নদী রক্ষা ও নৌখাতের উন্নয়ন: বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনা
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। নদীই ১৬ কোটি মানুষের প্রাণ—কথাটি নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। সারাদেশে জালের মতো বিস্তৃত সহস্রাধিক নদীর সঙ্গে সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা এবং জাতীয় অর্থনীতি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে থাকবে। নদীপথ ও নৌপরিবহন ব্যবস্থাই হবে যাতায়াত ও পণ্য পরিবহনের প্রধান মাধ্যম—এটাই স্বাভাবিক। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে ছিলও তাই। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের বিয়োগান্ত ট্রাজেডি ও রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সব কিছুই যেন ওলটপালট হয়ে যায়। সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার অস্বাভাবিক সম্প্রসারণে ধীরে ধীরে সংকুচিত হতে থাকে নৌপথ; শোচনীয় হয়ে পড়ে নৌপরিবহন ব্যবস্থা। সেইসঙ্গে নদ-নদীগুলো বিপন্ন হয়ে পড়ে।
পঁচাত্তর-পরবর্তী বিভিন্ন সরকারের সময়ে বহুজাতিক অটোমোবাইল কোম্পানিগুলোর বাণিজ্য সম্প্রসারণের স্বার্থে বিশ্ব ব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), এশিয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও জাতিসংঘ উন্নয়ন প্রকল্পসহ (ইউএনডিপি) বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার পরামর্শে আমরা হারাতে বসেছিলাম নদী ও নৌখাতের সোনালি অতীত। ঋণদাতা এ সংস্থাগুলোর শর্ত মানতে গিয়ে সড়ক অবকাঠামো উন্নয়ন এবং সেতু, কালভার্ট ও স্লুইসগেট নির্মাণের নামে অপরিকল্পিত ও পরিবেশবিনাশী উন্নয়ন কর্মযজ্ঞের ফলে নদীগুলোকে মৃতপ্রায় বানিয়ে ফেলেছি। অল্প সময়ে যাতায়াত ও পণ্য পরিবহনের স্বার্থে মানুষ সড়কপথে যাতায়াত করলেও পরিবহন ব্যয় যেমন বেড়েছে, তেমনই নদ-নদীসহ প্রাকৃতিক জলাভূমি ধ্বংসের ফলে আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশও চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেইসঙ্গে বেড়েছে নদী দূষণ ও দখল।
তবে আশার কথা, পরিস্থিতির পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। নৌখাতের সোনালি অতীতকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। ২০০৯ সালের শুরুতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পরই এ উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বিলুপ্ত ও বেদখল নদীগুলোকে পুনরুদ্ধার করে খননের মাধ্যমে প্রবহমান করা এবং নৌপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নের কঠিন কাজে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সরকারের কর্মযজ্ঞের ফলে বিলুপ্ত নৌপথের দুই হাজার কিলোমিটার ইতোমধ্যে পুনরুদ্ধারও হয়েছে।
এসব লেখার মূল উদ্দেশ্য হলো—‘বাংলাদেশের নদ-নদী ও নৌপরিবহন ব্যবস্থা’ এবং ‘নদী রক্ষা ও নৌখাতের উন্নয়ন: বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনা’ শিরোনামে দুটি বই সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আকারে কিছু বলা। গবেষণামূলক বই দুটি লিখেছেন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আশীষ কুমার দে। প্রচ্ছদ বাদে প্রথম বইটি ৩৮৪ পৃষ্ঠার; দ্বিতীয়টি বইটির পৃষ্ঠাসংখ্যা ২৮০। দুটি বইই অফসেট কাগজে রঙিন ও সাদাকালো মিলিয়ে ছাপা, চাররঙা প্রচ্ছদ এবং বোর্ড বাঁধাই। লেখক দীর্ঘ সময়ের মাঠপর্যায়ে সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতার আলোকে নদী দূষণ, ভরাট ও দখল, নৌ দুর্ঘটনা এবং নৌপরিবহন ব্যবস্থার করুণ দশা তাঁর লেখনীতে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। একই সঙ্গে নদী রক্ষা ও নৌখাতের সংকট উত্তরণে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন টানা তিন মেয়াদের বর্তমান সরকারের পদক্ষেপগুলোর ওপরও আলোকপাত করেছেন; যা এ দেশের সাধারণ মানুষকে আশার আলো দেখাচ্ছে।
আশীষ কুমার দে ‘নদী রক্ষা ও নৌখাতের উন্নয়ন: বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনা’ বইটিতে নদী রক্ষায় উচ্চ আদালতের দেওয়া পর্যবেক্ষণসহ পূর্ণাঙ্গ রায়টি পুরোপুরি তুলে ধরেছেন। এছাড়া দুটি বইতেই নদীসহ প্রাকৃতিক পানিসম্পদ ও নৌপরিবহন সংশ্লিষ্ট বিশদ তথ্য-উপাত্ত, বিভিন্ন সংস্থার চার্টার অব ডিউটিজ (কার্যাবলী), বিভিন্ন সময়ে দেওয়া উচ্চ আদালতের রায় ও আদেশের সারসংক্ষেপ এবং নদীর সঙ্গে পর্যটন, অর্থনীতি, প্রাকৃতিক পরিবেশ, কৃষি, মৎস্য, বাঙালির কৃষ্টি ও সভ্যতার সম্পর্ক তুলে ধরা হয়েছে। পাঠক যাতে কোনোভাবেই বিরক্ত না হন, সেজন্য লেখক অত্যন্ত সহজ-সরল, সাবলীল ও প্রাঞ্জল ভাষায় সরকারের গৃহিত উন্নয়নমূলক জনবান্ধব প্রকল্পসমূহ সবিস্তারে উল্লেখ করেছেন।
এছাড়া দীর্ঘ সময় ধরে পড়তে ধৈর্যচ্যুতি যাতে না ঘটে, সেজন্য পাঠক হৃদয়ে রস জোগানোর ব্যবস্থাও করা হয়েছে বই দুটিতে। নদীকে ঘিরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ ও জসীম উদদীনের কবিতাও স্থান পেয়েছে। সেইসঙ্গে বাংলাদেশের বিভিন্ন নদীর সঙ্গে দুই বাংলার প্রথিতযশা কবিদের আত্মিক ও প্রেমের সম্পর্কও তুলে ধরেছেন লেখক। পাঠকের মনোরঞ্জনের জন্য অনেক নদীর নামকরণের ইতিহাস এবং সেসব নদীর সঙ্গে ধর্মীয় সম্পর্ক, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, পর্যটন, সভ্যতার বিকাশ ও সাহিত্য-সংস্কৃতির যোগসূত্র উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া দুটি বইতেই সুপরিচিত নদীগুলোর পাশাপাশি বর্ণনা করা হয়েছে বহু অখ্যাত এবং ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র নদীর উৎস, আয়তন ও গতিপথসহ চূড়ান্ত গন্তব্য সম্পর্কে; যেসব নদীর নাম বর্তমান প্রজন্মের কাছে অজানা।
অনেক ভালোর মধ্যেও বলতে চাই, বই দুটিতে সরকার (পানি উন্নয়ন বোর্ড) স্বীকৃত সবগুলো নদ-নদীর নাম অঞ্চলভিত্তিক উল্লেখ এবং বেশ কিছু নদীর বর্ণনা থাকলেও অনেক নদীর বর্ণনা নেই। একজন নদীপ্রেমী পাঠক হিসেবে দেশের সব নদী সম্পর্কে আমার বা আমার মতো অন্যান্য পাঠকেরও জানার আগ্রহ নিশ্চয়ই আছে। আমার ধারণা, দুটি বইয়ে সবগুলো নদীর বর্ণনা তুলে ধরতে গেলে প্রতিটির পৃষ্ঠাসংখ্যা অনেক বেড়ে যাবে—এ বিবেচনা থেকেই লেখক তা করেননি। এ ছাড়া নদীভাঙন, বন্যা এবং উপকূলীয় জনপদ ও উত্তরবঙ্গের দারিদ্রপীড়িত চরাঞ্চলের জনজীবনের কথা সবিস্তারে উল্লেখ নেই।
তবে সব মিলিয়ে দুটি বইই সময়োপযোগী বলে আমি মনে করি। সামান্য কিছু মুদ্রণত্রুটি ও রিপিটেশন (পুনরুল্লেখ) ছাড়া কভার (প্রচ্ছদ), শব্দচয়ন, অক্ষরবিন্যাস ও অঙ্গসজ্জা রুচিশীল হয়েছে। আমি বই দুটির বহুল প্রচার, প্রসার এবং পাঠকপ্রিয়তা প্রত্যাশা করছি। সেই সঙ্গে জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট এমন একটি বিষয়ে মনোনিবেশ করায় লেখক-সাংবাদিক আশীষ কুমার দের উত্তরোত্তর সাফল্য, সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করি।
লেখক: সাংবাদিক ও উপ-প্রধান প্রতিবেদক, জাগোনিউজ২৪.কম।
এইচএস/এসইউ/জিকেএস