নজরুল-নার্গিসের প্রেম: নার্গিস বনে
আরিফুল হাসান
দুনিয়া উল্টে ফেলার নাম কবিতা। তবে দুনিয়া উল্টাতে গিয়ে নিজে উল্টো হলে চলবে না। কিন্তু বাস্তবতা হলো দুনিয়া উল্টে গেলে নিজেরও ভাঁজ থাকার উপায় নেই। তাই কবিরা উল্টাপাল্টা, মাতাল, বদ্ধপাগল। এই পাগলামিটাই কবিতা।
কবিতার পথে হাঁটতে হাঁটতে নজরুল আসলেন দৌলতপুর। এসে প্রেমে পড়ে গেলেন আরেক কবিতার। পটে আঁকা ছবিমুখের নার্গিসের সাথে দেখা হলো বিয়ে বাড়িতে। আনমনে নার্গিস কখন যে চুল খুলে দাঁড়িয়ে ছিলেন খান বাড়ির ছাদে। দূরে পুকুরের পাড়ে কদমতলায় বাঁশি বাজাতে বাজাতে কালা দেখে। তার সুর এলোমেলো হয়ে যায়। সৈয়দা খাতুনের তিনি নাম রাখেন নার্গিস আসার খানম। তারপর থেকে কালার বাঁশির সুর শুনেও নার্গিসের মন উতলা হয়। কিশোরী মনে খেলে যায় প্রেমের হিল্লোল। দখিনা বাতাস এসে উড়িয়ে দেয় উতলা আঁচল। সাথে শিউলির ঘ্রাণ মিশে তাকে মোহাচ্ছন্নতায় ঘিরে ফেলে। কল্পনায় ছোট্ট একটা সংসার দেখেন। যাহ! এই ঝাকড়া চুলের সাথে! না, আর কিছু ভাবতে পারেন না নার্গিস। মেঘের ফাঁক থেকে উঁকি দেওয়া মেঘলা দিনের সূর্যের মতো একটি হাসির বিভা ফুটে ওঠে ঠোঁটে। যে মহীয়সী বাস করেন তার অন্তরে, তিনি দৌড়ে পালান। সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে আসেন। বুক ধরফর করে তার। এই প্রেম লুকানো যায় না। আবার প্রকাশ করাও যায় না।
নজরুল পুকুর পাড়ে আমতলায় বসে গান রচনা করেন। সে গান আবার সুর করে নিজের কণ্ঠে গেয়ে ওঠেন। নার্গিসের বড় শখ হয়, তাকে বলে তার জন্য একটি গান লেখে দিতে। কিন্তু লজ্জায় আড়ষ্ট হন। এই পাহাড় উচ্চতার মানুষটির কাছে এলেই তার সবকিছু কেমন গুলিয়ে যায়। জানা কথাগুলোও কেমন অচেনা হতে থাকে। ভাবনারা বিক্ষিপ্ত হয়, দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করে, শেষে কূল-কিনারা না পেয়ে এক জায়গায় স্থিত হয়ে থাকে। মাটির দিকে চেয়ে থাকেন নার্গিস। মাটির গোপন কানে বোধহয় নীরব ভাষায় কোনো কথা বলে। নজরুলের ছায়া পড়ে মাটিতে। নার্গিস আঁড়চোখে চান সে ছায়ার দিকে। পরক্ষণেই লুকিয়ে ফেলেন নিজেকে। লজ্জায় আরও বেশি অধোমুখী হন। নজরুল স্মিত হেসে বাঁশিতে ঠোঁট রাখেন। পুকুর পাড়ের গাছগুলোর ছায়া সুনিবিড় ভাষার ভেতর মিশে যেতে যেতে নার্গিস দৌড়ে ঘরে ফেরেন। তবে পেছন পেছন একটি সুরও সঙ্গী হয়ে আসে। তার মনকে উদাসী বানিয়ে ঘরছাড়া করে। দেহখাঁচা খাঁটের উপরে ধপাস করে পড়লেও রুহপাখি উড়ে যায় নজরুলের কাছে। গোপনে খুব কাছাকাছি আসে। বুক ঘেঁষে বসে। আলতো হাতে বিলি কাটে কোকড়া চুলে। ভাবতে ভাবতে নার্গিস বালিশে মুখ চেপে খিলখিল করে হেসে ওঠেন।
হাসতে হাসতে দিন যায়। নজরুল ঝিঙে ফুল নিয়ে কবিতা লেখেন। মরা মাচানের দেশে, নার্গিস কি এসেছিলেন হলুদ শাড়িতে, খোঁপায় গুঁজেছিলেন দুটো ফুল? সবুজ পাতার আড়ালে, মুখ তুলে হেসেছিলেন ঝিঙে ফুলের মতো? হয়তো তখন বিকেল। স্নান সেরে নার্গিস চুলে ইচ্ছে মতন তেল দেন। খোঁপাটা বাঁধতে গিয়ে আবার খুলে দেন দীঘল কালো চুল পিঠ ভরে। হয়তো তখন তার সাধ হয় খোঁপায় দুটো ফুল গুঁজলে কেমন হয়? শরীরের শাড়িটা দেখে। কাঁচা হলুদের মতো যেন একটি মিষ্টি রোদ খেলা করে দেহে। খোঁপাটা আবার বাঁধেন। তখন হয়তো সে বাগানের পথে যান একটি-দুটি হলুদ গাঁদা ছিড়তে। কিন্তু বাগানের পথে হাঁটতে হাঁটতে তখন হয়তো তার কানে আসে আবার সে বাঁশির সুর, তিনি হয়তো তখন পথ হারান। মুন্সিবাড়ির দক্ষিণ উঠোনের বিশাল বাড়িটি ছেড়ে তখন তিনি হয়তো চলে যেতে থাকেন খানদের পুকুর পাড় ধরে। আর তখন হয়তো নজরুল ঝিঙে ফুল নিয়ে কোনো কবিতা লিখতে গিয়ে আটকে যান। এই বাঁশ-বেতের মরা মাচান তার কাছে খুব প্রাণহীন মনে হয়। খুব কবিতাহীনতা থেকে তখন তাকে হয়তো বাঁচান নার্গিস। হয়তো তখন তিনি ঝলমল করে ওঠেন হলুদ হলুদ তারার সুরভি নিয়ে ফুটে থাকা ঝিঙে ফুলের সাথে। তখন হয়তো নজরুল লেখেন, মরা মাচানের দেশ করে তোলে মশগুল।
নজরুল খানদের পুকুরে সাঁতার কাটেন। ঘাটে জল নিতে এলে বাড়ির বধূদের সাথে অপাপ মস্করায় লিপ্ত হন। তখন হয়তো বাড়ির বধূটির কলস ভেসে যায় জলে। নজরুল সাঁতার কেটে সে কলস ভরে এনে বৌটির কাছে দেন। এ খবর চলে যায় নার্গিসের কাছে। তিনি দুদিন ভাত না খেয়ে থাকেন। কেঁদে-কেটে চোখের কোটা ফুলিয়ে মন খারাপ করে বসে থাকেন। দুদিন পর হয়তো মান-অভিমান ভেঙে নার্গিসই আসেন নজরুলকে দেখতে। হয়তো নজরুল তখন নিজেই নার্গিসকে দেখতে যান। হয়তো তাদের দেখা হয় না সেদিন। হয়তো তখন নজরুলের বিরহী হৃদয় আরও বেশি পেতে চায় নার্গিসকে। তখন তিনি ঘন ঘন যেতে থাকেন নার্গিসের বাড়ি। কিন্তু নার্গিসও জেদ কমান না। কী? এত কিছু তলে তলে? কার কলস ভেসে গেল তা নিয়ে নজরুলের মাথাব্যথা থাকবে কেন? কেন প্রিয় মানুষটি অন্য কারো সাথে হেসে কথা বলবে? কেন তিনি জল ভরে দেবেন অন্য রমণীর কলসে। তখন হয়তো নার্গিসের জেদ আরও বেশি চাপে এবং ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে সারাদিন পড়ে থাকেন। সন্ধ্যার পরে হয়তো নজরুল আবার যান মুন্সিবাড়িতে এবং জানালার পাশে হাস্নাহেনা গাছটির নিচে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন। কিন্তু নার্গিস বেরোন না। হয়তো তিনি বুঝতে পারেন তার জন্য কেউ দাঁড়িয়ে আছেন জানলার পাশে। তিনি তখন জানালার কবাটটি আরও ভালোভাবে লাগিয়ে দেন।
সেই রাতে নজরুল তার সবচেয়ে মোহিনী বাঁশিটি হাতে নেন। বিরহের সুর তুলে তুলে খানবাড়ি ও মুন্সিবাড়ির সীমানা ধরে বাজাতে থাকেন। রাতের অন্ধকারে সে সুর কেঁদে কেঁদে নার্গিসের কাছে আরতি জানায়। সারারাত নার্গিস ঘুমোতে পারেন না।
পরদিন সকালবেলা এলোচুলে নার্গিস এসে দেখেন নজরুল মামাদের পুকুর পাড়ের আমগাছটির গুড়িতে হেলান দিয়ে শুয়ে আছেন। হয়তো সারারাত আজ ঘরে ফেরেননি। কড়ুল বাঁশের আগা দিয়ে তৈরি, পুড়িয়ে কারুকাজ করা জাদুর বাঁশিটি হয়তো পাশে পড়ে থাকে। হয়তো রাতভর অনিদ্রার ক্লান্তিতে নজরুলের চোখে তন্দ্রা নেমে আসে। হয়তো রাতজাগা নজরুল বাঁশি বাজাতে বাজাতে শেষরাতের দিকে এই আমগাছের গুড়িতেই শুয়ে পড়েন। নার্গিসের বড় মায়া হয় ঘুমন্ত নজরুলের মুখের দিকে চেয়ে।
হয়তো নজরুলের কোকড়া চুল এলিয়ে পড়ে তার একটি চোখ ঢেকে থাকে। হয়তো পাতার ফাঁকে রোদ এসে নজরুলের বুকের উপর খেলা করে। হয়তো কোথাও একটি বুলবুলি চুপচাপ চেয়ে থেকে নজরুলের দিকে হঠাৎ শিষ দিয়ে উড়ে যায়। নার্গিস ঘুমন্ত নজরুলের মুখের উপর থেকে চোখ সরাতে পারেন না। কী নিষ্পাপ সে মুখখানা। রাতজাগা ক্লান্তিতে চোখের নিচে কালি জমে আছে। নার্গিসের ইচ্ছে হয় খোঁপা খুলে কেশ দিয়ে মুছে দেয় কোজাগর ছাপ। হয়তো তিনি ধীরপায়ে নজরুলের আরেকটু কাছে আসেন। একটি হাত উঠিয়ে লাজে মরিমরি ডাক দেন, হেই! হয়তো তার ডাক তার গলার ভেতরই আটকে থাকে। রোমাঞ্চিত লজ্জায় সে ডাক কোনো ধ্বনিপ্রবাহ তৈরি করে না। নজরুল হয়তো সেই অস্ফুট ডাক শুনতে পান না, হয়তো শোনেন।
এসইউ/এমএস