আমিনুল ইসলামের কবিতায় বিবেকের প্রকাশ
আমিনুল ইসলাম (২৯ ডিসেম্বর ১৯৬৩) চাঁপাইনবাবগঞ্জের মহানন্দা পাড়ের কবি। নব্বই দশকের কবি হয়েও দশকের বাইরে তিনি। ব্যতিক্রম এক কাব্যভাষা নির্মাণ-বিনির্মাণ করে সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন। তার কবিতায় চারপাশের নানা অবিচার, অন্যায্য, বৈষম্য, দ্বিমুখিতা, মুখোশের চরিত্র উঠে এসেছে। এসব বৈষম্যের চিত্র তিনি বিভিন্ন প্রতীক-ব্যঞ্জনায় তুলে ধরেছেন। মানবতার নামে অন্ধকার, সেবার নামে সাম্রাজ্য ও ক্ষমতার লোভ, ‘পরামর্শ দেই কিন্তু নিজে মানে না’ চরিত্রের সূক্ষ্ম ও জটিলতার প্রবণতা আমিনুল ইসলামের কবিতার অন্যতম প্রধান ধারা বা প্রবণতা। ‘বিবেক যা বলে’ কবিতায় তা-ই প্রকাশ করে দেন তিনি।
আমরা দেখি, সমাজ ও মানসিক বিভিন্ন সংকটের কথা বা উপাদানের গুণেই (এক বা একাধিক) বিখ্যাত সাহিত্যিকরা অজেয় হয়েছেন। পরিবার ও সমাজের বিভিন্ন জটিল রূপ আমিনুল ইসলামের কবিতায় লক্ষ্য করা যায়। মানসিক সংকট ও জটিলতা ফুটে উঠেছে তার কবিতায়। এগুলো আমরা দেখি গদ্যে, বিশেষত উপন্যাস বা গল্পে। কিন্তু আমিনুল এসব চিত্র বা প্রবণতা কবিতাতেই বলে দিয়েছেন। বিচ্ছিন্নভাবে অনেক কবিই এমন কবিতা লিখে থাকেন। কিন্তু আমিনুল ইসলামের এমন কবিতার আধিক্য থাকে অজর ও অমর করে রাখবে বলে আমি মনে করি। ভাষা ও বাগশ্রেণির পেলবতা, বক্তব্য ও উচ্চারণের দৃঢ়তা, বিবেক প্রকাশে কুণ্ঠাহীন তার কবিতাকে আলাদা করে দিয়েছে। চিত্র ও চিত্রকল্প নির্মাণে তিনি অভিনত্ব দেখিয়েছেন। ভূগোল ও ভৌগলিক উপাদান, পরিভাষার প্রয়োগ, দাপ্তরিক ও কমন ইংরেজি শব্দ বা শব্দশ্রণির যুৎসই প্রয়োগে যথার্থতা এতই নিখুঁত যে তার কবিতা পড়লেই মনে হয় এগুলো সংশ্লিষ্ট পাঠকের মনেরই কথা, আশেপাশের কথা যা পাঠকের মুখ থেকে কেড়ে নিয়ে আমিনুল ইসলাম কবিতায় বলে দিচ্ছেন। এই শব্দশ্রেণিগুলো মনে হয় পাঠকের ‘পুষে-রাখা’ কথা—যা তিনি প্রকাশ করতে পারেননি বা প্রকাশে শঙ্কাবোধ করেছেন—আমিনুল ইসলাম কবিতায় তা বলে দিলেন। আবার, তা সাহস ও প্রজ্ঞার সাথেই তুলে ধরতে পেরেছেন। এজন্যই কবিতা পাঠ করে আমিনুল ইসলামকে পাঠকেরই একজন মনে হয়।
আধুনিক কবিতা মিউজিক, ভাস্কর্য, চিত্রকলা এবং অন্যান্য চারুকলার বিষয়াবলি দ্বারা প্রভাবিত। বাঙালি কবির মধ্যে এ-ধারা লক্ষ্য করা গেলেও কবি আমিনুল ইসলামের মধ্যে প্রবলভাবে দেখা যায়। বিবেকপ্রবাহ বা চেতনাপ্রবাহ (stream of consciousness) গুণ সব কবির মধ্যে থাকে না। যে কবি যত উচ্চমাত্রায় এসব সত্য বা বিবেক প্রকাশ করতে পারেন তিনি ততই বড় কবি, মহান কবি হিসেবে টিকে যাবেন। ‘নীরব সংগ্রাম’ আমিনুল ইসলামের কবিতার অন্যতম প্রধান প্রবণতা। তার কবিতায় সরাসরি বিদ্রোহ নেই, বিপ্লবের ঝাঁজ নেই কিন্তু তার অনেক কবিতা ছাইচাপা আগুন। তিনি যা সত্য তাই বলে দিয়েছেন কবিতায়। বিবেককে পরাজিত করতে চাননি। ‘চুম্বন নিয়ে লেখা যে কবিতার সকল চরিত্র কাল্পনিক’ কবিতার একটি অংশে তিনি বলেছেন:
মাননীয় অর্থমন্ত্রী,—
রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান মহোদয়,
দেখুন—
গরীরের ঘামে রোদ লেগে চিকচিক করছে ভ্যাট,
মুক্তবাজার অর্থনীতির দাগটানা পথ ধরে
দিনদিন বেড়ে চলেছে করের পরিসীমা;
বাড়ুক! শুধু এটুকু মিনতি—
দয়া করে আমাদের চুমুর ওপর ট্যাক্স বসাবেন না!
রাতরঙা ব্যাগহাতে
এক্সটার্নাল অডিট যাক মেগা প্রজেক্টের বাড়ি।
যে কোনো বিষয় বা উপাদান হতে পারে আধুনিক কবিতার টপিক। ফলে ট্রেন-প্লেন থেকে আকাশ-বাতাস, শিক্ষক কিংবা পতিতা, গণতন্ত্র-মানবতা, অফিস কিংবা অবসর ইত্যাদি নিয়েই কবিতাশৈলী নির্মাণ করেছেন আমিনুল ইসলাম। কবিতা হচ্ছে বক্তব্য ও অনুভবের। আর এ-দুটি বিষয়কে স্পষ্ট করতে এবং ভাষা নির্মাণে-বিনির্মাণে অভিনবত্ব আনতে বিভিন্ন উদ্যোগ বা কৌশল গ্রহণ করেছেন কবি আমিনুল ইসলাম। চিত্রকল্প নির্মাণে নতুন স্বাদ পাওয়া যায়, ভৌগলিক শব্দের আধিক্য, বিজ্ঞান ও পরিভাষার ব্যাপক প্রয়োগ, বক্তব্য প্রকাশে তথ্যপ্রযুক্তি শব্দের ব্যাপক প্রয়োগ, নদী-আকাশ-মাঠ প্রভৃতির আবহে প্রকৃতির কাছাকাছি যাওয়া, হৃদয়ের কাছাকাছি যেতে ভাষার নান্দনিকতা ও কোমলতা পাঠককে মুগ্ধ করে। তিনি পাঠক হিসেবেও ভালো। ফলে পাঠকের পালস বুঝতে কবির কষ্ট হয় না, অনুভূতি বুঝতে সমস্যা হয় না। দাপ্তরিক সমস্যা, মোড়লগিরি, বিভিন্ন-স্তরের বৈষম্য ইত্যাদির চিত্র আমিনুল ইসলামের মগজে প্রোথিত হয়ে গেছে। ফলে কবিতায় সাধারণ কিন্তু উন্নত ভাষাশৈলী সৃষ্টি করে পাঠকের মনের খুব কাছাকাছি যেতে পেরেছেন।
টি. এস. এলিয়ট হতাশাবাদী কবিদের অগ্রজন। নাগরিক ক্লান্তি, সমস্যা, বিভিন্ন অবিশ্বাস ও হতাশা উঠে এসেছে তার কবিতায়। এসব গুণেই তিনি জনপ্রিয় হতে পেরেছেন। আমাদের শামসুর রাহমান ঢাকাকেন্দ্রিক অনেক সমস্যা ও পাওয়া-না-পাওয়ার কথা লিখে জনপ্রিয় হয়েছেন। সমর সেন কলকাতার সমস্যা নিয়ে কবিতা লিখে স্থায়ী হয়েছেন। এলিয়টের মানসিক অবিশ্বাস ও হতাশার নমুনা এমন:
What are the roots that clutch,
What branches grow
Out of this stony rubbish? Son of man,
You cannot say, or guess, far you know only,
A heat of broken images, where the sun beats
And the dead tree gives no shelter, the cricket no relief.
কবি আমিনুল ইসলামও সমাজ ও মানুষের বিভিন্ন সমস্যা ও হতাশার কথা লিখেছেন। প্রেম ও নারীর মধ্যে আলোকিত বিষয়ের পাশাপাশি অন্ধকারের বিষয়গুলোও কবিতায় নিয়ে এসেছেন। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন অসঙ্গতি নিয়ে কবিতা লিখেছেন। এভাবেই তিনি পাঠকের কাছে নিজের একটা জগৎ সৃষ্টি করতে পেরেছেন। পাঠকদের অনুভূতি যেন আমিনুল ইসলামের কবিতায় প্রকাশিত। জন মেসফিল্ড প্রেমের মধ্যে হতাশা খুঁজে পেয়েছিলেন—Death has a lodge in lips as red as cherry/ Death has a mansion in the Yew-tree berries. কবি আমিনুল ইসলামের অনেক কবিতায় ধারাটি লক্ষ্য করা যায়। ‘আমার ভালোবাসা তোমার সেভিংস অ্যাকাউন্ট’ কাব্যগন্থের ‘‘ভালোবেসে আর কি হবে’’ কবিতায় বলেছেন, ‘ভালোবেসে আর কি হবে প্রেয়সী!/ ভালোবাসা কি নেভাতে পারবে/ শ্বেত—শয়তানের চুলো—যেখানে/ বারুদে ও ফুয়ে রাঁধা হয় রাতে/ তামাটে সভ্যতা—বিরোধী কার্পেট বোমার ডিশ?’। আমিনুল ইসলামের এরকম অনেক কবিতা আছে। ফলে পাঠকের যন্ত্রণাগুলো নিজের ভেবে কবিতায় এনেছেন তিনি। কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে:
১.
দ্যাখো দূরে–মধ্যপ্রাচ্যে-আফ্রিকায়
দ্যাখো কাছে–দুপাশের পড়শি ভূগোলে
ভেসে যায় প্রেম!
ভেসে যায় অহিংসা!
ভেসে যায় শান্তি!
ভেসে যায় ন্যায়বিচার!
বানে ভেসে যাওয়া শস্যের উপমা এর চেয়ে ভালো
আর কোথায় পাবে?
(প্রাচ্যের অসুখ)
২.
হে প্রেয়সী, আজ যেখানে আমার বাস,
সেটা দোমুখোদের রাজত্ব
সেখানেই আন্ডারগ্রাউন্ড লেফলিস্ট আমি
সফল হতে এসেছি
গভীরে বিশ্বাস করে কাছে নাও
সম্পর্কের রাজ্যে
প্রতিবিপ্লবী হওয়ার ঝুঁকি থেকে বাঁচাও আমাকে!
(হে মহানন্দা)
৩.
রাজপ্রাসাদ নেই, নেই রাজমুকুটও
অথচ যেখানেই হাত দেই,
সেখানেই রাজার শরীর;
আলো ছেড়ে অন্ধকারে যাই
চাররঙা আঁধারের যেখানেই
হাত পড়ে—ডানে কিংবা বামে,
সেখানেই হাতে ঠেকে
মাননীয় নিতম্বের ছোঁয়া!
(রাজাময়)
আমিনুল ইসলামের কবিতা অধিক পঠিত ও আলোচনা হওয়ার যোগ্যতা আছে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। বেশিমাত্রায় তার কবিতা পঠিত হলে নিজের কবিতার জগতকে আরও অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে সক্ষম হবেন বলে মনে করি। তার কবিতায় জাদু আছে, মোহগ্রস্ত করে তোলে। এ নেশা কবিতা পাঠক সৃষ্টির নেশা। বৈশ্বিক ও দেশীয় পরিমণ্ডলের সমন্বয়ে নতুন এক কাব্যভাষা নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছেন কবি আমিনুল ইসলাম। ‘মানবতার বাণী’ তিনি মুখ্য হিসেবে তুলে ধরেছেন। তিনি দেশীয় ও চারপাশের প্রেক্ষাপটের পাশাপাশি ফিলিস্তিন কিংবা সাম্রাজ্যবাদী বিভিন্ন রূপ তুলে ধরেছেন। বিবেককে না-ঠকিয়ে কবিতায় প্রকাশ বা উপস্থাপনের এ নান্দনিক কৌশল কবি আমিনুল ইসলামকে অমরত্ব দেবে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।
এসইউ/জিকেএস