নিরীহ হাওয়ার নদী: কবির হারানো শৈশব
জব্বার আল নাঈম
কবিতা হলো সত্যের অনুসন্ধান। আর সেই সত্যকে ধারণ করতে পারেন একজন কবি। কারণ সেখানে হৃদয় থাকে। হৃদয়ের স্পন্দন থাকে। আরব দেশে কবিকে ‘বংশের ঐশ্বর্য’ ভাবা হলেও বঙ্গদেশে ভাবা হয় প্রেমিক অথবা বিদ্রোহী। কবিসত্তাকে পৃথিবীর একেক দেশ একেক উপমায় চেনে। কোনো কোনো দেশে কবিকে সাধারণভাবে দেখা হয়। যদিও কবি সাধারণ কোনো সত্তা নয়। এদিক দিয়ে একজন রেজা নুর নিজেকে নিয়ে গর্ববোধ করতে পারেন। কারণ তিনিও কবিবংশের একজন উত্তম প্রতিনিধি।
কবিরা কাব্যশক্তির মাধ্যমে সেই অর্জনকে ধরে সমাজ ও রাষ্ট্রে নিজের অবস্থান তৈরি করে চলেছেন। সেখানে সূর্যের মতো প্রতিনিয়ত আলো ছিটিয়ে যাচ্ছেন কবি রেজা নুর। সময়ের সঙ্গে নিজেকে নিয়োজিত রেখে সোনায় পরিণত করে চলেছেন। লিখছেন অসাধারণ গদ্য ও পদ্য। দেশ থেকে বহুদূর গিয়ে অনিন্দ্য নান্দনিকতা মিশিয়ে লিখছেন কবিতা। যা চাঁদের মতো অন্ধকারে মিষ্টি আলো দেয়। আর প্রেমের তরীতে ভাসতে থাকে যৌথ জীবন। সেখানে এসে রেজা নুর জানান দেন:
‘সেদিনও সকাল হয়েছিল।
অসহিষ্ণু সূর্য আমিনা’র জানালায় রেখেছিল অজানা আলো।
গভীর যেন অন্ধকারে—জোনাকির ঝাঁক-বাতাসও অবাক, এমন শিশু-ঘ্রাণ কখনো পায়নি আগে।’
কিংবা
‘আজও অনুভব করি আমি বাতাসের লতানো শরীরে বিষণ্ন বারুদের গন্ধ।
বেয়োনেটের সুতীক্ষ্ম ফলা হৃদয়ে জাগায় কালের শিহরণ।’
কবিতা অমিমাংসীত সত্য শব্দের বন্ধন। যা বোধের প্রতিটি দরজায় টোকা দিয়ে ফুল ফোটায়। আনন্দ দেয়। ভাসায় কিংবা হাসায়। বিনোদন মানব জীবনে অবিচ্ছেদ্য এক অংশ। যা কোনোভাবেই কারো পক্ষে উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। কারণ লৌহজীবন মৃত্যুর নামান্তর। কবিতার আনন্দে থাকে চূড়ান্ত পর্যায়ের সৌন্দর্য, মানুষ আশায় বুক বাঁধে।
আবার সব কিছু-হারানো মানুষের কাছেও কবিতা বেঁচে থাকার রসদ। দূরগামীর জন্য নিজেকে ধরে রাখা বা টিকিয়ে রাখার মোক্ষম হাতিয়ার। কবিতা শুধু যে একজন কবির জন্য অন্যরকম রসদ তা নয়, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর ‘আমি কিংবদন্তির কথা বলছি’তে কবি দেখাতে চেয়েছেন—
‘যে কবিতা শুনতে জানে না
সে ঝড়ের আর্তনাদ শুনবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে দিগন্তের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে আজন্ম ক্রীতদাস থেকে যাবে।’
কবিতাটি এখানেই শেষ করতে পারতেন, কিন্তু তা না করে, আরও বললেন—
‘যে কবিতা শুনতে জানে না
সে নদীতে ভাসতে পারে না।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে মাছের সঙ্গে খেলা করতে পারে না।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে মা’য়ের কোলে শুয়ে গল্প শুনতে পারে না।’
কবিতা সত্যের একটি ইঙ্গিত অথবা আবহ তৈরি করতে পারে। সেখানে প্রতিপক্ষ হিসেবে মিথ্যা থাকে। মিথ্যা যে কেবল প্রতিপক্ষ হয়েই থাকে তা নয়, কখনো কখনো সত্যকে আরও শক্ত করতে সহায়ক ভূমিকাও পালন করে। তবে মিথ্যাকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেওয়া গেলেও তা প্রতিষ্ঠিত করা কঠিন, অন্যদিকে সত্যকে বারবার পরাস্ত করা হলেও সমূলে ধ্বংস করা অসম্ভব। তাই কবি রেজা নুর কিংবা রেজা নুরের কবিতা এখানে প্রাসঙ্গিকক্রমেই সত্য।
রেজা নুরের কবিতা সত্য থেকে উতরিয়ে আসা সেই শক্তি। যা যশোর থেকে সুদূর ম্যাসাচুসেটসে গিয়েও বাংলাদেশের গ্রাম, বিল, নিসর্গ, কর্দমাক্ত সরল রাস্তা, পড়ন্ত সূর্যের প্রেম, অন্ধকারে ডাহুকের ডাক, অবারিত ফসলের মাঠ, নতুন ধানের গন্ধ কিংবা ফেলে যাওয়া অসংখ্য স্মৃতি ভুলে থাকা অসম্ভব।
‘নিরীহ হাওয়ার নদী’ নামক কাব্যগ্রন্থের ‘চিহ্ন’ কবিতায় তা-ই যেন স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়েছে:
‘পায়ের চিহ্ন চিনে চিনে
পথের প্রান্তে দিনে দিনে
পৌঁছেছি যেই...
শুধু এক সমুদ্র অপার
শুষে নেয় সোমত্ত নদীর সম্ভ্রম,
নদীও সমর্পণে সুখী—
শেখে সে ঢেউয়ের কাছে...’
ঠিক পরের কবিতায় রেজা নুরের হারানো প্রেম যেন স্মৃতি হয়ে ধরা দেয়:
‘পথগুলো
কোন্ পথ ধরে
ফিরে ফিরে আসে?
কোন্ পথ চলে যায় নদীর মতো
মুখ ফিরিয়ে দূরে।’
ভালোবাসার অবাল্যস্মৃতি-গ্রাম ফেলে দূরে গিয়েও তিনি ফিরে আসতে চান ফেলে আসা শৈশবের গ্রামে। ফিরেও আসেন মানসিকভাবে, স্বপ্নে অথবা ক্ষণিকের জন্য বাস্তবে। সেই বাস্তবতার বৃক্ষে ফোটা ফুলের সৌরভ ছড়িয়ে দিতে চান ‘বৃক্ষ’ নামক কবিতায়:
‘বৃক্ষকে জানি—
বসেছিল বিশ্রামে
আজও তার ছায়া—
সুরভি ছড়ায়
কার যেন নামে।’
যশোরের সাগরদাঁড়ির কৃতিসন্তান মাইকেল মধুসূদনের কথা আমরা জানি। সুদূর থেকে ফিরে এসে স্নান করেছিলেন কপোতাক্ষের কোমলতায়। কপোতাক্ষের কাদা জলে নিজেকে সাজিয়েছেন রেজা নুর নিজেও। তাই তো তিনি যশোর বিলের সবুজ ফসলের মতো সতেজ। কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে ‘হৃদয়’ নামক কবিতায় স্বতঃস্ফূর্ত উচ্চারণ করেন:
হৃদয় অন্যের হাতে দিতে নেই,
এই অমূল্য নাজুক জিনিস
নিজের কাছে রাখা ভালো’
বাংলার জল কাদায় বেড়ে ওঠা শৈশব ও কৈশোর সুদূর চাকচিক্যময় শহর জীবনের সঙ্গে মিশিয়ে দিতে অনিচ্ছুক যেন। সেখানেই চাষাবাদ করছেন বাংলা ও বাঙালির পরিচয়। নিজের মতো কবিতার জগৎ বানিয়ে পরিব্রাজক হয়ে আমাদের জন্য নিয়ে আসেন নিশ্চিত আনন্দের উপলক্ষ্য। এ যেন বাঙালি ও বাংলাদেশের সাহিত্যের আনন্দ-শব্দ ‘সারেগামা’।
দুই.
প্রতীক্ষার ঘুড়ি গোপন ডানায় উড়তে উড়তে ভালোবেসে ছুঁয়ে যায়। কোথায় যায়? পানকৌড়ির দলে? অবারিত বিলে—যেখানে বসেছে চিলের মেলা? নাকি পদ্মপুকুরের বিলাসিতায়? নিশিরাতে সাঁতার জানা বালকের শৈশব-হারানো হাহাকারে! বেদনায়; ভালোবাসায় রেজা নুরের জীবনের পঙ্ক্তি এসেছে মূলত ‘নিরীহ হাওয়ার নদী’তে। যা মূলত প্রেম, প্রকৃতি, স্বপ্ন ও আশা-আকাঙ্ক্ষার উপাখ্যান। সুন্দরের দ্রাক্ষারস। যতই গভীরে যায়, ততই বড় হতে থাকে দেখা ও জানার পৃথিবী। পরাজয়ের গ্লানি টেনে টেনে আত্মতৃপ্তির বসন্ত-বাতাস এনে রেজা নুর দেখিয়েছেন কবিতার অপার্থিব নান্দনিক সৌন্দর্য অথবা কবিতা শেষ পর্যন্ত জিতে যাওয়ার দারুণ এক উপলক্ষ্য।
‘অসম একুশ’, ‘বিষণ্ন বারুদ’র ওয়াদা পড়া লাইন অতিক্রম করে প্রকৃত প্রেম কখনো তামাদি হতে দেয়, ফুল সৌরভচোখের জলে? তখনই সাক্ষী হয়ে পরাগরেণুতে উড়ে আসে সময়ের নীল প্রজাপতি। প্রেমহীন জীবন নিথর পড়ে থাকে নিষ্প্রাণ বারান্দায়। আলোর রেখাগুলো সকালের পায়ে তীক্ষ্ম চুম্বন রেখে ফিরে যায়, না পাওয়ার বিরহে। এসব মূলত স্বদেশের প্রতি গভীর ও প্রগাঢ় প্রেমের মালা বুনন। যে মালায় সাজানো হয় নৌকা, নিঝুম, রোদ্দুর ছায়ায়, ঠিক সেখানেই ফিরে আসেন রেজা নুর অথবা ‘নিরীহ হাওয়ার নদী’ প্রেমের বংশীবাদক হয়ে।
আমার বিশ্বাস ‘নিরীহ হাওয়ার নদী’র কবিতাগুলো সত্যিকারের কাব্য-প্রেমিককে বহুগামী নদীতে পড়ন্ত সূর্যের অপরূপ সৌন্দর্যে ভাসাবে, হাসাবে অথবা অন্যরকম এক আনন্দের জোগান দেবে।
বই: নিরীহ হাওয়ার নদী
ধরন: কবিতা
প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ
প্রকাশক: রণন প্রকাশ
মূল্য: ১৫০ টাকা।
এসইউ/জিকেএস