তেল, ঘৃত এবং কাঁচা হলুদ মাখিয়ে স্নান করায়। স্নানের পর মৃতদেহকে নতুন কাপড় পরায়। ঘৃত মাখিয়ে দেয় সারা শরীরে। সে তার পিতার মুখে ঘৃত ও মধু মাখাতে গিয়ে বুঝতে পারছিল না, এই মুখ কি তার বাবার! শুকনো চোপসানো হলদেটে মুখ। চোখ দুটি গর্তে ঢুকে গিয়েছে। চোখের পাতা বন্ধ। ঠোঁট দুটি কালোকালসিটে। নিজেকে সামলে নিয়ে গলায় মালা পরিয়ে কপালে চন্দনের তিলক এঁকে দেয় মিথুন। দুই চোখ, দুই কান, নাসিকার দুই ছিদ্র ও মুখ—এই সপ্তছিদ্রে তুলসীপাতা দ্বারা আচ্ছাদন করে। তারপর আতপ-চাল, ঘৃত, মধু, তিল ইত্যাদি দিয়ে পিণ্ডদান করে। পরিষ্কার ভূমিতে গোময় লেপন করে পিণ্ডদাতা মিথুন বাম জানু পেতে দক্ষিণমুখী হয়ে বসে। তারপর বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণপূর্বক পিণ্ডদান করে। এরই মধ্যে আমকাঠ দিয়ে চিতা সাজানো হয়। অতঃপর চিতার ওপর বস্ত্র দিয়ে মৃতদেহকে উত্তরদিকে মাথা দিয়ে উপুড় করে শোয়ানো হয়। তারপর একটি সাদা থান দিয়ে মৃতদেহকে ঢাকা হয়।
গঙ্গমণি যা-যা বলছেন তা-ই করে যাচ্ছে মিথুন; অত্যন্ত অন্যমনস্কভাবে; বিক্ষিপ্ত অবস্থায় সে কী ভাবছে কে জানে! চিতা সাতবার প্রদক্ষিণের সময় তাকে পার্থ বুকে জড়িয়ে রাখে, কোনো কারণে যেন তার মধ্যে বিভীষিকা সংক্রমিত না হয়। মুখাগ্নির কাজ সম্পন্ন করে, গঙ্গামণির উচ্চৈঃস্বরে মন্ত্রপাঠের সঙ্গে মিথুনও জপতে থাকে: ওঁ কৃত্বা তু দুষ্কৃতং কর্ম জানতা বাপ্যজানতা। মৃত্যুকালবশং প্রাপ্য নরং পঞ্চত্বমাগতম্\ ধর্মাধর্মসমাযুক্তং লোভমোহসমাবৃতম্। দহেয়ং সর্বগাত্রাণি দিব্যান্ লোকান্ স গচ্ছতু\
এই মন্ত্র ভীষণভাবে ধ্বনিত হয়ে শ্মশানে আগত মানুষজনকে স্তব্ধ করে রাখে। চিতায় দাউ দাউ করে আগুন ও ধোঁয়া উঠতে থাকে। মাঝেমধ্যে হরিধ্বনিও: বলো হরি, হরি বোল। চিতা জ্বলছে আর পার্থ মানুষের ভিড়ে সুশীলাকে সন্ধান করতে থাকে। মিথুন দাহকার্য ও অন্যান্য নিয়মবিধি শেষ না-হওয়া পর্যন্ত আমলকি গাছের নিচেই বসে থাকে; সে-ই মৃতের মূলধারা। পাশে অমিত। চিতা নির্বাপণ থেকে, ঘাটে ডুব দেওয়া, তারপর পেছনে আর না-তাকিয়ে বাড়ি ফেরা—সবই মিথুনকে করতে হবে।
সুশীলাকে দেখতে না পেয়ে অমিতকে প্রশ্ন করল মিথুন, দিদি কোথায়?
অমিত কোনো উত্তর দিতে পারল না।
পার্থ ভিড়ের মধ্যে খুঁজে পেল সুশীলাকে। তার যেন কোনো হুঁশ নেই। কীসের এক ঘোরে রয়েছে সে। সচেতনভাবে কিছুই বুঝছে না, খেয়াল করছে না। প্রতিবেশী নারীবৃন্দ যে যা বলে তা-ই করে যাচ্ছে।
দাহকর্মও মিটল। দ্বাদশ অঙুলি পরিমিত আমকাঠ নিয়ে সাতবার চিতা প্রদক্ষিণ করে সাতটি কাঠি চিতায় প্রদান করল মিথুন।
চিতার নিচ থেকে মাটির সরা করে অস্থিভস্ম ও নাভিকুণ্ডলী নিয়ে উঠে এলো মিথুন। সঙ্গে পার্থ ও অমিত। পাশে গঙ্গামণিও। মিথুনের হাতে তখনো তাত লাগছে। তলার দিকে মাটির সরাটার ওপর সামান্য মাটি, ছাই; তার ওপর নাভিকুণ্ডলী। ওপর থেকে আরও একটি মাটির সরা চাপা দেওয়া।
অমিত বলল, যাক, কাজ শেষ হলো।
গঙ্গামণি বললেন, আর-একটু বাকি আছে। গোমতীর জলে বিসর্জন দিতে হবে সরা দুটিকে। তারপর মিথুন ও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী প্রত্যেককেই একটি করে ডুব দিয়ে স্নান সমাপন করতে হবে।
পার্থ বলল, তাহলে অগ্রসর হওয়া যাক।
অমিত বলল, চল্!
ওরা এগোতে থাকে। দাহকারীরা সাত কলসি জল দিয়ে চিতার আগুন নিভিয়ে দেয়। তারপর একটি জলপূর্ণ কলসি চিতাভূমির ওপর রাখা হয়, কেননা পেছন ফিরে মিথুন মাটির ঢেলা দিয়ে কলসিটি ভেঙে শ্মশান ত্যাগ করবে। চিতা পরিষ্কার করার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে দাহকারীরা।
ঘাটের সামনে এসে পড়ল মিথুন। বাঁধানো সিঁড়ি। কোথাও কোথাও ভেঙেছে। ভিজে রয়েছে সিঁড়িগুলো। মাঝেমধ্যে শ্যাওলাও।
গঙ্গামণি বললেন: মিথুন, তুমি সিঁড়ি ধরে নিচে নেমে যাও। বেশি যেতে হবে না। কোমর জল পর্যন্ত গেলেই হবে। সরা দুটিকে ভাসিয়ে দেবে গোমতীর জলে। তারপর একটা ডুব, ব্যস্।
গোমতীর স্রোত কলকল বয়ে যাচ্ছে। সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামতে নামতে মিথুন শুনতে পারল, আবার কারা যেন হরিধ্বনি তুলতে তুলতে শ্মশানের দিকে ছুটে চলেছে। তার পা ডুবে আছে জলে। সামান্য দুর্বল লাগছে, এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে পদদ্বয়। তবুও আর-একটু এগিয়ে গেল। কোমর জলে এসে গেল সে। গোমতীর জল কি বাড়ছে? শব্দ ভাঙছে স্রোত। আকাশের দিকে সে একবার তাকাল। অজস্র তারা ফুটে রয়েছে মহাকাশে। জল বাড়ছে। টান বাড়ছে স্রোতের। পদদ্বয় আরও বাড়াল। জলকল্লোল তার কানে পৌঁছছে। স্রোতের শব্দও। গোমতী যেন কথা বলতে লাগল তার সঙ্গে। কী বলছে গোমতী? হাতে ধারণ করা মাটির সরা দুটি বড্ড দুঃসহ মনে হলো তার। এটি কার অস্থিভস্ম ও নাভিকুণ্ডলী সে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে? কে তিনি? কী সম্পর্ক তার সঙ্গে? পিতা ও পুত্রের সম্পর্ক! এতে তো বাজারদর নেই, তবুও কেন এত দুঃসহ মনে হচ্ছে!
পার্থ চেঁচিয়ে উঠল: আর যেয়ো না মিথুন। জোয়ার এসে গিয়েছে, ফিরে এসো।
তবুও মিথুন এগিয়ে চলল। অমিত আর অপেক্ষা করল না। ঘাটের সিঁড়ি ভেঙে ঝাঁপিয়ে পড়ল গোমতীর বুকে।
মাটির সরা দুটির বিসর্জন হলো। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী প্রত্যেকেই একটি করে ডুব দিয়ে স্নান সমাপন করল। অতঃপর জল থেকে ফিরে এলো সবাই। পেছন ফিরে মিথুন মাটির ঢেলা দিয়ে কলসিটি ভেঙে শ্মশান ত্যাগ করল। তারপর শ্মশানযাত্রীরা মিথুনদের বাড়িতে এসে নিমপাতা দাঁতে কেটে অগ্নি ও পাথর স্পর্শ করে গৃহে প্রবেশ করে।
এক বটবৃক্ষে আজ শ্বেতকেতু দুঃখ ভুলে প্রাণ খুলে হাসে
শূকরীর মতো তবুও এ পৃথিবী সন্তানের জন্ম দিতে থাকে
রাত্রি প্রভাত হতেই প্রতিবেশীরা নিজগৃহে ফিরে গেলে সুশীলার পাশে এসে মিথুন নিস্তব্ধ দাঁড়াল। মিথুনই তার একমাত্র ভরসা। শোকের একমাত্র সান্ত্বনা। মিথুন নানাবিধ কথা বলে সুশীলাকে সান্ত্বনা দিতে থাকে, কিন্তু সুশীলা কোনো কথাই শুনছে না, শুধু রোদন করে চলেছে। মাঝেমধ্যে প্রত্যাশাপন্নবৎ দ্বারপানে তাকাচ্ছে। মিথুন কৌতূহলপ্রযুক্ত জিজ্ঞেস করল: এতবার দরজা পানে তাকিয়ে কী দেখছিস!
সুশীলা বলল, দ্বারদেশে মা এসেছিল। আমাকে ডেকেছিল: ‘আমার সঙ্গে আয়।’ আমার কেমন দুর্বুদ্ধি হলো। আমি ভয়ে আর মায়ের সঙ্গে গেলাম না। এখন ভাবছি গেলেই হয়তো ভালো হতো! আবার যদি মা আসে, আমি তার সঙ্গে চলে যাব। তাই ঘন ঘন দরজার দিকে তাকিয়ে দেখছি, সে আসে কি না!
মিথুন বলল, মা কী করে আসবে! সে তো অনেক আগেই আমাদের ছেড়ে চলে গেছে।
সুশীলা নিথর পাথরের মতো হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, যেন এক বিষাদপ্রতিমা। সুশীলার জন্য কষ্ট হচ্ছে পার্থের। ভগ্নগৃহে প্রবেশ করে পার্থ বলল: জানি, তোমাদের সান্ত্বনা দেওয়ার কোনো ক্ষমতা আমার নেই। তবুও বলছি, আজ থেকে তোমাদের ভরণপোষণের ভার আমার দায়িত্ব হিসেবে গণ্য হবে।
সুশীলা স্তম্ভিতের মতোই দাঁড়িয়ে রইল। পদদ্বয় সরছে না। সে বিস্ময়োৎফুল্ললোচনে বিমূঢ়ার মতো পার্থের দিকে তাকাতেই মিথুন বলল: এটি কেমন কথা! আমরা নিজেদের ব্যবস্থা নিজেরাই করে নেব। তোমাকে এটি নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হবে না।
পার্থ বিস্মিত ও শঙ্কিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ, তারপর সংকুচিত মনে সুশীলার দিকে অগ্রসর হলো। সুশীলা কোনো কথা বলতে পারল না, শুধু বিস্ময়-বিস্ফারিত চোখে পার্থের দিকে তাকিয়ে রইল; আর মনে-মনে বলতে লাগল: থামো, আর অগ্রসর নয়। বাইরে স্তব্ধবাক নীল রাত্রি, আর কক্ষের মধ্যে প্রদীপের আলোক। আমার দিকে তাকাও। এই পৃথিবী তোমার সুখের হলেও আমার জন্য নয়। এক অনিশ্চিত জগতের দিকে আমি চলে যাব। অতিশয় বিনয়বশত বলছি: কী চাও তুমি? কী আর পেতে বাকি তোমার? আমাকে আর তোমার আকর্ষণে টেনে নিয়ে যেয়ো না। তোমাকে ভুলতে দাও।
অগৌর চন্দন চুয়া দিব কার গায়।
পিয়া বিনু হিয়া মোর ফাটিয়া যে যায় \
তাম্বুল কর্পূর আদি দিব কার মুখে।
রজনি বঞ্চিব আমি কারে ল’য়া সুখে \
চলবে...
এসইউ/এমএস