ব্যতিক্রমী কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হক
সাম্প্রতিক বাংলা সাহিত্যের গৌরবময় একটি নাম হাসান আজিজুল হক। তার তুলনা কেবল তিনিই। ব্যতিক্রমী এ কথাশিল্পী ১৯৩৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার যবগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মোহাম্মদ দোয়া বখশ এবং মা জোহরা খাতুন।
হাসান আজিজুল হক জীবনের বেশিরভাগ সময় রাজশাহীতে কাটিয়েছেন। তিনি ১৯৫৪ সালে যবগ্রাম মহারানী কাশীশ্বরী উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ১৯৫৬ সালে খুলনার শহরের অদূরে দৌলতপুরের ব্রজলাল কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
রাজশাহী কলেজে পড়ার সময় কলেজের উদ্যমী তরুণ মিসবাহুল আজীমের সম্পাদনায় প্রকাশিত ভাঁজপত্র ‘চারপাতা’য় হাসান আজিজুল হকের প্রথম লেখা ছাপা হয়, লেখার বিষয় ছিল রাজশাহীর আমের মাহাত্ম্য। তবে সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল পত্রিকায় ১৯৬০ সালে ‘শকুন’ নামে গল্প প্রকাশের মধ্য দিয়ে তিনি সাহিত্যাঙ্গনে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন।
তবে কৈশোর জীবনেই তার সাহিত্যচর্চার হাতেখড়ি। তিনি যখন কাশীশ্বরী উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র; তখন ওই স্কুলে রাজা সৌমেন্দ্র চন্দ্র নন্দীর আগমন উপলক্ষ্যে একটি সংবর্ধনাপত্র রচনা করেন। এর মধ্য দিয়ে তার লেখালেখি জীবনের শুরু হয় বলে মনে করা হয়। তখন থেকেই তিনি সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করতে থাকেন।
এছাড়া ১৯৬০ সালে ‘পূর্বমেঘ’ পত্রিকায় ‘একজন চরিত্রহীনের স্বপক্ষে’ গল্পটি প্রকাশিত হওয়ার পরই তিনি একজন ব্যতিক্রমী কথাশিল্পী হিসেবে পরিগণিত হতে থাকেন। অচিরেই বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বশীল সবগুলো পত্রিকায় তার ছোটগল্প প্রকাশিত হতে থাকে।
তার প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য’ এর প্রথম গল্প ‘শকুন’ এ সুদখোর মহাজন তথা গ্রামের সমাজের তলদেশ উন্মোচিত করেছিলেন। প্রায় অর্ধশতাব্দীর গল্পচর্চায় বিষয়, চরিত্র ও নির্মাণকুশলতায় হাসান আজিজুল হক অনেক উল্লেখযোগ্য গল্পের রচয়িতা।
তিনি ১৯৭৩ সাল থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনের অধ্যাপক ছিলেন। অবসরের পর ২০২১ সালের ১৫ নভেম্বর তিনি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। অধ্যাপনার সঙ্গে সঙ্গে তিনি অনেক গল্পের স্রষ্টা। গল্প অনেক লিখেছেন, কিন্তু রহস্যময় কোনো কারণে উপন্যাস-লেখায় বিশেষ আগ্রহ দেখাননি। তারপরও মাত্র তিনটি উপন্যাস পাওয়া যায় তার লেখা। তার ‘আগুনপাখি’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাঠকসমাজের উৎসুক প্রতীক্ষার যেন অবসান হয়।
ষাটের দশকে আবির্ভুত এ কথাসাহিত্যিক তার সুঠাম গদ্য এবং মর্মস্পর্শী বর্ণনাভঙ্গির জন্য প্রসিদ্ধ। জীবনসংগ্রামে লিপ্ত মানুষের কথকতা তার গল্প-উপন্যাসের প্রধানতম অনুষঙ্গ। রাঢ়বঙ্গ তার অনেক গল্পের পটভূমি। তবে আগুনপাখি (২০০৬) তার রচিত প্রথম উপন্যাস।
১৯৬০ সালে ‘বৃত্তায়ন’ নামে একটি ছোট উপন্যাস লিখলেও তিনি নিজেই এর বড় সমালোচক হয়ে ওঠেন। এ রচনাকে তিনি নিজেই উপন্যাস হিসেবে অস্বীকার করে থাকেন। তবে আগুনপাখি উপন্যাসটি প্রকাশিত হলে প্রথম আলো বর্ষসেরা বইয়ের স্বীকৃতি লাভ করে। এ উপন্যাসের জন্য তিনি ২০০৮ সালে কলকাতা থেকে ‘আনন্দ সাহিত্য পুরস্কার’ লাভ করেন।
তার দ্বিতীয় উপন্যাস ‘সাবিত্রী উপাখ্যান’ ২০১৩ সালে প্রকাশিত হয়। বৃত্তায়নের মতো ‘শিউলি’ নামে একটি ছোট উপন্যাসও তিনি লিখেছেন। তবে ‘শামুক’ উপন্যাসটি ২০১৫ সালে প্রকাশিত হলেও এটিই হাসান আজিজুল হক প্রথম রচনা করেছিলেন। প্রথমে উপন্যাসটি অংশ বিশেষ একটি লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশিতও হয়েছিল। পরে তিনি রচনাটি আর কোথাও প্রকাশ করেননি। একসময় চন্দন আনোয়ারের সম্পাদনায় উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছে।
তার আলোচিত গল্পগ্রন্থসমূহ হচ্ছে--সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য (১৯৬৪), আত্মজা ও একটি করবী গাছ (১৯৬৭), জীবন ঘষে আগুন (১৯৭৩), নামহীন গোত্রহীন (১৯৭৫), পাতালে হাসপাতালে (১৯৮১), নির্বাচিত গল্প (১৯৮৭), আমরা অপেক্ষা করছি (১৯৮৮), রাঢ়বঙ্গের গল্প (১৯৯১), রোদে যাবো (১৯৯৫), হাসান আজিজুল হকের শ্রেষ্ঠগল্প (১৯৯৫), মা মেয়ের সংসার (১৯৯৭), বিধবাদের কথা ও অন্যান্য গল্প (২০০৭)।
গল্পের চেয়ে তার উপন্যাসের সংখ্যা কম হলেও ঔপন্যাসিক হিসাবে কম আলোচিত নন হাসান আজিজুল হক। সব মিলিয়ে তিনি পাঠকের অন্তরে স্থায়ী আসন গড়ে নিয়েছেন। ব্যতিক্রমী কথাশিল্পী হিসাবে টিকে থাকবেন পাঠকের অন্তরে।
সাহিত্যচর্চার স্বীকৃতি হিসাবে তিনি ১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। বাংলাদেশ সরকার তাকে ১৯৯৯ সালে একুশে পদক ও ২০১৯ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান করে। এ অসামান্য গদ্যশিল্পী তার সার্বজৈবনিক সাহিত্যচর্চার স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে ‘সাহিত্যরত্ন’ উপাধি লাভ করেন।
এসইউ/জিকেএস