মন
শেফালীর তাহলে আস্ত একটা মন ছিল? কি ভীষণ আজেবাজে!
তাহলে যে মা সারাদিন কানের কাছে রেডিও বাজাতে থাকে, গরীবের খালি আছে শরীর, শরীর। গরীবের ব্যথা লাগে শরীরে, কষ্ট লাগে শরীরে, শীত- গ্রীষ্ম-ক্ষুধার কষ্ট। আনন্দও হয় শরীরে, জাকাতের শাড়ী-লুঙ্গি গায়ে চাপানোর আনন্দ, রিলিফের কম্বল-শীতবস্ত্র পাবার আনন্দ, কোনো উপলক্ষে, উৎসব-পার্বণে পেট পুরে খাবার আনন্দ। তার যেমন সিগনালে থামা গাড়িগুলিতে ফুল নিয়ে গেলে কেউ মায়া করে কিনে নিলে, এমনিতেই দুই পাঁচ টাকা দিলে একছুটে ঝালমুড়ি কি হাওয়াই মিঠাই খেতে পেলে কি আনন্দ হতো! জিভের আনন্দ, পেটের আনন্দ- সব শরীরে ।
মন হলো বড়লোকের বিলাসিতা। তাদের মনে কষ্ট পায়, মনের রোগ হয়, অভিমান-অপমান হয়। গরীবের মনের কথা মাথায় আনাও গুনাহ্। একটা মিথ্যা ১০বার বললে সেটাই সত্যি হয়ে যায়। নাহলে তাদের ফ্রি প্রাইমারি স্কুলে বড় আপা তো বলেছিলেন, সত্যিকার মন থাকে মধ্যবিত্তের। বড়লোকেরও নাকি সবটাই শরীরে। মন খারাপ লাগাটা মনে জানান হবার আগেই টাকা দিয়ে মিটিয়ে দেয়। মধ্যবিত্তের মন আছে, তা জানান দেয় থেকে থেকেই; কিন্তু সেই মনের কষ্টের কোনো উপশম নেই! নিত্যদিনের চাহিদা মিটিয়ে শরীরের ওষুধ কিনতেই জেরবার, মন সারাবার সামর্থ্য কই? সাদা কথায়, সিনেমার অবাস্তব গল্প ছাড়া কোথাও কোনোদিন বলে না গরীবের মন আছে।
শেফালীটার তাহলে কি হয়েছিল? কেন সে ক্ষুধা- পিপাসার বাইরেও অন্যকিছুর জন্য এমন আকুল হলো? কেন সেই অন্যকিছুর জন্য সে...? সে ভালবেসেছিল, প্রতিদানে অনেকখানি কষ্ট পেয়েছিল। ভালবাসার জন্ম কি তার ‘মনে’ই হয়নি? আলবৎ হয়েছিল। সে তো ভালবাসা পেতে শরীর মেলে দেয়নি! ভালবাসার পূর্ণতা পায় শরীরে, তার ভালবাসা তো পূর্ণতাই পায়নি! তবে তো আলবৎ তার একটা মন ছিল। কেউ তাকে গায়ে মারেনি, তবু সে এক বর্ষার আষাঢ় শ্রাবণ ভাসা কষ্টে ভেসে গিয়েছিল। কষ্টটা কি তার মনেই লাগেনি?
একটু একটু জেগে ওঠা করে শেফালীর কুসুমিত ভালবাসা সে দেখতে পেয়েছিল। তার তো শেফালীর মতো মন নেই- তাই বোধহয় অনুভব করতে পেত না। কেবল ফ্যালফ্যাল করে দেখেই যেতো।
প্রথম যখন গার্মেন্টসের কাজ নিল সে আর শেফালী, সূর্য জাগার আগেই উঠে নাকে মুখে ভাত গুঁজে দুপুরের ভাত গুছিয়ে দে ছুট। বাসে যেতে অনেক পয়সা। ১ ঘণ্টা পথ হেঁটেই যেতে হবে।
গ্রাম থেকে আসা অনেক মেয়ে বাসা ভাড়া করে থাকতো ধারেপাশের বস্তিতে । কাছে- এই যা, আগাগোড়া নরকবাস। ঘিঞ্জি ঘর, কত উৎকট, উটকো ঝামেলা। ঝামেলা সামলাতে অনেকে ভাড়ার স্বামীও নেয়। পেটের জ্বালা বড় জ্বালা! জিজ্ঞেস করলে ঝাঁজের সাথে মুখ খ্যাচাতো , ‘ঢাকা শহরে একলা মেয়ে ছেলে কাম করতে আসছি, ছিনাল তো হয়েই গেছি! যদি কোনদিন কোন ব্যাটা বিয়ে করতে আসে তো হেও ট্যাকার জন্যই আসবে। ভাল মেয়ে আমরারে কোন মুক্ষুও কবেনা। টাকার গাছ নিবে ঘরে, বউ না। সংসারে টাকা লাগবে, তাই কামে নামছি। কাম টিকায় রাখার জন্য, বাইচে থাকবার জন্য যা করতে হবে কইরে যাব। তাও বাসা বাড়ির কামের চেয়ে অনেক ভাল। স্বাধীন আছি। শুক্কুরবার শুক্কুরবারে সিনামা দেখি, ঘুরি ফিরি, সাজনের তা’ কিনি। রাইতের কালে ঘুমের সময় কেউ টান মারেনা। বাসা বাড়ির কাম করে শুনলে গ্রামে সেই মেয়ের বিয়ের কথা পারাই যায় না।’
জয়নব হা করে খালি শুনে যায় এদের কথা। শেফালী ডাক দেয় ওদের কথায় কান না দিতে। শেফালীর কাজই ঘাড় গুজে কাজ করা, কারো দিকে না তাকিয়ে কাজ শেষে বাড়ি ফেরা। সেই শেফালীই একদিন কেমন অন্যরকম বদলে গেল!
সকালে তাড়াহুরোর মাঝেও সুন্দর করে সুগন্ধী তেল পানি দিয়ে খেজুর বেনী বাঁধে, তোলা কাজল পরে, যত্ন করে ভাঁজ করা কামিজ পরে। প্রথম দিন জয়নব থতমত খেয়ে গিয়েছিল। মুখে রা সরে না।
- আইজকা কোন খাওন দিব আমরারে?
শেফালী খিল খিল করে হাসে,
- কিয়ের খাওন? আইজকা কি ঈদ?
- তাইলে কোন মিলাদ আছে?
- আরে না কিয়ের মিলাদ?
- তাইলে এতো সাজছ ক্যান?
শেফালী বিব্রতভাব লুকাতে বিরক্তি দেখায় ,
- আরে কই সাজছি? কাজল দিয়ে দুইডা ডলা দিছি !
- সাত সকালে খেজুড় বেনী করছ, এতো টাইম পাইলা কই? নতুন জামা, ইস্ত্রী করা!
- আরে এমনি, বেতন পাইছিনা? এই বয়সে সাজুম না তো কি চুল পাকলে, দাঁত পড়লে সাজুম! পা চালা, কার্ড মারতে দেরি হইলে বেতন কাইটা রাখবো।
জয়নবের কেমন কেমন যেন লাগে। শেফালীকে একটু পরপরই প্রশ্নবোধক চোখে দেখে যায়।
গার্মেন্টেস এ ঢোকার মুখে সিরাজ মিয়ার সাথে দেখা- মাস্টার রুলে কাজ করে। সিরাজ মাস্টারকে দেখেই শেফালীর চোখে যেন বিদ্যূত খেলে যায়। সিরাজ মিয়াও মুগ্ধ চোখে শেফালীকে দেখে যায়।
জয়নব অবাক হয়ে খেয়াল করে শেফালী যেন কাঁপছে। শীত নাই, জ্বর নাই- আচানক কাঁপছে কেন শেফালী?
- তোমারে একদম শেফালী ফুলের মতোই সোন্দর লাগতাছে আজকে শেফালী।
সিরাজ মিয়া ঘাড় বেকিয়ে বেশ কায়দা করে বলে।
শেফালীও কেমন লাল হয়ে যায়।
- ধুর আপনি বেশী কন! যাই, কামে দেরি হয়া যায়।
অপ্রকৃতস্থের মতো বলে দ্রুত টালমাটাল পায়ে ঢুকে মেশিনে বসে যায়। কিন্তু সারাদিনই তাদের চার চোখের আদানপ্রদান জয়নব লক্ষ্য করে যায় এবং বিস্মিত হয়। কি এসব?
২ দিন দেখে পরদিন বাড়ি ফেরার পথে সে আবার শেফালীকে জেঁকে ধরে।
- তোমার কি সিরাজ মিয়ারে মনে ধরছে? তার জন্য এমন সাজো?
শেফালী মাথা নীচু করে হেঁটে যায়। তাদের প্রেমের গল্প মেস বাড়িতে থাকা মেয়েগুলি অনেক বিশ্রীভাবে রসিয়ে রসিয়ে লাঞ্চের সময় বলেছে। জয়নব তাদের কাছেই শুনে থাকবে।
জয়নব কিছুক্ষণ জবাবের অপেক্ষায় থেকে ফের বলতে থাকে,
- সিরাজ মিয়ার চরিত্র ভালা না। অনেক মাইয়ার লগেই হের কেচ্ছা আছে । খামাখা সাইজা লাভ নাই। হ্যায় তোমারে বিয়ে করবো না, করলেও রাখব না।
শেফালী এবার ফস করে উঠে,
- কে কইছে হে ভালা না? সোহাগী আর হেরা, না? সবকয়টা অসইব্য ছেড়ী, ব্যাটা ছেলে দেখলেই ঢইলা পরে। হেরা কি বুঝে প্রেমের? সিরাজ মিয়ারে হেরা পায়না, তাই হেরার গতর জ্বলে আমরার প্রেম দেখলে। সিরাজ মিয়া নিচ্চয়ই আমারে বিয়া করবো। দুইজনে ঘর কিনতে টাকা জমাইতেছি। হইলেই বিয়া কইরা উইঠা যামু। যত্তসব আজাইরা প্যাচাল।
জয়নবকে আসলেই আজকে অনেক আজেবাজে কথাই শুনিয়েছে সোহাগীরা। সরল মুখ-সুন্দর মেয়ে পেলেই নাকি সিরাজ মিয়া প্রেমিকের ভড়ং ধরে। তলে তলে সবার সাথেই তার মাখামাখি চলে। অন্য মেয়েরাও সেখানে ছিল। কেউই প্রতিবাদ করেনি। জয়নবের মনের ভেতর তাই ভীষণ খচখচ করছে। শেফালী খুব ভাল মেয়ে। বাপ-মার যত্ন করে, সংসারের সবদিক সামলায়। পাড়া-বেড়ানী, ঢলাঢলি, চোগলখোরীতে সে কোনদিন নাই। তাই জয়নবের ভয়টা আরও প্রবল। মানুষের অন্ধকার দিকটা সে খুব কমই জানে। সিরাজ মিয়া যদি সত্যি মন্দলোক হয় তাহলে শেফালী বড় ভুল মানুষকে নিয়ে স্বপ্ন সাজাচ্ছে- গোটা জীবনের স্বপ্ন! স্বপ্নের ঘোরে সে এতোই অন্ধ যে মাত্র মাস দুয়েকের পরিচয়ে একটা মানুষকে সে খুব চিনেছে ভেবে সংকল্পবদ্ধ। এই অবস্থায় তাকে কিছুতেই কিছু বুঝিয়ে ফায়দা নেই। তার এখন চোখ-কান সিলগালা হয়ে গেছে।
বাংলা মাসের পয়লা তারিখ লালপাড় সাদা শাড়ী, মাথায় বেলী ফুল, লাল টিপ-চুড়ি-লিপিস্টিকে সেজে সিরাজ মিয়ার সাথে যেদিন শেফালী খুব সকালে অনেক ছুতো করে বেড়াতে বের হলো, দূর থেকে সেদিন ওকে দেখে জয়নবের মনে হয়েছিল যেন পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মেয়ে। মনেপ্রানে প্রার্থনা করছিল যেন মেয়েগুলির কথা মিথ্যা হয়ে যায়।
সন্ধ্যে ঘন হয়। শেফালীর দেখা নাই। শেফালীর বাবা- মার জেরার তোড়ে জয়নব মুখ খোলে। রাত বাড়লে সবাই থানায় ধর্না দেয়। তুমুল ধুন্ধুমারের দিন, বাদ্য বাজনায় রাস্তায় ভাতের হাড়ির ভাতের মতন মানুষ; সামান্য এক গার্মেন্টসকর্মী- কে কিভাবে তার খোঁজ নেয়? থানায়-হাসপাতালে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত সব বাড়ি ফেরে রাত শেষ প্রহরে।
ফজরের আজান ভেসে আসে। অগনিত মসজিদে আগে পরে একসাথে সম্মিলিত আজানের বুক চিরে ভোরের নির্জনতা ভেঙ্গে খানখান করে দেয় শেফালীদের বাড়ি থেকে আর্তনাদের উদগীরণ।
শেফালী ফিরেছিল। হয়তো কেউ ফেলেই গিয়েছিল।
কিন্তু দেহে তার প্রাণ ছিল। নেকড়েদের লুটপাট করে ছুঁড়ে যাওয়া সেই দেহে প্রাণটা সে নিজেই রাখেনি।
ভুল মানুষকে সবটা মন দিয়ে ভালবেসে আস্ত জীবনের হিসেবটাই তার ভুল হয়ে গেল। শুধরাতে ইচ্ছা করলো না। সংসারের অনেক দায়- সেই পিছুটানও আটকাতে পারলোনা। থানায় এমন খুনের মামলাই পরে পরে হাওয়া খায়, আর আত্মহত্যার মামলা! তার বাপ-মা হয়তো তার জমানো টাকায় ঘরটা কিনে উঠে যাবে, জানের বদল ঘর ভাড়াটা বেঁচে যাবে!
তবেও কি তার মন ছিল না? তা কি সাড়ে তিনহাত শরীরের চেয়েও বড় ছিলনা?
শেফালীর মন ছিল। এক নদী ধবধবে দুধ সাদা মন। কয়েকফোঁটা চোনায় তা মরে গেল!
এইচআর/পিআর