মুঠোফোনের কাব্য: কবিতার ভিন্ন আঙ্গিক
‘সমুদ্রের মতো এই উত্তাল উন্নিশে
তোমার হৃদয়-বন ভস্ম হলো কিসে?
প্রেমামৃতে? গুণের আগুনে?
নাকি কবির মতোই অনন্ত বিরহ-বিষে?’
প্রেমমাখা লাইনগুলো পড়ছিলাম ‘মুঠোফোনের কাব্য’ নামক চমৎকার এক কাব্যগ্রন্থ থেকে। কবির নামটিও বলবো বইয়ের কবিতার লাইন থেকে—
‘আসলে সে ছদ্মবেশী
শব্দ-অস্ত্রধারী ব্যাধ, অব্যর্থ অর্জুন।
আপাতত কবিরূপে—নির্মলেন্দু গুণ।’
হ্যাঁ, ‘মুঠোফোনের কাব্য’ বইটি জনপ্রিয় কবি নির্মলেন্দু গুণের লেখা। তাঁর কবিতার ভাষা, কাব্য-ক্ষমতা ও পাণ্ডিত্য সম্পর্কে আমাদের সবারই কম-বেশি ধারণা আছে। তাঁর কবিতা পড়েননি এমন পাঠক খুঁজে পাওয়া কষ্টসাধ্য বা অসম্ভবই বটে। কবি নির্মলেন্দু গুণের ‘মুঠোফোনের কাব্য’ কাব্যগ্রন্থটি নব আঙ্গিকে প্রকাশ করেছে কিংবদন্তী পাবলিকেশন।
বাংলা অভিধানে ‘মুঠোফোন’ শব্দটির সংযোজকও কবি নির্মলেন্দু গুণ। তাঁর আগে বাংলা ভাষায় এই শব্দ কেউ ব্যবহার করেননি। ‘মুঠোফোনের কাব্য’ গ্রন্থটিতে সর্বমোট ১৭২টি কবিতা আছে। যার মধ্যে কিছু আছে অণুকবিতা, কিছু আবার টানা গদ্যে লেখা, বেশ কিছু বড় কবিতাও আছে কাব্যগ্রন্থটিতে। অর্থাৎ কবিতার বিভিন্ন আঙ্গিকের এক দারুণ সংকলন ‘মুঠোফোনের কাব্য’। কাব্যগ্রন্থটির নাম দেখে অনেকেই হয়তো ভাবতে শুরু করে দিয়েছেন যে, এর নাম মুঠোফোনের কাব্য কেন? আমারও নাম নিয়ে কৌতূহল কাজ করছিল। পুরো বইটি পড়ে নামকরণের স্পষ্ট সার্থকতা বুঝতে পেরেছি। কাব্যগ্রন্থটিতে প্রেম, ধর্ম, দেশপ্রেম, মা ইত্যাদি বিষয়ক কবিতা আছে। তার মধ্যে অবশ্য প্রেম বিষয়ক কবিতার সংখ্যাই বেশি। উৎসর্গপত্রে কবি লিখেছেন—
‘মুঠোফোনের কাব্যের জননী
নূরে আফরোজ জামান চঞ্চু
আমার দুই কবি-বন্ধুনী
অদ্বিত্ব শাপলা ও মুশফিকা লাইজু শিমুল
প্রিয়তমাসু।’
কবি নির্মলেন্দু গুণের জন্ম নেত্রকোণা জেলার বারহাট্টা উপজেলার কাশবনে ২১ জুন ১৯৪৫ সালে। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’ প্রকাশিত হয় ১৯৭০ সালে। প্রথম কাব্যগ্রন্থই বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। তাঁর লেখা কাব্যসমগ্র আছে চারটি, গদ্যসমগ্র আছে চারটি, এছাড়া কিশোরসমগ্র, ভ্রমণসমগ্র, চারখণ্ডের আত্মজীবনী আছে। সেগুলো হলো- আমার ছেলেবেলা, আমার কণ্ঠস্বর, আত্মকথা ১৯৭১, মহাজীবনের কাব্য। কবি মাত্রই ভ্রমণপিয়াসী মনের অধিকারী। কবি নির্মলেন্দু গুণ ১৪টি দেশ ভ্রমণ করেছেন। কবিতা লেখার স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি পেয়েছেন স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারসহ ২৫টিরও বেশি পুরস্কার।
‘মুঠোফোনের কাব্য’ গ্রন্থটি রচনা করতে গিয়ে কবি নির্মলেন্দু গুণ গুরু মেনেছেন সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুরকার ও পিয়ানো বাদক জার্মানির ‘লুডভিগ ফান বেটহোফেন’কে। যা স্বীকারোক্তি স্বরূপ কবি লিখেছেন—
‘মুঠোফোনের কাব্য শুনে
বিঠোফেন বললেন:
ভালো হচ্ছে এভাবেই
প্রাচীন ঐতিহ্য ফের
লাভ করে নবপ্রাণ।
‘লিখে যান, আমি তো
এভাবেই তৈরি করেছি
আমার সিম্ফনি।’
গুরুর উসকানি পেয়ে
কবির অন্তরখানি
বাতাসের বক্ষ ভেদ করে
ছুটিল উল্কার বেগে
ইথারে-বিথারে।’
‘মুঠোফোনের কাব্য’ পাঠ করে বুঝতে পেরেছি, এর কবিতাগুলো মূলত মুঠোফোনে লেখা ক্ষুদেবার্তার কাব্যিক অবয়ব। সপ্তম কবিতায় কবি লিখেছেন—
‘অনেক দূরের আকাশ পাড়ি দিয়ে, তোমার ম্যাসেজ এইমাত্র আমার মুঠোফোনে প্রবেশ করেছে। পথে সে শ্রাবণের বৃষ্টিতে ভিজছে। তাই, আমি আমার নীল তোয়ালে দিয়ে খুব ভালো করে তার গা মুছে দিয়েছি।’
কবি মানস মাত্রই কি অস্থির আর অধৈর্য? কাব্যগ্রন্থটিতে অস্থির ও অধৈর্য নির্মলেন্দু গুণের নমুনা পাওয়া যায়। প্রিয়তমার বার্তা পেতে সবুর করতে রাজি নন তিনি। কবি চান সারাক্ষণ ডাকবে কোকিল অনবরত। কোনো বিরতি কবির পছন্দ নয়। কবি লিখেছেন—
‘তিন ঘণ্টা পর হঠাৎ তোমার একটা ‘কুহু’
চাই না আমি,—চাই না আমি।
আমি চাই মুহুর্মুহু কোকিল আমায়
ডাক পাঠাবে তার বাগানে।’
কাব্যগ্রন্থটিতে কবির দেশপ্রেমিক সত্তার সঙ্গে পরিচিত হতে পেরেছি। কাব্যিক ঢঙে কবিতায় দেশপ্রেম প্রকাশ করেছেন এভাবে—
‘আর কি আমি তোমায় ছাড়ি?
তুমি আমার শেষ-আশ্রয়, মাগো!
তুমি আমার দেশ, দুর্জয় ঘাঁটি।’
মা’কে নিয়ে আরও বেশ কয়েকটি কবিতা কাব্যগ্রন্থটিতে আছে। এছাড়া আছে গভীর ধর্মবোধের কবিতা। কবিতায় তিনি লিখেছেন—
‘ও মুসলমানের মা, ওঠেন, ওঠেন—
এখন রাইত চারটা বাজে।
সেহরি করার সময় হয়েছে।
বলি, হিন্দুর ছেলের ডাক কি
মুয়াজ্জিনের ডাকের মতোন
আপনার কানে বাজে?’
কাব্যগ্রন্থটিতে ভালো লাগার মতো অসংখ্য চরণে ভরপুর। তার মধ্যে আমার বিশেষ প্রিয় কিছু লাইন তুলে ধরা হলো—
১.
ভেবো না আমি সুযোগ বুঝে কোপ মারছি ঘাড়ে,
মিষ্টি হাতের মিষ্টি খেতে কেউ কখনও ছাড়ে?
২.
দরদ ভরা বক্ষ তোমার, প্রেমপূর্ণ প্রাণ,
কোন দুঃখে বন্ধু আমার হইবে পাষাণ?
৩.
আমাকে এমন পাগল করেছো তুমি
আলিঙ্গনে বেঁধেছ আকাশভূমি।
৪.
ধরো, তোমার জন্য পাঠালাম
একগুচ্ছ নীল আকাশের তারা।
খোঁপায় পরো, কপালে দাও টিপ
আকাশ দেখে হউক আত্মহারা।
৫.
মুঠোফোনে লেখা আমার কবিতা যেন
তোমার ঐ ছোট্ট নাক-ফুল।
৬.
ছি-ছি, কী লজ্জা! কী লজ্জা!
মাটির কবির লাগি
তুমি আকাশে পাতিলে শয্যা?
৭.
তোমার প্রেমে বৃষ্টি হবে,
সৃষ্টি হবে,—কাটবে খরা।
আমার প্রেম তো নয়, যে
ফেরত দেবে ডাকহরকরা।
৮.
তুমি যেনো শোন আর আমি যেনো ডাকি।
তুমি যেনো ভোল আর আমি মনে রাখি।
৯.
আমি কি আর সাধে তোমার নাম দিয়েছি ঘুম?
তুমি ঘুমের মধ্যেই ফুটাও ফুল, আনন্দ-কুসুম।
১০.
আমার চূড়ান্ত আনন্দ ধ্বনি ‘মা-আ’।
সব মিলিয়ে ‘মুঠোফোনের কাব্য’ একটি অসাধারণ কাব্যগ্রন্থ। এর কবিতাগুলো আমাকে দারুণভাবে মুগ্ধ করেছে। কবিতার বিষয়বস্তু, কবির অসাধারণ ভাষা দক্ষতা পাঠকের মন কেড়ে নেবে সহজেই। আমি বইটির বহুল প্রচার ও প্রসার কামনা করছি।
বই: মুঠোফোনের কাব্য
কবি: নির্মলেন্দু গুণ
ধরন: কাব্যগ্রন্থ
প্রকাশনী: কিংবদন্তী পাবলিকেশন
প্রচ্ছদ: চারু পিন্টু
মূল্য: ৩০০ টাকা।
এসইউ/জিকেএস