শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব: মহীয়সী বঙ্গমাতা
নান্টু রায়
তাঁর ঘুম প্রগাঢ়। তবু আজ ঘুম ভেঙে গেল। একটানা ঘরঘর শব্দ। দূরে একটা কুকুরের কান্না শোনা গেল। রাতে এক পশলা বৃষ্টি হয়েছিল বুঝি! বাতাস কেমন ভেজা ভেজা ঠান্ডা। বাড়ি এ ক’দিন সরগরম ছিল। দূরের আত্মীয়-স্বজনদের অনেকে চলে গেছেন। কাছের যারা, আশেপাশের, তাদের অনেকেও চলে গেছেন। তবু নেই নেই করেও আজ রাতেও জনাপঁচিশেক মানুষ বাড়িতে আছেন। যা ধকল গেল! বাব্বা! হবে না! দু-দু’টো ছেলের বিয়ে বলে কথা! বাড়িতে দুটো নতুন বউ এসেছে! ওদের ছোট চাচা এসেছে খুলনা থেকে। রাস্তাঘাট ভালো না। নৌকা লঞ্চ বাস রিকশা কত রকমের হাঙ্গামা করে আসতে হয় খুলনা থেকে! তবু ভালো, সবাইকে জড় করা গেছে এক জায়গায়! ফরিদপুর, বরিশাল, খুলনা—কত কত জায়গায় না আত্মীয়-স্বজনেরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে!
প্রাচীন বংশ শেখদের। লতায়-পাতায় বিরাট গোষ্ঠী। কত দিকে কত যে আত্মীয়-স্বজন! না, একটু পান খেতে পারলে ভালো হতো! জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন। এখন আবার সুনসান অন্ধকার চারিদিক! শ্রাবণের আজ বুঝি ঊনত্রিশ ছিল—শুক্লপক্ষের নবমী। তাই চারিদিক এত আঁধার। রাত আর বেশি নেই। বালিশের নিচে কামালের বাবার ঘড়ি থাকে। হাতে নিয়ে দেখলেন—চারটে সতেরো। এই ঘড়িটার এই এক সুবিধা, রেডিয়াম দেওয়া, অন্ধকারেই ঘণ্টার কাঁটা মিনিটের কাঁটা বেশ বোঝা যায়! রাসেল বাবার পাশে ঘুমিয়ে। ভাবিদের পেয়ে তার আনন্দের শেষ নেই। সারা দিন দাপিয়ে বেড়িয়েছে। এখন বাপকে জড়িয়ে ধরে কেমন ঘুমাচ্ছে! বাপের খুব নেওটা হয়েছে। তাঁর মুখে স্মিত হাসি খেলে গেল। কামাল তার নতুন বউ সুলতানাকে নিয়ে ঘুমিয়েছে তিনতলায় তার নিজের ঘরে। দোতলায় তাঁদের শোবার ঘরের পাশে এক রুমে ঘুমিয়েছে জামাল তার বউ রোজিকে নিয়ে; আরেক রুমে ওদের ছোট চাচা নাসের।
এর মধ্যে সোবহানবাগ মসজিদে ফজরের আজান পড়ল। তিনি দরজা খুলে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেন। সেখানে কাজের দুটো ছেলে ঘুমিয়ে আছে। রমা আর সেলিম। এরা সারাদিন কাজ করে আর রাতে মরার মতো ঘুমায়। রমার ভালো নাম আবদুর রহমান শেখ। অন্ধকার ফিকে হয়ে আসছে। পাঁচটার মতো বাজে হয়তো। তিনি রমাকে ডাকলেন, ‘এই রমা ওঠ। নিচে গিয়ে দেখ, কারা যেন বাড়িতে ঢুকতে চাইছে। সেরনিয়াবাতের বাসায় দুষ্কৃতকারীরা হামলা চালিয়েছে।’
রমা ধড়ফড় করে উঠে ঘুম চোখে দৌড়ে নিচে নেমে গেল। রাস্তায় গিয়ে দেখল, কয়েকজন সেনা জওয়ান ক্রোলিং করে বাড়ির দিকে আসছে। সে তক্ষুণি ফিরে এসে পেছনের সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে তাঁকে খবর দিল, ‘আম্মা আর্মি আসতেছে।’
মুহূর্তে তাঁর হাত-পা যেন অসাড় হয়ে গেল। তিনি কোনোরকমে দরজার কাছে গিয়ে বললেন, ‘কামালের বাপ তাড়াতাড়ি ওঠেন, নিচে কাদের যেন পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে! রমা বলল, আর্মি আসতেছে। তাদের বুটের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে!’
আরও পড়ুন: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক আলোচিত উপন্যাস
কামালের বাবা ততক্ষণে বিছানায় উঠে বসেছেন। পরনে ধূসর চেক লুঙ্গি। পাঞ্জাবি গায়ে, কোলে টেলিফোন। পিএ মহিতুলের সঙ্গে কথা বলছেন।
এর মধ্যে রমা এক দৌড়ে তিনতলায় গিয়ে ‘আমাদের বাসা আর্মিরা আক্রমণ করেছে’ বলে কামালকে ডেকে ওঠাল। কামাল তাড়াতাড়ি একটা প্যান্ট ও শার্ট পরে নিচের দিকে চলে গেল। রমা কামালের স্ত্রী সুলতানাকে নিয়ে দোতলায় নেমে একইভাবে ‘আমাদের বাসা আর্মিরা আক্রমণ করেছে’ বলে জামালকেও ডেকে ওঠায়। জামালও তাড়াতাড়ি প্যান্ট-শার্ট পরে রোজিকে নিয়ে তাঁর রুমে এলো।
নিচে গেট খোলার শব্দ হলো। হুড়মুড়িয়ে কারা যেন বাড়িতে ঢুকে পড়ল। কামালের বাবা দরজা খুলে বারান্দায় এসে বাইরে মুখ বাড়ালেন। এত রাতে কারা ঢুকল বাড়িতে?
এ সময় নিচে গোলাগুলি শুরু হলো। একপর্যায়ে কামালের আর্তচিৎকার শোনা গেল। সঙ্গে সঙ্গে সিঁড়িতে বুটের শব্দ।
কামালের বাবা দ্রুত ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। নিচে প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ হচ্ছিল। তারপর এক সময় গুলির শব্দ থেমে গেল। কামালের বাবা অসম সাহসী। দরজা খুলে বাইরে এলেন। সঙ্গে সঙ্গে আর্মিরা তাঁকে চারপাশ দিয়ে ঘিরে ধরল। তারা তাঁকে নিয়ে নিচে নামাতে চাচ্ছিল বোধহয়! কামালের বাবা এগিয়ে গিয়ে সিঁড়ির মুখে দাঁড়ালেন। হাতে ধরা পাইপ। ধরাবার সময় পাননি। পেছনে সব অস্ত্রধারী সেনা জওয়ান।
আজানের ধ্বনির সঙ্গে নিতান্তই বেমানান চিৎকারে কথা বলছে এক আর্মি মেজর। মেজর মহিউদ্দিন। তার হাতে স্টেনগান। সে আছে সিঁড়ির মুখে নিচে।
যে মানুষ কাউকে কোনো দিন ভয় পাননি, আজ উদ্যত সঙ্গীন দেখে থমকে গেলেন, কিছুটা বিভ্রান্তও বটে! বললেন, ‘কী চাস তোরা?’ মেজর বিব্রত ভঙ্গিতে আমতা-আমতা করতে লাগল। তাঁর কঠিন ব্যক্তিত্বের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না। কামালের বাবা আবার বললেন, ‘তোরা কী চাস?’
মেজর মহিউদ্দিন বলল, ‘স্যার, একটু আসেন।’
‘কোথায়?’
মেজর আবারও আমতা-আমতা করে বলল, ‘স্যার, একটু আসেন।’
কামালের বাবা বললেন, ‘তোরা কি আমারে খুন করবার চাস? পাকিস্তান সেনাবাহিনী যে কাজ করতে পারে নাই, সেই কাজ তোরা করবি?’
আরও পড়ুন: বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাড়ি একটি ইতিহাস
স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে ছুটে এলো আরেক মেজর। মেজর নূর। খুনে মারকুটে চেহারা। চোখ লাল। কামালের বাবা তার দিকে ফিরে তাকানোর আগেই সে ব্রাশফায়ার করল। কামালের বাবা সিঁড়িতে লুটিয়ে পড়লেন।
রমা ছিল আর্মিদের পেছনে দাঁড়ানো। ‘আমি এ বাড়িতে কাজ করি’ বলায় আর্মিরা তাকে ভেতরে যেতে বলে। রমা তাঁদের বেডরুমের বাথরুমে আশ্রয় নিলো। সেখানে তাঁর সঙ্গে দুই বউমা, জামাল-রাসেল দুই ছেলে, দেবর নাসেরও আশ্রয় নিয়েছেন। নাসেরের হাতে গুলি লেগেছে, রক্ত ঝরছে। রক্ত দেখে রমা স্থির থাকতে পারে না। বলে, ‘বড়সাহেবকে আর্মিরা গুলি করেছে।’ তিনি ডুকরে কেঁদে উঠলেন। তারপর শাড়ির আঁচল ছিঁড়ে নাসেরের আঙুল বেঁধে দিলেন।
এরপর আর্মিরা আবার দোতলায় উঠে এসে দরজা পেটাতে থাকলে তিনি দরজা খুলে দেন, ‘মরলে সবাই একই সাথে মরব।’ আর্মিরা বাথরুমে ঢুকে সবাইকে নিচের দিকে নিয়ে আসছিল। সিঁড়িতে কামালের বাবার লাশ দেখে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়লেন। বললেন, ‘আমি যাব না, আমাকে এখানেই মেরে ফেলো।’ এই কথার পর আর্মিরা তাঁকে দোতলায় তাঁর রুমের দিকে নিয়ে গেল। একটু পরে ওই রুমে গুলির শব্দসহ মেয়েদের আর্তচিৎকার শুনতে পাওয়া গেল।
যে জীবন শুরু হয়েছিল টুঙ্গীপাড়ায় ১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট, আজ তার রক্তাক্ত পরিসমাপ্তি ঘটল। মাত্র ৮ বছর বয়সে ১৯৩৮-এ যখন বউ হয়ে এসেছিলেন, কামালের বাবার বয়স ১৮। তারপর হাসু জন্মাল ১৯৪৭-এ, পাকিস্তান হওয়ার ক’মাস আগে। ওই মেয়েটা লক্ষ্মী, ও জন্মাবার পর সংসারে উন্নতি শুরু হলো। সেই মেয়েটা বিদেশ-বিভুঁইয়ে পড়ে রইল ছোটবোনটাকে নিয়ে। এ জীবনে আর দেখা হলো না তাদের সঙ্গে। তীব্র হাহাকারের সঙ্গে তাঁর জীবনদীপ নির্বাপিত হলো। হায় জীবন।
পাদটীকা
আর্মিরা নাসের, রাসেল ও রমাকে নিচতলায় এনে লাইনে দাঁড় করায়। সেখানে সাদা পোশাকের একজন পুলিশের লাশ পড়ে ছিল। নিচে নাসেরকে লক্ষ্য করে জিজ্ঞাসা করে, ‘তুমি কে’, তিনি ‘শেখ নাসের’ বলে পরিচয় দিলে তাকে নিচতলায় বাথরুমে নিয়ে গিয়ে গুলি করে। ছোট্ট রাসেল ‘মার কাছে যাব’ বলে কান্নাকাটি করছিল আর পিএ মহিতুলকে ধরে বলছিল, ‘ভাইয়া, আমাকে মারবে না তো?’ এমন সময় একজন আর্মি তাকে বলল, ‘চলো তোমাকে তোমার মায়ের কাছে নিয়ে যাই’ বলে তাকে দোতলায় নিয়ে যায়। একটু পরেই কয়েকটি গুলির শব্দ ও আর্তচিৎকার ভেসে আসে।
আরও পড়ুন: বঙ্গবন্ধু শিশুদের যেভাবে ভালোবাসতেন
রমা, সেলিম, ডিএসপি নুরুল ইসলাম, পিএ মহিতুল হতাহত হলেও সেদিন সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যায়। এরপর কালো পোশাক পরিহিত আর্মিরা বাসার সব জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে যায়।
বাসার সামনে একটা ট্যাংক আসে। ট্যাংক থেকে কয়েকজন আর্মি নেমে ভিতরের আর্মিদের জিজ্ঞাসা করে ভেতরে কে আছে? উত্তরে ভেতরের আর্মিরা বলে, ‘All are finished.’
বেলা ১২টার দিকে আর্মিরা রমাকে ছেড়ে দিলে সে প্রাণভয়ে তার গ্রামের বাড়ি টুঙ্গীপাড়ায় চলে যায়।
মন্ত্রী সেরনিয়াবাত (বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি) এবং শেখ মণির (বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে) বাড়িতেও আর্মিরা একই সঙ্গে হামলা চালায়। শেখ মণি মারা গেলেন তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর সঙ্গে। পিতামাতার মৃত্যুদৃশ্য শিশু তাপস দেখল খাটের নিচে বসে। শিশুটি তখন কী ভাবছিল? কেবিনেট মন্ত্রী সেরনিয়াবাত মারা গেলেন তার দশ-পনেরো বছরের দুই কন্যা, এগারো বছর বয়সী এক পুত্র এবং মাত্র পাঁচ বছর বয়সী এক নাতির সঙ্গে।
তথ্যঋণ: দেয়াল (উপন্যাস), লেখক হুমায়ূন আহমেদ।
তথ্যকণিকা
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের নিজ বাড়িতে একদল সেনার হাতে নিহত হন। সেদিন তিনি ছাড়াও ঘাতকের বুলেটে নিহত হন তাঁর স্ত্রী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব। পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়-স্বজনসহ নিহত হন আরও ২৬ জন। দেশের বাইরে থাকায় বেঁচে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর ছোটবোন শেখ রেহানা। প্রতি বছর ১৫ আগস্ট জাতি গভীর শোক ও শ্রদ্ধায় স্মরণ করে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের, পালিত হয় জাতীয় শোক দিবস।
লেখক: রাজনীতিক।
এসইউ/জিকেএস