ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

ডাবলু লস্কারের গল্প: ছায়া

সাহিত্য ডেস্ক | প্রকাশিত: ০২:২৫ পিএম, ১৪ নভেম্বর ২০২৩

খটাং, খটাং, খটাং
অনেকক্ষণ ধরে বাইরের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হচ্ছে।
‘মিন্নি দাদুভাই, দ্যাখ তো কে এলো? অনেকক্ষণ ধরে বাইরের দরজায় কড়া নাড়ছে।’
‘যাই দাদি, দেখি কে এলো।’
এ বাসায় কলিং বেল নেই। কেউ এলে কড়া নাড়ে। বিশ্রি খটাং খটাং শব্দ হয়। মিন্নি দরজা খুলে দেখে একজন বয়স্ক ভদ্রলোক। চুল-দাড়ি পাকা ধবধবে, দাঁড়িয়ে আছেন।
‘কী ব্যাপার? কাকে চান?’
‘আসলে আমি ঢাকা থেকে আসছিলাম একটা জরিপের কাজে। পাশেই উঠেছি আমি। এ এলাকায় নতুন, তেমন কিছু চিনি না। এ পথ ধরেই যাচ্ছিলাম। অনেক পানি তেষ্টা পেয়েছে। গলা শুকিয়ে কাঠ! তাই এই দুপুরবেলা ঢুকে পড়ে আপনাদের বিরক্ত করছি। যদি একটু পানি খেতে পারতাম?’
‘ও সিওর। আসুন ভেতরে একটু রেস্ট নিয়ে পানি পান করেন। বাইরে অনেক রোদ।’ মিন্নি বিনয়ের সুরে বলল।

ভদ্রলোক মিন্নির পেছন পেছন গিয়ে একটি রুমে বসলেন। ফ্যানের নিচে বসে একটু ঠান্ডা হলেন। বারবার উঁকি দিয়ে এদিক-ওদিক কী যেন দেখছেন।
‘খুকু, বাসায় তুমি কি একা? আর কেউ নেই?’
‘জি, আছেন, আমার দাদি। পাশের রুমে। দাদি অনেকদিন ধরে ডায়াবেটিকে ভুগছেন তো। এ জন্য এখন ভালো করে চোখে দেখতে পান না। তাই বেশি নড়াচড়া করেন না। সারাদিন রুমে বসে ইবাদত-বন্দেগি করেন।’
এ কথা শুনে লোকটি যেন কিছুটা বিচলিত। মুখটা হাসি হাসি ছিল। হঠাৎ করেই কালো হয়ে গেল।
‘আমি কি একটু দেখা করে যেতে পারি ওনার সাথে, খুকি?’
‘হ্যাঁ, অবশ্যই। আসেন এদিকে।’
বয়স্ক লোকটি মিন্নির পেছন পেছন গিয়ে দাদির রুমে ঢোকে। বলে ওঠেন,
‘কেমন আছেন? অনুমতি না নিয়েই চলে এলাম।’
‘ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?’
‘চলছে ভালোই। এই শেষকালে ঘাটে বসে আছি, কখন নৌকা আসবে সেই অপেক্ষায়।’ বললেন বয়স্ক লোকটি।
দাদি বললেন, ‘আমারও একই অবস্থা। চোখে দেখি না। সারাদিন ছেলে আর ছেলের বউ অফিস নিয়ে ব্যস্ত। আমি একাই বাসায় থাকি। নাতনিটার কলেজ না থাকলে আমার সাথে থাকে।’
বয়স্ক লোকটি কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে বয়স্ক মহিলাটির দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর বললেন, ‘আপনার সাথে দেখা হলো। কথা হলো। এবার আমি চললাম। ভালো থাকবেন।’
‘আপনিও ভালো থাকবেন।’ দাদি আস্তে আস্তে বললেন।
যাওয়ার আগে বয়স্ক লোকটি বললেন, ‘সেদিন না বলে চলে গিয়েছিলাম। আজ কিন্তু বলে যাচ্ছি। হয়তো এটাই শেষ দেখা। তবুও আমি তো দেখলাম কিন্তু আপনি তো দেখতেও পেলেন না।’
‘আমি চোখে দেখি না কিন্তু সব অনুভব করতে পারি, কানে শুনতে পারি।’
বয়স্ক লোকটি আর একবার পেছন ফিরে তাকালেন। তারপর হনহন করে চলে গেলেন।

মিন্নি দাদির কাছে এসে বলল, ‘দাদি, তুমি কি লোকটাকে চিনতে? কে উনি? মনে হলো তোমার পরিচিত।’
দাদি বললেন, ‘সে এক বিরাট কাহিনি। আমার বাবা আর ওর বাবা একই অফিসে চাকরি করতেন। আমরা এক কোয়ার্টারে পাশাপাশি ভবনে থাকতাম। পাশাপাশি থাকতে থাকতে, একসাথে চলতে চলতে আমাদের মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি হয়। ও আমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসতো। আমিও বাসতাম। তবে ওর মতো নয়। একদিন ওর বাবা বদলি হয়ে চলে যান অন্য জায়গায়। কিছুদিন পরে আমার বিয়ে ঠিক হয়। আমার বিয়ে উপলক্ষে ওদের দাওয়াত দেওয়া হয়। ও আমার বিয়ের কথা শুনে ভেঙে পড়ে। চলে আসে আমাদের বাড়িতে। সেদিন রাতেই আমার বাবার হার্ট অ্যাটাক হয়। বিয়ে পেছানো হয়। আমরা সিদ্ধান্ত নিই, বাবা একটু সুস্থ হলে আমরা পালিয়ে যাবো। কিন্তু বাবা দিন দিন আরও অসুস্থ হতে থাকেন। বাবা চান আমাকে দ্রুত বিয়ে দিতে। সে মতই দিন-তারিখ দ্রুত ফেলা হয়। বিয়ের আগের রাতে ও আমাদের বাসায় এসে অনেক অনুরোধ করে পালিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু আমি যাইনি। ভেবেছিলাম পালিয়ে গেলে বাবা হয়তো সঙ্গে সঙ্গে মারা যাবেন এ খবর শুনে। ফলে আমার বিয়ে হয়ে যায়।’
দাদি এবার একটু থামলেন।
‘তারপর কি উনি তোমাকে ভুলে গিয়েছিলেন? দাদি বলো না। খুবই ইন্টারেস্টিং কাহিনি। আমার আরও শুনতে ইচ্ছে করছে।’
দাদি আবার বলতে শুরু করলেন, ‘বিয়ের পরে আমি তোর দাদার সাথে চলে আসলাম মানিকগঞ্জে । মানিকগঞ্জে এসে তোর দাদা গার্মেন্টস ব্যবসায় যুক্ত হলেন। তোর দাদা সারাদিন ব্যস্ত থাকে ব্যবসা নিয়ে। ভুলে গেলাম অতীত জীবনের কথা। পুরোদমে আমি তখন সংসারী। হঠাৎ একদিন তোর দাদা বাসায় এসে বললেন তার এক ব্যবসায়িক পার্টনার আসবেন যশোর থেকে। কয়েকদিন থাকবেন আমাদের সাথে। হোটেলে উঠতে চেয়েছিলেন কিন্তু তোর দাদা বলেছেন বাসা থাকতে হোটেলে থাকতে দেবেন না তাকে। আমি তোর দাদার ওপর রাগ দেখালাম। বললাম, এমনিতেই সারাদিন ব্যস্ততায় কাটে আমার। তারপর আবার গেস্ট এলে রান্নাবাড়া এসব ঝামেলা আমায় দিও না। তোর দাদা বললেন, আরে লোকটি অনেক ভালো। আমি তাকে না করতে পারবো না।
পরদিন তোর দাদার সাথে সে হাজির। আমি লোকটিকে দেখেই ঘরের ভেতরে চলে আসলাম। সে আর কেউ নয়, আমার অনেক আপন সে, আমার যত্নে রাখা অতীত সে। বাইরে থেকে তোর দাদা ডাকছিল নাস্তা দেওয়ার জন্য কিন্তু নড়তে পারছিলাম না। যেন পাথর হয়ে গেছি। আমি ভাবছিলাম আমি সারাজীবন দাঁড়িয়ে থাকবো, না হয় মরবো। কিন্তু ওর সামনে যেতে পারবো না। নিজেকে অপরাধী লাগছিল। ও হয়তো আমাকে অনুসরণ করেই এতদূর আসতে পেরেছে। কিন্তু আমি দিব্যি ওকে ভুলে অনেক ভালো আছি।’

‘তারপর দাদি?’ মিন্নি তাকিয়ে আছে ওর দাদির মুখের দিকে অপলক।
‘তারপর কয়েকদিন থাকলো আমাদের বাসায়। বলল শুধু এক নজর দেখার জন্য নাকি আমার স্বামীর ঠিকানা অনেক কষ্টে জোগাড় করে তারপর তার সাথে ব্যবসায়িক অংশীদার হয়েছে। বলেছিলাম, বিয়ে করবে না? বলেছিল, না। এ জীবনে ও নাকি শুধুই আমাকে ভালোবেসেছে। তাই আমার বিয়ে হয়ে যাওয়ায় ও আর অন্য কাউকে বিয়ে করবে না। ও যে কয়েক দিন আমাদের বাসায় ছিল, আমি সব সময় অস্থিরতায় ভুগতাম। সব সময় অনুশোচনা হতো। আমার জন্য একটা মানুষ বিয়ে করবে না। এত ভালোবাসার পরও আমি স্বার্থপরের মতো বাড়ির পছন্দে বিয়ে করে সুখে সংসার করছি। তোর দাদা বাসায় এলে তোর দাদার সাথে খারাপ ব্যবহার করতাম।
ও একদিন বলে বসলো, চলো দুজনে পালিয়ে যাই। আবার নতুন করে শুরু করি। আমি তোমাকে ছাড়া কিছু বুঝি না। আমার রাতগুলোকে আর আঁধার করো না। আমি জানি, তোমার বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে তুমি বিয়ে করেছিলে। হয়তো তুমি সুখে নেই। আমার মতো দহনে জ্বলে মরছো ভেতরে ভেতরে।’
‘তুমি কী বললে?’ মিন্নি জানতে চাইলো।
‘আমি শুধু নির্বাক তাকিয়ে থাকলাম ওর দিকে। আমি বুঝতেছিলাম ওর ভেতরে কী তৃষ্ণা আমাকে পাওয়ার জন্য। কিন্তু আমার কিছুই করার ছিল না। আমি এতদিন তোর দাদাকে ভীষণ আপন করে নিয়েছি। তোর দাদার সরলতা আর ভালো মানসিকতা আমাকে আর আমার ভালোবাসাকে জয় করে নিয়েছিল। আমি টের পাচ্ছিলাম, ও আমার প্রতি আরও দুর্বল হয়ে পড়বে। আর ও এখানে থাকলে আমিও শান্তি পাবো না এক মুহূর্তের জন্য। তাই সেদিন বিকেলে তোর দাদা এলে বললাম, গেস্ট আর কয়দিন থাকবে? তুমি বাসায় থাকো না। এ রকম অচেনা একজন বাসায় থাকে আমার ভয় করে। তোর দাদা ফিসফিসিয়ে বলেছিল, আস্তে বলো। উনি শুনতে পাবেন। কিন্তু আমি আস্তে বলিনি। জোরেই বলেছিলাম। যেন ও শুনতে পায় এবং যথারীতি ও শুনতেও পেয়েছিল। পাশ থেকে হা করে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে। যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না, আমি এমন কথা বলতে পারি।
সেদিন রাতে সিগারেট কেনার কথা বলে সেই যে বাইরে গেল আর ফেরেনি। রাতে তোর দাদা বার বার বলছিল, লোকটা না বলে চলে যাবে এমন তো হতে পারে না। কিন্তু আমি জানতাম, ও আর আসবে না। না বলেই বিদায় নিয়েছে ও। হয়তো এক বুক কষ্ট নিয়ে রাতের আঁধারে নিজের অশ্রু লুকাতে চলে গেছে।’

মিন্নি বাকরুদ্ধ, কথা বলতে পারছে না। কী বলছে তার দাদি এতক্ষণ ধরে। এমন ভাবেও মানুষ ভালোবাসতে পারে?
‘তারপর দাদি? উনি এর মধ্যে আর আসেননি?’
‘হ্যাঁ, এসেছিলেন। তবে আমার সামনে আসেননি। আমাদের বাসার আশপাশ দিয়ে ঘুরে যেতেন। আমি দূর থেকে দেখতাম, কেউ একজন আমাকে সব সময় অনুসরণ করছে। আমি তার কাছে যাওয়ার আগেই কোথায় যেন হারিয়ে যেত। এর মধ্যে তোর বাবা বড় হয়ে গেল। তোর দাদা মারা গেল।’
‘তোমার কি কখনো তাকে দেখতে ইচ্ছা করতো না?’
‘হ্যাঁ। আমি যখনই ভাবতাম আমার জন্য একজন মানুষ এত অপেক্ষা করে আছে। অনেক মায়া হতো। মনে হতো একবার যদি দেখতে পেতাম তার মুখটা। এর মধ্যে ডায়াবেটিস হয়ে দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হয়ে গেল। আজ এতদিন পরে এলো কিন্তু কপাল দ্যাখ। আমি দেখতে পারলাম না ওকে।’

মিন্নি ভাবতে লাগলো, কত মহান প্রেম এদের মাঝে। কত পবিত্র ছিল এদের ভালোবাসা। কিন্ত এখনকার প্রেম-ভালোবাসা কত ঠুনকো। একটি আইস্ক্রিম বা এক প্যাকেট বাদামের জন্য যে কোনো মুহূর্তে ব্রেকআপ হয়ে যাচ্ছে। একটু আগে যে আগন্তুক এসেছিলেন, তার প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে গেল। মিন্নি ভাবতে লাগলো, এক মহান মানুষের সাথে একটু আগে কথা বলল সে। আবার যদি মানুষটা আসতো মিন্নি তাহলে তার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতো।
‘আচ্ছা দাদি। ওনার নাম কী?’
দাদির চোখ ছলছল করছিল। যেন অনেকক্ষণ ধরে সেই আগের কতকিছু মনে করছে সে। হঠাৎ দাদি বলে উঠলেন, ‘ওর নাম ছায়া। ও আমার ছায়া, যে সব সময়ই আমার সঙ্গে থাকে। সর্বদা আমাকে অনুসরণ করে।’

এসইউ/জিকেএস

আরও পড়ুন