ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

ডাবলু লস্কারের গল্প: মাস্টার

সাহিত্য ডেস্ক | প্রকাশিত: ০১:২২ পিএম, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৩

চারিদিকে হঠাৎ চিৎকার-চেঁচামেচি, হুলস্থুল-দৌড়াদৌড়ি। সন্ধ্যা তখন তার মা গৌরিপ্রিয়া দেবীর সঙ্গে বসে ভাত খাচ্ছে। হই-হুল্লোড় শুনে খাওয়া বাদ দিয়ে কান পেতে থাকে কী হচ্ছে বোঝার জন্য। এর মধ্যে রাঙা কাকি হাপাতে হাপাতে এসে বলে, ‘হারান বৈদ্যর ছেলে চিন্টুরে কারেন্টে ধরিছে।’

এ কথা শুনে সবাই রাঙা কাকির সঙ্গে দৌড়ে তিন রাস্তার মোড়ে ফকিরদের জামতলায় চলে আসে। এসে দেখে বিশাল জটলা। বিশাল জাম গাছের ওপরে মগডালে চিন্টু বড় ডাল আঁকড়ে ধরে আছে আর ‘বাঁচাও আমারে’ বলে চেঁচাচ্ছে। কিন্তু কেউ আগাতে সাহস পাচ্ছে না। কারণ জাম গাছের একটা ডাল মাঝে মাঝে বাতাসে হেলে পাশের কারেন্টের লাইন স্পর্শ করছে। তখন কারেন্টের ঝাকি অনুভব করছে চিন্টু। এ অবস্থায় ছোট মানুষ বলে অনেক ভয় পেয়ে গাছ থেকে আর নামতে পারছে না।

পাশ থেকে সবাই চিৎকার করছে নেমে আসার জন্য কিন্তু কেউ কাছে যাচ্ছে না। এর মধ্যে ভিড় ঠেলে কেউ যেন তরতর করে গাছে উঠে যায়। পাশ থেকে একজন বলে, ‘মাস্টার, বিপদ হবে; নেমে এসো।’ কিন্তু কে শোনে কার কথা? কয়েকবার মৃদু ঝাটকা খেয়ে ঠিকই নামিয়ে আনে চিন্টুকে।

এর মধ্যে কারন্টের শক খেয়ে দুজনেরই অবস্থা কিছুটা খারাপ। সন্ধ্যা অবাক হয়ে ভাবে, কী সাহস এই মাস্টার নামের মানুষটার। কোনো ভয়-ডর কিচ্ছু নেই। সন্ধ্যা বাড়িতে এসেছে এই দু-তিন দিন। এসেই সে গ্রামের সবার কাছ থেকে শুধু একটি নামই শুনছে, মাস্টার।

যশোরের ভবদহ বিলের সঙ্গেই মনোহরপুর গ্রামের বাসিন্দা সন্ধ্যারা। তার বাবাকে সবাই মহাজন বলে ডাকে। মহাজন একাই নিয়ন্ত্রণ করে এত বড় বিলের ঘেরের ব্যবসা। সবাই প্রচণ্ড ভয় পায় মহাজনকে। বাড়িতে অনেক কাজের লোক। তবে মহাজনের সব থেকে বিশ্বস্ত কাজের লোক ফণী। গত ছয় মাস আগে ভবদহের পাশ থেকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় উদ্ধার করা হয় মাস্টারকে। কে বা কারা প্রচণ্ড মারধর করে ফেলে রেখে যায়। পাশের গ্রামের নরেন ডাক্তার এসে পরীক্ষা করে বলে মাথায় প্রচণ্ড আঘাতের কারণে স্মৃতিশক্তি গেছে।

এ কারণে কেউই তার পরিচয় জানতে পারেনি। তবে কিছুদিন না যেতেই প্রচুর কাজ করতে থাকে সে মহাজনের বাড়িতে। মহাজন প্রথম প্রথম এই অনাকাঙ্ক্ষিত আগন্তুককে নিয়ে বিরক্তিতে থাকলেও এখন তার কাজে অনেক খুশি। মহাজন ফ্রিতে এমন একজন কাজের লোক পাবে ভাবতেই পারেনি! কিছুদিন পরে লোকজন দেখে এই আগন্তুক ছোট ছোট বাচ্চাদের ছড়া শেখাচ্ছে। সেখান থেকেই লোকজন তাকে মাস্টার নামে ডাকা শুরু করে।

সন্ধ্যার পরীক্ষা থাকায় প্রায় আট মাস বাড়িতে আসে না। কিন্তু এর মধ্যে যে বাড়িতে এত কিছু ঘটে যাচ্ছে, তা কিছুই জানতো না। সে অবাক হয়ে মাস্টার নামের এই লোকটার কথা শোনে। গ্রামের প্রায়ই প্রতিটি মানুষ লোকটাকে ভালোবাসে। সারাদিন ফণীসহ অন্যদের সঙ্গে পড়ে থাকে ভবদহের বিলে। বেশি কথা বলে না। চুপচাপ থাকে। সন্ধ্যায় পাড়ার বাচ্চাদের এক সঙ্গে নিয়ে সুর করে ছড়া শেখায় আবার গভীর রাতে ভবদহের বিল পাহারায় গিয়ে আপন মনে বাঁশি বাজায়।

সন্ধ্যার কেমন যেন মায়া হয় লোকটার প্রতি। সেদিন দুপুরবেলায় সন্ধ্যা বাড়ির সব কাজের লোককে খাবার বেড়ে দিচ্ছিল। অন্য সবাই যেখানে চিল্লাচিল্লি করছে, ‘মাছ দাও, মাংস দাও’ বলে; সেখানে মাস্টার নামের লোকটা শুধু ডাল দিয়ে খেয়ে চুপচাপ উঠে চলে গেল।

অন্যবার বাড়িতে এলে সন্ধ্যা উন্মুখ হয়ে থাকে, কখন যশোরের মেসে যাবে সবার কাছে। কিন্তু এবার যেন কেমন বাড়িতেই অনেক ভালো লাগছে। সেদিন মাস্টার স্নান করার জন্য যখন সরিষার তেল নিতে আসে, হঠাৎ সন্ধ্যা বলে ওঠে, ‘আমাদের বাড়িতে থাকতে কষ্ট হচ্ছে না তো?’

মাস্টার কিছু বলে না। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে মাথা নিচু করে চলে যায়। সন্ধ্যার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। মাস্টারের সঙ্গে একটু কথা বলার জন্য অনেক ছটফট করে। কী বলবে, কী দিয়ে শুরু করবে বাড়ির এই কাজের লোকটার সঙ্গে কিছুই মাথায় আসে না। তাই সুযোগ বুঝে আজকে এ কথাটাই বলে।

মাস্টার আর ফণী সারারাত ভবদহ বিলের পাশে অস্থায়ী ছাউনিতে ঘুমায়। ইদানীং ঘুমের মাঝে মাস্টার চিৎকার করে ওঠে। বলে, ‘ফণীদা আমারে মাইরে ফেইললো। ধরো আমারে।’ ফণীর ঘুম ভেঙে যায় মাস্টারের চিৎকারে। ফণীর একটাই সমস্যা, তার ঘুম ভেঙে গেলে মাথা কাজ করে না। আবোল-তাবোল বলা শুরু করে। প্রচণ্ড রেগে গিয়ে হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। প্রায়ই মাস্টার এ রকম ঘুমের ভেতর চিৎকার করা শুরু করেছে ইদানীং। সেদিন রাতে ঘুমের মধ্যে মাস্টার চিৎকার শুরু করলেই ফণী প্রচণ্ড রেগে বলে, ‘এই শালার ছওয়াল, তোরে মারবি কিডা? এইহানে এই ভবদহে আমরাই মারি। আর কোনো বাপের ব্যাটার সাহস আছে তোরে মারবি? কয়েক বছর আগে নিজির হাতে মারিছি একটারে। শালা, তোর ধারণা আছে কার সাথে থাহিস তুই?’ এই বলেই আবার ঘুমিয়ে যায় ফণী।

পরদিন থেকেই ফণীকে আর মাস্টারকে খুঁজে পাওয়া যায় না মনোহরপুর গ্রামে। সবাই হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে তাদের কিন্তু কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। মহাজনকে অনেক চিন্তিত দেখায়। গ্রামের সবাই মাস্টারের জন্য দুঃখ করতে থাকে। ফণীকে কেউ পছন্দ করতো না। এভাবে কেটে যায় প্রায় ছয়দিন।

সেদিন সকালে মহাজন বাড়িতে পুলিশে ভরে যায়। একটি কালো রঙের মাইক্রোবাস থেকে নামতে দেখা যায় মাস্টারকে। গায়ে পুলিশের পোশাক। বুকের পাশে নেমপ্লেটে লেখা হাসান জাহিদ। সবাই অবাক হয়ে যায়। গাড়ি থেকে খুড়িয়ে খুড়িয়ে নামে ফণী। গায়ে-মুখে প্রচণ্ড মারের দাগ।

মহাজনকে অ্যারেস্ট করা হয়। সন্ধ্যা ছুটে আসে। মাস্টার সবার উদ্দেশ্যে বলে, ‘প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি আমার পরিচয় গোপন করার জন্য। আমি ডিবির এসি হাসান জাহিদ। কয়েক বছর আগে এ গ্রামে ভবদহের বিলে সনাতন নামে একটি ছেলে পানিতে ডুবে মারা যায়। আসলে সনাতন পানিতে ডুবে মারা যায়নি। তাকে হত্যা করা হয়। তাকে হত্যা করে মহাজন আর ফণী। পানিতে চুবিয়ে। পরে পানিতে ডুবে মৃত্যু বলে চালিয়ে দেয়।’

চারদিকে সুনসান নীরবতা। মাস্টার একটু থেমে আবার বলে, ‘সনাতন আমার বন্ধু ছিল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে একই রুমে, একই বেডে আমরা ঘুমাতাম। সাঁতারের দিকে বরাবরই ওর খুব নেশা ছিল আমার মতো। আমরা পদ্মার উত্তালে স্রোতে সাঁতার কাটতাম। সেই বন্ধু একটা বিলের পানিতে ডুবে মারা যাবে? এটা সবাই বিশ্বাস করলেও আমি করিনি। তাই পুলিশে চাকরি হওয়ার পর নিজে থেকেই হায়ার অথোরিটিকে বলে সনাতন মার্ডার মিস্ট্রি নিয়ে কাজ শুরু করি। সে কারণেই এখানে আসা ছদ্মবেশ নিয়ে।’

উপস্থিত কারো মুখে কোনো কথা নেই। বলে যাচ্ছে তাদের প্রিয় মাস্টার, ‘আসলে সনাতন বুঝতে পেরে গিয়েছিল মহাজন ভবদহ বিলের সব ইজারা নিয়ে সাধারণ মানুষকে ধোকা দিচ্ছে। তাই সে এটা নিয়ে মহাজনের কাজের প্রতিবাদ করেছিল। মহাজন বুঝতে পারে, সনাতন ভবিষ্যতে তার পথের কাঁটা হতে পারে। তাই ফণীকে দিয়ে তার সাথে ভালো সর্ম্পক গড়ে। একদিন রাতে ভবদহে সাঁতার কাটবে এ নেশা ধরিয়ে সাঁতারের সময় ফণী আর মহাজন মিলে চুবিয়ে তাকে হত্যা করে।’

এসইউ/জিকেএস

আরও পড়ুন