ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

সে আমাকে ভালোবাসেনি

সাহিত্য ডেস্ক | প্রকাশিত: ০২:১৫ পিএম, ১৭ জুন ২০২৩

জান্নাতুল নাঈম

নবীণ বরণ হবে। ঠিক নয়টায় উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছিল। আমরা উপস্থিত। অধ্যক্ষ স্যারসহ শিক্ষকরাও উপস্থিত। তবু অনুষ্ঠান শুরু হচ্ছে না। স্যার মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বললেন, ‘বাচ্চারা, আমি একটু সময় চেয়ে নিচ্ছি। আমাদের প্রিয় শিক্ষক শুভ্রা এখনো উপস্থিত হননি। তিনি আমাদের স্নেহের, আমি নিশ্চিত তিনি তোমাদেরও প্রিয় হবেন। কখনো দেরী করেন না।হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তবুও আসছেন।’

স্যার মাইক্রোফোনটা রাখতেই সেমিনার কক্ষে হাস্যোজ্জ্বল কেউ ডুকছেন। বয়স বেশি নয়। শাড়ি পরা। মেরুন রঙের শাড়ি।প্রত্যেকে সুদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন। ম্যাম এসেই চেয়ারে বসলেন। ক্ষাণিক পরেই মাইক্রোফোন হাতে নিলেন। বললেন, ‘আমার বাচ্চারা, তোমাদের স্বাগতম। তোমরা আসবে আর আমি বাসায় থাকবো, তা কি হয়? শোনো বাচ্চারা, কলেজে শিক্ষা নিতে এসেছো। তার বাইরে আমি তোমাদের অভিভাবক, বন্ধু হয়ে থাকবো। তোমাদের মানসিক যত সমস্যা, আমি সমাধান করার চেষ্টা করবো।’

আমাদের এক সহপাঠী মেয়ে আত্মহত্যা করেছে। পরদিন ম্যাম ক্লাসে উপস্থিত। বোর্ডে লিখতে গিয়ে ডাস্টার হাতে নিয়ে বললেন, ‘আমি তোমাদের বলবো যে কোনো সমস্যা আমাকে মন খুলে বলবে। যদি সেটা মা-বাবা কিংবা কাছের বন্ধুদের বলতে ভয় পাও। তবে আমাকে বলবে। আমি তোমাদের জন্য আছি। আমার স্বপ্ন, সাধনা সব তোমাদের নিয়ে। মনে রেখো, তোমরা যে জীবনের পথ পাড়ি দিচ্ছো, তা বড্ড আবেগের। নিজেকে মূল্যায়ন করতে শেখো।’ ক্লাস শেষে অনেকেই ম্যামের কাছে গেছে। ম্যাম পরদিন আবার ক্লাস নিতে গিয়ে বলেছেন, ‘মানসিক সমস্যা লুকানোর ব্যাপার নয়। আমি তাদের সাধুবাদ দেবো, যারা এ বিষয়ে খোলামেলা কথা বলে।’

বহু বছর পর। আমার কন্যা নীলার বছর চারেক হলো। আমার স্ত্রীর ডির্ভোসের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। আমার কন্যার দিকে তাকিয়ে ম্যামের কথা মনে পড়ে। ম্যামকে ফোন দিলাম, ‘ম্যাম, আপনি তো শুধু ছাত্রীদের মানসিক সমস্যা সমাধান করেন।ম্যাম, আপনি কি আমার জীবনের সমস্যা সমাধান করবেন? আপনি না করবেন না।’ ম্যাম বললেন, ‘তুমি কলেজে এসো না।তুমি বরং বাসার ঠিকানা দাও।’

ঠিক সন্ধ্যায় দরজায় কড়ানাড়ার শব্দ। আমার স্ত্রীও ম্যামের ছাত্রী। আমার স্ত্রী দরজা খুলেই ‘ম্যাম’ বলে কেঁদে উঠে সালাম করলো। ম্যাম মুচকি হেসে বললেন, ‘মিলু, কেমন আছো?’ আমার স্ত্রী বলল, ‘ম্যাম, অনেক ভালো আছি।’ ক্ষাণিক পরে ম্যাম আমার স্ত্রীর হাতের ভাঁজে হাত রেখে বললেন, ‘মিলু, আমার সংসার হয়নি। তাই তোদের সংসার নিয়ে পরামর্শ দেবো না। শুধু বলবো, তোরা দুজন সব ঠিক করে নে। মিলু, ভালোবাসা ছেড়ে যেতে নেই। এটা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মানসিক সম্পদ।ভালোবাসাকে জোড়া লাগাতে হয়। দুজন দুজনকে ক্ষমা করে সংসারটা কর। দেখ, নতুনভাবে সব শুরু করা যায় কি না।’ আমার স্ত্রী বলল, ‘ম্যাম, আপনি যা করেন, বলেন; তার সবটুকুতে ভালোই থাকে। আমি সংসারটা করবো।’ ম্যাম হাসতে হাসতে বললেন, ‘সংসার বড্ড সুখের।’ আমরা অবলোকন করলাম, ম্যাম একটি চাপা কষ্ট বুকে রেখেই কথাটা বললেন।

মাস কয়েক পর আমি ফোন করে বললাম, ‘ম্যাম, আমরা ভালো আছি।’ ম্যাম বললেন, ‘তোরা সুখী হঅ। তোরা তো জানিস, আমার অন্যের সুখ দেখতে ভালো লাগে।’ রাতে ছলছল চোখে আমার স্ত্রীকে বললাম, ‘ম্যাম কাকে এত ভালোবাসলো যে, বিয়ে করলেন না!’ আমার স্ত্রী বলল, ‘জানি না, কে ম্যামকে ভালোবাসলো না। এত ভালো মানুষটাকে ফিরিয়ে দিলো।’ বলতে বলতে আমার স্ত্রীর চোখ ছলছল করে উঠলো। ম্যাম ঠিকই বলেছিলেন, ‘আমি তোমাদের মাঝেই বেঁচে থাকবো।’ আজ আমরা ম্যামের দুঃখে কাঁদছি। যিনি অন্যের মানসিক দুঃখ লাঘব করেন, তার জীবনেই দুঃখ চিরস্থায়ী।

কিছুদিন পর হঠাৎ আমার স্ত্রী বলল, ‘এই শুনছো, ম্যামের একটা বই বের হয়েছে। বইয়ের নাম ‘সে আমাকে ভালোবাসেনি’।আমি উৎসুক হয়ে বললাম, ‘ম্যামের বইটা সবাই মিলে কিনতে যাবো। সবার সঙ্গে দেখাও হবে। চলো বন্ধুদের ফোন করি।’

দুদিন পর আমরা দশ বন্ধু দলবেঁধে বইমেলায় হাজির। আমাদের দেখে ম্যাম কেঁদে ফেললেন। এই প্রথম ম্যাম কাঁদছেন।বইয়ের ওপর ফোঁটায় ফোঁটায় চোখের জল পড়ছে। আমরা নীরবে দাঁড়িয়ে থাকলাম। আজ প্রত্যেকের বুকের ভেতর ঝড় বইছে। ভীষণ ঝড় বইছে।

এসইউ/জিকেএস

আরও পড়ুন