ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

মায়াবতী: পর্ব ৪০

মোহিত কামাল | প্রকাশিত: ০৮:১৮ এএম, ০১ মে ২০২২

কথাসাহিত্যিক মোহিত কামালের মায়াবতী বাংলা সাহিত্যে দ্বিতীয় মনোবৈজ্ঞানিক উপন্যাস। সাহিত্যের শব্দবিন্যাসে তিনি ব্যবহার করেছেন মনস্তত্ত্ব, সমাজের আড়ালের চিত্র। মা প্রত্যক্ষ করেছেন, মেয়েরা নানাভাবে উৎপীড়ন ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়, সহজে মুগ্ধ হয়ে অবিশ্বাস্য পাতানো ফাঁদে পা দেয়। মায়ের একান্ত চাওয়া মেয়ে ক্যারিয়ার গড়ে তুলুক। বিধিনিষেধ আরোপ করেন মা। মেয়ে তখন মনে করে, মা স্বাধীনতা দিতে চায় না, বিশ্বাস করে না তাকে। মায়ের অবস্থানে মা ভাবছেন তিনি ঠিক। মেয়ের অবস্থানে মেয়ে ভাবছে, সে ঠিক। মায়ের ‘ঠিক’ এবং মেয়ের ‘ঠিক’র মাঝে সংঘাত বাধে। সংঘাত থেকে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়, ভুল করে বসে মেয়ে রিয়া। পালিয়ে যায় ঘর থেকে। এই ‘ভুল’ই হচ্ছে উপন্যাসের মূলধারা, মূলস্রোত। মায়াবতী পড়ে চিন্তনের বুননে ইতিবাচক গিঁট দেয়ার কৌশল শেখার আলোয় পাঠক-মন আলোকিত হবে। জানা যাবে টিনএজ সমস্যা মোকাবিলার কৌশল। জাগো নিউজের পাঠকের জন্য ধারাবাহিক প্রকাশিত হচ্ছে সাড়া জাগানো উপন্যাসটি—

ঘরে মেয়ে থাকলে ছেলেরা জ্বালাবে। টেলিফোন আসবে। টেলিফোনের নিপীড়ন চলছে ঘরে ঘরে। অনেক উটকো কথা শুনতে হয়। টেলিফোন কানেকশনের মাধ্যমে অনেক সরল মেয়ে একদম অযোগ্য পাত্রের হাতে চলে যায়। জীবন ছারখার হয়ে যায়। এই অভিজ্ঞতা মায়ের। মা চারপাশে এমনটা ঘটতে দেখেছে। মায়ের অন্তর্গত চাওয়া তাই ঘুরপাক খেয়েছে অশুভর হাত থেকে মেয়ের জীবন নিষ্কণ্টক রাখা। ইনসিকিউরিটি বা নিরাপত্তাহীনতাবোধ মূলত মায়ের মনে উদ্বেগ ঢেলে রাখে। ফলে স্বয়ংক্রিয় নেতিবাচক চিন্তায় ঘুরপাক খেয়েছে। এটাই কগনিটিভ মডেলের মনস্তত্তে¡র ভাষা। এই ভাষায় আবর্তিত হয়েছে মায়ের প্রতিটি পদক্ষেপ, আচরণ। এসব আচরণ রিয়াকে চাপে ফেলে দেয়। এখানে রিয়ার কগনিটিভ ইভালুয়েশন বা মূল্যায়নে যথাযথ ইন্টারপ্রিটেশনের ছায়া অনুপস্থিত। রিয়ার মনে স্বয়ংক্রিয় আবেগের ঝড় ওঠে। ওই ঝড়ে বুদ্ধি-বিবেচনা লোপ পেয়ে যায়। যথার্থ সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করে সে। ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

মায়ের মন এই বেরিয়ে যাওয়া মেনে নিতে পারেনি। তার চিন্তা এবং আচরণের সঙ্গে বেরিয়ে যাওয়াটা বেমানান। অসংগতিপূর্ণ। কষ্টদায়ক। তীব্র স্ট্রেস তৈরি হয়ে যায়। মনস্তত্ত্বে চাপ তৈরি হয়। এই চাপ থেকে মায়ের মন ডিসোসিয়েট হয়ে যায়, উধাও হয়ে যায় উদ্বেগ। অবচেতন থেকে ঘটে গেছে এমন প্রতিক্রিয়া। মা ভুলে গেছে রিয়ার চলে যাওয়ার বিষয়টা। মার স্মরণে নেই। ইচ্ছাকৃত এমনটা ঘটেনি। ফিরে আসার পর মা যে প্রতিক্রিয়া রিয়ার সঙ্গে ঘটিয়েছেন, দেখা যায় মা উদ্বেগশূন্য। এমনি অবস্থায় উপন্যাসের ডায়লগে আমরা দেখতে পাই মনোচিকিৎসকের একটা ডায়াগনোসিস, ডিসোসিয়েটিভ ডিসঅর্ডার। আগে এই মনোরোগটাকে বলা হতো হিস্টিরিয়া। মনোচিকিৎসা বিদ্যায় সাম্প্রতিক সময়ে হিস্টিরিয়া বলা হয় না। অতি চাপ বা দ্বন্দ্ব থেকে অনেক সময় দৈহিক উপসর্গও তৈরি হয়। দৈহিক উপসর্গ এলে রোগটাকে বলা হতো ‘কনভারসন ডিসঅর্ডার’। এ ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে ‘ডিসোসিয়েটিভ ডিসঅর্ডার’। কারণ রাহেলা চৌধুরীর মধ্যে দেখতে পাই ‘রিয়ার ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার বিষয়টা’ তার মনে নেই। এটা হচ্ছে ডিসোসিয়েটিভ এমনেসিয়া। এই ‘এমনেসিয়া’ হচ্ছে সাইকোলজিক্যাল উপসর্গ।

‘রিয়া ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে।’
এই সত্যের প্রকাশ হলে উৎকণ্ঠা আরও বেড়ে যেত। এ ধরনের উৎকণ্ঠা দীর্ঘদিন ধরে সহ্য করা মানুষের পক্ষে অসাধ্য। ফলে মনের অজ্ঞাতে ‘ইগো ডিফেন্স মেকানিজম’ এই সত্যটাকে অবদমন করে। উৎকণ্ঠা উদ্রেককারী চাপ বিদায় করা অবদমনের মূল অর্থ না। ‘ডিফেন্স মেকানিজম’ অবদমনের জন্য সব সময় সক্রিয় থাকে। অবদমনের এই শক্তি কোনো কারণে দুর্বল হয়ে গেলে চাপা দেওয়া অবাঞ্ছিত সত্য অবচেতন থেকে উঠে আসতে চায় আমাদের চেতনায়। এ ক্ষেত্রে অবদমন ছাড়াও ইগো ডিফেন্স মেকানিজমের অন্য অনুষঙ্গগুলোর সাহায্যের প্রয়োজন হয়। তখন নিউরোসিস বা লঘুতর মানসিক রোগের উদ্ভব ঘটার সুযোগ তৈরি হয়ে যায়। ঘটনাটি মনোসমীক্ষণ থিওরির আলোকে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এখানে বলে রাখা উচিত, ডিসোসিয়েটিভ ডিসঅর্ডার একধরনের লঘুতর মানসিক রোগ। লঘুতর এই রোগের মূল ক্যাটাগরির নাম নিউরোসিস।

বর্ণিত আখ্যানে আমরা দেখতে পাই, মিসেস রাহেলা চৌধুরী একজন বিবাহিত নারী, বয়স পঁয়ত্রিশের সামান্য কম। নারীদের এই রোগ বেশি হয়। অপেক্ষাকৃত কম বয়সে এই রোগ বেশি হয়। টিনএজে হয় সবচেয়ে বেশি। সাধারণত পঁয়ত্রিশের পর এই রোগ হয় না। চল্লিশের পর হয় না বললেই চলে। ডিসোসিয়েটিভ ডিসঅর্ডারের মতো রোগের জন্য একটা মানসিক সংঘাত বা দ্বন্দ্ব থাকতে হয়। এই দ্বন্দ্বের তীব্রতা দেখেছি আমরা রাহেলা চৌধুরী জীবনে। দ্বন্দ্বের সঙ্গে মানসিক বা দৈহিক উপসর্গ তৈরি হওয়ার একটা ‘টেম্পোরাল রিলেশনশিপ’ থাকতে হয়। অর্থাৎ মানসিক চাপ বা দ্বন্দ্বের পরপরই উপসর্গ তৈরি হতে হয়। সেটাও আমরা দেখেছি এ ঘটনায়। এই রোগের স্বয়ংক্রিয় প্রাথমিক অর্জন হচ্ছে সচেতন মন থেকে চাপটা সরে যাওয়া। এটা উদ্ভূত পরিস্থিতির বাস্তব সমাধান না হলেও, এ কারণেই রোগী একদম স্বাভাবিক হয়ে যায়। ঘটনার ফলাফল কষ্টকর হলেও রাহেলা চৌধুরীর পরবর্তী আচরণের অভিব্যক্তিতে চোখে পড়ার মতো কষ্টের ছাপ দেখা যায়নি।

পরবর্তী সময়ে আমরা আরও দেখতে পাই রিয়ার জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন। মা যেমন চাইতেন, রিয়া তেমনি আচরণ করে। এটা হচ্ছে রাহেলা চৌধুরীর সেকেন্ডারি অর্জন।
এ ধরনের রোগীর চিকিৎসার জন্য অবশ্যই মনোচিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত। সুস্থতার জন্য মনোচিকিৎসা গ্রহণ করা উচিত। উপন্যাসে সেই পদক্ষেপও আমরা দেখতে পাই।

রাহেলা চৌধুরী নিজের উপলব্ধির অবস্থানে ছিলেন ঠিক।
‘ঠিক ভাবনার’ ঘোড়দৌড়ে ছুটেছেন তিনি। সরাসরি বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। রিয়ার পেছনে লেগে ছিলেন।
রিয়া বিরক্ত হয়েছে। অপমান বোধ করেছে। তার আবেগে আঘাতে লেগেছে। ইগোতে চোট লেগেছে। এই চোট সামাল দিতে পারেনি ও।
এ বয়সী মেয়েকে বাধা দিলে বাধবে লড়াই। একটা প্রবাদ আছে। এই প্রবাদ জীবননির্ভর, বিজ্ঞাননির্ভর।
তাহলে কী করা উচিত ছিল রাহেলা চৌধুরীর? কীভাবে ট্যাকল করলে সমস্যা সহজে জয় করা যেত?
রাহেলা চৌধুরী মেয়ের মঙ্গল দেখতে চান। ঠিক আছে। কিন্তু মুনার বাড়ির সামনে গাড়িতে বসে থাকাটা হচ্ছে বাড়াবাড়ি।
বাড়াবাড়ি কোনো ক্ষেত্রেই ভালো না।
তাঁর উচিত ছিল নিজের উদ্বেগের কথা মেয়ের সঙ্গে খোলামেলা আলাপ করা।
আলাপ করেননি তিনি।
অনেক মা অভিযোগ করেন, আলাপ করে লাভ হয় না। মেয়েরা নিজের মতোই চলতে চায়। কথা শোনে না।
সেখানেও ত্রুটি আছে। পারিবারিক আবহে ছোটবেলা থেকে ডিসিপ্লিন গড়ে তোলা হয়নি। তাই আচমকা বাধা দিলে শুনবে না সন্তান। না শোনার অর্থ এই না সে ক্রাইম করছে। সে তো নিজের কাছে নিজে স্বচ্ছ। সে তো কোনো ক্রাইম করছে না, ভুল করছে না। এটা মেয়ের বোধ।
মাকে উপলব্ধির দৌড়ে মেয়ের বোধের স্তরে নেমে এসে মেয়েকে মূল্যায়ন করতে হবে। মূল্যায়ন করতে হবে তার আবেগ, আচরণ, চিন্তা, চাওয়া-পাওয়ার ধরনটা। সেই স্তরে নেমে এসে বিপদের ঝুঁকির কথা তুলে ধরতে পারলে কথাগুলো তার মনে ধরার ক্ষেত্র তৈরি হতে পারে।

কেবল কল্পিত ধারণার কারণে ক্ষতিরোধ করতে গিয়ে অনেকে মেয়ের স্বাধীনতায় হাত দিয়ে বসে।
অল্প বয়সে মনে স্বাধীনচেতা মনোভাব আসন গেড়ে বসতে পারে। সেই মনোভাবে টান দিলে হিতে বিপরীত হতে পারে। স্বাধীনচেতা মনোভাব সামাল দিতে হলে স্পেসিফিক বা সুনির্দিষ্ট বিপদের ঝুঁকির ক্ষেত্রেই কেবল শক্ত হতে হবে। সব ক্ষেত্রে শক্ত হওয়া উচিত হবে না।
স্পেসিফিক বিপদ শনাক্ত করতে হবে বাস্তবের আলোকে। কল্পিত দৃশ্যের আলোকে নয়। অতীতের একক কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনার আলোকে পরিস্থিতি মূল্যায়ন করলে চলবে না। সামগ্রিক অর্থে কমন ঘটনার আলোয় মেপে দেখতে হবে। ওই ক্ষেত্রে যে বিপদ থাকতে পারে, তা মেয়ের বোধে দিতে হবে। বিপদ হতে পারে―বোধে এমন ধারণা ঢুকিয়ে দিতে পারলে মেয়ে নিজের বুদ্ধির আলোকে বাকি কাজ সারিয়ে নিতে পারবে। জয় করতে পারবে। মায়ের কথা শুনবে। স্বতঃস্ফূর্তভাবে মায়ের আহ্বানে সাড়া দেবে। মনে রাখতে হবে, সহজ পরামর্শ দেওয়া আর বোধে ঢুকিয়ে দেওয়া এক কথা নয়।
বড়রা এখানেই ভুল করে। নিজের অবস্থানে থেকে নিজের উপলব্ধি মেয়ের বোধের ভেতর চাপিয়ে দিতে চান।
এই ধারার পরিবর্তন হতে হবে।
ছোটবেলা থেকে পারিবারিক কাঠামোতে বিষয়টার চর্চা করতে হবে। মেয়ের বন্ধুদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে।
পারিবারিক নৈতিকতা এবং চেতনাগত অবস্থানে দৃঢ় থাকা দরকার। আচমকা টিনএজে ধাক্কা না দিয়ে ছোটবেলা থেকেই তাদের এই চেতনা ও নৈতিকতায় গড়ে তোলা উচিত।
পরিবার একজন আদর্শ মানুষ গড়ে তোলার জন্য উপযুক্ত বিদ্যাপীঠ। এই বিষয়টা মা-বাবাকে ভুলে গেলে চলবে না। পারিবারিক সততা, মা-বাবার মধ্যে পারস্পারিক বোঝাপড়া এবং ভালোবাসার বন্ধন, সুন্দর হওয়া দরকার। সব মিলিয়ে মেয়ের মনস্তত্ত্বে আসন গেড়ে বসবে সুন্দর দৃষ্টিভঙ্গি।
পারিবারিকভাবে বিনোদনমূলক কাজে একসঙ্গে অংশগ্রহণ করলে, মেলামেশা করলে, শেয়ার করার চর্চা অনুশীলন হলে, মেয়েদের লুকোনোর স্বভাব কমে যাবে। জীবন অনেক সুন্দর হবে তখন। অনেক ইতিবাচক ধারণা নিয়ে বড় হবে মেয়ে।

ইতোপূর্বে বলা হয়েছে, এই উপন্যাসের ঘূর্ণির কেন্দ্র হচ্ছে ‘ভুল’। মূলধারা বা মূলস্রোত হচ্ছে ‘ভুল’। রিয়ার এই ভুলের পাশাপাশি আরও দুটি সমান্তরাল ধারা প্রতিটা অধ্যায়ে দেখা যায়। সমান্তরাল ধারার একটা হচ্ছে ড. ইউনূসের নোবেল প্রাইজ জয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত মাহিনের হৃদয়স্পর্শী এক্সপ্রেশন। অন্যটা হচ্ছে রূপবতী, মায়াবতী মেয়েদের জীবনের নানা ধরনের বিড়ম্বনা এবং নিপীড়নের চিত্র, দেখেছি ফলবিক্রেতা শাড়িবিক্রেতা থেকে শুরু করে শিক্ষকের গলে পড়ার দৃশ্য, কর্মক্ষেত্রের কঠিন রূপ। বিদেশে থাকে এমন পাত্রের সঙ্গে রূপবতীর বিয়ের প্রতারণা। দেখেছি নিকটজন বা ঘনিষ্ঠস্বজনদের নৈতিক বিবর্জিত যৌনতার ফাঁদে মেয়েদের আটকে যাওয়ার দৃশ্য। নৈতিকতার ঝাণ্ডাধারী হুজুরদের অনৈতিক যৌন স্পর্শের অবিশ্বাস্য দৃশ্যও সংযুক্ত হয়েছে দ্বিতীয় সমান্তরাল ধারার সঙ্গে। মেয়েদের দ্বারা কচি মেয়েরাও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়, সেই দৃশ্যও বাদ যায়নি।
মূলধারার সঙ্গে মাঝে মাঝে অ্যাসোসিয়েট বা সংযুক্ত হয়েছে সমান্তরাল ধারা দুটি। আরোপিত বা কল্পিত নয়। সমাজ জীবনেরই চিত্র। সমাজ জীবনের চিত্রগুলোর সম্পৃক্তি, সংযোজন জীবনের কঠিন সত্য পাঠকের সামনে উন্মোচিত করেছে। মূলধারার সঙ্গে সমান্তরাল ধারার অ্যাসোসিয়েশন হওয়ার কারণে উপন্যাসের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি অনেক বেশি দৃঢ় হয়েছে। ধাপে ধাপে আমরা জীবনের মাঝ থেকে বৈজ্ঞানিক, মনস্তাত্ত্বিক সেই আলোর সন্ধান পাব।

প্রিয় পাঠক, আসুন, আমরা এবার দেখি মাহিন ও কুসুমকলির প্রথম এপিসোডের ধারাটা, আসুন দেখি, বিজ্ঞান এখানে কীভাবে গোপন চাল চালিয়েছে। চলুন দেখি নিজের স্কুলের প্রতি কী গোপন টানে একাত্ম হয়ে গেছে নোবেল জয়ের মতো আনন্দময় ঘটনা:
চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের মেধাবী ছাত্র মাহিন। মেধাবী ছাত্র হিসেবে জীবনের ধারাবাহিক উত্তরণের পথে এগিয়ে এসেছে। বুয়েটের মতো প্রতিষ্ঠানের ছাত্র সে।
স্কুলজীবন শিক্ষাজীবনের মূল ভিত তৈরি করে দেয়। তুলনামূলকভাবে দীর্ঘ সময় স্কুলে পড়তে হয়। এসময় শিশুদের মন থাকে নরম। কৈশোরে নরম মনে অনেক উচ্চাশার বীজ রোপিত হয়ে যায়। সেই বীজ একদিন মহীরুহরূপে প্রকাশ পায়। যত দেরিতেই সেই প্রকাশ ঘটুক না কেন, শেকড় থেকে যায় বিদ্যাপীঠে, কৈশোরে। ড. ইউনূস এ বয়সে নোবেল জয় করলেও তার শেকড় পড়ে আছে স্কুলজীবনে।
একই প্ল্যাটফর্মে বড় হয়েছে আরেক কিশোর মাহিন।
অতীত তাকে ছেড়ে দেয়নি। অতীতের শেকড়ে টান খেয়েছে বর্তমান।
সেই টানে দেখেছে সে অতীত।
এই অতীত একান্তই তার। ফলে ড. ইউনূসের নোবেল জয়কে অতীতের টানে ‘আমার প্রাইজ’ হিসেবে ভাবতে পেরেছে। ইউনূসকে ‘আমার স্কুলের ছাত্র’ ভাবতে পেরেছে মাহিন।
কেন ‘আমার এ বোধ’?
কোত্থেকে আসে ‘আমার করে উপলব্ধির চেতনা’?
অন্তর্গত প্রেষণা মানুষকে লক্ষ্যপানে টেনে নিয়ে যায়। ‘প্রেষণা’ হচ্ছে মনের স্বাস্থ্যের আরেকটা শক্ত ভিত, শক্ত পিলার। এই ভিত বিজ্ঞানের রসায়নে গড়া মৌলিক টান তৈরি করে দেয়। মৌলিক টান ধরে রাখে। মৌলিক টানের স্ফূরণ ঘটায়। এই টানের স্পন্দনে আলোকিত হয়ে ওঠে চারপাশ। অন্যরা সেই আলোর পরশ পায়। আলোকিত হয়। মোহিত হয়। সম্ভাবনার দ্বার অন্যদের সামনে তুলে ধরে অনাগত দিনের ঐশ্বর্যের কথা। বর্তমানের সাফল্যগাথা তৈরি হয়ে যায়। সেই সাফল্যবার্তায় বর্তমান প্রজন্ম দেখতে পায় নিজের সাফল্য। সামনের দিনের সফলতার আশা দেখতে পায়।

ড. ইউনূসের সাফল্য মাহিনের সামনেও এমনি সাফল্যের সিঁড়ি খুলে দিয়েছে। ইউনূস তার শেকড়ের মূলে আছে। বর্তমানে আছে। ভবিষ্যতেও গভীরে থাকার ক্ষেত্র পাইয়ে দিয়েছে। এ কারণে ইউনূস হচ্ছেন মাহিনের ইউনূস। ইউনূসকে সে ভাবতে পেরেছে আমার করে।
প্রেষণার মূল প্ল্যাটফর্মের ইট-সুরকি সিমেন্ট হচ্ছে নিড বা চাহিদা, উৎসাহ উদ্দীপনা। চৈতন্যস্পর্শী আগ্রহ, ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষা চাহিদাকে সমৃদ্ধ করে। উৎসাহের অনুরণনে চাহিদা পূরণের জন্য চিত্তে আলোড়ন ওঠে। সেই আলোড়নে সামনে ছুটতে থাকে মানুষ। লক্ষ্য ছিনিয়ে আনতে গোপন শক্তির সঞ্চার করে। এই শক্তি হচ্ছে হৃদয়গ্রাহী চিত্তের শক্তি, ইন্দ্রিয়শক্তির বিপুল বিস্ফোরণ, বিপুল টান। এই টানে ছুটে চলে মন।
কোথা চলে মন?
মন চলে সফলতার দিকে, বিজ্ঞান বলে নিড ফর অ্যাচিভমেন্ট।
মন চলে ক্ষমতার দিকে, বিজ্ঞান বলে নিড ফর পাওয়ার।
মন চলে সম্মানের দিকে, বিজ্ঞান বলে নিড ফর অনার।
মন চলে সামাজিক স্বীকৃতির দিকে, বিজ্ঞান বলে নিড ফর অ্যাপ্রুভাল।
মন চলে ভালোবাসার দিকে, বিজ্ঞান বলে নিড ফর লাভ।
মন চলে অন্যের প্রিয় হতে, অন্যের উষ্ণ সান্নিধ্য পেতে, বিজ্ঞান বলে নিড ফর অ্যাফিলিয়েশন।
মন চলে খাদ্যের টানে, বিজ্ঞান বলে নিড ফর ফুড।
মন চলে তৃষ্ণা মেটাতে, বিজ্ঞান বলে নিড ফর থ্রাস্ট।
মন চলে যৌনতার দিকে, বিজ্ঞান বলে নিড ফর সেক্স।
এগুলো হচ্ছে যে কোনো আচরণের মোটিভ। প্রেষণার গতি নির্ধারিত পথে চলে মোটিভের কারণে।
উপরে উল্লিখিত নিচের তিনটি হচ্ছে বায়োলজিক্যাল বা জৈবিক মোটিভ এবং উপরের ছয়টি হচ্ছে সাইকোলজিক্যাল মোটিভ, সোশ্যাল মোটিভ।
মাহিনের মনে বায়োলজিক্যাল মোটিভের পাশাপাশি সফলতার চাহিদা আছে।
ভালোবাসার চাহিদা আছে।
অন্যের ভালোবাসা পাওয়া বা অন্যের প্রিয় হওয়ার চাহিদা আছে। আরও চাহিদা পূরণের টানে মাহিন ধাপে ধাপে এগিয়ে যায়।
চাহিদা পূরণের অনুঘটক তৈরি হয়ে যায়। কুসুমকলির মতো ধারালো এক সুন্দরীর উপস্থিতিতে চিত্তে উচ্ছল আলোড়ন ওঠে। চৈতন্যস্পর্শী আগ্রহ তৈরি হয়ে যায়। সেই আগ্রহ নিজের ভালোবাসার চাহিদাকে গোপনে সমৃদ্ধ করে তোলে, উৎসাহের অনুরণনে ইন্দ্রিয়শক্তির গোপন ঘরে ঢেউ জাগে। ফলে মাহিন ছুটে চলে কুসুমকলির টানে।
এই ব্যাখ্যা একইভাবে প্রযোজ্য কুসুমকলির ক্ষেত্রে।

মাহিনের ইউনূস নোবেল প্রাইজ জয় করেছে। বিষয়টি অতলস্পর্শী চেতনার মর্মমূল থেকে অনুভব করেছে মাহিন। পেপার জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে সে। অনুভবের নির্যাস হচ্ছে আনন্দ, আনন্দাশ্রু।
শুদ্ধতম মৌলিক ও নির্মল ‘এক্সপ্রেশন’টা দেখেছে কুসুমকলি।
এই এক্সপ্রেশন কুসুমকলিকে চুম্বকের মতো টেনে নিয়ে গেছে মাহিনের সামনে।
এখানে ‘চুম্বক-টান’ হচ্ছে সাহিত্যের ভাষা।
বিজ্ঞানের ভাষা স্নায়ুকোষের গোপন খেলার সঙ্গে সম্পর্কিত, হরমোনসহ অনেক রাসায়নিক উপাদনের ক্রিয়া-বিক্রিয়ার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
মাহিনের এক্সপ্রেশনটা ছিল অভূতপূর্ব। অসাধারণ বিমূর্ত সৌন্দর্য চোখ দিয়ে ধারণ করে কুসুমকলি। দৃশ্যপট চোখের মধ্যে দিয়ে চলে যায় ব্রেইনে। ব্রেইনে আলোড়ন তোলে। নিঃসরণ ঘটে জৈব রাসায়নিক পদার্থ এমফিটামিনস-এর ফিনাইলইথাইলামিন (পি পদার্থ) ও নরইপিনেপ্রিন চকিত ছলকে ওঠে। ভালো লাগার ঘোরতর এক কম্পন জেগে ওঠে কুসুমকলির মনে। কালক্রমে ভালো লাগা অপ্রতিরোধ্য গতিতে রূপ নেয় ভালোবাসায়। এই কম্পন হচ্ছে স্বয়ংক্রিয় কম্পন, ভালোবাসার এই গতি হচ্ছে স্বতঃস্ফূর্ত গতি।
কুসুমকলির বিমুগ্ধ এক্সপ্রেশনও মাহিনকে আলোড়িত করে। মাহিনের স্নায়ুকোষ একই ধারায় বিপ্লব ঘটায়। এই বিপ্লবের টানে টানে এগিয়ে যায় সে। একে অপরের কাছাকাছি চলে আসে, ভালোবাসার প্রাণরসায়নে সিক্ত হয় উভয়ে।
বিজ্ঞান বলছে, পি পদার্থের কারণে জেগে ওঠে ভালোবাসার তীব্র ব্যাকুলতা। এই আকুলতা স্থায়ী না। একই মুখ, একই চোখ, একই স্পর্শে পি পদার্থের মাত্রা দীর্ঘদিন একই রকম থাকে না। সময়ের পরিক্রমায় এটির নিঃসরণ মাত্রা এবং প্রতিক্রিয়ার তীব্রতা কমে যায়। ভালোবাসার উত্তাল জোয়ারে তখন আসে ভাটির টান। আমরা কুসুমকলি ও মাহিনের আকুলতার জোয়ার দেখেছি উপন্যাসে। ভাটির টান হবে কি হবে না, এমন অগ্রিম কমেন্ট করার সুযোগ তৈরি হয়নি। শরীর মনের পুলকিত তাগিদ কমে যায় রাসায়নিক উপাদানের টলারেন্সের কারণে। স্নায়ুতন্ত্রের এই টলারেন্স তৈরি হতে সময় লাগে ঊর্ধ্বে চার বছর। এই থিওরির উল্টো ব্যাখ্যা হচ্ছে দুজন মানব-মানবী দীর্ঘদিন একসঙ্গে থাকার কারণে অদৃশ্য মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে যায়। এই বাঁধনে শক্ত গিঁট গেঁথে দেয় এন্ডরফিনস নামক রাসায়নিক উপাদান, অক্সিটোসিন নামক হরমোন।

এন্ডরফিনস দুজনার মাঝে শান্ত সৌম্য নিরাপত্তার অনুভূতি জাগায়, উন্মাতাল ঢেউ জাগায় না। প্রধানত উত্তাল অনুভূতি তৈরি হয় কম বয়সী প্রেমিক-প্রেমিকার মাঝে। উন্মাতাল অনুভূতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছে পি পদার্থ।

কম বয়সের প্রেম দ্রুত মিলিয়ে গেলেও নিঃশেষ হয়ে যায় না। এ বয়সে প্রেম পাত্র থেকে পাত্রে সঞ্চারিত হয়। নতুন মুখ, নতুন চোখ, নতুন হাসি তুমুল উদ্দীপনায় আবার ব্রেইনকে উদ্দীপ্ত করে, নতুন করেই সমান মাত্রায় পি পদার্থের নিঃসরণ বাড়িয়ে তুলতে পারে। নতুন প্রেমের জোয়ার পূর্ণোদ্যমে আবার চলে আসে এভাবেই। রাসায়নিক দ্রব্যটার গুণাগুণ বর্ণনায় এই ব্যাখ্যা এসেছে। এই ব্যাখ্যার সঙ্গে মাহিনও কুসুমকলির মনস্তাত্ত্বিক ভিত অ্যানালাইসিস করা হচ্ছে না।

এন্ডরফিনসের কারণে ভালোবাসার স্থিতি আসে। এই স্থিতি এবং উচ্ছ্বাস আমরা লক্ষ্য করেছি কুসুমকলি ও মাহিনের জীবনে। এন্ডরফিনসের কারণে স্থিত মন নিজেদের ভুলত্রুটিগুলো শুধরে নিতে পারে, হুট করে এ ধরনের ভালোবাসা চলে যায় না, রং বদলায় না।

মার্কিন মনোগবেষক হ্যাগোপ একিস্কাল মনে করেন, নিউরোট্রান্সমিটার সেরোটোনিনের ওপর প্রেমের আকর্ষণ নির্ভর করে। প্রেমের জন্য তীব্র দাবালন প্রজ্বলিত করে এই সেরোটোনিন।

অন্তর্গত রাসায়নিক পরিবর্তন আমাদের চিত্তে ঝলক তোলে, পাল্টে দেয় জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে প্রেম-রোমান্সের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার থাকে কামের নেশা। এই নেশা প্রথমে থাকে লুকোনো। সুযোগ ও সময় মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। প্রেম ও কাম তাই বিলীন থাকে একই মুদ্রার দুপিঠে। তখন সবকিছু আর আবেগের গণ্ডির মধ্যে থাকে না। রাসায়নিক উপাদানের গোপন টানে খুলে যায় আদিম খোলস। এমন একটা উপাদান হচ্ছে ইস্ট্রোজেন হরমোন। এটাকে স্ত্রী হরমোন বলা হয়। আর একটা হচ্ছে টেস্টোস্টেরন বা পুরুষ হরমোন। নারী-পুরুষের শারীরিক গড়ন নির্ভর করে এই দুটি হরমোনের আনুপাতিক হারের ওপর। শারীরিক গড়ন, কামতৃষ্ণা ছাড়াও রোমান্টিক আবেগ অনুভূতির সঙ্গেও রয়েছে ইস্ট্রোজেন এবং টেস্টোস্টেরনের গোপন চাল। রাসায়নিক উপাদনের বিক্রিয়ার ফলে প্রেম ভালোবাসা এবং মানবিক আবেগীয় অনুভূতিগুলো নিয়ন্ত্রিত হয়।

ফলবিক্রেতা কিশোরোত্তীর্ণ ছটফটে ছেলেটা অনিন্দ্যসুন্দরী কুসুমের উপস্থিতিতে গলে যায়। মুগ্ধ হয়। সে নিজেও জানে না, মুগ্ধতার কারণে তার আচরণ ঘুরপাক খেয়েছে, অন্যদের কাছ থেকে দাম বেশি আদায় করলেও কুসুমের কাছে কেনা দামে বিক্রি করেছে। রূপবতী মায়াবতী নারীরা কেবল বিড়ম্বনারই শিকার হয় না, এমন ধরনের বাড়তি সুবিধাও পেয়ে থাকে। এ ধরনের আচরণে তারা বিব্রত হয় না। এনজয়ও করে। অর্কিড প্লাজায় শাড়িবিক্রেতা কিছুতেই শাড়ির দাম কমাবে না। মনু’পা শাড়ির দাম করছেন। দাম কমছে না। কুসুম ক্যাশের সুদর্শন বিক্রেতার সামনে দাঁড়ায়। এক লাফে শাড়ির দাম কমে যায় এক হাজার টাকা। সঙ্গে সঙ্গে বিগলিত হাসি দেয় ক্যাশ ম্যানেজার। এই গলে যাওয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত আছে ভালো লাগা। আছে তাৎক্ষণিক পি পদার্থের নিঃসরণ। আছে সেরোটোনিনের খেলা। উপন্যাসের এই ছোট্ট ঘটনার মধ্যে গুটি চালিয়েছে বিজ্ঞান। সাহিত্যের গতিপথ স্বতঃস্ফূর্ত হয়েছে বিজ্ঞানের চালের কারণেই। সামান্য ভালো লাগার কারণে মানুষ অনেক বেশি সেক্রিফাইস করতে পারে। বিনিময়ে কোনো কিছু পাওয়ার আশা না-করেই নিঃস্বার্থ ত্যাগের এমন দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়ে যায় ভালো লাগার গোপন চালের কারণে। এই চাল মানে না বয়স। মানে না নিজের অবস্থান। মানে না ধর্ম। মানে না বর্ণ।

চলবে...

এসইউ/এমএস

আরও পড়ুন