ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

ওবায়েদ আকাশের কবিতা: ন্যারেশনে মোড়ানো নিবিড় প্রতীক

সাহিত্য ডেস্ক | প্রকাশিত: ০১:১৫ পিএম, ১৩ জুন ২০২৪

এমরান কবির

মাহবুব কবির সম্পাদিত নব্বইয়ের দশকের কবিতা নিয়ে সংকলন ‘নব্বইয়ের কবিতা’র ভূমিকার প্রথম বাক্য ছিল, ‘নব্বইয়ের কবিতা এক মহাজাগতিক ব্যপ্তি।’ ওই সময়ে একত্রে পাওয়া নব্বইয়ের প্যাকেজ হাতে নিয়ে বাক্যটি পড়বার পর থেকে আমরা, নব্বইয়ের পরবর্তী প্রজন্ম, যাঁরা শূন্য দশকের লেখক হিসেবে পরিচিত, নব্বইয়ের কবিতার মধ্যে ওই মহাজাগতিক ব্যাপ্তি খুঁজে চলেছি। বলা বাহুল্য, ওই সময়ে নতুন লেখক হিসেবে সাহিত্যাঙ্গনে পা দিয়ে আমাদের নতুন চোখ ও অনভিজ্ঞ মন সত্যিই নব্বইয়ের কবিতার মাঝে মহাজাগতিক ব্যাপ্তি খুঁজে পেয়েছিল। পরবর্তীতে বয়স বাড়ার সাথে সাথে, মন ও মননের ভেতরে অনেক অভিজ্ঞতা ঢুকে পড়ার পর, পর্যবেক্ষণ নিজস্বতায় স্থিত হওয়ার পর মনে হয়েছে আক্ষরিক অর্থে নব্বয়ের কবিতাকে ঠিক মহাজাগতিক ব্যপ্তি না-বলে জাগতিক ব্যাপ্তি বলা যেতে পারে। আর সেই জাগতিক ব্যপ্তির যারা উজ্জ্বল কারিগর- ওবায়েদ আকাশ তাঁদের মধ্যে অন্যতম।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

এ তো গেল মহাকালের একটি ক্ষুদ্রতম অংশে তাঁর অবদানের উজ্জ্বল অবস্থান বিষয়ক একটি তথ্য। কিন্তু অধিকতর অর্থে শিল্প-সাহিত্যের এই জায়গায় ওবায়েদ আকাশের স্বাতন্ত্র কোথায়। তাঁর স্বাতন্ত্র হলো আবহমান বাংলা, বাঙালি এবং এর ঐতিহ্যিক ঐশ্বর্যের শিল্পভাষ্য বিনির্মাণে। এর সাথে সংশ্লেষিত হওয়া অধুনাবাদী উপাদানের মিথস্ক্রিয়া। আর কাঠামো হিসেবে তিনি আশ্রয় করেছেন আরও নানাবিধ প্রকরণে। কখনো গীতিলতায়, কখনো নিরেট গদ্যে, কখানো গদ্য-গীতলতায়, কখনো ছন্দে, কখনো বিনির্মিত ছন্দে ইত্যকার নানারকম কাঠামোতে। নিয়ত নবায়নের ভেতর দিয়ে সচল নব্বই দশকের এই কবি নিজের কাব্যচর্চাকে রেখেছেন তুঙ্গ মুহূর্তে। এই তুঙ্গ মুহূর্ত থেকে তিনি কখনো সরে আসেন না। শিল্প-যাত্রায় রত থেকে তাঁর চলমান চর্চা তাই সত্যিই প্রশংসনীয়। নানারকম কাঠামোর আশ্রয় নিলেও আমার মতে তিনি সবচেয়ে সফল হয়েছেন ন্যারেশনে। এই ন্যারেশনের ভেতরে তিনি গেঁথে দিয়েছেন নানারকম প্রতীক। কখনো গল্পের কাঠামোয়, কখনো ইতিহাসের ভেতরের জন-ইতিহাসের মাধ্যমে, কখনো কখনো বিবিধ অনুষঙ্গে। ফলে তাঁর কবিতা হয়ে উঠেছে ন্যারেশনে মোড়ানো নিবিড় প্রতীক।

‘আমাকে ডেকো না। সুদূরে তাকাও। দেখো ঠিকরে বেরুচ্ছে রোদ/ ও দুটি আমার হারিয়ে যাওয়া চোখ, তোমাকে দেখার স্পর্ধা (বিনির্মাণ) কিংবা, ‘এ নিয়ে কিছু ভাববেন না হে/ আজকাল মাছেরা যেভাবে রক্তপাত করতে শুরু করেছে/ এভাবে চললে আপনি-আমি সবাই এমন রক্তে নেয়ে যাবো/ আর তৎক্ষণাৎ বাজারের সকল মৎস্যবিক্রেতা যার যার রক্তের ধারা/ আবিষ্কার করতে ব্যস্ত হয়ে গেল/ কেউ বলল, আমি সেন বংশজাত, আমি পাল বংশোদ্ভুত, আমি/ এবং দেখা গেলো, বাজারে যে ক’জন ক্রেতা ছিলেন/ শুধু তারাই ছিলেন মীনবংশজাত/ যারা নিজেরাই নিজেদের মাংস ভক্ষণ করতে/ বাজারে এসে কথা কাটাকাটি থেকে রক্তারক্তি পর্যন্ত চলে যেতে পারে (রক্তের ধারা)
বোঝা যাচ্ছে ন্যারেশনে মোড়ানো নিবিড় প্রতীকের এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যই ওবায়েদ আকাশের কবিতা প্রথমে নব্বইয়ের কবিতা থেকে, এরপর বাংলা কবিতা থেকে পৃথক করেছে, স্বতন্ত্র করেছে। ন্যারেশনকে কতভাবে যে কবি ওবায়েদ আকাশ ব্যবহার করতে পারেন তা ভাবলে অবাকই হতে হয়।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

শব্দগুলো কাব্যিক কিন্তু আবহটা গল্পীয়, আসলে কবিতা কিন্তু ভঙ্গিমা গল্পের কিংবা বলতে পারি গল্পে মোড়ানো কবিতা বা কবিতায় মোড়ানো গল্প- যাই বলি না কেন, যেভাবেই বলি না কেন এক অদ্ভুত চুম্বকীয় আকর্ষণে টানে। টেনে গভীরে নিয়ে যায়, পরিভ্রমণ করায় এর রূপে-অরূপে, কল্পে-চিত্রকল্পে, সম্ভাবনায়-অসম্ভবে। আর প্রতীক ও রূপকের আশ্রয়ে গল্পের মোড়কে যা বলে তার গভীরে লীন হয়ে যাওয়াতেই যেন পাঠকের পরিণতি। কারণ এ এক অমোঘ আকর্ষণ যেখান থেকে পাঠকের নিস্তার নেই। আর পাঠোত্তরের আবহ ও ঘোর থাকে। এই ঘোরের ভেতরে বারবার ঘা মারতে থাকে এর চরিত্রগুলো, প্রতীকগুলো, চিত্রকল্পগুলো। এবার একটি কবিতা উদ্ধৃত করা যেতে পারে,

‘প্রাক-বৈবাহিক

বিজ্ঞাপন

একবার আমাকে একটি বিবাহ-উপযুক্ত মেয়ের হস্তাক্ষর পাঠিয়ে বলা হলো, এই মেয়ে এতদিন জলেই বসবাস করেছেন; আর তার সাম্প্রতিক স্যাঁতসেঁতে প্রকাণ্ড শরীর রৌদ্রে শুকোতে দেয়া আছে। তার হস্তাক্ষরে এই যে কোথাও মাত্রা পড়েছে বা পড়েনি, আর এই যে যতিচিহ্নের কোথাও ভুল বা কোথাও সঠিক ব্যবহার—এসব কিছুই নাকি মেয়েটির যথার্থ যোগ্যতা বা দোষগুণ যেটাই ধারণা করা হোক। মেয়েটির উচ্চতা আমাদের মাঠভর্তি জলের সমান, অর্থাৎ এটা আমার আন্দাজ করে নেয়ার কথা। যা হোক, আমি মায়ের কাছ থেকে পত্রমারফত এ সংবাদ জেনেই কিছু ব্যক্তিগত প্রশ্নপত্র তৈরি করেছি। আর ভাবছি, মীন রাজ্যের অধ্যয়ন পর্বে মেয়েটির দীর্ঘ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এসব প্রশ্ন খুব একটা কমন পড়ার কথা নয়। আর তাহলে এভাবে হস্তাক্ষর পাঠিয়ে এক জননীর কোনো অনাথ যুবকের এ মতো মন ভোলানোর কোনো মানেই হয় না। ভেবে দেখছি, আমার অপেক্ষার দিনগুলো কী উৎকণ্ঠার! শীত কিংবা বর্ষাই আমার প্রিয় ঋতু হলেও ভাবছি, তাকে ভেজা জবুথবু নাকি শীতে কোঁকড়ানো দেখতেই বেশি আনন্দদায়ক হবে। আজ এই মুখর বর্ষণে ছাতা হাতে বৃষ্টি বাঁচিয়ে এমনতর ভাবনাগুলোই পোস্টাপিস অবধি পৌঁছে দিয়ে এলাম। আর তখনই আমার হঠাৎ মনে এলো—তাকে শেষ প্রশ্নটি করাই হয়নি যে, অবশিষ্ট জীবনে তিনি মীন ধর্মেই ফিরে যেতে আগ্রহী কিনা’

আরও পড়ুন

কবি ওবায়েদ আকাশের কবিতা থেকে উদ্ধৃত করার একটি বড় সমস্যা হলো তাঁর কবিতা থেকে দুই-চার লাইন উদ্ধৃত করা যায় না। তাঁর কবিতার উপাদানগুলোর পরম্পরা এতই নিবিড় যে কবিতা থেকে হঠাৎ দুই এক লাইন বের করে আনা যায় না। তাতে কিছুই উঠে আসে না। তাঁর কবিতার সৌধ এমনই। এই ক্র্যাফটম্যানশিপ বাংলা কবিতায় অভিনব সংযোজন এবং সাম্প্রতিক কবিতায় তা প্রয়োগে তিনি অনন্য।

বিজ্ঞাপন

তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘পতন গুঞ্জনে ভাসে খরস্রোাতা চাঁদ’ (২০০১) একদা আমাদের তরুণ কবিদের কবিতার জগৎ ওলোট পালোট করে দিয়েছিল। এরপর নিজেকে ভেঙেচুরে নানামাত্রিক কবিতার স্বাদ উপহার দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। সাতাশটি মৌলিক কাব্যগ্রন্থের জনক ছাড়াও তাঁর কাব্য সংকলনের সংখ্যা তেরো—যেগুলো বের হয়েছে বাংলাদেশ ও ভারতের বিখ্যাত সব প্রকাশনা সংস্থা থেকে। একাধিক কাব্যগ্রন্থ অনূদিত হয়েছে ইংরেজিতে। অনুবাদ করেছেন ফরাসি ও জাপানি কবিতা। গদ্যেও তিনি সচল ও সফল। দুটি গদ্যগ্রন্থ ছাড়াও বের হয়েছে শিশুতোষ গ্রন্থ। সম্পাদনা করেছেন দুই বাংলার নব্বইয়ের দশকের নির্বাচিত কবিতা, পাঁচ দশকে বাংলাদেশ: সাহিত্য সংস্কৃতি সমাজভাবনা।

পঁচিশ বছর ধরে সম্পাদনা করছেন লিটল ম্যাগাজিন শালুক, যা ইতোমধ্যেই সর্বমহলে সমাদৃত হয়েছে। পেয়েছেন এইচএসবিসি-কালি ও কলম তরুণ লেখক পুরস্কার-২০০৮, কলকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্র পুরস্কার ২০০৯, সংহতি লিটারারি সোসাইটি বিশেষ সম্মাননা ২০১২ (লন্ডন), ঐহিক মৈত্রী সম্মাননা ২০১৬ (কলকাতা), বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি লিটল ম্যাগাজিন পুরস্কার ২০২২, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয় বিশেষ সম্মাননা-২০২৩।

নিয়ত নবায়নের ভেতরে নিজেকে রেখে তিনি চলমান রেখেছেন তাঁর কাব্যচর্চা। আজ ১৩ জুন এই প্রতিভাবান কবির জন্মদিন। জন্মদিনে তাঁকে শুভেচ্ছা জানাই।

বিজ্ঞাপন

এসইউ/জিকেএস

আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন