সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালের এক মাসের কবিতা
খৃষ্টমাসের দীর্ঘ দশ দিনের ছুটিতে ফেসবুকে পোস্ট করা দুই বছরের (২০২০-২০২১) কবিতা কয়লার খনি থেকে কষ্টি পাথরের মতো উদ্ধার করে আনলাম। সেই কবিতাগুলো প্রতি মাস অনুযায়ী বিভিন্ন অনলাইন পোর্টাল ও ওয়েব ম্যাগাজিনে প্রকাশ হচ্ছে। জাগো নিউজের সাহিত্য বিভাগের জন্য অক্টোবর ২০২১ সালে লেখা কবিতাসমূহ উপস্থাপন করছি।
নিষিদ্ধ গ্রামের গন্ধম
একটি স্নিগ্ধ বিদেশি বিকেলের সাথে স্নিগ্ধাকে নিয়ে চা খাবো
দানিউব নদী অথবা নায়াগ্রা নদীর পাড়ে—
আপেল ক্ষেত বা আঙুর বাগানের পাশে।
আমাদের আলোচনা হবে—বুড়িগঙ্গা, সদর ঘাট, বরিশালের লঞ্চ নিয়ে।
আড্ডা হবে ফেলে আসা বাংলা কবিতা নিয়ে,
যদিও বাংলা কবিতা চাঁদের মতো আমাদের সাথে সাথেই থাকে
স্নিগ্ধ জোছনা ছড়ায়।
কতটা জোছনা ছড়ালে স্নিগ্ধা নিজেই কবিতা হয়ে ওঠে?
বাউলদের তো ঘর নেই, তুমি কেন ফিরলে নিজের কাছে!
হাঙ্গেরির প্রথম রাজা কিং সেন্ট স্টিফেন
তোমার কবিতা শোনার জন্য ৩১ অক্টোবর আমাকে ফোন করেছিলেন।
তিনি জানতে চেয়েছেন, অ্যাজোথালোম কি কিছু বলেছে?
বুদাপেস্ট কি তোমাকে ভাত দেয়নি!
স্টিফেনের মতো আমিও বঞ্চিত হলাম—
দানিউব বা নায়াগ্রার টেবিলে বসে দু’পাড়ে দুই জন চা-চিয়ার্স থেকে,
এশিয়ান যাযাবর অভিবাসী মজর গোষ্ঠীর সংঘবদ্ধভাবে
হাঙ্গেরিতে ধর্মান্তরিত হবার গল্প থেকে,
বঞ্চিত হলাম—নিষিদ্ধ গ্রাম অ্যাজোথালোমের গন্ধম থেকে ।
টরন্টো, ৩০ অক্টোবর ২০২১
দাঁতের ডাক্তার
চুমু খাবার আগে দাঁতব্রাশ
এবং পরে মুখ ধোয়া অনিবার্য।
এ ব্যাপারে দাঁতের ডাক্তারকে প্রশ্ন করা হলে বলেন:
বিষয়টি আমার জানা নেই।
কারণ,
আমি মুখের চিকিৎসক নই।
টরন্টো, ২৯ অক্টোবর ২০২১
বাংলা এবং বাঙালি
নাইট কোচে চাটগাঁ যাচ্ছে কাইয়ূম
একটু পরপর সিটের উপরের টং থেকে ব্যাগ খুলে
পানি খাচ্ছে, ওষুধ খাচ্ছে।
পানির ভেতরে জল মেশানো
জল মানে ওষুধ, ওষুধের বোতলে বাংলা।
দেশপ্রেমিক কাইয়ুম গানে গানে গান করে:
‘বাংলা আমার তৃষ্ণার জল, তৃপ্ত শেষ চুমুক
আমি বাংলায় গান গাই
আমি বাংলার গান গাই
আমি আমার আমিকে চিরদিন এই বাংলায় খুঁজে পাই।’
একবার শীতকালে বিদেশে ট্রেনিংয়ে গিয়েছিলেন
সেখানেও তিনি প্রতুল মুখার্জীর
খাঁটি ‘বাঙালি’ ছিলেন।
টরন্টো, ২৮ অক্টোবর ২০২১
গামছা
আমাদের গরিবের গামছা এখন আর দরিদ্র নয়,
ঐতিহ্যবাহী গামছার গৌরব বিবি তুলে ধরেছেন ফ্রান্সের ফ্যাশন শো’য়
গামছার ওড়না, গামছার স্কার্ট, গামছার ফতুয়া
সংস্কৃতির অংশ, বাঙালির গর্ব।
আমি শ্রমজীবী মানুষের গামছার গান গাই—
‘ঘাড়ের গামছা থুইয়া যাও’
আমি গামছা বাঁধা দই দেখি,
গামছার কবিতা লিখি।
বীর কাদের সিদ্দিকী টুপি খুলে গ্রহণ করেছেন গামছা।
কড়া রোদ আর হালকা বৃষ্টিতে ছাতা,
গরমে পাখা এবং গরিবী চাঁদর বিছিয়ে হাত-বালিশে
গাছের শীতল ছায়ায় শান্তির ঘুম।
আর স্নান সেরে নারীরা গামছা দিয়ে ভেজা চুল ঝাড়ে
মাঠে বিছিয়ে মাগরেব পড়ে কেউ কেউ।
শুধু এসব ঐতিহ্য নয়; ঐতিহাসিক দুঃখও আছে—
গামছা গলায় ঝুলিয়ে আত্মহত্যা করেছেন
ঋণগ্রস্ত প্রান্তিক বর্গাচাষি।
এই লাল গামছা মাথায় বেঁধে
নীল বিদ্রোহ, কৃষক আন্দোলনে রক্ত দিয়েছে এদেশের মানুষ!
গা মোছা থেকেই গামছার উৎপত্তি
আমিও তা দিয়ে গা মুছি, মন মুছি,
তোয়ালের চেয়ে গামছা আমার আপন, আত্মীয়।
মাটির গন্ধের মতো গামছায় মিশে থাকে—
আমাদের পূ্র্বপুরুষের রক্তস্মৃতি, কৃষিঋণ ও জলঘ্রাণ।
টরন্টো, ২৫ অক্টোবর ২০২১
মেয়েটি
‘মেয়েটি কাঁদছিলো ঠিক মেয়েদের মতো’
আপেলটা দেখতে
অবিকল আপেলের মতো।
মানুষটি কিন্তু মানুষ নয়, অবিকল জীব-জানোয়ারের মতো।
এবং স্বদেশটা আর বাংলাদেশের মতো নয়!
মেয়েটি কাঁদলে আমার চোখ ভিজে যায়,
মন ও মাটি ভিজে যায়
বাংলাদেশে বৃষ্টি নামে!
টরন্টো, ২৪ অক্টোবর ২০২১
মানচিত্র
মেয়েটির রক্তক্ষরণ হলে—
সারা শরীরের শিরা-উপশিরা
তিনশ কুড়িটি নদীমাতৃক জল শুকিয়ে যায়!
মেয়েটি ধর্ষিতা হলে—
বাংলাদেশের যোনিপথ সন্দ্বীপ দিয়ে টপটপ রক্ত ঝরে।
মেয়েটি ফাঁসিতে ঝুললে—
গাইবান্ধার গলা আটকে থাকে সোনালি আঁশের রশিতে।
মেয়েটি স্তন ক্ষতাক্ত হলে—
চাঁপাইনবাবগঞ্জ চুপসে যায় লজ্জায়।
মেয়েটির ডানা কাটা গেলে—
সিলেট খণ্ডিত হয়ে পড়ে।
মেয়েটির নাভিমূলে তাজা তলোয়ার ঢুকে পড়লে—
ঢাকা শহরে দিন দুপুরে ঘন অন্ধকার নেমে আসে।
মেয়েটি পা হারিয়ে পঙ্গু হলে—
পার্বত্য অঞ্চল টিকটিকির কাটা লেজের মতো লাফায়
একটি মানচিত্র, একখণ্ড বাংলাদেশ!
টরন্টো, ২৪ অক্টোবর ২০২১
নদ-নদীর লিঙ্গ
নদ-নদী নিয়ে ভাবি এবং এক ভাবীর সাথেও আলোচনা করি। নদী, উপনদী, শাখা নদীর সম্পর্ক ভাবতে ভাবতে ভাবীর সাথে হাবুডুবু সাঁতার কাটি; পাগলদের মতো হাসি। হাসতে হাসতে নদী বিষয়ক গবেষক হয়ে উঠি! নদের শিশ্ন নেই, নদীর যোনি নেই। তবু তারা প্রাণিদের মতো, স্বামী-স্ত্রীর মতো পুংলিঙ্গ, স্ত্রীলিঙ্গ!
কোন পণ্ডিত জলধারায় সেক্সটয়ের মতো নকল লিঙ্গ বসিয়ে নদ-নদী নিয়ে রসিকতা করেছেন! পুরুষবাচক, স্ত্রীবাচক শব্দ দিয়ে হাস্যকর নামকরণ। সূত্র মোতাবেক নদী ক্লিবলিঙ্গ। তবে পঞ্চম শ্রেণিতে নদীর রচনা লিখতে গিয়ে গরুর রচনা লিখেছিলাম। ভূগোল স্যার বেত দিয়ে পেটাতে পেটাতে শিখিয়ে ছিলেন: যার কোনো শাখা নেই, সেটাই নদ। যেমন- নীল নদ। আর এই তিনশ কুড়ি পক্ষান্তরে ৩১০টি নদীমাতৃক দেশে নদও আছে কিছু—ব্রহ্মপূত্র, কপোতাক্ষ।
তবে মিথলজিক্যাল নামকরণে অমিমাংসিত ‘কুমার’ নদ নামে পুরুষালি হলেও নারী নদী হিসেবেই পরিচিত; মূলত সে কুমারী। এ ব্যাপারে আমাদের পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট নীরব ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে; মুখ খুলছে না।
নদীরা নারীর মতো। জুলেখা, বিপাশা, রূপালি, তাহমিনাদের মতো তাদের আকার আছে, ইকার আছে—পদ্মা, মেঘনা, করতোয়া, কর্ণফুলি, সন্ধ্যা, সুগন্ধা, বুড়িগঙ্গা।
আবার একই সাথে আড়িয়াল খাঁ এবং ভৈরব উভয় লিঙ্গ। হিজড়াদের মতো আংশিক নদ বাকিটুকু নদী। যাই হোক, নদ-নদীরও ধর্ম আছে। আড়িয়াল খাঁ মুসলিম। ভৈরব হিন্দু।
টরন্টো, ২৩ অক্টোবর ২০২১
আন্তর্জাতিক পিতৃভাষা
ইংরেজি সার্বজনীন ভাষা হিসেবে স্বীকৃত
আমি অস্বীকার করি।
পাখিরা, নদীবৃন্দ, অনুবাদক
এবং ধ্বনি উৎপাদনকারী বাতাসও বোঝে না ইংলিশ।
প্রকৃত প্রতীকী ভাষাই
আমাদের, তোমাদের সার্বজনীন সম্পদ।
ইশারা ভাষাই মানুষের আসল ভাষা, পিতৃভাষা
উত্তরসূরি এবং পূর্বসূরির এজমালিক বায়বীয় ভূগোল।
জাতিসংঘের বাইরে থাকা—
দখিনসূরি, পশ্চিমসূরিরাও একদিন অংশিদার হবে
চাইবে আন্তর্জাতিক পিতৃভাষার সদস্যপদ।
যদিও সাংকেতিকতায়
কিছুটা বিভ্রান্ত, কিছুটা বৈপরীত্ব, কিছুটা বেদনা আছে:
হেলাল মহিউদ্দিনের সম্মতিসূত্রের তথ্য—
[ঘাড়ের দু’পাশে মাথা দোলালে ‘না’ বোঝায়!
অসম্মতির—না।
শ্রীলঙ্কায় ঘাড়ের দু’পাশে মাথা দোলানোর অর্থ কিন্তু ‘হ্যাঁ’!
সম্মতির—হ্যাঁ!]
স্বদেশে বুড়ো আঙুল দেখালে ভুল বুঝে, গালিসূত্রে
বিদেশে বুড়ো আঙুল প্রশংসা প্রকাশ করো, গুণসূত্রে।
তবে
বাম তর্জনির সাথে বাম বৃদ্ধা গোল করে—
সেই বৃত্তের ভেতর ডান তর্জনি ঢুকালে বিশ্বের সর্বত্র একই অর্থ,
সার্বজনীন ভাষা।
টরন্টো, ২৩ অক্টোবর ২০২১
লাবণ্য দাশ
অহংকারী, সুন্দরীদের ভীষণ ভালো লাগে,
তারা নিজে নিজে জীবননান্দ দাশের
প্রেমিকা হয়ে থাকে,
তাহারা বসন্তে বসবাস করে হেমন্তের ঋণে জর্জরিত,
অপছন্দনীয় লাবণ্যকে মনে করে প্রতিপক্ষ!
বরিশাল্যা বাবু ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানেন না
মৎস্য এবং ধুতি কেনার পয়সা ছিল না।
সেই জীবননান্দের বেদনাগুলো
আমাদের অমূল্য সম্পদ।
সুন্দরীদের বেশ ভালো লাগে, মিষ্টি লাগে
মিষ্টি আমার অপছন্দীয়; ইগনোর করি—
ভালোবাসি লাবণ্যকে।
ঋতুদৃশ্য জীবন বাবু দূর থেকে দূরবীণ দিয়ে দেখেন,
আর আমাদের মা কুসুমকুমারী দাশও
এসব টের পান!
টরন্টো, ২২ অক্টোবর ২০২১
হিন্দু-হিন্দু খেলা
আর্জেন্টিনার সমর্থক, ব্রাজিলের ভক্ত
দলের জার্সি পরে—
পতাকা হাতে নিয়ে মাঠে, মাঠের বাইরে মারামারি করে,
আবহানী-মোহামেডানের মতো ভাঙচুর করে।
কিন্তু তারা ফুটবল খেলে না; খেলোয়াড় নয়,
জানে না—বলের ভাষা, ব্যাকরণ
জানে না—বল খেলার দোয়া।
ধর্মান্ধ ভক্তরাও জানে না—
লাকুম দিনুকুম ওয়ালিয়াদীন।
তারাও শাদা জার্সি পরে
আগুন নিয়ে এক তরফা হিন্দু-হিন্দু খেলে, মারামারি করে।
বাংলাদেশ তখন অসহায়, অনাথ শিশু; চিৎকার করে কাঁদে!
টরন্টো, ১৮ অক্টোবর ২০২১
ভারতীয় রবীন্দ্রনাথ
আমরা কলকাতার চেয়ে এগিয়ে এবং রবীন্দ্রনাথের চেয়েও আধুনিক, অনেক অগ্রগামী। উদাহরণ, দৃষ্টান্ত ছাড়া বলছি না। ল্যাবে তুলনামূলক সাহিত্যর মতো অঙ্ক করে প্রমাণ দিচ্ছি:
আমরা প্রাদেশিক নই। অর্জন করেছি মাতৃভাষা। ঢাকা থেকে কলকাতা পিছিয়ে থাকে সব সময়। সময়ের দিক থেকে আমরা আধা ঘণ্টা এগিয়ে থাকি; সূর্যোদয়েও। আমাদের ভোরের ফুল ফোটে ত্রিশ মিনিট আগে।
সীমাবদ্ধ রবীন্দ্রনাথ বুড়ো, পুরোনো, প্রাচীন, অআধুনিক। বেরিয়ে আসতে পারেননি ধুতি থেকে, ঠাকুর বাড়ি থেকে। তিনি জানতেন না স্প্যানিশ ভাষা। বেচারা অ্যানালগ পদ্ধতিতে হাতে-কলমে-কালিতে-কাগজে লিখতেন।
আমরা লিখি যান্ত্রিক ডিজিটালে। আমরা অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট। আমরা দুই-তিন দেশের নাগরিক, সেই সাথে বিশ্ব নাগরিক। রবীন্দ্রনাথ শুধু ভারতীয়!
টরন্টো, অক্টোবর ১৫ ২০২১
কাশফুলের কবিতা
টরন্টোতে ভাদ্র-আশ্বিন নেই, ফ্রাঙ্কফুটে শরৎ নেই
তবু ফোটে শারদীয় পাতাবাহার
বর্ণিল হয়ে ওঠে মেপল লিফ!
কাশবনের কন্যার জনক অভিমানে ঘুমিয়ে থাকে
প্রিমাপর্তায়, রোমে।
রাইনের পাড়ে কাশফুলের নিচে দাঁড়িয়ে
মনে পড়ে ব্রহ্মপুত্র
নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে ভাবি নদের স্মৃতি।
টরন্টো, ১৪ অক্টোবর ২০২১
গরম ভাতের ধোঁয়া
চাঁদের মতো আমিও কোনো এক আকাশের গভীরতায়
মেঘে মেঘে ডুবে যাই
ফুটে উঠি অক্সিজেনের ফুল হয়ে,
জেগে উঠি ঋতুতে, ঋতুস্রাবে।
পাহাড়ি নির্জনতা থেকে জন্ম নিই—
নতুন নদী,
মাছেরাও ভালোবাসে জল মাখানো জোছনা।
বরফের নিচে শুয়ে থাকা
ঝরা, মৃত মেপল লিফও রেখে যায়
আনন্দের কয়েন এবং জবা ফুলের জিহ্বা!
ডুব সাঁতারের মতো ফিরে আসি দ্বিতীয় বিবাহে, বৈশাখে
আউশ চালের গরম ভাতের ধোঁয়া হয়ে ফিরে আসি।
টরন্টো, ১৩, অক্টোবর, ২০২১
মা, আমিও মা হতে চাই
সেলাই করা গ্রন্থিত যৌথ শরীরে এতো অদ্ভুত গন্ধমের গন্ধ
তা কেন কখনো বলোনি, মা-বন্ধু।
সেক্সানন্দ এতো ওয়ান্ডারফুল!
ইয়েসটার ডে আই লস মাই ভার্জিন—
বাট কী অসাধারণ অভিজ্ঞতা;
গন্ধমের গন্ধে আমি বিভোর, আমি খুঁজে পেয়েছি তৃপ্তির পৃথিবী।
সিঙ্গেল মাদার, মা আমার
তুমি বাবাকে দূরে সরিয়ে দিয়ে কেন নিজেকে বঞ্চিত করছো
স্বর্গীয় সুখ থেকে, তৃপ্তির পৃথিবী থেকে!
মা আমিও মা হবো, মা হতে চাই
যেভাবে আমি তোমাকে অক্টোপাসের মতো জড়িয়ে থাকি,
ভালোবাসি।
আমার মেয়েটিও আমাকে নিবিড়ভাবে ভালোবাসবে!
“হা হা হা। যদি তোর একটি ছেলে হয়,
যদি তোর পেট থেকে তোর বাপ এবং সাপ যমজ বেরিয়ে আসে
যদি করোনাভাইরাস জন্ম নেয়”!
টরন্টো, ১২ অক্টোবর ২০২১
বেসামরিক কবিতা
কন্ট্রাক ল্যান্সের মতো ঘুমগুলো খুলে বালিশের নিচে রেখে দেই। রাত গভীর হলেই ঘুমগুলো অস্থির হয়ে ইঁদুরের বাচ্চার মতো ছটফট ছোটাছুটি করে! আর তখনই নিদ্রার ফরমান জারি হয় সামরিক নির্দেশে!
অথচ নারী শাসিত নির্দেশের আগে গণতন্ত্রের বিপরীতে আমাকে রাজ্য দেয়, রাজা বানায়। আমার গায়ে জড়িয়ে থাকে বাদশাহ-সম্রাটদের ঝলমলে পোশাক, শিরদেশে গ্রাজুয়েশনের চমৎকার টুপির মতো মাথায় রাজকীয় কারুকাজ করা মুকুট, কোমরের খাপে নাটকের নকল চকচকে তলোয়ার, পায়ে খন্ডিয়াতৎ’এর মতো নাগ্রা জুতো। অভিষেক স্বরূপ সুদূর লক্ষ্ণৌ থেকে আনা হচ্ছে বাঈজি আমার ঘুমের ভেতর বেজে ওঠে নাচনিওয়ালির ঘাগড়া, ঝাঁঝালো ঝনঝনানো নূপুর।
তুমি তো সম্রাজ্ঞী নও; সৃষ্টিকর্তী। সৃষ্টি করো সংগীত। বানাও পুতুল, পর্বত, দ্বিতীয় পৃথিবী। সামরিক অধ্যাদেশের ঘুম, সেই ঘুমের বিরুদ্ধে তথাকথিত গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে নকল তলোয়ারের স্থলাভিষিক্ত হলো বিষাক্ত ছুরি। আমার বিদ্রোহ টের পেয়ে তুমি ক্ষমতার অপব্যবহার করে আমাকে ব্যাঙ না বানিয়ে বানালে বৃটেনের ক্ষমতাহীন রানি।
টরন্টো, ১১ অক্টোবর ২০২১
মুক্ত-যুক্ত
প্রতিটি সংখ্যা, ৭ কিংবা ০
স্বতন্ত্রতায় নিজে নিজে ধন্য।
আংশিক স্বাধীন, আংশিক মুক্ত।
মিলেমিশে হয় একাকার, যুক্ত
সমবায়; সমবেত যৌথ যাত্রা
পেয়ে যায় গাণিতিক ভিন্ন মাত্রা।
প্রশ্ন ছাড়াই চলে আসে উত্তর—
যেমন সাতের সাথে শূন্য, সত্তর।
জড়িয়ে জড়িয়ে তৈরি করে শব্দ
প্রতিটি বর্ণও ‘ক’ কিংবা ‘দন্তস্য’
মিলেমিশে ফুটিয়ে তোলে বর্ণিল বসন্ত।
বর্ণ জড়িয়ে জড়িয়ে তৈরি করে মালা
আকার-ইকার সুঁই-সুতার সেলাই; গালা।
একাকী অক্ষর অনেকটা অর্থহীন—
আক্ষরিক বিবাহ বন্ধনে শর্তহীন
বর্ণমালার বাগান, সংসার। পূর্ণতা।
একাকী, শূন্যতা।
টরন্টো, ০৯ অক্টোবর ২০২১
খাদ্য এবং আত্মরক্ষার পাটি গণিত
হরিণ এক লাফে তেরো হাত দূরত্ব অতিক্রম করে
জঙ্গলের ঝরনা পাড়ি দেয়
পক্ষান্তরে এক লাফে বাঘের গন্তব্য বারো হাত,
খাদে পড়ে নষ্ট করে কিছুটা সময়।
খাদ্য এবং আত্মরক্ষার অলিম্পিকে
দৌড়ের ক্ষীপ্রতায় এই সরল অঙ্কের পরেও ধরা খাই,
আমরা হরিণ হেরে যাই
বারবার পেছনে ফিরে তাকাই।
বাঘের দৃষ্টি সামনে শিকারীর দিকে
আমরা দেখি তীব্র বেগে ধেয়ে আসছে মৃত্যু।
টরন্টো, ০৪ অক্টোবর ২০২১
টাকা হারানো পর
টাকা হারালে আপনার কেমন লাগে?
আপনারা কি নরম জলের বদলে গরম কড়াইয়ে সাঁতার কাটেন!
আমার তো ঝরঝরে লাগে;
জ্বর ছেড়ে যাওয়ার মতো।
নিজেকে মনে হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর।
খাবারে রুচি দ্বিগুণ হয়,
বিয়ার এবং সঙ্গমের তৃষ্ণাও বাড়ে
পুরোনো বন্ধুদের সাথে তুমুল আড্ডা মনে পড়ে
এবং নিজেকেও হারাতে ইচ্ছে করে।
টাকা হারিয়ে গেলে নিজেকে কাঠগোলাপ ভাবি,
কারণ আমার নিশ্বাস থেকে বের হতে থাকে ঘ্রাণ
আমি নিজের সুরে সৌরভে রবীন্দ্রসংগীত গাইতে থাকি।
টাকা হারানোর আনন্দ আমাকে বান্দরবানে ভ্রমণে নিয়ে যায়
ফিরিয়ে দেয় শৈশব।
টাকা-পয়সা নাকি হাতের ময়লা,
টাকা খোয়া গেলে খুব গোছল করার ইচ্ছে জাগে।
যিনি টাকাগুলো কুড়িয়ে পেলেন,
তার হাসি, তার আনন্দ আমারও ভীষণ ভালো লাগে!
টরন্টো, অক্টোবর ০৪ ২০২১
এসইউ/এমএস