রামা কি আসলেই অসুস্থ
নীল আকাশের বুকের কালো মেঘ থেকে সাদা জল ঝরছে। বৃষ্টি। ঝিরিঝিরি। ফোঁটায় ফোঁটায়। তোড় কম কিন্তু অনবরত। অনেকক্ষণ যাবৎ টানা বৃষ্টি হওয়ায় কলেজের ছোট মাঠটার কোথাও কোথাও জল জমতে শুরু করেছে। বৃষ্টির ছোঁয়ায় মাঠের সবুজ ঘাসগুলো আশ্চর্য সৌন্দর্য ধারণ করেছে। দেখতে বেশ ভালোই লাগছে। সময়টা বোধহয় আষাঢ়ের কোনো একদিন। এই বৃষ্টি কখন থামবে, তা কেউ জানে না। এমনকি কলেজের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর অধ্যক্ষও নয়।
বৃষ্টি চলাকালীনই কলেজের ছুটির ঘণ্টা বাজলো। মহা মুশকিলে পড়া গেল। আমার মশাই ভুলো মন। আষাঢ়েও ছাতা আনিনি। এখন উপায় মাত্র দুইটা। হয়তো অপেক্ষা করো, নয়তো বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বাসায় যাও। বৃষ্টিতে ভিজলে আবার জ্বর, সর্দি লাগার ভয় আছে। তাই নিচতলায় এসে বৃষ্টি থামার অনিশ্চিত অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি।
হঠাৎ খেয়াল করলাম, আমাকে তানভীর ডাকছে হাত ইশারায়। বন্ধুদের সাথে ও ছাঁদে যাচ্ছে। বৃষ্টিতে শরীর অবগাহনের জন্য। একবার ভাবলাম, যাই; একটু ভিজি ওদের সঙ্গে। জ্বর-টর যা হবার হবে। হলে, পরে দেখা যাবে। তানভীরকে সম্মতি জানানোর আগেই পেছন থেকে আবার কেউ ডাকছে। বড্ড কোমল মায়াবী মেয়েলি কণ্ঠে, ‘কবি...’
ঘুরে তাকাতেই দেখলাম রামা আর রাইতা আসছে। ওদের দুজনকে দেখে তানভীরের বৃষ্টি ভেজার আমন্ত্রণ নাকোচ করে দিলাম। তানভীর চলে গেল। আমি ওদের দিকে এগিয়ে দুজনকে সালাম দিলাম। এরপরে তিনজন একটু এগিয়ে কোনো এক সিঁড়িতে বসলাম। একপাশে রামা আরেক পাশে আমি, মাঝে বসা রাইতা। হাব-ভাব, ভাব-ভঙ্গিতে বুঝলাম রামা অসুস্থ। তাই তো বলি, ও সবার আগে ভিজতে গেল না কেন! সুস্থ থাকলে ও ছুটতো সবার আগে।
রাইতা ওর ব্যাগ থেকে একটি কালো মলাটের ডায়েরি বের করল। গতকাল নতুন কী একটা যেন লিখেছে, সেটাই দেখাবে। লেখাটা বের করে আমার হাতে দিলো। আমি পড়তে শুরু করলাম। প্রথম লাইনটা যতদূর মনে পড়ে এরকম ছিল, ‘আমার মাথা তখন ব্যথায় ভোঁ ভোঁ করছে।’ মনোযোগ দিয়ে বেশখানিকটা পড়লাম। শেষ করার আগেই রাইতার ডানে বসা রামা বলল, ‘আমার শরীরটা বেশি খারাপ লাগতিছে। আমাকে একটু কোনো এক ক্লাসরুমে নিয়ে চলো।’
এ কথা শুনে রাইতা নিচুস্বরে ‘সর্বনাশ’ বলে আমার হাত থেকে ডায়েরিটা নিয়ে ঝটপট ব্যাগে ভরলো। রামাকে আলতোভাবে ধরলো রাইতা। ধীর পায়ে আমরা সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় চলে এলাম। সেখানে দেখা হলো সামিয়ার সাথে। রামার এ অবস্থা দেখে ও আমাদের সঙ্গে যুক্ত হলো। সিঁড়ির কাছে প্রথম রুমটায় রামাকে রাখলাম।
রাইতা ও সামিয়া পর্যায়ক্রমে ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করতে থাকে। ওদের সব প্রশ্নের জবাব ধীর গলায় দেয় রামা।
একটু বাদে রামা বলে ক্ষীণস্বরে, ‘আমার প্রচণ্ড ক্ষুধা লাগছে। কিছু খাব।’
আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলাম, ‘কী খাবে বলো? এক্ষুণি এনে দিচ্ছি।’
এবার বেশ স্পষ্টভাবে বলল, ‘আমি পেয়ারা খাব। আর রুটি খেতে ইচ্ছে করতিছে।’
বারো-তেরো না ভেবে সামিয়ার রঙিলা ছাতা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বৃষ্টির গতি বেড়েছে সাথে আকারও। আজই পদার্থবিজ্ঞান স্যার পড়ালেন তীর্যকভাবে পড়ন্ত বৃষ্টির মুখে ছাতা ধরার কৌশল। পদার্থের কৌশল নাকি সহজাত গুণের কারণে জানি না, মাথায় ছাতা ধরে কিছুটা নিস্তার পেলাম। যদিও বাঁশের কঞ্চির ন্যায় পা দুখানাকে রক্ষা করা যাচ্ছিল না। তাও কোনোমতে বৃষ্টি এড়িয়ে পথ চলতে লাগলাম।
কলেজের সীমানা পেরিয়ে রাস্তায় পৌঁছলাম। বৃষ্টিভেজা পিচের রাস্তা কিছুটা আয়নার মতো। রাস্তার বুকে কালো গম্ভীর আকাশের ছবি। হাতের বামের ফুটপাত ধরে কিছুদূর যেতেই পেয়ারা পেয়ে গেলাম। চড়া দরে আধা কেজি নিয়ে রুটি খুঁজতে পা বাড়ালাম। কিন্তু ঠিক কোন ধরনের রুটি কিনবো তা বুঝতে পারলাম না। নিশ্চিত হতে রামাকে ফোন করলাম। রিসিভ হলো। হ্যালো-ট্যালো না বলে সোজাসুজি জানতে চাইলাম, ‘আচ্ছা কী রুটি আনব? বনরুটি নাকি অন্য কোনো রুটি?’ ওপাশ থেকে জবাব এলো, ‘বনরুটি আবার কী জিনিস, কবি?’
বনরুটি কী জিনিস, তা বোঝানোর আগেই সংযোগ কেটে গেল। আবহাওয়া খারাপ হলে মরার নেটওয়ার্কও খারাপ হয়ে যায়। যেন এদের মধ্যে এক গোপন তবে শক্ত আত্মীয়তা বিরাজমান। যে লোক বনরুটি চেনে না, তাকে আর ফোন দেওয়ার মানে হয় না। এটা কোনো কথা হলো, বনরুটি চিনবে না!
এখন কী করবো, কোন রুটি কিনবো তা ভাবতে লাগলাম। ভাবছি আর হাঁটছি। সাথে বৃষ্টি পড়ার শব্দ শুনছি। কী মধুর শব্দ, আহা! এমন বৃষ্টির দিনে যদি রামা আমাকে একত্রে ভেজার জন্য ডাকতো, তাহলে কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে নেমে পড়তাম। নেমে পড়তামই।
পার্শ্বিক কোলাহল, অযাচিত শব্দে শান্তির ঘুমের অসুন্দর সমাপ্তি ঘটল। রামার না হলো পেয়ারা খাওয়া, না হলো রুটি! সামিয়ার ছাতাও ফেরত দেওয়া হলো না। পড়া শেষ করতে পরলাম না রাইতার লেখাটাও। কতগুলো টাকা দিয়ে পেয়ারা কিনলাম অথচ একটা কামড়ও বসানো হলো না। এক ঝুড়ি আফসোস নিয়ে দেওয়াল ঘড়ির দিকে চোখ ফিরতেই দেখি পৌনে এগারোটা। হায়রে কতটা দিন পেরিয়ে গেল। রামা কি আসলেই অসুস্থ!
তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে উঠে মোবাইল হাতে নিয়ে রামাকে কল দিলাম। দ্বিতীয় চেষ্টায় রিসিভ হলো—জিজ্ঞেস করলাম, ‘রামা কি আসলেই অসুস্থ?’
বৃষ্টিভেজা ঠান্ডা হাওয়ার মতো শীতল কণ্ঠে উত্তর এলো, ‘কবি, তুমি জানলে কী করে! কে বলল?’
উত্তরে আমার আর কিছু বলা হয়নি।
এসইউ/এএসএম