ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

মায়াবতী : পর্ব ০৯

মোহিত কামাল | প্রকাশিত: ০৪:৪৭ পিএম, ১৯ জুন ২০২১

কথাসাহিত্যিক মোহিত কামালের মায়াবতী বাংলা সাহিত্যে দ্বিতীয় মনোবৈজ্ঞানিক উপন্যাস। সাহিত্যের শব্দবিন্যাসে তিনি ব্যবহার করেছেন মনস্তত্ত্ব, সমাজের আড়ালের চিত্র। মা প্রত্যক্ষ করেছেন, মেয়েরা নানাভাবে উৎপীড়ন ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়, সহজে মুগ্ধ হয়ে অবিশ্বাস্য পাতানো ফাঁদে পা দেয়। মায়ের একান্ত চাওয়া মেয়ে ক্যারিয়ার গড়ে তুলুক। বিধিনিষেধ আরোপ করেন মা। মেয়ে তখন মনে করে, মা স্বাধীনতা দিতে চায় না, বিশ্বাস করে না তাকে। মায়ের অবস্থানে মা ভাবছেন তিনি ঠিক। মেয়ের অবস্থানে মেয়ে ভাবছে, সে ঠিক। মায়ের ‘ঠিক’ এবং মেয়ের ‘ঠিক’র মাঝে সংঘাত বাধে। সংঘাত থেকে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়, ভুল করে বসে মেয়ে রিয়া। পালিয়ে যায় ঘর থেকে। এই ‘ভুল’ই হচ্ছে উপন্যাসের মূলধারা, মূলস্রোত। মায়াবতী পড়ে চিন্তনের বুননে ইতিবাচক গিঁট দেয়ার কৌশল শেখার আলোয় পাঠক-মন আলোকিত হবে। জানা যাবে টিনএজ সমস্যা মোকাবিলার কৌশল। জাগো নিউজের পাঠকের জন্য ধারাবাহিক প্রকাশিত হচ্ছে সাড়া জাগানো উপন্যাসটি—

এগারো.
বসার ঘরে পায়চারি করতে লাগল রেজা। এদিক-ওদিক হাঁটছে কেবল। গ্লাসে পানি ঢালতে গিয়ে পুরো গ্লাস থেকে অল্প একটু ছলকে বাইরে পড়ে গেল। ভরা গ্লাস থেকে এক চুমুক পানি পান করায় বাকিটা থেকে যায়। গ্লাসের অবশিষ্ট পানি নড়ছে। ধীরে ধীরে পানির টলমলে ঢেউ কমে স্থির হয়ে গেছে।

কিন্তু রেজার মনের অস্থিরতা কমেনি। অস্থিরতা নিয়ে মুনার ঘরের সামনে এসে দরজার নব হালকাভাবে ঘোরাল। দরজা ভেতর থেকে লক করা।

মুনার দরজায় টোকা দিল। প্রতিবার দুই টোকা ঠকঠক... ঠকঠক... ঠকঠক... মোট তিনবার টোকা দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল রেজা।
দরজা খুলে গেছে।
কী? মামার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল মুনা।
কী করছিস? শান্তস্বরে জানতে চায় রেজা।
বাথরুমে ঢুকেছিলাম। আবার গোসল করে নিলাম।
কেন? আবার গোসল করলি কেন? সকালে তো গোসল করেছিলি?
করেছিলাম। আবার করলাম।
দুবার গোসলের প্রয়োজন হলো কেন?
তোমার জানার দরকার নেই।
কেন? জানলে অসুবিধে কী? ভাগনির ব্যাপারে কি জানার অধিকার থাকে না?
ভাগনি হলেও আমি তো নারী।
তো, নারী হয়েছিস তো কী হয়েছে?
নারীদের সব জানতে নেই।
এখানে নারীত্বের বিষয় এলো কেন?
নোংরা ঘটনার কারণেই এসেছে। কেমন যেন ঘেন্না লাগছিল। রিরি করছিল শরীর।
ঘৃণা করছে কেন?
দেহে বুড়ো দামড়ার হাত লেগেছে বলেই ঘেন্না লাগছে। নিজেকে অপরাধী লাগছে। পাপী লাগছে। ধুয়ে নিলাম।
বুড়োর হাত লেগেছে। ইচ্ছাকৃতভাবে হাত লাগালে বুড়োর দোষ। অন্যের দোষের বোঝা নিজের ঘাড়ে নিচ্ছিস কেন? অন্যের দোষ দিয়ে নিজেকে অপরাধী ভাবছিস কেন? রেজা ঝড়ো প্রশ্ন করতে লাগল।
অন্যের দোষ হলেও শরীর তো আমার। আমার শরীর আমি ধোব। তোমার কী? মুনা দৃঢ় গলায় বলল কথাটা।
তোর শরীর। তো ঘৃণা আসবে কেন?
ঘৃণা ইচ্ছাকৃত আনিনি। ঘৃণা আপনা-আপনি আসছে মনে। অসম্ভব ঘৃণা লাগছে নিজেকে।
এটাই মেয়েদের দোষ। ঘটনার ভুল ব্যাখ্যা করে ভুল যাতনা নেয়।
মোটেই ভুল করছি না। দৃঢ়ভাবে বলল মুনা।
ঠিক আছে। না হয় বুড়োটা ইচ্ছাকৃতভাবে তোকে ছুঁয়েছে। তো শরীরকে ঘৃণা করবি কেন? নিজেকে একটু শোধরা। বুঝেছিস? বুড়োর হাত কি পচা যে ঘৃণা করবি?
বুড়োর হাত পচা না। তবে ওটা পুরুষের কুত্তাহাত। ওই হাত সর্বনাশ করতে পারে জীবন। ছারখার করে দিতে পারে সুন্দর মন। সুন্দর সংসার। এজন্যই ঘৃণা লাগছে।
সংসার ছিন্ন হতে পারে?
হ্যাঁ, পারে। তোমার সংসার ছারখার হয়নি? আচমকা আক্রমণ করল মুনা।

রেজা থেমে গেল। আকস্মিক আক্রমণ। নিজের ওপর আক্রমণ। অন্যের ওপর আক্রমণ ঠেকানো যায়। নিজের ওপর আক্রমণ ঠেকানো যাচ্ছে না। বিব্রতবোধ করে থেমে গেল ও। একদম চুপ হয়ে গেল। ঘটনা সত্য। বহু বছর আগে ওর সংসার ছিন্ন হয়েছে। এই ছিন্ন হওয়ার পেছনে পুরুষের হাত আছে কি-না জানা নেই। হয়তো আছে, মুনার কথায় বোঝা যাচ্ছে অবশ্যই পুরুষেরও হাত আছে। তবে ষড়যন্ত্র ছিল। নারীর ভালোবাসাও ছিল। জেনেছে। নারীর অন্যটানের আগুনে পুড়ে যেতে পারে সংসার। পুড়িয়ে দিতে পারে অন্য পুরুষের মন। সুখী নারীর মনে অন্য নারী ঈর্ষার কারণে গোপনে ঢুকিয়ে যেতে পারে বিষ। সেই বিষে শেষ হয়ে যেতে পারে সংসার। জীবন। সব।

মাথা নত হয়ে গেল রেজার।
নিজের ত্রুটি নিয়ে কথা বাড়ানো ঠিক না। নিজের ক্ষত নাড়াচাড়া করলে গন্ধ বেরোবে। গন্ধ বেরোলে যাতনা আরও বাড়বে। মাথানত করে সরে এসে নিজের ঘরে ঢুকে গেল রেজা।

মুনা শ্রদ্ধা করে মামাকে। ভালোবাসে মামাকে। মামাকে কষ্ট দেওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই ওর। ছিলও না। আকস্মিক কটু কথা বলে ফেলেছে। নিজের মনে ঘৃণা আছে। রাগ আছে। ঘৃণা ও রাগের মিশ্র আবেগের ফাঁদে পা দেওয়ার কারণে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে মুনা, বোঝে। রেজা মামা নতমুখে চলে যাওয়ার পর এ ভুলটা ধরতে পারে ও।

ভুল বুঝতে পারায় মন নরম হয়ে যায়। পা-পা করে পেছনে পেছনে মামার ঘরে ঢোকে।
সরি মামা। তোমাকে কষ্ট দিলাম।
মুখ ঘুরিয়ে রেজা তাকাল মুনার দিকে। হাসি ফোটে রেজার মুখে।
মুনা, আমি কষ্ট পাইনি।
পেয়েছ। জোর করে বলল মুনা।
বললাম তো, পাইনি। তবে নিজেকে নতুনভাবে দেখতে পেরেছি। নতুন করে উপলব্ধি করেছি।
মুনা বলল, এটাই তো কষ্ট। ক্ষতের মধ্যে নুনের ছিটা দিয়েছি আমি।
রেজা এবার অবাক হয়ে মুনার দিকে তাকিয়ে বলল, এত বুঝিস তুই? এত ম্যাচিউর হয়েছিস?
মুনা আবার বলল, বাহ! কচিখুকি না-কি আমি? মামার চোখে দেখছ, তাই ছোটো লাগছে আমাকে।
রেজা বলল, মামা তো মামার চোখেই দেখবে। এটাই তো স্বাভাবিক।
অনেকে আছে, ভাগনিদের মামার চোখে দেখে না। পুরুষের চোখে তারা ভাগনির মধ্যে দেখে নারীত্ব। নারীদেহ। নারীমন।
অনেকে দেখে দেখুক। আমি তো দেখি না। আমি আমার মতো।
মামার অস্তিত্বে দৃঢ় থাকতে চায় রেজা।
মুনা হো-হো করে হেসে উঠল। রহস্যময় সেই হাসির দমকে রেজা নড়ে ওঠল। নিজেকে আবার মেপে দেখে ভাবল নিজের মধ্যে মামার চেয়েও পুরুষসত্তা কি বেশি স্ট্রং?
মুনা কি দেখে ফেলেছে সব? বুবলির মতো মুনাও কি তবে অনেক অভিজ্ঞ। অভিজ্ঞতা কোথায় পেল সে?
মুনা হেসে বলল, মামা একটা প্রোপোজাল দেই। শুনলে তোমার মন ভালো হয়ে যাবে।
মুনার ভঙ্গি দেখে ঘাবড়ে গেল রেজা। ঠোঁট শুকিয়ে গেছে। গলা শুকিয়ে গেছে। মুহূর্তে ফ্যাকাশে হয়ে উঠছে উজ্জ্বল রঙের মামার পুরুষমুখ।
কী মামা! ঘাবড়ে গেলে! প্রোপোজালের কথাতেই ঘাবড়ালে?
নাহ্! ঘাবড়াব কেন? ঘাবড়াইনি। থতমত খেয়ে বলল রেজা।
অবশ্যই ঘাবড়িয়েছ। নার্ভাস মুখ চেনার বয়স হয়েছে আমার। সহজ হও মামা। মামার খোলস ঝেরে পুরুষ সাজো।

আরও ধসে গেল রেজা। মুনার সহিংস স্বভাব জানা আছে ওর। ভেতরে ক্ষোভ লুকিয়ে থাকলে যেকোনো অঘটন ঘটাতে পারে সে। মাথা ঠান্ডা রেখে ঘটাতে পারে যা-তা।

কী করতে পারে সে, কী প্রোপোজাল দিতে পারে? মনে মনে কয়েক সেকেন্ড ভেবে নিল রেজা। ভাবনার কিনারা খুঁজে পেল না। কূল খুঁজে পেল না। কিছু একটা মনে আসায় মামার অস্তিত্ব সঙ্গে সঙ্গে সংকুচিত হয়ে গেল। গুটিয়ে গেল। পুরুষসত্তা জেগে ওঠায় বুকের ঢিপঢিপ নিয়ে বলল, বল, কী প্রোপোজাল।
মুনা মামার হাত চেপে ধরে বলল, আগে কাঁপাকাঁপি থামাও।
রেজার কাঁপুনি আরও বেড়ে গেল। কে কাঁপায়? পুরুষসত্তা, না-কি মামাসত্তা? মোটেও বোঝার চেষ্টা করল না মুনা। হাসিমুখে বলল, চলো রিয়ার কাছে যাই। রিয়ার কাছে গেলে তোমার মন ভালো হয়ে যাবে।

মুনার মুখে চোরাহাসির রেখা ফুটে ওঠে। হাসির আড়ালে মনে মনে ভাবে, মামা তোমাকে পরীক্ষা করে ফেলেছি আমি। পরীক্ষায় হেরে গেছ তুমি। মামার চেয়েও তোমার পুরুষ অস্তিত্ব বেশি টনটনা। বেশি স্ট্রং। জানো না তুমি, ভাবতে ভাবতে গোপন হাসির রেখা আরও রহস্যময় হয়ে উঠল। মোনালিসার হাসির বহুমাত্রিক অর্থময়তার চেয়েও জটিল এ অভিব্যক্তি। বুঝতে পারল না মুনা। বুঝতে পারল না রেজা।

রিয়ার বাসায় যাওয়ার প্রোপোজাল শুনে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল রেজা।
সহজ হয়ে কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানেই ইজি হয়ে বলল, কেন? এখন রিয়ার বাসায় যাবি কেন? তখন-না বলেছিলি রিয়াকে আর এ বাসায় আসতে দিবি না?
বলেছিলাম। এটা বলিনি যে রিয়াদের বাসায় যাব না।
ওঃ! বাঁচালি। রেজা কথা শেষ করে একদম সহজ হয়ে মনে মনে ভাবল, মেয়েদের মন বোঝা সত্যিই কঠিন। মুনি-ঋষিরাও সহস্র বছর সাধনা করে নারীমনের স্বরূপ বের করতে পারেনি। নিজে তো তুচ্ছ মানব। তুচ্ছ মানবের বড় ঘটনা নিয়ে বেশি ভাবা উচিত নয়।
রেজা বলল, তুমি যাও, আজ যাব না আমি। অন্য দিন যাব।

মুনা আর কথা বাড়াল না। চাপাচাপি না করে হাসতে হাসতে দেহ বাঁকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
রেজা ঘরের চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিল।

ঘরে নিম্নচাপ তৈরি হয়েছিল। উন্মাতাল ঘূর্ণির চাপ তৈরি হয়েছিল। সুনামির বিধ্বংসী গতি তৈরি হয়েছিল। গতি থেমে গেছে। আচমকা চাপ। আচমকা চাপমুক্তি। সুনামির পলায়নে ধ্বংস থেকে বেঁচে গেছে রেজা। বেঁচে আছে মন। বেঁচে আছে মামার অস্তিত্ব। পুরুষসত্তাও বেঁচে আছে।

মুনা গুঁতো দিয়েছে। জিদানের থেকেও ভয়াবহ গুঁতো। বিশ্বকাপ ফাইনালে ফুটবল মাঠে বিশ্বনায়কের গুঁতো দেখেছে বিশ্বব্যাপী নারী-পুুরুষ সবাই। মুনার গুঁতো কেউ দেখেনি। অনুভব করেছে কেবল রেজা। নীরবে নিভৃতে এ নিশব্দ অভিজ্ঞানের মূল স্রোতের উৎস কোথায়? আশ্চর্য এক মিল খুঁজে পেল রেজা। জিদান বাংলাদেশে এসেছে। বিশ্বজয় করে বাংলাদেশে এসে প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক গ্রামীণ নারীর প্রশ্নবাণে বিদ্ধ হয়েছিল। নারীটি জানতে চেয়েছিল, ফুটবল মাঠে গুঁতো মেরেছিলেন কেন?
জিদান উত্তর দিতে পারেনি।

বল পায়ে যাচ্ছেতাই করতে পারে জিদান। বাংলাদেশের মানুষের মন জয় করে রেখেছিল। জিদানকে নিয়ে বাংলাদেশের নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর, তারুণ্যের উন্মাদনার প্রমাণ ভালোভাবেই পেয়েছে জিদান। দুদিনের ঝটিকা সফরে নতুন করে মাতিয়ে গেল বাংলাদেশ। শত সফলতার মাঝেও গুঁতো মারার দৃশ্যটি ভুলতে পারেনি আলোড়িত মানুষের দল।

রেজা নিরীহ মানুষ। তার জীবনের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘটনাও ভুলতে পারেনি চারপাশের কেউ।
তারা কথায় কথায় স্মরণ করিয়ে দেয় অতীত। কথায় কথায় মনে পড়ে যায় অতীত। ‘সম্মুখে ঠেলিছে মোরে পশ্চাতের আমি...।’ কেবল পশ্চাতের আমিত্ব আমাকে ঠেলে নিতে পারে না। এ ধারণা ছিল রেজার। এখন দেখছে কথাটা কত সত্যি!
নিত্যনতুন আমিত্ব তৈরি হয়, ক্ষণে ক্ষণে সেই আমিত্ব আমাকে টেনে নিয়ে যায় সামনে।
কতদূর? কোথায়? কতদূর যেতে হবে রেজাকে, বোঝে না ও। কেবল বোকার মতো তাকিয়ে রইল শূন্য ঘরে, শূন্য দেয়ালের দিকে।

চলবে...

এসইউ/জিকেএস