ইন্দুবালা ভাতের হোটেল: দৃঢ়চেতা নারীর গল্প
সুরাইয়া পারভীন
কলকাতার লেখক, অধ্যাপক ও চিত্রনাট্যকার কল্লোল লাহিড়ীর দ্বিতীয় উপন্যাস ‘ইন্দুবালা ভাতের হোটেল’। উপন্যাসের গল্পটি হতে পারতো দুস্থ নারীর। হতে পারতো স্বপ্নবিলাসী উচ্ছ্ল গ্রাম্য কিশোরীর স্বপ্নহরণের। হতে পারতো স্বেচ্ছাচারী বাবার কাণ্ডজ্ঞানহীনতার। হতে পারতো বিয়ের নামে বলী দানের। হতে পারতো দুই বাংলার মানুষের বিভেদের। অথচ অদ্ভুতভাবে গতি সেসব দিকে না গিয়ে গল্পটি হয়ে উঠেছে এক দৃঢ়চেতা নারীর। অবলা নারীর বাধ্যতামূলক বিচরণক্ষেত্র যে রান্নাঘর, সেটিকে তৈরি করেছেন একটি প্রতিষ্ঠানে। রান্নাকে রূপ দিয়েছেন শিল্পে।
গা-ভর্তি গয়না নিয়ে কিশোরী ইন্দুবালা বউ হয়ে কলকাতায় গিয়েছিল দেশভাগের আগেই। ঠাকুমা বলে দিয়েছিল গয়নাগুলো আগলে রাখতে। তা আর পেরে ওঠেনি। দোজবরে মদখোর, নেশাখোর স্বামী পৌরুষ দিয়ে ছিনিয়ে নিয়েছে সেসব। ছেনু মিত্তির লেনের পুরোনো নোনাধরা দোতলা বাড়ির বাইরে কলকাতার আর কোনো দর্শনীয় জিনিসের বর্ণনা ইন্দুবালার মুখে শোনা যায় না। তাকে ঘিরে রাখে খুলনার কলাপোতা গ্রাম, বোসদের পুকুর, কপোতাক্ষ নদ।
পূর্ণিমা-অমাবস্যায় তিথি নক্ষত্রের ফেরে শাশুড়ির সাথে গঙ্গাস্নানে যেতেন। ভাঙা গাড়ির মত আজব জিনিস নিয়ে এসেছিল তার স্বামী। প্রথমবার দেখে ইন্দুবালা শুধিয়েছিল, ‘এরেই বুঝি টানা রিক্সা বলে?’ শাশুড়ির সামনে স্বামীর সাথে কথা বলার রেওয়াজ ছিল না। জবাব শাশুড়িই দিয়েছেন। ‘দেখেছো কখনও বাপের জনমে?’ তাচ্ছিল্যের নামে অপমান তার গা সওয়া হয়ে গিয়েছিল। উঠতে-বসতে বাঙাল বলা সে বাড়ির রেওয়াজ হয়ে গিয়েছিল। আর রিফিউজি সে সময় কলকাতার আকাশ-বাতাস জুড়েই।
ছোটবেলায় দাদুর কাছে হারিকেনের আলোয় কৃতদাসের গল্প শুনতো। দাদুর বর্ণনার সেসব মানুষগুলো দিন-রাত কাজ করতো। নাওয়া নেই, খাওয়া নেই। উঠতে-বসতে মার। জাতের নামে অপমান, গায়ের রঙে অপমান। কাজ না পারলেই অন্ধ কুঠুরিতে বন্ধ করে রাখা। একেক সময় ছেনু মিত্তির লেনের বাড়িটাকে অন্ধ কুঠুরি মনে হতো ইন্দুবালার।
নিজের একান্ত কেউ ছিল না। ‘সেইসব কথা কিছুটা জানে কর্পোরেশনের ওই ছিরছিরে জল পরা কল আর বাগানের আমগাছ, নারকেল গাছ। তার ডালে কদাচিৎ এসে পরা পাখিগুলো। কান্নার শব্দ যাতে বাইরে না বেরোয় মুখের ভিতর কাপড় গুঁজে নিতেন ইন্দুবালা। শুকনো মাটিতে চোখের জল পরলে বৃষ্টি নামতো শহর জুড়ে। শাশুড়ি জল ভরা মেঘের দিকে তাকিয়ে তাঁর সংসারের মঙ্গল কামনা করতেন।’
গল্পের এসব সত্য। এসব সত্য একসময় ঘুরে গেল। সবকিছু ছাপিয়ে, সব না পাওয়া, নির্যাতন আর হয়রানি কেমন যেন মিইয়ে গেল। গল্পের আসরে নির্যাতিতা ইন্দুবালা কোনো গুরুত্ব পেল না। উল্টো, এই গল্পে ইন্দুবালা হয়ে উঠেছিলেন পুরোপুরি ভিন্ন এক বলিষ্ঠ চরিত্র। অসাধারণ গুণবতী, দৃঢ়চেতা, স্বাধীনচেতা, একরোখা, জেদী।
গল্পটি হয়ে উঠেছিল ভালোবাসার। অসাধারণ দক্ষতায় চমৎকার ভাবে লেখক গল্পের মোড় ঘুরিয়েছেন। রান্নার প্রতি ভালোবাসা, চুলার গনগনে আঁচের প্রতি ভালোবাসা, টগবগ করে ফুটতে থাকা ভাতের প্রতি ভালোবাসা, খুলনার কলাপোতার প্রতি ভালোবাসা, সীমান্তের ওপারে যাওয়া ট্রেনের প্রতি ভালোবাসা, গভীর রাতে খেতে আসা এক দঙ্গল নকশাল ছেলেমেয়ের প্রতি ভালোবাসা। দুই বাংলার প্রতি ভালোবাসা। এই বাংলার কলাপোতা গ্রামে তার প্রাণ ওই বাংলায় আছে তার সন্তানেরা।
রান্নাঘর ঘিরেই ইন্দুবালার জগৎ তৈরি হলো। সে গল্প আত্মপ্রত্যয়ী নারীর। মাছওয়ালী লছমিকে দিয়ে শুরু। আর পেছনে ফিরতে হয়নি। সামনের অফিসের লোকজন খেয়ে যায়। মেসের ছেলে-মেয়েরা আসে। কিছুদিন বাদে সাইনবোর্ড শোভা পায় ‘ইন্দুবালা ভাতের হোটেল’। ইন্দুবালার বয়স বাড়ে। তার হোটেল বন্ধ হয় না।
পূর্ববাংলার এক কিশোরী শ্বশুরবাড়িতে এসে রান্না করেছিল নিতান্ত দায়ে পড়ে। পূর্ববাংলার রান্না শিখেছিল ঠাকুমার কাছে। পশ্চিমবাংলার রান্নার চিনি আর পূর্ববাংলার ঝাল ব্যালেন্স করে সাথে প্রচুর ধৈর্য আর ভালোবাসার মিশ্রনে ইন্দুবালা রাঁধতেন তাঁর নিজস্ব রেসিপিতে।তার মুখ ঝামটা দেওয়া শাশুড়ি মারা যাওয়ার আগে খুশি মনে ইন্দুবালাকে আশির্বাদ করেছিল, ‘সবাইকে এইভাবে খাইয়ে পরিয়ে সুখী রাখিস বউ।’ ইন্দুবালা ভাবেন তার কথাই ফলেছে। নইলে এতগুলো মানুষকে এই বয়সে কীভাবে খাওয়াতে পারেন? বলা হয় মৃত্যুপথযাত্রীর কথা নাকি ক্ষণার বচনের চাইতেও ফলপ্রদ।
চমৎকার মুন্সিয়ানায় গল্পের অবয়ব ঘুরিয়েছেন লেখক কল্লোল লাহিড়ী। ব্যক্তিজীবনে কল্লোল লাহিড়ী চলচ্চিত্র বিষয়ে অধ্যাপনা করছেন। সাথে আছে তথ্যচিত্র নির্মাণ, টেলিভিশন ধারাবাহিক, ওয়েব সিরিজের চিত্রনাট্য রচনা এবং নিজের লেখালেখি। এপার-ওপার যাদের সম্বন্ধ হয়েছে, দেশভাগে তারা পরস্পর ভিনদেশী হয়ে যায়। হৃদয়ের হাহাকার বাড়ে। ‘এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাওয়া মানুষদের ভীড় বাড়ে। পাসপোর্টে ছাপ পড়ে। বাক্স প্যাঁটরা নিয়ে ইমিগ্রেশন পার করে মানুষ। এক সময়ে যে দেশটা নিজের ছিল সেটারই বেড়া টপকায়।’
অনেক কাল পরে এপার বাংলায় কলকাতার ট্রেন আসে-যায়। পড়ন্ত বয়সের ইন্দুবালার ঘোরলাগা বিস্ময় জাগে। সে আটকা পড়ে আছে কলকাতায়, ট্রেন ঠিকই যেতে পারছে। নিজ দেশের মাটিতে এই ট্রেন চলে। এই ট্রেন কাঁটাতারের বেড়া ডিঙায়, তার বাড়ির সীমানা চেনে। গভীর আবেগে ট্রেনটা ধরে দেখে। নিজ দেশের মাটির স্পর্শ পায় যেন।
বয়স সত্তরোর্ধ্ব হয়েও উপন্যাসে কিশোরী ইন্দুবালা বিচরণ করে গেছেন দাপটের সাথে। কলকাতার ছেনু মিত্তির লেনে পুরো জীবন কাটলেও খুলনার কলাপোতা গ্রাম আর কিশোরী ইন্দুবালাই সব সময়ের জন্য জীবন্ত ছিল।
আছে হরেক পদের রকমারি রান্না। প্রতিটি রান্নার বর্ণনা এমনই জীবন্ত, আনাড়ি যে কেউ সেসব অনায়াসে করতে পারবে। তবে অবশ্যম্ভাবী ভাবে শর্ত হিসেবে রান্নায় ধৈর্য আর ভালোবাসার মিশেল থাকতে হবে। রান্নাঘর যাদের বিরক্তির জায়গা, তারাও ইন্দুবালার রান্নাঘরে সেঁটে থাকতে চাইবেন। এতই মজাদার, এতই চমকপ্রদ, লেখার প্রতিটি আঁচড় সামনে টেনে নিয়ে যায়।
অসহায় নারীর রান্নাঘরকে, নির্যাতিতা হওয়ার ক্ষেত্রটাকে লেখনীর মুন্সিয়ানায় একেবারে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন কল্লোল লাহিড়ী। উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন নয়। একেবারে বাস্তব প্রয়োগ আছে এতে। ভালো লাগা প্রিয় একটি বই ‘ইন্দুবালা ভাতের হোটেল’।
বইয়ের নাম: ইন্দুবালা ভাতের হোটেল
লেখক: কল্লোল লাহিড়ী
ধরন: উপন্যাস
প্রকাশক: সুপ্রকাশ
প্রথম প্রকাশ: ২০২০ সাল
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ: মেখলা ভট্টাচার্য
মূল্য: ২৫০ টাকা
এসইউ/জিকেএস