সৈয়দ শামসুল হকের কাব্য রচনার রূপরেখা
ড. মো. সানোয়ার হোসেন
বাংলাদেশের শিল্পী-সাহিত্যিকদের নিরন্তর ভালোবাসা ও প্রশংসার আলোকিত নাম সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬ সালে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেণ। তাঁর প্রতি রইলো শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
সৈয়দ শামসুল হক বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন মাধ্যমে শিল্প রচনা করে প্রতিভার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেও তিনি উভয় বাংলায় কথাসাহিত্যিক বা ঔপন্যাসিক হিসেবে অধিক পরিচিত। তাঁর রচিত প্রতিধ্বনিগণ কবিতার গ্রন্থে আছে—‘সৈয়দ শামসুল হক আধুনিক বাংলা কবিতার বিরল প্রতিভাবান কবিকর্মীদের একজন, যদিও কথাশিল্পী হিসেবেই তার সমধিক পরিচিতি’। সৈয়দ শামসুল হক নাট্যকার হিসেবেও উভয় বাংলায় বহুল পরিচিত। তবে একথা বলা প্রয়োজন যে, তিনি বাংলা সাহিত্যের লেখক, পাঠক, দর্শক, সমালোচক, গবেষক এবং নন্দনতাত্ত্বিকদের কাছে ‘সব্যসাচী’ লেখক হিসেবে অধিকমাত্রায় পরিচিত।
সৈয়দ শামসুল হক সাহিত্যচর্চার শুরুতে পাশ্চাত্যের শিল্পরীতি অনুসরণ করলেও শেষ পর্যন্ত তিনি শিল্প রচনায় প্রাচ্যকেই শিল্পভূমি হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তিনি নাটক, গল্প, উপন্যাস রচনায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন নিরন্তর। ফলে তাঁর শিল্প রচনায় প্রযুক্ত হতে দেখা যায় নানা মাত্রায় নতুনত্বের বৈশিষ্ট্য। এই নতুনত্বের বৈশিষ্ট্য তিনি তৈরি করেছেন ভাষা প্রয়োগে, রচনার বিষয়বস্তুতে, কাহিনি ও চরিত্র নির্মাণে, বিশেষ করে আঙ্গিক বা রচনার গড়ন কৌশল উপস্থাপনে। বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্রের মত দ্যূতিময় এই লেখকের কাব্য রচনার রূপরেখা সংক্ষিপ্ত পরিসরে আলোচনা করা অত্র প্রবন্ধের মূল বিষয়।
সৈয়দ শামসুল হকের সাহিত্যজীবন শুরু হয়েছিল কবিতা রচনার মধ্যদিয়ে। যতদূর জানা যায় সৈয়দ শামসুল হক পঞ্চম শ্রেণিতে অধ্যায়নকালে স্কুলের একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত দুই পাখি কবিতা আবৃত্তির মাধ্যমে কবিতার সঙ্গে তাঁর প্রথম পরিচয় ঘটে (সৈয়দ শামসুল হক, কিশোরসমগ্র, আমার স্কুল)। অতঃপর এই কবি বার বছর বয়সকালে লেখেন: আমার জানালার পাশে একটি গাছ রহিয়াছে/ তাহার উপরে দু’টি লাল পাখি বসিয়াছে। (সৈয়দ শামসুল হক, কবিতাসংগ্রহ, ভূমিকা দ্রষ্টব্য)
কবির ভাষ্যমতে, অন্ত্যমিলসমেত উল্লিখিত দুই লাইনের কবিতা বা পদ রচনার মাধ্যমেই শুরু হয়েছিল তাঁর কবিজীবন বা কাব্য ভাবনার জগৎ। অতঃপর অনেকটা আকস্মিকভাবে ১৯৫৩ সালে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশের সংকলনে তিনি কবিতা লেখেন। মূলত এরপর থেকেই তিনি কবিতা রচনায় পূর্ণ মনোনিবেশ করেন। তাঁর কাব্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় ‘একদা এক রাজ্যে’। এই গ্রন্থ সম্পর্কে লেখক নিজেই বলেন—‘তেইশ বছর বয়সে লেখা আমার এই কবিতা—একদা এক রাজ্যে—এই নামটি বহন করেই প্রকাশিত হয়েছিল আমার প্রথম কবিতার বই (সৈয়দ শামসুল হক, মার্জিনে মন্তব্য)।’ একদা এক রাজ্যে কবিতায় কবি সৈয়দ শামসুর হক ‘ছন্দ হিসেবে গদ্যস্পন্দনকে সচেতনভাবে ব্যবহার করে’ নারী প্রেমের ও চলমান জীবনের এক অসাধারণ চিত্রকল্প অঙ্কন করেছেন। যার শিল্পরস পাঠক বা মানবমনে সৃষ্টি করে অন্য এক জগৎ, অন্য এক রাজ্য। সেই রাজ্য একান্তই নিজস্ব, আপন ভুবন। যেখানে কল্পনার রেখাচিত্র ক্ষণে ক্ষণে আসা-যাওয়া করে।
এরই ধারাবাহিকতায় প্রকাশিত হয় তাঁর বিরতিহীন উৎসব, বৈশাখে রচিত পঙক্তিমালা, প্রতিধ্বনিগণ, অপর পুরুষ, নিজস্ব বিষয়, পরাণের গহীন ভিতর, এক আশ্চর্য সঙ্গমের স্মৃতি, বেজান শহরের জন্যে কোরাস, রজ্জুপথে চলেছি, অগ্নি ও জলের কবিতা, কাননে কাননে তোমারই সন্ধানে, আমি জন্মগ্রহণ করেনি, নাভিমূলে ভষ্মাধার ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থ। এ ছাড়াও সৈয়দ শামসুল হকের প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে আছে অধোগামী দিনের পঞ্জিকা এবং অস্তিত্ব পথিক আমি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, কবির ভাষ্যমতে উপরোক্ত কাব্যগ্রন্থে প্রকাশিত কবিতাসমূহ এবং আরও অল্প কিছু কবিতার সমন্বয়ে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর কবিতাসংগ্রহ মিরোনামকৃত গ্রন্থ। এতদ্ব্যতীত তাঁর অন্যান্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে আছে—সবুজ নীল লাল জামা, বুকের লবন আর চোখের ম্যাজিক, বর্বরেরা আসছে এবং শ্রেষ্ঠ কবিতা।
লেখক জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিচিত্র বিষয় এবং নানা আঙ্গিকে কবিতা রচনা করে তিনি আধুনিক বাংলা কাব্য সাহিত্যে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছেন। কেননা অন্যান্য কবিদের রচিত কবিতার তুলনায় তাঁর কবিতার বিষয় ও গঠন কৌশলে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের দাবিদার। তিনি কবিতা রচনায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন বারবার, লিখেছেন গদ্য-পদ্যের মিশেলে অসংখ্য কবিতা। একই সঙ্গে চৌদ্দমাত্রার পয়ার ছন্দে তিনি রচনা করেছেন দীর্ঘ কবিতা বৈশাখে রচিত পঙক্তিমালা। এখানে তিনি ‘কবি-কবিতাকে একটি প্রতীক’ হিসেবে দেখেছেন এবং সে জন্যেই তিনি ‘মানবের স্বপ্নসমূহের অনুবাদককেই কবি বলেছেন’। এই অনুবাদক বলতে তিনি এখানে কবি কিংবা অন্য কোনো মাধ্যমের সৃজনশীল লেখক আপন মনে যা ধারণ করেন, লালন করেন অথবা কল্পনার নানা রং ও রেখা খেলা করে তা শব্দমালায় প্রকাশ করাকেই বুঝিয়েছেন।
বৈশাখে রচিত পঙক্তিমালা’র পর তাঁর কাব্যগ্রন্থ প্রতিধ্বনিগণ প্রকাশিত হয়। কাব্যগ্রন্থটির শুরুতেই ‘নতুন বছরের ভোজসভায় জনৈক আমলা-কবির বক্তৃতা’ শীর্ষক কবিতাটি স্থান পেয়েছে। উক্ত শিরোনাম থেকেই বোঝা যায় কবিতাটির বুনন বক্তৃতা বা ভাষণের ঢঙে বা রীতিতে রচিত। আর সাধারণ অর্থে বক্তৃতা পদ্যে নয়, গদ্য ছন্দেই প্রকাশিত হয়। সেই হিসেবে কবি আলোচ্য কবিতায় গদ্য ছন্দ ব্যবহার করেছেন। কবিতাটির শুরুতেই আছে: ‘সমবেত প্রাজ্ঞজন, পরিনামে ধনতন্ত্র আমাদের সংহার করে।/ কিংবা সে নিজেকেই। যদি সে নিজেকেই করে, আমাদেরও/ সহযাত্রী হতে হয় অবশ্য নিয়মে।’
উপরোক্ত পঙক্তিতে নাটকের প্রস্তাবনার বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। এভাবে নাটকের প্রস্তাবনা, নাটকের সংলাপ, ভাষণ বা বক্তৃতা, গদ্যছন্দ কিংবা গ্রামে বসবাসরত কৃষিজীবী মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের চলমান ভাষা কিংবা কখনো আঞ্চলিক ভাষার সুর কবিতার ছন্দ ও অলঙ্কার যথাযথভাবে প্রয়োগ করে কবি রচনা করেছেন আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাসমূহ। আলোচ্য গ্রন্থে যারা বলেন, আপনার নতুন কবিতা কই শীর্ষক শিরোনামকৃত কবিতায় কবি শারীরিকভাবে বেঁচে থেকেও কালপরম্পরায় বেঁচে থাকার আত্মপ্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।
অতঃপর নিজস্ব বিষয় কবিতাটির নাম অনুসারে প্রকাশিত কাব্য গ্রন্থের ‘সবিনয় নিবেদনে’ কবি নিজেকে একজন ‘মিশনারী’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এ বিষয়ক কবির ভাষ্য উদ্ধৃত হলো: ‘এ বইয়ের অধিকাংশ রচনাই গদ্যে লেখা। আমার সম্পর্কে লঘুকণ্ঠে আমারই একটি প্রিয় বর্ণনা এই যে, আমি কবি, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক বা গল্প লেখক নই, আমি একজন মিশনারী মাত্র। লেখার ভেতর দিয়ে আসলে আমি একটি কাজই করে যাবার চেষ্টা করছি, আর তা হলো জীবন এবং ভাষা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে ন্যূনতম একটি মান আমাদের আয়ত্বের ভেতর নিয়ে আসা। হয়ত এ বইয়ের কোনো কবিতায় তিরিশ বছরের সেই ইচ্ছার বিবরণ লক্ষ্য করা যাবে’।
উল্লিখিত উদ্ধৃতি থেকে সুস্পষ্টরূপে বোঝা যাচ্ছে যে, সৃজনশীল লেখক হিসেবে সৈয়দ শামসুল হক কবি, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক কিংবা গল্পকার ইত্যাদি পরিচয়ে পরিচিত হতে চাননি। তিনি তাঁর ভাবনাগুলো শব্দমালায় প্রকাশ করার প্রয়াসী ছিলেন মাত্র। তাঁর এই বক্তব্যের অন্তঃমূলে যেনবা সেলিম আল দীন কৃত ‘দ্বৈতাদৈতবাদী’ শিল্পতত্ত্বের সুর অনুরণিত হয়। কারণ শিল্প রচনায় তিনি আঙ্গিকের বন্ধনটি মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন না, উপরোক্ত উদ্ধৃতিই এ কথার প্রমাণ বহন করে। অন্যদিকে তাঁর পরাণের গহীন ভিতর কাব্যগ্রন্থে প্রকাশ পেয়েছে কবির ভাবনা, অনুভব, উপলব্ধি এবং নানা প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধানী কাব্যিক চিত্রপট। গ্রন্থটিতে ধৃত কবিতায় নারী ও পুরুষের প্রেম ভালোবাসার চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। প্রথমত, কবি পুরুষের প্রতি নারীর আহ্বান এবং সেই আহ্বানের মধ্যদিয়ে নারীর সর্বাঙ্গের সৌন্দর্য বর্ণনা করেছেন এবং দ্বিতীয়ত, নারী পুরুষের কাম-আকাঙ্খার চিত্রপটে কবি নারীকে ফসলি জমির মাঠ এবং পুরুষকে ফসলি জমির সেই মাঠের চাষি হিসেবে চিত্রিত করেছেন। অন্য কবিতায় কবি বিস্তীর্ণ ফসলি মাঠে মৃদুমন্দ বাতাসের ছন্দে ছন্দে বেড়ে ওঠা যুবতির প্রেমাকর্ষণের খেলা রূপায়ণ করেছেন। এসব কবিতা বা সনেট রচনা করতে গিয়ে কবি পূর্বপুরুষের সন্ধান করেছেন। এই জন্যেই কবি বলেন—‘এই সনেটগুলো লিখতে গিয়ে বারবার আমি অনুভব করেছি, আমার পেছনে অজানা অচেনা লোককবিদের উপস্থিতি’। সব মিলিয়ে বলা যায় ‘সমকালীন দৃষ্টি ও দর্শনকে বলি না দিয়ে’ সৈয়দ শামসুল হক আলোচ্য গ্রন্থে মূলত ‘আঞ্চলিক ভাষার প্রেমের কবিতা’ই রচনা করেছেন।
কবিতার বিষয়বৈচিত্র্য, ভাষা, ছন্দ-অলঙ্কার এবং কবিতার রূপ সন্ধানে নিরন্তর প্রয়াসী সৈয়দ শামসুল হক এ পর্যায়ে রচনা করেন অন্তর্গত এবং বেজান শহরের জন্যে কোরাস কাব্যগ্রন্থ। অন্তর্গত কাব্যগ্রন্থে কবি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা আকবর হোসেনের জীবনচিত্র গদ্যছন্দ এবং কখনো কখনো রংপুরের আঞ্চলিক ভাষা প্রয়োগে, অনেকটা ঐতিহ্যবাহী বাংলা নাটকের গড়নকৌশলে নির্মাণ করেছেন স্বাধীনতা যুদ্ধের কাব্য কাহিনি। বেজান শহরের জন্যে কোরাস কাব্যগ্রন্থটির নামকরণের সঙ্গে কোরাস শব্দটি সম্পৃক্ত থাকলেও তা নাটকের কোরাস নয়, কবিতার কোরাস। বেজান শহরের জন্যে কোরাস কবিতাটি ছাড়াও এতে আছে—স্বাধীনতা, এই দিবস, এই ঘণ্টাধ্বনি, অসমাপ্ত পঙক্তিগুলো আজ, কোনো শোকগাথা নয়, আমি একটুখানি দাঁড়াব, আর কত রক্তের দরকার হবে, নৌকায় চিত্রকর কাইয়ুম চৌধুরী, আমার কন্যারা, এখনই তো, এবং এমন হওয়াই সম্ভব। বক্ষমান গ্রন্থটির শুরুতেই স্থান পেয়েছে গ্রন্থনামকৃত কবিতা বেজান শহরের জন্যে কোরাস। কবি তাঁর এই কবিতায় একটি শহরের অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের স্বপ্নছায়া নাটকীয় গড়নকৌশল অনুসরণে রূপায়ন করেছেন। কিন্তু কবির আশা-আকাঙ্ক্ষার স্বপ্নতরী ভাসমান নয়, চলমান। সেজন্য তিনি শুধু এই কবিতায় নয়, আলোচ্য গ্রন্থের অধিকাংশ কবিতার বিষয়বস্তু একটি শহর কিংবা বর্তমান বাংলাদেশের ভূ-খণ্ড নির্মাণ ও বিনির্মাণে যে রক্তস্রোত বহমান তারই ছায়াচিত্র অঙ্কন করেছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসের পাতায় পাতায় যে রক্তচিহ্ন পড়েছে কবি তা আর দেখতে চান না, শুনতে চান না, উচ্চারণ করতে চান না সেসব ঘটনার শোকবাণী। এই জন্যই কবি বলেন: আমরা বলছি, না কোনো শোকগাথা নয়।/ এক জীবনের পক্ষে আমরা অনেক দেখেছি—/ হিরোসীমা, গণহত্যা, স্বাধীনতা,/ দিল্লীতে প্রার্থনা সভা/ ধানমন্ডি বত্রিশ নম্বর;/ একটি প্রজন্মের পক্ষে আমরা দেখেছি অনেক।’
তাঁর অধোগামী দিনের পঞ্জিকা কাব্যগ্রন্থে প্রকাশিত কবিতাসমূহের মধ্যে গ্রন্থনাম শীর্ষক কবিতাটির গড়নকৌশল হিসেব প্রতি পাঁচ লাইন অন্তর অন্তর সৃষ্টি হয়েছে এক একটি দৃশ্যচিত্র। মূল কবিতার উপশিরোনাম হিসেবে এতে প্রকাশ পেয়েছে গ্রাম বাংলার যুবতি নারীর প্রেম ভালোবাসার পরিণতির দুঃখ-যন্ত্রণাদায়ক কল্পচিত্র। অস্তিত্ব পথিক আমি কবিতায় কবি সৈয়দ শামসুল হক একজন ব্যক্তিচরিত্রের প্রাত্যহিক জীবনচিত্র থেকে শুরু করে একটি রাষ্ট্রের সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরেছেন। কবি কল্পনায় পূর্বপুরুষের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে নিজের অস্তিত্ব অনুসন্ধান করতে গিয়ে মূলত সর্বকালের সর্ব মানুষের অস্তিত্ব শব্দমালায় চিত্রিত করেছেন এভাবে: কারো পথ ভিন্ন নয় নিসর্গে বা সংকটে: বস্তুত/ সব পথ অবিকল সর্বকালে সব অন্বেষার,/ যদিও পথিক ভিন্ন কিন্তু পথ—পরিচয় এক;/ আমি কিম্বা পিতা, পিতামহ, অপিত প্রপিতামহ,/ আরো উর্ধ পূর্বপুরুষেরা—সকলেই পথগত/ বটে; পথ অগ্রসর হয় ধীর ক্রমবাহিকায়—’
সৈয়দ শামসুল হকের কাব্য রচনার উল্লিখিত রূপরেখায় প্রত্যক্ষ করা যায়, বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ, নারী পুরুষের প্রেম-ভালোবসা, বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের দ্বন্দ্ব এবং ব্যক্তিগত জীবন দর্শন। এভাবে একের পর এক কবিতা রচনা করে কবি সৈয়দ শামসুল হক কবিতার জগতে আপন ভুবন নির্মাণ করেছেন। সমসাময়িককালের অপরাপর কবিদের রচিত কবিতার বিষয়, ছন্দ-অলঙ্কার এবং গঠনশৈলীর তুলনায় তাঁর কবিতা ব্যতিক্রম। কারণ নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে তিনি তাঁর কবিতাকে স্বতন্ত্র ধারায় রূপায়িত করেছেন। সর্বশেষে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, সৈয়দ শামসুল হক তাঁর সৃষ্ট কবিতার শিল্পগুণেই বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে স্বমহিমায় উজ্জ্বল হয়ে থাকবেন।
লেখক: অধ্যাপক, নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, সাভার, ঢাকা।
এসইউ/জিকেএস