ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

মুক্তিযুদ্ধের কবিতায় বিজয় চেতনা

সাহিত্য ডেস্ক | প্রকাশিত: ০২:৪৯ পিএম, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৩

রত্না মাহমুদা

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বাঙালির জাতীয় জীবনের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। পশ্চিম পাকিস্তানিরা নির্যাতন-শাসন-শোষণ-বৈষম্য-নিপীড়ন-ধর্ষণ-লুণ্ঠন-অগ্নিকাণ্ড ও পৈশাচিকতার কোনো অংশ বাদ দেয়নি। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে প্রায় সাড়ে সাত কোটি বাঙালি তাদের বিরুদ্ধে প্রাণপণ লড়েছে। নয় মাস যুদ্ধের পর বিশ্বের বুকে নতুন মানচিত্রের অভ্যুদয় ঘটে। একটি নতুন মানচিত্র—একটি নতুন পতাকা—একটি স্বাধীন দেশ।

৩০ লাখ শহীদের প্রাণ, মানুষের ত্যাগ, বিসর্জনের অর্জন আমাদের এই স্বাধীনতা। বস্তুত মুক্তিযুদ্ধের সূত্রপাত হয় অনেক আগে থেকে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। পাকিস্তানিদের জোরপূর্বক উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদ মুক্তিযুদ্ধের মূল কারণ। মুক্তিপরায়ণ মানুষ বারবার সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে। জনগণ মুক্তিকামী ও স্বাধীনতার অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে সময়ের বিবর্তনে বহু সংগ্রাম করেছে। যুগে যুগে সে মুক্তি-আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে। সিপাহী বিপ্লব, তিতুমীর-ফরাসি-তেভাগা-ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের ইতিহাসে তা সংরক্ষিত। দেশভাগের পর ভাষা আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান সর্বশেষ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি জাতি একটা স্বাধীন দেশ অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।

বাঙালির ভাষা-সংস্কৃতি-সাহিত্য-মানবিক-মর্যাদা-গণতন্ত্র-স্বাধীনতা-ত্যাগ ও রক্তদানকে কবিতার মাধ্যমে নিজস্ব কাব্য ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছেন। বাংলা সাহিত্যের উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, গল্পের মতো কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের সমকালীন ও পরবর্তী সময়ের দৃশ্যপট নানাভাবে সবার সামনে তুলে ধরেছেন। কবিতায় সুক্ষ্ম সুক্ষ্ম বিষয়গুলো কবির কাব্যশৈলীতে সুনিপুণভাবে ধরা দিয়েছে। কবিমনের প্রাত্যহিক ভাবনা, নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ও অস্তিত্বের লড়াইয়ে কবি শোক-দুঃখ-যন্ত্রণাকে কাব্যিক ভাষায় উপস্থাপন করেছেন। তৎকালীন কবিদের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধের মূল প্রেক্ষাপট। দেশের মানুষ টানা নয় মাস অপেক্ষা করছে—একটি নতুন সূর্যের উদয় হবে। যে সূর্য নিপীড়িত-অত্যাচারিত মানুষের বিজয়ের বার্তা বয়ে আনবে। দেশ স্বাধীন হবে পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করবে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের ভয়াবহ গণহত্যা ঢাকাবাসীর স্বাভাবিক জীবন বিপন্ন করে তোলে। মানুষ কতটা নির্দয় হলে ঘুমন্ত একটি শহরে মধ্যরাতে আক্রমণ করতে পারে।

ষাটের দশক থেকে টানা পাকবাহিনী শাসন-শোষণ চালাতেই থাকে। বাঙালির মাতৃভাষার ওপর আক্রমণ করার পর যুদ্ধের মতো ভয়াবহ সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়। মুক্তিযুদ্ধের দিনরাত্রি সমান ভয়ঙ্কর ছিল। ২৪ ঘণ্টার প্রতিটি সেকেন্ড বাঙালির জন্য আতঙ্কের। অবরুদ্ধ দেশকে মুক্তিবাহিনী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ-আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা প্রতিমুহূর্তে আলিঙ্গন করার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল। বাঙালির অদম্য সাহস ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ বাঙালিকে লড়তে উদ্বুদ্ধ করে। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে মৃত্যু-জীবনের উপলব্ধি-যুদ্ধের ভয়াবহতা এ দেশের শিল্প-সাহিত্যের এক করুণ অভিজ্ঞতা। এ দেশের কবিরা তাঁদের কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা, আবেগ, চেতনা সহজ ভাষায় ছড়িয়ে দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের কবিতা এদেশের কবিতাঙ্গণে একটি যথার্থ প্রসঙ্গ ও কণ্ঠস্বর। মুক্তিযুদ্ধের সময় দুঃসহ দিনরাত্রির অভিজ্ঞতা অনুভূতির অন্তর চেতনাকে প্রজ্জ্বলিত করেছে।

মানুষ সভ্য শান্তিপ্রিয় জীবনযাপন করতে অভ্যস্ত। যুদ্ধের মতো অশান্তি কোনো মানুষ বা কোনো জাতি সহজে চায় না। আধুনিক যুগের বিবর্তনের ধারায় যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার নানা কারণ খুঁজে পাওয়া যায়। “যুদ্ধের ধারাবাহিক ইতিহাস পর্যালোচনায় একটি সত্য সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, মানবজাতির প্রকৃতিতে এবং এই বিশ্বের পরিচিত পরিবেশে মানবিক বিগ্রহের মূল প্রথিত। মানব সমাজ যেখানেই বসবাস করছে সেখানে অন্তর্গত এবং পারস্পরিক সংঘাত-সংঘর্ষ অনিবার্যভাবে দেখা দিয়েছে। এটি সর্বলৌকিক প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য। ইতিহাসের শুরু থেকে মানুষ যুদ্ধ প্রস্তুতিকে গবেষকগণ বলেছেন, sina qua non of survival’’। (stevens 1989:751), (২০০০ঃ১৬)

সংকট থেকে সংঘর্ষের উৎপত্তি, ক্ষমতা অধিকার চর্চার জন্য ভূখণ্ড দখলের লোভে পর্যবসিত, ধর্মের দালালি জোরপূর্বক রাষ্ট্র দখলের অন্যতম অনুব্রত কারণ যুদ্ধ। পৃথিবীর অন্যতম আদিম ইতিহাস খুঁজলে জানা যাবে, যুদ্ধ-সংঘাত-অশান্তি সব সময় লেগেই ছিল। তাই প্রাচীন সভ্যতার উত্থানের জন্য যুদ্ধ যেমন দায়ী পতনের জন্য সমানভাবে দায়ী। অনিচ্ছাকৃতভাবে দুর্ঘটনা মানুষের কুটচাল ও অশুভ মানসিকতা-গণতন্ত্র-সমাজতন্ত্র অধিকার চর্চার মূল কারণ। যুদ্ধ জয়ী হবে তার কোনো ভিত্তি নেই। দুর্ঘটনা-অধিকার চর্চা-শাসন-শোষণ মুখ্য কারণ হবে এমন কথা নয়। পৃথিবীর আয়ুষ্কালে ক্রমবর্ধমান হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে ভৌগলিক কারণ মুখ্যত হতে পারে।

মানুষ সামাজিক জীব। মানুষ শ্রেষ্ঠ জীব। মানুষ বসবাসের যোগ্য করার জন্য, মৌলিক চাহিদা মেটানোর জন্য, মানব প্রকৃতির জীবন ব্যবস্থার সুবিধার জন্য যুদ্ধ হতে পারে। ষড়যন্ত্র ও প্রতিশোধের স্পৃহা মানুষের মজ্জাগত বৈশিষ্ট্য। সভ্যতার পরিবর্তনে বিবর্তনের অন্যতম কারণ যুদ্ধ। যুদ্ধ শুধু অস্ত্রের হামলা, বোমা হামলায় হয় এমন নয়। গৃহযুদ্ধ-স্নায়ুযুদ্ধের রূপ আরও বেশি ভয়ঙ্কর। স্বজনপ্রিয় দেশ, উন্নত দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র এবং ষড়যন্ত্রের যুদ্ধের অন্যতম কারণ। দেশে দেশের স্নায়ুযুদ্ধ একসময় বিশ্বযুদ্ধে পরিণত হয়েছিল।

“১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ, ১৯৪০ থেকে ১৯৪৭ সালের পাকিস্তান আন্দোলন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনে বাঙালির স্বতন্ত্র জাতীয় চেতনা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম বৈ নয়। কেননা জাতীয় সংস্কৃতি বিকাশে রাষ্ট্র কাঠামো অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তাই ধর্মনিরপেক্ষভাবে সংস্কৃতি বিনির্মাণে যেমন এ দেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে তেমনি ধর্মীয় আবহ পুষ্ট সংস্কৃতি তৈরিতে অনেক ক্রিয়াশীল ছিল। ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতি ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠায় এবং প্রগতিশীল জীবনদৃষ্টি ও জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের সাংস্কৃতিক প্রাণশক্তি যোগাতে ১৯৪৭-১৯৭১ কালপর্বে নানাবিধ সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। (২০১৬ঃ১১)

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মুক্তিযুদ্ধ পরিবর্তনের সময় কাব্যচর্চা হয়ে উঠেছিল প্রতিবাদের মূল ভাষ্য। আবুল হাসান সম্পাদিত ‘কবিতায় মুক্তিযুদ্ধ’ কাব্য সংকলন থেকে আলোচনায় তা সুস্পষ্টভাবে উপলব্ধি করা যাবে। কবিদের মধ্যে তিনি বেছে নিয়েছেন বাংলাদেশের প্রথিতযশা কবিদের। জসীম উদদীন (১৯০৩-১৯৭৬), সুফিয়া কামাল (১৯১১-১৯৯৯), আবুল হোসেন (১৯২২-২০১৪), আহসান হাবীব (১৯১৭-১৯৮৫), সানাউল হক (১৯২৪-১৯৯৩), সিকান্দার আবু জাফর (১৯১৮-১৯৭৫), রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (১৯৫৬-১৯৯১), হাসান হাফিজুর রহমান (১৯৩২-১৯৮৩), আব্দুল গাফফার চৌধুরী (১৯৩৪-২০২২), সৈয়দ শামসুল হক (১৯৩৫-২০১৬০), মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান (১৯৩৬-২০০৮), আবু হেনা মোস্তফা কামাল (১৯৩৬-১৯৮৯), আল মাহমুদ (১৯৩৬-২০১৯), আব্দুল মান্নান সৈয়দ (১৯৪৩-২০১০), রফিক আজাদ (১৯৪১-২০১৬), হায়াত মাহমুদ (১৯৩৯), নির্মলেন্দু গুণ (১৯৪৫), হাবিবুল্লাহ সিরাজী (১৯৪৮-২০২১), হেলাল হাফিজ (১৯৪৮) প্রমুখ।

কবি জসীম উদদীনের ‘মুক্তিযোদ্ধা’ কবিতায় একজন মুক্তিযোদ্ধার জীবনকে তিনি কিভাবে উপলব্ধি করেছেন।
‘‘আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা মৃত্যু পিছনে আগে,
ভয়াল বিশাল নখর মেলিয়া দিবস রজনী জাগে।
কখনো সে ধরে রেজাকার বেশ, কখনো সে খান-সেনা,
কখনো সে ধরে ধর্ম লেবাস পশ্চিম হতে কেনা!
কখনো সে পশি ঢাকা-বেতারের সংরক্ষিত ঘরে,
ক্ষ্যাপা কুকুরের মরণকামড় হানিছে ক্ষিপ্ত স্বরে।’’ (২০০০ঃ৩)
জসীম উদদীনের মুক্তিযোদ্ধা কবিতায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত দায়িত্বকে জনসম্মুখে তুলে ধরেছেন। মৃত্যুকে উপেক্ষা করে বিষাক্ত নখর দিয়ে রাত্রি পাহারায় থাকতে হয়। ছদ্মবেশ ধরে পাক-সেনাদের গোপন খবর উদ্ধার করতে হয়। রাজাকার-হুজুরের বেশ ধরে তাদের আত্মমনের ষড়যন্ত্রের ভাবনাগুলো ক্রয় করতে হয়। ক্ষ্যাপা কুকুর যেমন করে কামড় দেয়; তেমন করে পাকসেনার অঙ্গে মরণকামড় দিতে হয়। মা-বোনের ইজ্জত রক্ষার জন্য, শত শহীদের রক্তকে সাহসী অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে হয়।
‘‘মাঠগুলি পুনঃ ফসলে ফসলে পরিবে রঙিন বেশ,
লক্ষ্মীর ঝাঁপি গড়ায়ে ছড়ায়ে ভরিবে সকল দেশ।
মায়ের ছেলেরা হবে নির্ভয়, মুখ হাসি ভরা ঘরে,
দস্যুবিহীন এ দেশ আবার শোভিবে সুষম ভরে।” (২০০০ঃ৪)
স্বাধীন ভূখণ্ডে মাঠ ফসলে ভরে উঠবে। এ দেশ থেকে যতক্ষণ তাদের না তাড়ানো যাচ্ছে; ততক্ষণ শান্তি মিলবে না। সুখ-আনন্দে ভরে উঠবে না যতক্ষণ দস্যুবিহীন এদেশ হবে।
“গীতারা কোথায় যাবে?
কোথায় যাইয়া পাবে আশ্রয় ঠাঁই
সামনে পেছনে ডাহিনে ও বামে
তাহাদের তরে কোন বান্ধব নাই।” (২০০০ঃ৫)
মানুষকে বাঘের সাথে তুলনা করেছেন। ভয়াল থাবায় গীতাদের মতো মানুষের ঠাঁই সভ্য সমাজে নাই। চারপাশ অন্ধকারে ভরে উঠেছে। নারীদের ওপর হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়তো। পাকসেনারা সাধারণ মানুষের চেয়ে বেশি নারীদের ওপর অত্যাচার চালিয়েছে। নারীর ইজ্জত যুবতি কিশোরীদের সম্ভ্রমহানীর বিনিময়ে পতাকার আকাশে উজ্জয়ন হয়েছে।
‘‘শত শিখা মেলি অগ্নিদাহন চাহি আকাশের পানে,
হয়তো-বা এর ফরিয়াদ করি ঊর্ধ্ব নিঃশ্বাসে হানে,
আকাশে আজিকে নাহি কোনো পাখি সুনীল আরোসি তার,
দিগন্তে মেলি ভীষণ রূপ দগ্ধি হে অনিবার,
মুহূর্তে সব শেষ হয়ে গেল ভস্মাশেষ গ্রাম
দাঁড়ায়ে রয়েছে বিষাদ-মলিন দগ্ধ দুটি আধপোড়া খাম।’’ (২০০০ঃ৯)
কবির চোখে সম্পূর্ণ একটি দগ্ধ গ্রামের চিত্র পাঠকের মাঝে তুলে ধরেছেন। গ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর পরিবেশ পরিস্থিতিকে ধূলিস্যাৎ করে দিয়েছে। স্মৃতিময় সে গ্রামের মানুষের জীবনচিত্র কবির চোখে নান্দনিক করে তুলেছে। নতুন বউয়ের সিঁদুর পরার স্বপ্ন, বৈশাখ মাসের ঝড়, দস্যু ছেলেদের অত্যাচার থেকে সাধারণ মানুষের মুক্তির কত কাহিনি কবির ভাষায় উঠে এসেছে।

কবি সুফিয়া কামাল ‘উদাত্ত বাংলা’ কবিতায় সাত কোটি বাঙালির সন্তানদের আত্মদ্রোহকে জয়ের মাল্য ছিনিয়ে আনার আহ্বান জানিয়েছেন।
‘‘উদ্বেলিত সিন্দুর সমান
সরোজিয়া সাত কোটি বাংলার সন্তান
শোণিত সাগর সন্তরিয়া
পরপারে উত্তরিবে গিয়া
প্রাণে রেখেছে এরা পণ। (২০০০ঃ৯)
শাসক-শোষকের নিষ্ঠুর অত্যাচারে ও করেছে আমৃত্যু পণ, পেছনে ফেরার কারুর সময় নেই।
“শাসকের-শোষকের পীড়কের নিষ্ঠুর পীড়ন
রোধিতে করেছে তারা পণ।
তারা মাটিরে ভালোবাসে
ফলায় সোনার শস্য আপনার দেশে।” (২০০০ঃ৯)
মাটির কাছে রয়েছে সাত কোটি বাঙালির ঋণ। আপন ভূমি দখল করে অত্যাচারের চিত্র সহ্য করতে তারা নারাজ। সাম্প্রদায়িক কূটচালের নেতাদের উৎখাত করে এ দেশকে শত্রুমুক্ত করার দায় মুক্তিবাহিনীর। ঘৃণার স্বর, বলিষ্ঠ বজ্রধ্বনি, কঠিন হুঁশিয়ারিতে মুক্তির মাল্য বাংলাদেশের মানুষ জয় করবেই করবে।
“মুক্তির আলোকশিখা পশিবে যে প্রতি ঘরে ঘরে,
সেই শুভদিন লাগি পথ চাহি জাগে
জননী-ভগিনী-বধূ-বিধাতার আশীর্বাদ মাগে।” (২০০০ঃ১০)

মুক্তির আলোক শিখা জ্বলজ্বল করবে, এ প্রত্যাশায় কবি কাব্য রচনা করেছেন। ‘আজকের বাংলাদেশ’ কবিতায় দ্বিধা-দ্বন্দ্বের ভয়াল চিত্রে বাংলাদেশ এখন ক্লান্ত। পরিত্রাণের নতুন পথ নতুন উপায় সামনে নবোদ্যমের বাংলাদেশ গঠনের প্রত্যয়ে সবাই চেষ্টা করছেন।
“দ্বন্দ্ব ও দ্বিধায় কেটে গেছে বহুকাল
কত যে ভয়াল
শ্বাপদ সংকুল মন তিমির নিশীথে
পথ পাড়ি দিয়া দিয়া হল উত্তরিতে
মুক্ত নীল আকাশের তলে।” (২০০০ঃ১১)
মুক্তিকামী জনতা, শতাব্দীর পর শতাব্দী চলে গেলেও স্বাধীন বাংলা পৃথিবীর মানচিত্রে অক্ষত ও স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। কঠোর বঞ্চনার আঘাতে জর্জরিত মানুষগুলোকে বিলীন করার অপচেষ্টায় হয়েছে তারা ব্যর্থ। আত্মচেতনা যেন বারবার জানান দেয় স্বাধীন হবে এ ভূমি।
‘‘সহস্র তরঙ্গসম অযুত উন্নত শির সেনা
আনিল মুক্তি দিশা রক্তাক্ত সে লেখা
আমার এ বাংলাদেশ উড়িতেছে আমার পতাকা। (২০০০ঃ১২)
বিলুপ্ত ধ্বংসস্তূপ, বিক্ষুপ্ত বাঙালির অবরুদ্ধ মন স্বপ্নের সাহস অনুপ্রেরণার উৎস। আমার দেশের পতাকা মুক্ত বাতাসে উড়ছে।

‘ভালোই করেছ’ কবিতায় কবি আবুল হোসেন বলেছেন, ভয় না দেখালে ভয় ভাঙতো না। ভয়কে জয় করার জন্যই ভয় জরুরি। ভয় দেখিয়ে বাঙালিদের মূলসত্তাকে জাগ্রত করেছে।
“ভালোই করেছ তোমরা এমনি করে
আমাদের ভয় দেখিয়ে নেহাত
বন্ধুর কাজ করেছ
আর ভয় না দেখালে
আমাদের ভয় ভাঙত কেমন করে।’’ (২০০০ঃ১৪)

আহসান হাবীবের ‘স্বাধীনতা’ কবিতায় কবি শব্দের মালায় স্বাধীনতাকে সমস্ত বুকে স্থান করে নিয়েছেন।
“বুক জুড়ে স্বাধীনতা হও
সারা বুকে ছড়াও অথবা
মায়ের দোলনা হও’’ (২০০০ঃ১৮)
‘সার্চ’ কবিতায় আহসান হাবীব পাকবাহিনীর ঘটনা শব্দ তরঙ্গের শব্দের গুচ্ছে একটি ছেলের সাহসী হুংকারকে উপস্থাপন করেছেন। সার্চ করা শেষ হলে যাও বলে ধিক্কার যেন সমগ্র কিশোরদের অন্তরের প্রতিবাদের ভাষণ।
“যাও বলে আবার গর্জন আর ছেলেটি অটল
ধীর পায়ে চলে গেল
আপন গন্তব্যে
তার গন্তব্য কোথায়?
তার গন্তব্য কোথায়? তার ভয় নেই?” (২০০০ঃ১৯)

দানবদের অত্যাচার, অস্ত্রের ভয়, খুনের ভয়কে উপেক্ষা করে মনের প্রতিবাদকে ধুন্দুগিরি সুরে বাজাবে। স্বাধীনতা চাই। স্বাধীনতা তোমাকেই চাই বিধ্বংসী চিত্রে হয়ে উঠেছে জয়ের হাতিয়ার।

একটি মানচিত্র-একটি দেশ-একটি পতাকা-একটি স্বাধীন ভূখণ্ড-একটি স্বীকৃত স্বাধীন রাষ্ট্র-যার নাম বাংলাদেশ। যাদের আত্ম থেকে আমরা পেয়েছি সেই বাংলাদেশ। বাংলাদেশকে রক্তস্রোতের বিনিময়ে দিয়ে গেল মাথা উঁচু করে বাঁচবার অধিকার। বাংলা সাহিত্যের কবিতা এক সূক্ষ শিল্পচর্চা। নাটক-গল্প-উপন্যাস প্রায় সব শাখায় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রচিত হয়েছে নানা সাহিত্যকর্ম। কিন্তু কবিতায় যাঁরা বাংলার জয়গান গেয়েছেন; তারা মুক্তিযুদ্ধের হাতিয়ারের বদলে স্বপ্নের তলোয়ার চালিয়েছেন। যে তলোয়ার, যে অস্ত্র, রেডিওতে আবৃত্তি হয়ে মুক্তিবাহিনীকে যুদ্ধ করার সাহসী শক্তি হিসেবে সঞ্চরণী শক্তি দান করেছে।

তাই স্বাধীনতার এত বছর পরও বাংলা সাহিত্যের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কবিতাগুলো বাঙালির মনে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। আবুল হাসান সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধের কবিতা গ্রন্থ থেকে উল্লেখযোগ্য কবির কয়েকটি কবিতা আলোচনা করার ক্ষুদ্র প্রয়াস মাত্র! বিজয়ের উল্লাসে বিজয়ের মালা জয় করেই আজ বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে বাঁচার অনুপ্রেরণা পায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ, নেতৃত্ব, আত্মত্যাগ, বন্দিজীবন, শত লাঞ্ছনা সবকিছু যেন নিমিষেই বাংলাদেশিদের দুঃখ ভুলিয়ে দেয়।

সহায়ক গ্রন্থ:
১. আবুল হাসনাত সম্পাদিত, মুক্তিযুদ্ধের কবিতা, অবসর প্রকাশনা, প্রথম প্রকাশ-২০০০, বাংলা বাজার, ঢাকা-১১০০।
২. মাহমুদ উল আলম, বাংলা কথাসাহিত্যে য্দ্ধুজীবন, প্রথম প্রকাশ-নভেম্বর ২০০০, বাংলা একাডেমি, ঢাকা।
৩. রিষিণ পরিমল, কবিতায় মুক্তিযুদ্ধ, ফেব্রুয়ারি ২০১৬, জাতীয় সাহিত্য পরিষদ, ঢাকা।

লেখক: কবি ও গবেষক, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

এসইউ/এমএস

আরও পড়ুন