ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

হরতনের বিবি ইস্কাপনের গোলাম: সমকালীন সমাজের প্রতিবেদন

জান্নাতুল যূথী | প্রকাশিত: ০৪:২৫ পিএম, ১২ মে ২০২২

সাম্প্রতিক বাংলা ছোটগল্পে বিষয়বৈচিত্র্য যেমন চোখে পড়ে, প্রকারণে নতুনত্ব তেমন চোখে পড়ে না। প্রায় সব গল্প যেন একই প্যাটার্নে রচিত। কেবল কাহিনি ভিন্নতার কারণেই গল্পের ভিন্নতা চোখে পড়ে। তবু সুখের কথা এই যে, গল্প লিখিত হচ্ছে। সবাই যে একই পথে হাঁটছেন, তা নয়। কেউ কেউ ভিন্ন রকমও লিখছেন। সেই সব গল্প হয়তো সমানভাবে সব পাঠক-সমালোচককে আকৃষ্ট করতে পারছে না। তবু লিখিত হচ্ছে। তেমনই একজন ছোটগল্প লেখক প্রদীপ আচার্য (জন্ম ১২ জানুয়ারি ১৯৭৫)। ২০২২ সালের বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে তার প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘হরতনের বিবি ইস্কাপনের গোলাম’। বইটিতে মোট গল্পসংখ্যা ১৩টি।

প্রতিটি গল্পের স্বাদ ভিন্ন। সমাজিক বিভিন্ন বাস্তব কাহিনিকে কেন্দ্র করে একেকটি গল্পের প্লট গড়ে উঠেছে। সমকালীন বিভিন্ন ইস্যুও গল্পগ্রন্থের কলেবরে বিদ্যমান। প্রথম নামগল্প ‘হরতনের বিবি ইস্কাপনের গোলাম’। গল্পটি একটি বিশেষ আমেজ সৃষ্টি করে মনে। একটি মধ্যবিত্ত পরিবার কীভাবে জীবনযুদ্ধে ভালোবাসা পর্যন্ত বিকিয়ে দিতে বাধ্য হয়, তার জ্বলন্ত উদাহরণ গল্পটি। প্রেমহীন মানুষ, মানুষ নয় কিন্তু সেই মহত্তম চিরন্তন প্রেমও দারিদ্র্যের কষাঘাতে কীভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে, তারই বর্ণনা রয়েছে এ গল্পে। প্রধান চরিত্র ইয়াসিন। লোনের টাকায় সওদাগর মার্কেটে চাল বিক্রির একটি দোকান নেয়। কিন্তু হঠাৎ দোকানটি আগুনে পুড়ে গেলে সে নিস্ব হয়ে পড়ে! বাবা নেই। তাই পুরো পরিবারের দায়িত্ব তার কাঁধে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে ইয়াসিনের সামান্য চালের দোকানটিও পুড়ে যায়।

একদিকে পরিবারের দায়িত্ব, অন্যদিকে ভালোবাসার মানুষকে জীবনের তাগিদে বিসর্জন দেওয়া—দুটোরই মুখোমুখি হতে হয় তাকে। জোছনাকে ভুলে তাই বিয়ে করে জোবাইদাকে। কারণ জোবাইদার ভাই কফিল মুন্সি বিয়ের বিনিময়ে ইয়াসিনকে মধ্যপ্রাচ্যে নিয়ে যাবে। ফলে তার সাংসারিক জটিলতা কিছুটা কমবে। মনে ভালোবাসা আর কাঁধে দায়িত্বের বোঝা নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমালেও সংসারকে সুখী করা হয়ে ওঠেনি ইয়াসিনের! উল্টো ব্রেন ক্যান্সারের মতো জটিল রোগে ভুগে মৃত্যু হয় তার। আর লেখক এখানেও দেখিয়েছেন চরমতম বাস্তবতা! যে মানুষটি সবার মুখের দিকে চেয়ে নিজের সুখ-আহ্লাদ বিসর্জন দিয়েছে। প্রবাসে পাড়ি জমিয়েছে, সেই ব্যক্তির মৃত্যুও যেন একসময় টাকা উপার্জনের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে! কী নিষ্ঠুর বাস্তবতা অঙ্কন করেছেন লেখক। যেহেতু ইয়াসিনের মৃত্যু অবধারিত তাই তার শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হাসপাতলে বেঁচে দেওয়ার সিদ্ধান্তে মত দিয়ে স্বপ্নের পৃথিবী সাজাতে ব্যস্ত হয় জোবাইদা! সন্তানের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে চায় সে।

গল্পটি হৃদয়কে নাড়া দেয় বিশেষভাবে! মানব জীবন কী তবে শুধুই মায়ার খেলা। একে অন্যের জন্য দিনরাত এক করে খেটে চলেছে কিন্তু বাস্তবতার কাছে এসে তার প্রাপ্য সম্মান-শ্রদ্ধা-ভালোবাসাটুকুও ইয়াসিনের মতো ব্যক্তিরা পাচ্ছে না। জোবাইদাকে প্রথমত নিষ্ঠুর আখ্যা দিতে পারেন অনেকেই। কিন্তু জোবাইদার মধ্যে ফুটে ওঠে আবহমান মায়ের চিরন্তন মাতৃস্নেহ। বাবার ছায়া সন্তানের মাথা থেকে সরে পড়লে তার কী হবে ভবিষ্যৎ! সেই চিন্তা থেকেই মূলত জোবাইদা হৃদয়ে পাথর চাপা দিয়ে সন্তানের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করেছে। একদিকে চরমতম নিষ্ঠুরতা অন্যদিকে পবিত্র ভালোবাসা সন্তানকে ঘিরে।

দ্বিতীয় গল্প ‘বিন্নি ধানের খই ও স্বপ্নখাদক’। গল্পটির কাহিনি গড়ে উঠেছে চৌধুরী বাড়ির অশ্বিনী কুমারের ব্রতের অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে কিন্তু এর মোড় ঘুরেছে কেন্দ্রীয় চরিত্র সুহাসিনীর জীবনকে ঘিরে! গোটাবিশেক পরিবারের এ বাড়িতে সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ প্রিয়ব্রত চৌধুরী। সুহাসিনীর দাদু। তার কী এক রোগ। অনেক ডাক্তার দেখালেও মুখে কথা ফেরেনি। গল্পের কেন্দ্রে সুহাসিনী, বিধবা মেয়ে। বিয়ের ছয় মাসের মাথায় স্বামীকে হায়ায়। তিলক নামের একজনের সঙ্গে প্রেম থাকলেও বাস্তব সম্পর্কে রূপ নেয়নি। বিয়ের সময় তিলকের পথ চেয়ে থাকলেও কোনো সম্মতি আসেনি প্রেমিকের থেকে। গল্পের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনাকে ছাপিয়ে সুহাসিনীর জীবনের ঘটে যাওয়া একটি অঘটনই যেন মনকে বিষিয়ে তোলে! হৈমন্তিকার মাঠে তিনদিনের মেলাকে কেন্দ্র করে সুহাসিনী ছোট ভাই বিমলের সঙ্গে ঘুরতে যায়। ভাইয়ের আবদার রক্ষায় সার্কাস দেখায় মেতে ওঠে দুজন। কিন্তু ভিড়ের মাঝে দিদির হাত ছেড়ে বিমল কোথায় যেন হারিয়ে যায়। অনেক খোঁজের পর বিমলকে না পেয়ে একা রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে সুহাসিনী কিন্তু রাতের অন্ধকারে সুহাসিনীর বুক শুকিয়ে আসে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে কালভার্ট পার হতেই একদল মানুষ নামধারী জানোয়ার সুহাসিনীর ওপর আক্রমণ করে। তাদের ভোগের বস্তুতে পরিণত হয় সুহাসিনী! পশুত্বের কাছে মানবতার চরমতম বলি হতে হয় সুহাসিনীর মতো নারীকে! গল্পটিতে সুহাসিনীর মতো হাজারো নারীর অনিরাপদ জীবনকে চিত্রায়িত করেছেন লেখক। নারী তার আপন জগতে আপন ভুবনের মহিয়সী হলেও একদল পশু নারীর জীবনকে শ্রদ্ধা-সম্মান করতে পারে না। বর্তমান যুগে এসেও নারীর নিরাপত্তা কোথায়? লেখকের দৃষ্টিতে গল্পটিতে সুহাসিনীদের জীবনকে নিরাপদ করে তোলার প্রয়াস চালানো হয়েছে।

কোথাও ঝড় উঠেছে ভীষণ, ঘৃণা আর ক্ষোভের তীব্র তোলপাড়ে ডুবে যাচ্ছে তার বোধের পারদ। চোখের কোণে বেয়ে নামা গরম জলের ধারায় শুকনো মাটি ভিজে ওঠে অনেকটা। মাটিতে লেগে থাকে ছোপ ছোপ রক্ত। শেষবারের মতো তিলকের কথাগুলো কানে বাজে সুহাসিনীর, যেন বহুদূর থেকে ভেসে আসে, ‘অশ্বিনী কুমারের কাছে বর মাগুম, তুমি যেন আমার হইয়া যাও...’। সুহাসিনীর হৃদয়ের অন্তিম আকাঙ্ক্ষা জাগরূক। তিলককে না পেলেও মনের অজান্তে তিলককে প্রাণ সঁপে দিয়ে নিজের মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে চেয়েছে। জীবনের পরাজয়ে জীবনকে নতুনরূপে স্বাগত জানানোর মধ্যেই যেন না পাওয়ার বেদনাকে পেয়েছে সুহাসিনী। প্রদীপ আচার্যের হরতনের বিবি ইস্কাপনের গোলাম বইটির তৃতীয় গল্প ‘ব্লাকবোর্ড’। ছোট কলেবরে গড়ে ওঠা গল্পটিতে স্থান পেয়েছে সমকাল। সময়ের সাক্ষ্য বহন করাই যেন এ গল্পের মূল উদ্দেশ্য। গল্পের কেন্দ্রে টগর আর রঞ্জনা। দুজনেই পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী। ক্লাসরুম রঞ্জনার দুরন্তপনায় মুখরিত থাকতো কিন্তু করোনার প্রকোপে স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। করোনায় চারিদিকে লোক মারা যাচ্ছে। হঠাৎ রঞ্জনা পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে পরপারে পাড়ি জমায়। পুলিশি সহযোগিতায় রঞ্জনার দাফনের ব্যবস্থা করা হয়। টগরের কচি মনে বন্ধুর হারিয়ে যাওয়া ক্ষত সৃষ্টি করে। গল্পটির মধ্য দিয়ে লেখক সময়কে ধরে রাখার চেষ্টা করেছেন।

গল্পগ্রন্থের চতুর্থ গল্প ‘ফেরা’। গল্পের নামকরণ থেকেই অনুমেয়, কারো ফেরাকে কেন্দ্র করেই গল্পের প্লট নির্মিত। গল্পের মূল চরিত্র গফুর। গুণবতী স্কুলে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে মাধ্যমিকের নিচের ক্লাসে গণিত পড়াতেন। কিন্তু এখন শ্রীঘরের বাসিন্দা। কিন্তু কেন জেলে যেতে হলো এবং কিভাবে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছে গল্পের কাহিনি বর্ণনায় লেখক তা তুলে ধরেছেন। শিক্ষক সর্বদাই জাতির বিবেকরূপে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু মধ্যবিত্ত এই শ্রেণি সর্বদা সমাজের উচ্চ শ্রেণির কাছে শোষিত-বঞ্চিত। গফুর আর সাধুরাম বোধের মূর্তিমান রূপকার হওয়ার নিরঞ্জনের পৈত্রিক ভিটা রক্ষা করার আপ্রাণ চেষ্টা করে। সিকদার ব্যাপারী সমাজের শোষকশ্রেণি। গায়ের জোরে নিরীহ দরিদ্র নিরঞ্জনের পৈতৃক ভিটা দখল করতে গিয়ে সংঘর্ষ বাঁধে। মারামারির একপর্যায়ে শত্রুপক্ষের জলিলের মাথায় আঘাত লেগে মৃত্যু ঘটে। বারো বছরের জেলজীবন পার করে গফুরের ঘরে ফেরা। গল্পে পাই—‘তমালতলা হাটে বাস এসে থামলে গফুর নেমে পড়ে। গাঢ় এই অন্ধকার তার কাছে নতুন ঠেকে। রিক্সার হাঁক-ডাক শুনে কোনো জবাব দেয় না সে। এ রিকশাওয়ালাদের গফুরকে চেনার কথা নয়। সে হেঁটে বাড়ি ফিরবে। অনেক বছর পর গ্রামে ঢুকছে। অনেক কিছুই বদলে গেছে নিশ্চয়।’

শাসকের হাতে পড়ে সাধারণ মানুষের জীবনে কতটা বিপর্যয় ঘটতে পারে তা এ গল্পে দেখানো হয়েছে। ফেরা গল্পের মতোই উচ্চশ্রেণির দ্বারা শোষণের আরও একটি গল্প ‘জলজগাথা’। অসাধারণ একটি গল্প। যদিও কাহিনির দিকে দৃষ্টি দিলে প্রাণ বেদনায় ভরে উঠবে। কীভাবে নিম্নশ্রেণির মানুষকে শোষকশ্রণি জিম্মি করে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ এই গল্প। গল্পের মূল চরিত্র লক্ষ্মীন্দর। জেলেপাড়ায় বসবাস পরিবারের সঙ্গে। দারিদ্র্য যাদের নিত্যসঙ্গী সেখানে টাকা রোজগারের কোনো উপায় পেলে হুমড়ি খেয়ে পড়ে লক্ষ্মীন্দর। শোষকশ্রেণি সর্বদাই গরিবের আর্থিক সংকটের সুযোগ গ্রহণ করে। লক্ষ্মীন্দরের ছোটভাই শুকলালের মাদক পাচারে সহযোগিতা করতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে সে। পুলিশের হাত থেকে রক্ষা পেতে লক্ষ্মীন্দরের বউ রাজরাণী সাহায্য নিতে ছুটে যায় সমাজের উচ্চশ্রেণির প্রতিনিধি মোবারক মুন্সির কাছে। সেখানে ঘটে চূড়ান্ত সর্বনাশ। সাহায্যের নামে রাজরাণী, তার মেয়ে বিউটির প্রতি কুদৃষ্টিকে বাস্তবরূপ দেয় মোবারক মুন্সি। এমনকি লক্ষ্মীন্দরের ছেলে বিশ্বজিতকে দিয়েও মাদক পাচার করাতেও দ্বিধা করে না। দারিদ্রতা ও শোষকশ্রেণির রোষানলে পড়ে একটি পরিবার কীভাবে নিঃশেষ হলো তার চিত্র ফুটে উঠেছে। অন্ত্যজ শ্রেণি সর্বদাই শোষিত। সমাজের কষাঘাতে তাদের স্বাভাবিক জীবন রুদ্ধ। গল্পে পাই—‘মোবারক মাঝির কাছে অনেক অনুনয় করে মোবারক মাঝি তাকে আশ্বস্ত করে, লক্ষ্মীন্দরকে ছাড়ানোর চেষ্টা করবে সে। কিন্তু শর্ত দেয় বিউটিকে নিয়ে যেতে হবে মোবারক মাঝির কাছে।’

ষষ্ঠতম গল্প ‘ঘুমে ডুবে যায় কবিয়াল চোখ’। আবদুল লতিফ কবিয়াল, মাজেদা, হারুণ, রোকসানা, বশির গল্পের মূল চরিত্র। করোনায় কাজ হারানো আবদুল লতিফ কবিয়ালের জীবনচিত্র এ গল্পের উপজীব্য। আর্থিক সংকটকে কেন্দ্র করে জীবনের টানাপোড়েন। করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত দুস্থ শিল্পীদের সাহায্য করা হবে ঘোষণা থাকলেও আবদুল লতিফ কোনোই সাহায্য পাননি। বাস্তব ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রতিটি গল্প গড়ে উঠেছে। করোনার কারণে কাজ হারিয়ে বেকার লতিফের করুণ দশা। মেয়ে রোকসানা, জামাই হারুণ। তাদের দাম্পত্য জীবনের প্রসঙ্গও গল্পে স্থান পেয়েছে। লেখকের সবচেয়ে বেশি বিশেষত্ব বর্ণনার ক্ষেত্রে তিনি কার্পণ্য করেননি বরং নির্দিষ্ট কলেবরে গল্প শেষ করার চেষ্টা করেছেন। অযথা ফেনিয়ে গল্পের মূল স্বাদ নষ্ট করেননি। এমনকি চরিত্র অনুযায়ী তাদের মুখে ভাষার প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। গল্পে পাই—‘ভালাই জ্বর আহে নাই। ধান কাটানোর সময় বিষ্টিতে ভিইজ্জা ঠাণ্ডা লাগছিল। হেই কারণে জ্বর আইছিল, ভয়ের কিছু নাই।’

‘মগ্নতায় বিবর্ণতা’ গল্পগ্রন্থের সপ্তম গল্প। গল্পটিতেও মধ্যবিত্ত শ্রেণির নানামাত্রিক জটিলতাকে কেন্দ্র করে কথকের অবচেতন মনে বয়ে চলা জীবন। দুঃখ-কষ্ট যাদের নিত্যসঙ্গী সেই ক্ষুদে মাছ বিক্রেতা এবং কথকের জীবনের না পাওয়া সব একাকার হয়ে গেছে। জীবন সর্বত্র সংগ্রামের। গল্পে এ বিষয়ে লেখক যে কোনো পরিস্থিতিতে মানবের বেঁচে থাকাটাই প্রধানরূপে দেখিয়েছেন। ‘লাইফ সাপোর্ট’ একটি মানবিক গল্প। মায়ের অসুস্থতাকে কেন্দ্র করে মানুষের চিরন্তন রূপকে তুলে ধরেছেন। শফিকের মা জেবুন্নেছা লাইফ সাপোর্টে। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। মায়ের মৃত্যুর প্রহর গুনছে মেয়ে নাসরিন, মেজো ছেলে মেজবাহ, তার স্ত্রী তাহেরা। মায়ের মৃত্যু নিশ্চিত জেনে সন্তানেরা সিদ্ধান্ত নেয় অকারণ টাকা খরচ করে মাকে লাইফ সাপোর্টে রাখার কী দরকার! মৃত্যু যেখানে নিশ্চিত! কিন্তু হঠাৎ মায়ের জ্ঞান ফিরে আসে। তার মস্তিষ্ক সাড়া দেয়। মায়ের জীবনকে সংকটে পতিত করার অপরাধে ভোগে শফিক। গল্পের মধ্য দিয়ে লেখক জীবনের সর্বোচ্চ সত্যটা তুলে ধরেছেন। মানুষ নশ্বর। আর খনিকের পৃথিবীতে কতই না অভিনয়। বেঁচে থাকা, ভালোবাসা-শ্রদ্ধা! কিন্তু মৃত্যুর ঘণ্টা বাজলেও পৃথিবীতে সকলেই পর। নিজের পরিবার পরিজনও। গল্পে পাই—‘মৃধা চলে গেলে নির্বাক বসে থাকে শফিক। তার অবনত দৃষ্টি ক্যান্টিনের ফ্লোরে স্থির। মনে মনে ভাবে, পরিবারের টাকা বাঁচাতে বন্ডে স্বাক্ষর করেছে শফিক, মা সুস্থ হয়ে যখন এই কথাটা জানবেন, কেমন হবে তার মুখটা তখন? তখন শফিকই বা কোথায় লুকাবে তার মুখ!’

‘করোটিতে ঘুণপোকা-ঘোর’ দীর্ঘ কলেবরের গল্প। গল্পটিতে ভালো মানুষের মুখোশের আড়লে পৈশাচিক নিষ্ঠুরতার শিকার একটি ছোট্ট মেয়ের করুণ কাহিনি তুলে ধরা হয়েছে। সোনিয়া ও খালিদ দম্পতির মেয়ে জেরিন। বাবা- মায়ের দাম্পত্য সম্পর্কের জটিলতার বলি ছোট্ট শিশু মেয়েটি। মায়ের আদর থেকে বঞ্চিত হয়ে জেরিন ফুপু ফারজানার বাড়িতে কিছুদিন বেড়াতে যায়। কিন্তু ফুপুর স্বামী সাজিদের কুদৃষ্টিতে পড়ে জেরিন। সাজিদ সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। তার বন্ধু শিশুর পর্নোছবি নিয়ে ব্যবসা করে। সাজিদের এই নোংরা মানসিকতার বলি হয় ছোট্ট জেরিন। একসময় তাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে তার বিভিন্ন রকম ছবি ও ভিডিও ধারণ করে তারই পরম আত্মীয়! কিছু মানুষের নোংরা মানসিকতার কাছে নারী-শিশু কারোরই রক্ষা নেই একসময় বিভিন্ন সাইটে ভিডিও ও ছবি প্রকাশ হলে পুলিশের সহোযোগিতায় মূল হোতাদের ধরা হয়। কিন্তু সামাজিকভাবে ছোট্ট মেয়েটির যে চরম ক্ষতি হয়, তা কী কোনো কিছুর বিনিময়ে ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব! এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে গ্রাম থেকে বেড়াতে আসে জেরিনের দাদা আলতাফ আহমেদ। তার পৈশাচিক আচরণেরও শিকার হয় জেরিন! গল্পটি বর্তমান সমাজের কদর্য কিন্তু বাস্তব একটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে! নারী-শিশুর নিরাপত্তা কোথায়? পরিবার-পরিজন থেকেও যদি তাদের মুক্তি না মেলে তবে তারা কোথায় যাবে! কঠোর আইন প্রয়োগ সেইসঙ্গে শিশু-নারীদের সচেতন করে না তুললে কোনভাবেই এ ধরনের ঘটনাকে মোকাবিলা করা সম্ভব নয়।

‘নিলীন’ গল্পটির প্লট গড়ে উঠেছে দুজন মায়ের আহাজারিতে! এক মা সরলা যিনি নিজের সন্তানকে হারিয়ে পাগলপ্রায়। আর এক মা ফারজানা যিনি উচ্চশিক্ষিত। ছেলে আবরার অস্ট্রেলিয়া ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। সরলা ফারজানার বাসায় কাজ করে। সরলার হারিয়ে যাওয়া সন্তানের সঙ্গে আবরারের ছবির পুরোই মিল। সরলা মুখে না বললেও আবরারকে নিজের হারিয়ে যাওয়া সন্তান মনে করে অন্যদিকে ফারজানাও মনে করে আবরার হয়তো সরলারই হারিয়ে যাওয়া সন্তান। যে সন্তানকে আদরে লালন করে তুলছে ফারজানা। গল্পের এ পর্যন্ত একটা ধোঁয়াশা থাকেই কিন্তু সবচেয়ে ধাক্কা লাগে অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটিতে শ্রেণিকক্ষে উগ্রতা, ওপেন ফায়ার, গুলিতে ঘটনাস্থলে কয়েকজন মারা যায়। তাদের একজন আবরার! কর্তৃপক্ষ তার মৃতদেহ দেশে পাঠানোর সব ফরমালিটিজ শুরু করেছে। গল্পটির দুই মায়ের সামাজিক অবস্থান ভিন্ন হলেও তাদের ভালোবাসা এক সুতোয় গাঁথা।

‘অতঃপর শূন্য দাঁড়িয়ে’ অন্ত্যজ শ্রেণির প্রতিনিধি কুলসুমা। মানসিক ভারসাম্যহীনা কুলসুমা নিজ সন্তানকে কূপের মধ্যে ফেলে দেয়। ছোট্ট শিশুটির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে কুলসুমাকে জেলহাজতে পাঠানো হয়।

প্রতিটি গল্পে মূলত সমাজ, অর্থনীতির পাশাপাশি মনস্তত্ত্বের ছবি এঁকেছেন প্রদীপ। চরিত্র-সংলাপ-কাহিনির ভেতর দিয়ে মূলত তার স্বসমাজের সচিত্র প্রতিবেদন তুলে ধরেছেন লেখক। এদিক থেকে লেখক সমাজ-স্বকাল সচেতন বলে মেনে নিতেই হবে।

এসইউ/জিকেএস

আরও পড়ুন