বাংলাদেশের উপন্যাস ও দিলারা হাশেম
১৯৪৭ সালে দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগ হয়ে তিনটি খণ্ডে দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়; ভারত ও পাকিস্তান। পাকিস্তানের আবার দুটি ভাগ পশ্চিম পাকিস্তান এবং পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ)। পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ছিল ঢাকা। নৃতত্ত্ব, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ভৌগোলিক পরিবেশ, খাদ্যাভ্যাসসহ সব ক্ষেত্রে বিস্তর ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও কেবল ধর্মের ভিত্তিতে প্রায় এক হাজার মাইলের অধিক ব্যবধানে অবস্থিত পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করে অসম রাষ্ট্র গড়ে তোলা হয়। ফলে শিল্প-সাহিত্য জগতেও আসে পরিবর্তন। সাতচল্লিশের দেশভাগের পরে ঢাকাকে কেন্দ্র করে বাংলা উপন্যাস রচনার নতুন ক্ষেত্র তৈরি হয়।
বাংলাদেশের ঔপন্যাসিকেরা পূর্বসুরিদের ধারাকে গ্রহণ করলেও উপকরণের দিক দিয়ে তাঁরা বেছে নিয়েছিলেন প্রধানত মুসলমান সমাজকে। পরবর্তী সময়ে যে স্বল্পসংখ্যক ঔপন্যাসিক শিল্পরীতির নতুন পরীক্ষায় অগ্রসর হয়েছিলেন, তারাও সমাজ এবং পরিবেশের এই বিশেষ বন্ধনকে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। গ্রামীণ জীবন, নাগরিক জীবন, আঞ্চলিক জীবনচিত্র, মনস্তত্ত্ব, ঐতিহাসিক চেতনা প্রভৃতি বিষয় বাংলাদেশের উপন্যাসে স্থান পেয়েছে।
দেশ বিভাগের ফলে বিপুল সংখ্যক হিন্দু মাতৃভূমি ত্যাগ করে হিন্দুস্থান চলে যায় আবার অনেক মুসলমানকে ভারত ছেড়ে পাকিস্তানে চলে আসতে হয়। এসব পরিবর্তন, আশা এবং সাফল্য, বেদনার কাহিনি আমাদের উপন্যাসে স্থান করে নিয়েছে। এ ছাড়া ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধের কথাও বাংলাদেশের উপন্যাস সাহিত্যে বিশেষভাবে ফুটে উঠেছে। তবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ফলে বাংলার মুসলমানদের জন্য সুযোগের একটা নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়, তা তাদের একাধিক উপন্যাস থেকে বোঝা যায়। এ সময়ে প্রাচীনপন্থী ধর্মীয় ও মাদ্রাসা শিক্ষার সাথে সাথে আধুনিক শিক্ষার প্রতি আগ্রহের পরিচয় পাওয়া যায়।
আধুনিক শিক্ষার এসব গ্রহীতারাই পরবর্তীতে মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে, অন্তত সংখ্যার দিক দিয়ে পুষ্ট করে তোলে। সাতচল্লিশের দেশবিভাগ, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর নির্বাচন, আটান্নর সামরিক শাসন, পয়ষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন ও একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রাম বাঙালির ব্যক্তি ও সমাজ মানসে যে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে, যে আশা- নৈরাশ্যের জন্মদান করে সবই বাংলাদেশের উপন্যাস সাহিত্যে লক্ষণীয়। বিভাগোত্তরকালে প্রথম দশকে উপন্যাস রচনায় যাঁরা ব্রতী হয়ে তৎকালীন সময়কে ধরে রেখেছেন তাঁদের মধ্যে প্রথমেই যাঁর নাম স্মরণযোগ্য তিনি আবুল মনসুর আহমদ (১৮৯৮-১৯৭৯)। তিনি ‘জীবনক্ষুধা’ (১৯৫৫) এবং ‘আবেহায়াত’ (১৯৬৮) উপন্যাসের মাধ্যমে সাহিত্যজগতে স্থান করে নিয়েছেন।
‘জীবন-ক্ষুধা’র নায়ক হালিম আদর্শবাদী এবং আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত যুবক। চরিত্রটির মাধ্যমে লেখক একজন আদর্শবাদী এবং সুবিধাভোগীর দ্বন্দ্ব চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, বিয়াল্লিশের ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলন, তেতাল্লিশের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ, ছেচল্লিশের মুসলিম লীগের ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম’ দিবসে প্রভৃতি রাজনৈতিক ঘটনা এ উপন্যাসের কাহিনিকে অগ্রগতি দান করেছে। কিন্তু লেখক উপমহাদেশের দেশভাগের বিপর্যয় বা দেশত্যাগের ভয়াবহ রূপকে মর্মে উপলব্ধি করতে সক্ষম হননি, ফলে পাকিস্তানে হিন্দুদের নিরাপত্তাহীনতা তিনি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
দৃষ্টির সীমাবদ্ধতা তাঁর উপন্যাসের প্রত্যাশিত মহিমা দান করতে পারেনি। তাঁর ‘আবেহায়াত’ উপন্যাসটিও কাহিনি বিন্যাস এবং ঘটনা সংস্থানের বাস্তব ভিত্তি অত্যন্ত দুর্বল। উপন্যাসটি শিল্প-সম্মত নয়, শুধু পূর্ববঙ্গের পীরপ্রথা ও ধর্মীয় সংস্কারের কারণে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে আছে। আবুল মনসুর আহমদের পরে বাংলাদেশের উপন্যাস সাহিত্যে মুসলিম ঔপন্যাসিকদের মধ্যে অন্যতম হলেন আবুল ফজল (১৯০৩-১৯৮৩)। তাঁর ‘চৌচির’ (কলকাতা, ১৯৩৪) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছিল। ‘রবীন্দ্রনাথ চৌচির পাঠের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেন আবুল ফজলকে লেখা এক চিঠিতে (৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৪০)। ১৯৪০ এর আগস্টে আবুল ফজল চট্টগ্রাম থেকে ‘চৌচির’, ‘মাটির পৃথিবী’ ও ‘বিচিত্র কথা’ শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথকে পাঠিয়েছিলেন। ‘চৌচির’ পাঠ করে রবীন্দ্রনাথ আবুল ফজলকে লেখেন, ‘আমার পক্ষে এ গল্প বিশেষ ঔৎসুক্যজনক। আধুনিক মুসলমান সমাজের সমস্যা ঐ সমাজের অন্তরের দিক থেকে জানতে হবে; এই প্রয়োজন আমি বিশেষ করেই অনুভব করি। আপনাদের মতো লেখকের হাত থেকেই। এই অভাব যথেষ্টভাবে পূর্ণ হতে থাকবে এই আশা করে রইলুম।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চৌচিরকে গল্প বলে আখ্যায়িত করেন। সুস্পষ্ট ও তীব্র দ্বন্দ্বের অভাব এবং নায়কের উদ্দেশ্যহীন জীবনযাপনের কারণে একটি সার্থক উপন্যাসের মর্যাদা লাভ করেনি। এ ছাড়া তাঁর ‘প্রদীপ ও পতঙ্গ’ (১৯৭০); ‘সাহসিকা’ (১৯৪৬); ‘জীবন পথের যাত্রা’ (১৯৪৮) এবং ‘রাঙ্গাপ্রভাত’ (১৯৫৭) প্রভৃতি উপন্যাসের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আবুল ফজলের পর বিভাগোত্তর বাংলাদেশের উপন্যাস সাহিত্যে যিনি আসন লাভ করে আছেন তিনি হলেন সত্যেন সেন (১৯০৭-৮১)। তাঁর ‘ভোরের বিহঙ্গী’ (১৯৬৬); ‘রুদ্ধদ্বার মুক্তপ্রাণ’ (১৯৭৩); ‘অভিশপ্ত নগরী’ (১৯৭৪); ‘সেয়ানা’ (১৯৭৫); ‘পদচিহ্ন’ (১৯৭৫); ‘কুমারজীব’ (১৯৭৫); ‘আল বেরুনী’ (১৯৭৬)’ ‘অপরাজেয়’ (১৯৭৭) প্রভৃতি উপন্যাস শিল্প সাফল্য অর্জন করেনি। কিন্তু ‘বিদ্রোহী কৈবর্ত’ (১৯৭৬) এবং ‘উত্তরণ’ (১৯৭০) উপন্যাস দুটি অনেকটা শিল্পগুণ সম্পন্ন।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ (১৯২২-১৯৭১), ‘লালসালু’ (১৯৪৮) অন্যতম প্রধান গুরুত্বপূর্ণ দিক এর ভাষা। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ সম্পর্কে তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হক (জ. ১৯৩৯)-এর উক্তি প্রণিধানযোগ্য, ‘বাংলাদেশের উপন্যাস কিভাবে অচেতন প্রয়াসের ক্লান্তিকর অনুবর্তনের মধ্যে প্রথম সচেতন শিল্পীর পদলাভ ঘটে, তা বুঝতে গেলে আমাদের সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর রচনার সঙ্গে পরিচিত হতে হবে। জীবননিষ্ঠা ও আধুনিক শিল্প-প্রকরণ, তাঁর শৈল্পিক সচেতনতা ও দক্ষতা, স্নায়ু ছেঁড়া সংযম ও পরিমিতবোধ, নিচু ও নির্বিকার উচ্চারণ আধুনিক সুনির্মিত উপন্যাসের সমস্ত বৈশিষ্ট্য সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’তে পাওয়া যায়।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম ঔপন্যাসিক শওকত ওসমান (১৯১৭-১৯৯৮)। ঔপন্যাসিক হিসেবে সিদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ তাঁর নিরীক্ষাধর্মী গদ্যরীতি। সংস্কৃত, তৎসম, তদ্ভব শব্দের সঙ্গে আরবি, ফারসি এবং দেশি শব্দের সংমিশ্রণে এমন একটা আবহ তাঁর উপন্যাসে তিনি তৈরি করেন, যা পাঠকের কাছে নতুন অভিজ্ঞতার সঞ্চার করে। তবে আবুল মনসুর আহমদের মতো ভাষার গোঁড়ামী তাঁর মধ্যে নেই। ‘শওকত ওসমানের গদ্যের স্বাতন্ত্র্য ও বিশিষ্টতা সম্পর্কে মুনীর চৌধুরীর মত উল্লেখযোগ্য, আধুনিক গদ্যে আরবি ফারসি শব্দ প্রয়োগের দক্ষ কারিগর শওকত ওসমান। কথা নিয়ে খেলা তাঁর শিল্পী সত্তার স্বভাবের অন্তর্গত। যখন আরবি-ফারসির দারস্থ হন তখনো তিনি এই বিজ্ঞ ক্রীড়াপরায়ণতাকে পরিত্যাগ করেন না। মূল ভাষার বিশুদ্ধ উচ্চারণ অনুযায়ী বানান লেখন, ব্যাকরণ সম্মত উপায়ে মিশ্রিত করেন। কেবল ঠাট্টা মস্করার জন্য নয়, প্রণয়লীলা, কাব্য-সাধনা, রাজকার্য পরিচালনা ইত্যাদি বিচিত্র বিষয়ের উপযোগী ঘটনা প্রবাহ সৃষ্টির জন্যও তিনি অকাতরে আরবি-ফারসি থেকে ঋণ গ্রহণ করেন।’
আবু রুশদ (১৯১৯-২০১০)-এর ‘নোঙর’ (১৯৬৭) উপন্যাসে দেশভাগের বিপর্যয় এবং স্বাধীনতা প্রাপ্তির আশা ও আশাভঙ্গের কাহিনি স্থান লাভ করেছে। এ উপন্যাসের নায়ক কামাল। লেখক উপন্যাসে কামাল চরিত্রটিকেই সর্বাধিক প্রাধান্য দিয়েছেন ফলে অন্যান্য চরিত্র জীবন্ত হয়ে ওঠেনি। তাঁর ‘ডোবা হল দীঘি’ (১৯৬৬) উপন্যাসের কাহিনি সরল ও সাদামাটা। এ ছাড়া ‘অনিশ্চিত রাগিণী’তে (১৯৬৯) কিছু মধ্যবিত্তসুলভ আদর্শ চরিত্র নির্মাণ করেছেন যা উপন্যাসের শিল্পগুণকে ব্যাহত করেছে। আবু রুশদের পর যিনি বাংলাদেশের উপন্যাস সাহিত্যকে শিল্পসফলতার পর্যায়ে পৌঁছে দেন তিনি হলেন শহীদুল্লা কায়সার (১৯২৫-১৯৭১)। ‘সারেং বৌ’ (১৯৬২); ‘সংশপ্তক’ (১৯৬৫) উপন্যাসের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের সাহিত্যজগতের বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে আছেন। ‘শহীদুল্লা কায়সারের প্রথম উপন্যাস ‘সারেং বৌ’ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ১৯৬৯ সালে রচিত হয়। দীনেশচন্দ্র সেন সম্পাদিত ‘পূর্ববঙ্গ গীতিকার’ ‘নছর মালুম’ লোক-কাহিনি অবলম্বনে তিনি ‘সারেং বৌ’ রচনা করেন। ‘সারেং বৌ’ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই উপন্যাসটি পাঠকমহলে সমাদৃত হয়। ১৯৬৮ সালে মুদ্রিত তৃতীয় সংস্করণের ‘ভূমিকা’য় শহীদুল্লা বলেন, ‘জীবনের যে অন্তর্নিহিত তাগিদ স্থবিরতা এবং অবক্ষয়ের বাঁধ ভেঙে সৃষ্টির উৎসকে উন্মুক্ত করে সে তাগিদ তো আমরা চারপাশেই দেখতে পাচ্ছি, অনুভব করছি। দেশময় আজ সৃষ্টির ও ভাঙনের ‘দ্বৈত-সঙ্গীত’ জন-জীবনের সর্বস্তরে আজ জিজ্ঞাসার কোলাহল। এ দ্বৈতচিত্র শিল্পী সাহিত্যিকদের মহৎ উপাদান, এ কোলাহল সৃষ্টির আহবান।’ ‘সংশপ্তক’ শুধু শহীদুল্লা কায়সারের শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম নয়, বাংলাদেশের উপন্যাস সাহিত্যেও এটি গুরুত্বপূর্ণ।
হিন্দু-মুসলমানের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি উপন্যাসটি রচনা করেন। চল্লিশের দশকের একজন অন্যতম ঔপন্যাসিক আবু জাফর শামসুদ্দীন (১৯১০-১৯৮৮) তাঁর ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’ (১৯৭৪) সুবৃহৎ উপন্যাস। এ ছাড়া ‘পরিত্যক্ত স্বামী’ (১৯৪৫); ‘মুক্তি’ (১৯৪৭); ‘ভাওয়াল গড়ের উপাখ্যান’ (১৯৬৩); ‘সংকর ও সংকীর্তন’ (১৯৮০); ‘প্রপঞ্চ’ (১৯৮১) প্রভৃতি উপন্যাস রচনার মাধ্যমে সাহিত্যজগতে বিশেষ স্থান দখল করে আছেন। বিভাগোত্তর সময়ে এসব ঔপন্যাসিক সাহিত্যজগতে প্রবেশের মাধ্যমে ধীরে ধীরে উপন্যাসকে একটি সফলতার পর্যায়ে পৌঁছে দেন। পরবর্তীতে ষাটের দশকে এক ঝাঁক শিল্পী-সাহিত্যিক তাঁদের রচনার সম্ভার নিয়ে হাজির হন। তাঁদের মধ্যে দিলারা হাশেম অন্যতম। এ ছাড়া তাঁর সমসাময়িক নারী ঔপন্যাসিকদের মধ্যে রয়েছেন রাবেয়া খাতুন (জ. ১৯৩৫), রাজিয়া খান (১৯৩৬-২০১১) এবং রিজিয়া রহমান (জ. ১৯৩৯)। দিলারা হাশেম ১৯৩৬ সালের ২৫ আগস্ট যশোরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, ব্রডকাস্টার এবং সংগীতশিল্পী হিসেবে খ্যাত। লেখকের পিতৃপ্রদত্ত নাম দিলারা খানম। তাঁর ডাকনাম ডেজী। পিতা বজলুর রহমান এবং মাতা শওকত আরা ওরফে শুকু। বিবাহের পরে ঔপন্যাসিক দিলারা হাশেম নামে পরিচিতি লাভ করেন। আর এটাই লেখকের সাহিত্যিক নাম।
দিলারা হাশেম ছয় বোনের মধ্যে মেজো। এ ছাড়া তাঁর দুই ভাই মিলে মোট আট ভাই-বোন। পিতা ব্রিটিশ সরকারের জুট রেগুলেশনের কমিশনার ছিলেন। সাব-রেজিস্ট্রার হিসেবে চাকরিতে যোগদান করলেও এক ধাপ পদোন্নতি হয়ে তিনি জুট রেগুলেশন কমিশনার হন। ১৯৪৫ সালে তিনি গোটা বরিশাল বিভাগের ইনচার্জ ছিলেন। পিতা সরকারি চাকরিজীবী হওয়ায় দিলারা হাশেমের শৈশব-কৈশোর ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় কাটে। সেই বঙ্গদেশের বিভিন্ন জায়গায় পিতা চাকরিসূত্রে থেকেছেন। বাঁকুড়া, পাবনা, বরিশাল। প্রথম স্কুল জীবনের সূচনা হয় পাবনায়। বাবার চাকরিতে বদলি হওয়ায় তাঁর স্কুল জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটে বরিশালে। সিরাজগঞ্জ থেকে বরিশালে বাবার পোস্টিংয়ের কারণে ১৯৪৫ সালে বরিশাল সদর গার্লস্ স্কুলে ক্লাস ফাইভে ভর্তি হন। এখানেই ঔপন্যাসিকের স্কুল জীবনের সমাপ্তি ঘটে। ম্যাট্রিক পরীক্ষায় স্কলারশিপ নিয়ে পাস করেন। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে ঔপন্যাসিক, চট্টগ্রামের ‘কে-এড’ কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। এরপর ১৯৫৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন এবং ১৯৫৭ সালে এমএ সম্পন্ন করেন। পড়াশোনা শেষে তিনি ঢাকা বেতার তথা পূর্ব পাকিস্তান বেতারে যোগদান করেন। এখানে তিনি প্রোগ্রাম প্রডিউসার হিসেবে যোগদান করেন এবং পরবর্তীতে ঘোষিকা হন। লেখক দিলারা হাশেম পরবর্তীতে স্বামীর পোস্টিংয়ের জন্য করাচি চলে যান এবং করাচি থেকে জাতীয় সংবাদ পাঠ করতেন। করাচিতে থাকাকালীন তিনি টেলিভিশনে গান করতেন। ষাটের দশকে এইচএমবিতে তাঁর গান প্রকাশিত হয়। তিনি নজরুল গীতি, গজল, আধুনিক সব ধরনের গান হারমোনিয়াম ছাড়াই গাইতেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় লেখক লন্ডনে চলে যান এবং ১৯৭২ সালে আমেরিকায় অবস্থান নেন। ১৯৭১ সালে তিনি বিবিসিতে খণ্ডকালীন চাকরি করেন। এরপর ভয়েস অব আমেরিকা (বাংলা বিভাগ), ওয়াশিংটনের অনুষ্ঠান প্রযোজন ও ব্রডকাস্টার হিসেবে যোগদান করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যয়ন শেষ করার আগে থেকেই দিলারা হাশেম লেখালেখি শুরু করেন। লেখকের সাহিত্যজীবনের সূচনা হয় শৈশবেই। ছোটবেলা থেকেই লেখালেখির ওপর ঝোঁক ছিল তাঁর। বরিশাল সদর গার্লস স্কুলের বড় লাইব্রেরি দিলারা হাশেমের লেখক হয়ে ওঠার পশ্চাতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। মা শওকত আরা ওরফে শুকু সাহিত্যপ্রেমী হওয়ায় স্কুল লাইব্রেরি থেকে মায়ের জন্য বাংলা, রুশ, জার্মান, ইংরেজি প্রভৃতি বিভিন্ন ভাষার সাহিত্যের বই নিয়ে আসতেন এবং মায়ের সাথে সাথে সেগুলো দিলারা হাশেমও পড়ে শেষ করতেন।
ফলে ছোটবেলা থেকেই সাহিত্য এবং লেখালেখির ওপর তাঁর অজস্র আগ্রহ সৃষ্টি হয়। ক্লাসিক ধারার উপন্যাসগুলো তিনি স্কুলজীবনেই শেষ করে ফেলেছিলেন। স্কুলজীবনে থাকাকালীন তিনি মাকে খুব উপন্যাস পড়তে দেখতেন। বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্রসহ সবার উপন্যাস ছোটবেলায়ই আত্মস্থ করেছিলেন। দিলারা হাশেম তাঁর আত্মজৈবনিক উপন্যাস ‘কাকতালীয়’তে বলেছেন, ‘বাড়িতে মা খুব পড়ুয়া; সিনেমা ম্যাগাজিন ও নানা ধরনের পাঠ্য তাঁর। কিন্তু সেই প্রথম শরৎচন্দ্রের উপন্যাস হাতে পেলাম। মা ও বাবা দুজনেরই আমাদের নানান সুশিক্ষা দানের ব্রত ছিল বলে অনেক ধরনের বহু বই থাকলেও উপন্যাস দেখিনি; পড়িওনি। থাকলেও মা আমাদের চোখের আড়ালেই রাখতেন।’
অপরাধ করলেই বরিশাল সদর গার্লস স্কুলের নিয়মানুযায়ী ডিটেনশনে যেতে হতো। ‘ডিটেনশনের শাস্তি পরে আরও বার কয় পেতে হয়েছে কিন্তু বইগুলোর সান্নিধ্যের দরুনতা শাস্তির পরিবর্তে সুখকরও কাম্যই হয়ে দাঁড়িয়েছিল তা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই। বাস্তবিক উপন্যাস পাঠের নেশা জন্মে গিয়েছিল সেই ডিটেনশন সূত্রেই। দুপুরের লাঞ্চ-ঘণ্টা বাজতেই আমরা গিয়ে হাজির হতাম বরিশাল সদর গার্লস স্কুলের প্রধান ভবনটির মাঝামাঝি সেই বিশাল লাইব্রেরি ঘরটিতে। মাঝখানে টানা টেবিলের দুপাশে বেঞ্চ পাতা আর দেয়ালের সাথে লাগানো সারি সারি ছাদ ছুঁই ছুঁই সেলফে অগুনতি বই। ফ্রেঞ্চ, জার্মান, রাশান বইয়ের বাংলা তর্জমাসহ বাংলা ভাষার সাহিত্যের অমূল্য সম্পদে পরিপূর্ণ ছিল লাইব্রেরিটি। আমাদের উর্বর মস্তিষ্কের জন্য তা ছিল চুম্বক আকর্ষণ।’
ছোটবেলার এই সাহিত্যপ্রেম পরবর্তী সময়ে দিলারা হাশেমকে লেখক হওয়ার অনুপ্রেরণা জোগায়। শখের বসেই তাঁর প্রথম উপন্যাস লেখা। তিনি চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন যে তিনশ-চারশ পাতার উপন্যাস লিখে পাঠকের আগ্রহ কতটুকু ধরে রাখতে পারেন। এভাবেই লেখকের সাহিত্যচর্চার সূচনা ঘটে।
দিলারা হাশেমের সাহিত্যচর্চার নেপথ্যে পারিপার্শ্বিক জগতের ভূমিকা ছিল। বরিশালে তাঁর বেড়ে ওঠা কিন্তু যশোরে দাদার বাড়ি হওয়ায় মাঝে মাঝে সেখানে বেড়াতে যেতেন। এ ছাড়া তাঁর নানাবাড়ি মুর্শিদাবাদের বহরমপুর কিন্তু তাঁরা মামবাড়ি বা নানাবাড়ি বলতে কলকাতায় বেড়াতে যেতেন। দিলারা হাশেমের মা কলকাতায় তাঁর নানির কাছেই মানুষ। বিয়ের সময় বজলুর রহমান (দিলারা হাশেমের বাবা) যশোরের সাব-রেজিস্ট্রার ছিলেন। তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াশোনা করেন এবং সেখানেই হোস্টেলে থেকেছেন বলে তাঁর ভাষা ছিল শুদ্ধ বাংলা। তাঁর মাও বিশুদ্ধ বাংলায় কথা বলতেন। এ সম্পর্কে স্বয়ং দিলারা হাশেম তাঁর ‘কাকতালীয়-২’ আত্মজৈবনিক উপন্যাসে বলেছেন, ‘কলকাতায় তৎকালীন সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে লেখাপড়া শিখেছিলেন এবং আমার নানি মানে আম্মার মা অনেক উর্দু মিশেল দিয়ে কথা বলতেন, কিন্তু আমার মা, মামুরা, নানা এবং একমাত্র খালার বাংলায় ছিল অতি বিশুদ্ধ উচ্চারণ। তাতে কলকাতার টান নয়; ছিল বিষ্ণুপুর, নদীয়ার মিষ্টি বাংলার সুর। আর পূর্ব বাংলায় থাকার কারণে আমাদের ভাষা ও উচ্চারণ নষ্ট হয়ে যাবে বলে মার ছিল আমাদের উচ্চারণ শুদ্ধ রাখার অক্লান্ত প্রয়াস। (বোধ করি পরবর্তীতে সে কারণেই আমি ভালো বেতার সম্প্রচারক বা সংবাদ পাঠক হিসেবে সুনাম অর্জন করতে পেরেছিলাম)। ফলত আমার মায়ের শেখানো সেই বিশুদ্ধ বাংলায় মিষ্টি উচ্চারণেই কথা বলতাম, ছোটবেলা থেকে সেই ভাষাটাই রপ্ত হয়েছিল।’ দিলারা হাশেমের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ তাঁকে লেখক হয়ে উঠতে সহযোগিতা করে।
ষাটের দশকে আমাদের পারিপার্শ্বিক জগতের মধ্য থেকে নারী হিসেবে লেখক হয়ে আত্মপ্রকাশ করা খুব একটা সহজ কাজ ছিল না। আমাদের সাহিত্যে নারীদের অবদান দেখলে তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু দিলারা হাশেমের পরিবার ছিল তাঁর মূল শিক্ষাকেন্দ্র। মা-বাবার সাহচর্য তাঁকে বেড়ে উঠতে সহায়তা করেছে। তিনি লেখক, সংগীতশিল্পী এবং শৈশবে ছবি আঁকতেও তাঁর যথেষ্ট সুনাম ছিল। ‘কাকতালীয়-২’-এ পাই, ‘আমার ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকার শখের কথা আমি আগেই বলেছি। প্রথম শুরু হয়েছিল ভাঙা ইটের লাল টুকরো দিয়ে ছাদের উপর রাজা ও রানির মুখ আঁকার মধ্য দিয়ে।...ইয়াং পাকিস্তান ক্লাবের একটি পাতায় মো. আলী জিন্না ও ফাতেমা জিন্নার কালি ফোঁটা দিয়ে আঁকা ছবিটিও ছাপা হয়েছে। তলায় আমার নাম। বোধহয় সেটাই আমার শিল্পী জীবনের শুরু।’
এ পর্যন্ত প্রকাশিত তার গোটা তিরিশ গ্রন্থের মধ্যে ‘ঘর মন জানালা; ‘আমলকীর মৌ’; ‘কাকতালীয়’; ‘একদা এবং অনন্ত’; ‘স্তব্ধতার কানে কানে’ প্রভৃতি উপন্যাস উল্লেখযোগ্য। ১৯৬৫ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘ঘর মন জানালা’ বাংলাদেশের একটি অতি জনপ্রিয় উপন্যাস হিসেবে সুভাষ দত্তের পরিচালনায় ও কবরীর প্রযোজনায় ১৯৭৩ সালে ‘বলাকা মন’ নামে চলচ্চিত্র হয়ে প্রকাশিত হয়। ‘ঘর মন জানালা’ উপন্যাসটি ১৯৬৫ ও ১৯৯৬ সালে যথাক্রমে রুশ এবং চীনা ভাষায় অনূদিত হয়। দিলারা হাশেমের ‘ঘর মন জানালা’ (১৯৬৫) ‘একদা এবং অনন্ত’ (১৯৭৫); ‘স্তব্ধতার কানে কানে’ (১৯৭৭); ‘আমলকীর মৌ’ (১৯৭৮); ‘বাদামী বিকেলের গল্প’ (১৯৮৩); ‘কাকতালীয়’ (১৯৮৫) ‘মিউর্যাল’ (১৯৮৬); ‘শঙ্খ করাত’ (১৯৯৫)’; ‘সেতু’ (২০০০); ‘চন্দ্রগ্রহণ’ (২০০২); ‘ শেষরাতের সংলাপ: টুইন টাওয়ার’ (২০০৩); ‘রাহুগ্রাস’ (২০০৩); ‘সিংহ ও অজগর’ (২০০৬); ‘অয়নায়ন’ (২০০৯); ‘কাকতালীয়-২’ প্রভৃতি উপন্যাসের মাধ্যমে দিলারা হাশেম বাংলা উপন্যাসে তাঁর চিরস্থায়ী আসন করে নিয়েছেন।
এসইউ/জিকেএস