উত্তর-ঔপনিবেশিক নিসর্গতত্ত্ব ও আমিনুল ইসলামের কবিতা: পর্ব ০১
নাজিব ওয়াদুদ
আমিনুল ইসলামের কবিসত্তার উত্থান গত শতাব্দীর নব্বই দশকের শুরুতে। অবশ্য তিনি দশক নিয়ে মাথা ঘামান না। তার কোনও বইয়ের ফ্লাপে উল্লেখ নেই তিনি কোন দশকের কবি। তবে তিনি যে উত্তর-উনিবেশবাদী কবি তা স্পষ্ট তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘তন্ত্র থেকে দূরে’ থেকেই। এই গ্রন্থে অনেকগুলো উপনিবেশবাদবিরোধী কবিতা আছে। এই গ্রন্থের প্রথম কবিতা ‘অক্ষম উচ্চারণ’-এর একটি লাইন হচ্ছে—‘বর্গীর রেকর্ড মোছে বিশ্বব্যাংক ধূর্ত হাতে জলে ও ডাঙায়’। বিশ্বব্যাংক উপনিবেশবাদী ইউরো-মার্কিন শক্তিরই স্বার্থের প্রতিনিধি। তিনি তাকে শনাক্ত করেন এবং তার বিরুদ্ধে পরিহাসে সোচ্চার হন। ইউরোপ ও আমেরিকা আধুনিকতার নামে বিশ্বব্যাপী যে বেনিয়াবৃত্তি, শোষণ ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালাচ্ছে আমিনুল ইসলামের কবিতায় তার চিত্রায়ন এবং তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ রয়েছে। একই সাথে তিনি পরিবেশবাদী কবিও। তিনি সবসময় প্রকৃতিকে আশ্রয় করেন। প্রাচ্যীয় জীবনধারার মধ্যেই শান্তি, স্বস্তি ও জীবনের অর্থবহ পরিণাম খুঁজে নিতে চেয়েছেন তিনি। তার এই কাব্যপ্রবণতাকে উত্তর-ঔপনিবেশিক নিসর্গতত্ত্বের অনুগামী হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। আমিনুল ইসলামের এই বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করার আগে উত্তর-ঔপনিবেশিক নিসর্গতত্ত্ব সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ধারণা নেওয়া প্রয়োজন।
প্রকৃতি সাহিত্যের একটি অপরিহার্য উপাদান, তবে সাহিত্যের আঙ্গিক নির্ধারণে প্রকৃতি সাধারণত ভূমিকা পালন করে না, তার ব্যবহার সীমাবদ্ধ থাকে মূলত প্রেক্ষাপট ও চরিত্র চিত্রণের সহায়ক হিসেবে। বিগত শতাব্দীর একেবারে শেষদিকে সাহিত্যে প্রকৃতির ভূমিকা নিয়ে চিন্তা শুরু হয়। তারপর খুব দ্রুত এটি একটি সমালোচনাতত্ত্ব হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়, যদিও এখনো অবধি এটি প্রাথমিক পর্যায়েই রয়ে গেছে এবং এর কর্মপরিধি ও উদ্দেশ্য-লক্ষ্য নিয়ে নানান তর্ক-বিতর্ক চলছে।
১৯৮০ দশকের শেষদিকে এবং অপেক্ষাকৃত স্পষ্টভাবে ১৯৯০ দশকের প্রথমদিকে, যুগপৎ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে এই তত্ত্ব চর্চিত হতে শুরু করে। এই সমালোচনাতত্ত্বকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ‘ইকোক্রিটিসিজম’ (ecocriticism), বাংলায় ‘প্রতিবেশ সমালোচনাতত্ত্ব’ বলা হচ্ছে। ইতোপূর্বে আমি আমার এক প্রবন্ধে এটাকে ‘নিসর্গতত্ত্ব’ বলেছি। এর মূল প্রতিপাদ্য হলো সাহিত্যের সঙ্গে পরিবেশের বা বিশেষভাবে প্রকৃতির, সম্পর্ক শনাক্ত ও বিশ্লেষণ করা।
পরিবেশবাদী ভাবনা থেকেই নিসর্গতত্ত্বের উদ্ভব। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রসারের ফলে বিশ্বময় যে পরিবেশসংকট দেখা দিয়েছে তাকে কেন্দ্র করে পরিবেশ আন্দোলন গড়ে উঠেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন এলাকার ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশ আন্দোলনের পাঠ ও পর্যালোচনা ‘পরিবেশবাদ’ বা ‘পরিবেশতত্ত্ব’ (environmentalism) নামে একটি জ্ঞানশাখার জন্ম দেয়। এটি মূলত প্রকৃতি-বিজ্ঞানের একটি বিষয়। এর উদ্ভব বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে। ষাট এবং সত্তর দশকে শিল্প-কারখানার দূষণ আলোচনার কেন্দ্রে আসে। আশির দশকে এর সঙ্গে যুক্ত হয় আবহাওয়ার পরিবর্তনের বিষয়টি। এটিকে অবলম্বন করে সাংস্কৃতিক পরিপ্রেক্ষিতকে পর্যালোচনা করতে গড়ে ওঠে ‘প্রতিবেশ সমালোচনাতত্ত্ব’ (Ecocriticism), বা নিসর্গতত্ত্ব। এই তত্ত্ব অনুযায়ী সাহিত্য হচ্ছে প্রকৃতির সৌন্দর্যতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক উপস্থাপনা। যেহেতু মানবজীবনের অস্তিত্বের সঙ্গে প্রকৃতি ও পরিবেশের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য, সেজন্য পরিবেশ ও প্রতিবেশের ধারণার প্রয়োগ করে সাহিত্য অধ্যয়নের মাধ্যমে মানুষ ও প্রকৃতির আন্তঃসম্পর্কের পরিস্থিতি নির্ধারণ করতে চায় এই তত্ত্ব। অর্থাৎ কোনও একটা সাহিত্যকর্মে নিসর্গতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করছে কি না এবং কাজ করলে তার প্রবণতা কী সেটাই দেখার বিষয়। নিসর্গতাত্ত্বিক সাহিত্যবিশেষজ্ঞ লরেন্স বুয়েল মনে করেন নিসর্গতাত্ত্বিক সাহিত্যের চারটি বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে:
১. পরিবেশ কেবল সাহিত্যের কাঠামো নির্মাণ করেই ক্ষান্ত হবে না, মানুষের ইতিহাস যে প্রকৃতির ইতিহাসের মধ্যেই নিহিত ন্যূনপক্ষে তার বহিঃপ্রকাশ বা ন্যূনপক্ষে ইঙ্গিত থাকতে হবে;
২. মানুষের ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষাই একমাত্র বৈধ ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষা নয়, প্রকৃতির চাহিদাও সমান গুরুত্বপূর্ণ, এই প্রতীতীর প্রতিফলন থাকতে হবে;
৩. পরিবেশের প্রতি মানুষের দায়বদ্ধতাকে সাহিত্যিক প্রতিবেদনের নৈতিক ভিত্তি হিসেবে নির্মাণ করতে হবে;
৪. সাহিত্যিক প্রতিবেদনে পরিবেশকে একটা ধারণাগত পদ্ধতি বা ভাবনা হিসেবে দেখাতে হবে। (লরেন্স বুয়েল: ১৯৯৫-৭-৮)
নিসর্গতত্ত্বের দাবি হলো, সাহিত্যে প্রকৃতি ও পরিবেশ সম্পর্কে মানুষের যে-ধারণা তার বস্তুগত প্রয়োগ থাকতে হবে। কোনো একটা সাহিত্যকর্মের মধ্যে প্রকৃতি ও পরিবেশ সম্পর্কে সমকালীন দৃষ্টিভঙ্গি ও তার বাস্তব প্রতিফলনের চিত্র প্রস্ফুটিত হবে। নিসর্গতত্ত্ব পরীক্ষা করে দেখবে সাহিত্যে এইসব প্রতিফলন বস্তুনিষ্ঠ বাস্তবতা হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে কি না, প্রাকৃতিক অস্তিত্বকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে কি না, প্রতিফলিত মূল্যবোধ পরিবেশ ও প্রকৃতি সম্পর্কিত সমকালীন জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ কি না স্থান (তার পরিবেশ ও প্রতিবেশ সমেত), অর্থাৎ দেশ, ভিটে, বাড়ি বা বসবাসের জায়গার প্রতি বিশেষ টান, আকর্ষণ, দায়বোধ ও অঙ্গীকার নিসর্গতাত্ত্বিক সাহিত্যের প্রধান বিবেচ্য বিষয়। সে কারণে এর আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, এতে একটা বিশেষ কালের বিশেষ অঞ্চলের মানবসমাজ ও প্রকৃতি-পরিবেশের আন্তঃসম্পর্ক উঠে আসে। নিসর্গতত্ত্ব মানুষকে তার পরিপার্শ্বস্থ অন্য সবকিছুর সঙ্গে সম্পর্কিত করতে চায়। যাই হোক, নিসর্গতত্ত্বের সংজ্ঞা বা এর কর্মপরিধি বা কাজ সম্পর্কে এখনও কোনো সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। আমাদের কেবল এটুকু মনে রাখলেই চলবে যে, প্রকৃতি যেন সাহিত্যে নিজেই একটা প্রধান চরিত্র হয়ে ওঠে, যার পর্যালোচনা আমাদের তৎকালীন মানবসমাজ এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ সম্পর্কে ধারণা সৃষ্টি করবে।
নিসর্গতত্ত্বের জন্ম ইউরোপ-আমেরিকায়, এর চর্চাও এখনও প্রধানত ওই এলাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ, সে কারণে নিসর্গতত্ত্বের সঙ্গে রোম্যান্টিকতা, আধুনিকতা ও উত্তর-আধুনিকতার সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা শুরু হয়েছে ব্যাপকভাবে, যা একান্তই পাশ্চাত্যের অনুষঙ্গ। কিন্তু এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার প্রেক্ষাপটে এই তত্ত্বের প্রয়োগ ও পর্যালোচনা করতে গেলে ঔপনিবেশিক ও উত্তর-ঔপনিবেশিক তত্ত্বের পর্যালোচনা অপরিহার্য হয়ে পড়ছে। কেননা এ তিনটি মহাদেশ ইউরোপ-আমেরিকার ঔপনিবেশিক শাসনের শিকার। ঔপনিবেশিকতা এই দুই মহাদেশের রাজনীতিকেই কেবল নষ্ট করেনি, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও প্রকৃতিকেও সমানভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এদিক থেকে উত্তর-উপনিবেশবাদের সঙ্গে নিসর্গতত্ত্বের একটা সম্পর্ক আছে, যদিও এ সম্পর্কের বিষয়টি এখনও অনালোচিত। পরিবেশ সংকট অর্থাৎ নিসর্গের ক্ষতির জন্যে দায়ী মূলত শিল্পোন্নত দেশগুলো, দু’একটা ব্যতিক্রম বাদে আসলে ইউরোপ ও আমেরিকা, অর্থাৎ ঔপনিবেশিক শক্তি পাশ্চাত্য। এই কারণে পরিবেশ সংকটকে ঔপনিবেশিক সংকটেরই একটা ফল হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। নিসর্গতত্ত্বে কয়েকটি দার্শনিক বিশ্বাস ও কাঙ্ক্ষা গুরুত্ব পেয়েছে। যেমন, জটিল ও কৃত্রিম আধুনিকতা থেকে সরল ও আসল প্রাকৃতিক জীবনে প্রত্যাবর্তনের স্বপ্ন। কোনো কোনো নিসর্গবাদী আরও এগিয়ে বলেছেন, গ্রাম হচ্ছে সাময়িক নিষ্কৃতির জায়গা, আসল ও স্থায়ী নিষ্কৃতি মিলবে স্বর্গে প্রত্যাবর্তনে। নিসর্গতত্ত্ব রোম্যান্টিসিজমকে প্রশ্রয় দেয়। শৈশব, ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ জীবিকা, প্রকৃতিমগ্নতা, আত্ম-অচেতনতা, বৌদ্ধিক জাড্যতা এর বৈশিষ্ট্য। এসব কারণে নিসর্গতাত্ত্বিকরা রুশো, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কোলরিজ এবং কীটসকে ভীষণ পছন্দ করেন।
নিসর্গতত্ত্ব এখনও পুরোপুরি একটি সাহিত্যিক তত্ত্ব হিসেবে দাঁড়াতে পারেনি, কিন্তু দাঁড়াতে চাইছে। মার্কিন মুল্লুকে পরিবেশ সংকট নিয়ে উপন্যাস লেখা হচ্ছে। ইতোপূর্বে লিখিত সাহিত্যে পরিবেশ সংকট কীভাবে চিত্রিত হয়েছে তার অনুসন্ধান চলছে। সমালোচনা সাহিত্যের এই নতুনতর ধারাটি প্রচল তত্ত্বগুলোর, যেমন, উত্তর-উপনিবেশবাদ বা উত্তর-আধুনিকতাবাদ, কোনোটির সঙ্গেই সম্পর্কিত হতে চাইছে না। সে-ও একটি ঔপনিবেশিক মনোভাবের প্রতিফলন বলে মনে হয়। অথচ আমরা খুব সহজেই একে উত্তর-উপনিবেশবাদের সঙ্গে মেলাতে পারি। কারণ, উত্তর-উপনিবেশবাদের মূল লক্ষ্য উপনিবেশিতের নিজস্ব সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয় নির্মাণ করা। তার অন্যতম প্রধান উপায় হচ্ছে নিজস্ব প্রকৃতি ও লোকজ সংস্কৃতির কাছে প্রত্যাবর্তন এবং বিষয়, উপমা, প্রতীক, চিত্রকল্প এই প্রকৃতি থেকে আহরণ করা। আর লোকজ সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবন স্বাভাবিকভাবেই প্রকৃতি-নির্ভর। আঙ্গিক ও ভাষাও আসবে এই প্রকৃতি এবং তার মধ্যে জীবনযাপনকারী মানুষের জীবন থেকে। এভাবে একটা পর্যায়ে গিয়ে উত্তর-উপনিবেশবাদ ও নিসর্গতত্ত্ব হাত ধরাধরি করে হাঁটতে বাধ্য। সেজন্য আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা ও এশিয়া অর্থাৎ উপনিবেশিত এলাকার প্রেক্ষাপটে নিসর্গতত্ত্বকে উত্তর-ঔপনিবেশিক তত্ত্বের সঙ্গে মিলিয়েই অধ্যয়ন করতে হবে। সেক্ষেত্রে এটি কেবলই নিসর্গতত্ত্ব থাকছে না, এটি হয়ে উঠছে এই দুই তত্ত্বের সংমিশ্রণ, একেই আমি বলছি ‘উত্তর-ঔপনিবেশিক নিসর্গতত্ত্ব’। আমি ‘উত্তর-ঔপনিবেশিক নিসর্গতত্ত্ব’ বলতে বোঝাতে চাইছি, খুব সংক্ষেপে, সেই নিসর্গচেতনাকে যার মধ্যে উত্তর-ঔপনিবেশিক চেতনা প্রবল, বা যখন ঔপনিবেশিকতার বিরোধিতায় নিসর্গ বা নিসর্গচেতনাকে ব্যবহার করা হচ্ছে। এখানে উত্তর-উপনিবেশবাদ সম্পর্কে আর একটু বিস্তারিত আলোচনা করলে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে।
গত তিন দশকব্যাপী সাম্রাজ্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ এবং উপনিবেশবাদের সমালোচনা করে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে। এসব গ্রন্থ ও প্রবন্ধে লেখকদের দৃষ্টিভঙ্গি, তথ্য বিশ্লেষণ ও মতামতের মধ্যে যথেষ্ট ভিন্নতা থাকলেও এগুলোকে ‘উত্তর-উপনিবেশবাদী’ বলে শ্রেণিকৃত করা হয়। তার কারণ এসব রচনার সাধারণ আলোচ্য বিষয় ঔপনিবেশিক শাসন, তার প্রক্রিয়া ও কুফল এবং তার প্রতিক্রিয়া ও মোকাবেলা। ষোড়শ শতাব্দী থেকে আজকের দিন পর্যন্ত ঔপনিবেশিক ও উপনিবেশবিরোধী তৎপরতা ও সংঘর্ষের ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং কেতাবী পরিপ্রেক্ষিতকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে পর্যালোচনা করে উত্তর-উপনিবেশবাদী এইসব রচনা। এই চর্চার বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষিত শেষ পর্যন্ত উত্তর-উপনিবেশবাদকে একটি সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক সমালোচনাতত্ত্ব হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। এর মূল উদ্গাতা এডওয়ার্ড সাইদ। পরে যুক্ত হয়েছেন গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক, হোমি ভাবা, স্টুয়ার্ট হল, অনিয়া লুম্বা, জ্ঞানপ্রকাশ, এবং আরো অনেকে।
উত্তর-উপনিবেশবাদ শুরুতে সাহিত্যতত্ত্ব ছিল না। সাধারণ রাজনৈতিক উপনিবেশবিরোধিতা থেকে এর যাত্রা শুরু, যাকে সর্বপ্রথম কেতাবী রূপ দান করেন ফ্রাঞ্জ ফ্যানন তার বিখ্যাত ব্ল্যাক স্কিন, হোয়াইট মাস্কস (১৯৫২) এবং দি রেচেড অব দি আর্থ (১৯৬১) গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে। ফ্রান্সের বিরুদ্ধে আলজিরিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী এই মনোরোগ চিকিৎসক তার বইতে বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বিশ্বব্যাপী যেসব জাতীয়তাবাদী ও স্বাধীনতাকামী রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হয় সেগুলোকে সূত্রবদ্ধ করেন। তার আলোচ্য বিষয় অবশ্য সম্পূর্ণ রাজনীতিকেন্দ্রিক। তিনি দেখান উপনিবেশবিরোধী সংগ্রাম তিনটি পর্যায়ের মধ্য দিয়ে এগোয়। প্রথম পর্যায়ে উপনিবেশিত জাতি রাজনৈতিক চেতনা লাভ করে। দ্বিতীয় পর্যায়ে জাতি তার আত্মপরিচয় গড়ে তুলতে চায় নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির পুনরাবিষ্কার ও পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। আর তৃতীয় পর্যায়টা হচ্ছে সরাসরি সংঘর্ষের। আলজিরিয়াতে কাজ করতে গিয়ে ফ্যানন লক্ষ্য করেন, ঔপনিবেশিক শক্তি উপনিবেশিতের ওপর কেবল বস্তুগত শোষণই চালায় না, তার মনের ওপরেও এমন প্রভাব বিস্তার করে যে, সে নিজেকে অধমর্ণ বলে মনে করে। তার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের সঙ্গে-সঙ্গেই তার বিরোধিতা ও মোকাবেলাও সক্রিয় হয়, অর্থাৎ উত্তর-উপনিবেশ মানে উপনিবেশের পরবর্তী পর্যায় নয়। যাই হোক, বিংশ শতাব্দীর চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশক এবং তার পরে জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক বুদ্ধিজীবীরা জাতীয় স্বাধীনতা অর্জনের জন্যে জাতিকে উদ্বুদ্ধ করতে শুরু করেন। তাদের ওইসব আন্দোলনকে নৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভিত্তি দিতে গিয়ে তারা যেসব বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক যুক্তি খাড়া করেন সেগুলোই উত্তর-উপনিবেশবাদ তত্ত্বের প্রাথমিক ধারণা গড়ে তোলে।
চলবে...
লেখক: কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক।
এসইউ/জিকেএস