ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

শ্বশুর আব্বার পুনর্বিবাহ

মোকাম্মেল হোসেন | প্রকাশিত: ০৬:২২ পিএম, ১৮ মে ২০২১

পান খাওয়ার অভ্যাস নেই তাজুলের। দুপুরের আগে অফিসে এক পার্টি এসেছিল। তারা বিরিয়ানির সঙ্গে মিষ্টি জর্দা দিয়ে বানানো দুটো পানও এনেছিল। খাওয়া শেষ করে তাজুল একটা পান মুখে দিয়ে কেবল চেয়ারে হেলান দিয়েছে; এমন সময় ফোন বেজে ওঠল। পানের পিক পেটের ভেতর চালান করে তাজুল হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে নূরুদ্দিন সাহেবের গলা ভেসে এলো
: হ্যালো, তাজুল মিয়া।
: আব্বা, স্লামালেকুম।
: ওয়ালাইকুম সালাম; অফিস থেইকা ফেরার পথে একবার আসতে পারবা?
: একবার কেন আব্বা! আপনি বললে আই অ্যাম রেডি টু কাম টেন টাইমস।
: দশবার আসার প্রয়োজন নাই। একবার এলেই হবে; ঠিক আছে?

ফোন ছেড়ে দিলেন নূরুদ্দিন সাহেব। তাজুল মহাভাবনায় পড়ে গেল। সাধারণ সূত্র অনুযায়ী নূরুদ্দিন সাহেবের কাছ থেকে ইষ্টি-আলাপনের অনুরোধ আসার কথা নয়। সে হচ্ছে শাশুড়িপক্ষের লোক। মাসছয়েক আগে নূরুদ্দিন সাহেব ও পদেরা বেগমের মধ্যে তুমুল ঝগড়া হওয়ার পর দুজন আলাদা থাকছেন। দুজন দুই ভুবনের বাসিন্দা হতেই তাজুল তার শাশুড়ি পদেরা বেগমের পক্ষ নিয়েছে। তাজুলকে পদেরা বেগমের দিকে ঝুঁকতে দেখে নূরুদ্দিন সাহেব মেজ মেয়ের জামাই মাজুলকে নিজের দলে টেনে নিয়েছেন। শ্বশুরবাড়িতে তাজুল-মাজুলের পরিচয় এখন বড় মেয়ের জামাই বা মেজ মেয়ের জামাই হিসেবে নয়; নূরুদ্দিন সাহেব তাজুলকে সম্বোধন করেন দোতলার পার্টি বলে; আর পদেরা বেগম মাজুলকে অভিহিত করেন নিচতলার পার্টি বলে।

শ্বশুর-শাশুড়ি যে নামেই সম্বোধন করুক, দুই ভায়রা ভাইয়ের মধ্যে চমৎকার সম্পর্ক বিদ্যমান। শ্বশুরের সঙ্গে সাক্ষাৎপর্বের বিস্তারিত বিবরণ মাজুল যেমন তাজুলকে দেয়; তেমনি তাজুলও শাশুড়ি সংক্রান্ত সব তথ্য মাজুলকে জানায়। নূরুদ্দিন সাহেব ফোন করতে পারেন- এমন কোনো পূর্বাভাস মাজুল দেয়নি। তাজুল মাজুলের ক্লিনিকে ফোন করল
: হ্যালো মাজুল।
: বলেন দুলাভাই।
: ঘটনা তো ঘইট্যা গেছে!
: কী ঘটনা?
বুড়া মিয়া ফোন করছিল।
মাজুল আঁতকে উঠে বলল-
: বলেন কী! কী জন্য?
: সেইটা কিছু বলে নাই। শুধু বলল, সন্ধ্যার টাইমে আসো।
: যাইতে কইছে, যান।
: ঘটনা বুঝতেছি না; তুমি কিছু জানো নাকি?
: আমি জানা মানেই তো আপনে জানা।
: তা ঠিক। কিন্তু...
: অত কিন্তু কিন্তু করতেছেন কেন?
: বিরোধীপক্ষ হঠাৎ কল করছে! ইস্যুটা জানা থাকলে ভালো হইত।
: ইস্যু আর কী! বড় মেয়ের জামাই হিসেবে দায়িত্ব নিতে বলবেন হয়তো!
: কিসের দায়িত্ব!
: আপনের শ্যালিকা কয়জন?
: ইচকামি করতেছ?
: ইচকামি না দুলাভাই; উত্তর দেন।
: দুইজন।
: তারা কি বিবাহিতা?
: অবশ্যই না।
: তাদের বিয়া দেওন লাগব না?
: তাতো লাগবই।
: শ্বশুর আব্বা হয়তো এই দায়িত্বটাই আপনেরে নিতে বলবেন।

মাজুলের কথা শুনে তাজুলের বুক থেকে দশ মণ ওজনের একটা পাথর সরে গেল। সে মুখ দিয়ে দম ছেড়ে বলল-
: যাক, এতক্ষণে তবু একটা আলোর ইশারা পাইলাম। তোমারে যাইতে বলে নাই?
: বলছে।
সন্ধ্যার সময় নিচতলায় শ্বশুরের ফ্ল্যাটে ঢোকার সময় তাজুল দেখল, পদেরা বেগম দোতলার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছেন। পদেরা বেগমের চোখে চোখ পড়তেই হাত তুলে নীরবে সালাম দিল তাজুল। তারপর ইশারায় জানালÑ বুড়া মিয়া কল করায় সে বাধ্য হয়ে তার কাছে যাচ্ছে। তবে কাজ শেষ হলে এক মুহ‚র্ত দেরি করবে না; সোজা দোতলায় চলে আসবে।
ড্রয়িংরুমে ঢুকে তাজুল দেখল, মাজুল বসে আছে। পাশে নূরুদ্দিন সাহেব। মাজুলের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করে তাজুল নূরুদ্দিন সাহেবের পা ছুঁয়ে সালাম করার পর জানতে চাইল
: কেমন আছেন আব্বা?
নূরুদ্দিন সাহেব উদাসীন হয়ে গেলেন। বললেন
: যেমন দেখতেছ।
: হঠাৎ...
: হঠাৎ ডাকার প্রয়োজন দেখা দিল, তাই ডাকলাম।
এসময় কাজের ছেলেটা টেবিলে নাস্তা দিল। নীরবে নাস্তা পর্ব সমাধা হবার পর মুখ খুললেন নূরুদ্দিন সাহেব। বললেন
: আইজ ছয় মাস পূর্ণ হইতে চলছে, তোমাদের শাশুড়ি আম্মার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নাই। নো মেন্টাল; নো ফিজিক্যাল।
রিলেশনশিপের ক্যাটাগরি শুনে তাজুল মাজুল পরস্পর পরস্পরের দিকে তাকাল। নূরুদ্দিন সাহেব পুনরায় বললেন
: তোমরা এ যুগের শিক্ষিত মানুষ। আমি আশা করব, বিষয়টারে তোমরা কেবল ইমোশনালি নিবা না; এর রিয়েলিটিটাও বুঝবার চেষ্টা করবা।
দুজনেই মাথা নেড়ে একসঙ্গে বলল
: জি আব্বা।
নূরুদ্দিন সাহেব কিছুক্ষণ তাজুল মাজুলের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন
: আইজ আমার জায়গায় তোমরা হইলে কী করতা?
মিনমিনে গলায় মাজুল বলল-
: ঝগড়া মিটমাট কইরা একসঙ্গে বসবাস করার ডিসিশন নিতাম।
তাজুল বলল-
: আমিও তাই করতাম আব্বা।
দুই মেয়ে জামাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে গম্ভীরকণ্ঠে নূরুদ্দিন সাহেব বললেন
: আমি সেইটা করতে পারতেছি না বইলা দুঃখিত। এক্সট্রিমলি স্যরি। আমি ডিসিশন নিছি...
নূরুদ্দিন সাহেব তাজুলের চোখে চোখ রাখলেন। শ্বশুরের দৃষ্টির সামনে তাজুল খুবই বিব্রত বোধ করে। ঢোক গিলে জানতে চায়
: কী ডিসিশন আব্বা!
: ডিসিশন নিছি, আরেকটা বিবাহ করব।
শ্বশুরের কথা শুনে তাজুলের বেহুশ হওয়ার মতো অবস্থা। মাজুল আগের মতোই মিনমিন স্বরে বলল
: মেয়ে দেখাদেখি কি শুরু কইরা দিছেন আব্বা?
মাজুলের ভুল শুধরে দিয়ে তাজুল বলল-
: মাজুল, ইউ আর সামথিং রং। বর্তমানে আব্বার যে বয়স, তাতে তার ক্ষেত্রে মেয়ে শব্দটা অ্যাপ্রোপ্রিয়েট নয়; মহিলা বলতে হবে।
মাজুল অনুচ্চকণ্ঠে বলল-
: আব্বা! আপনি চাইলে একটা না, দশটা বিবাহ করতে পারেন। কিন্তু প্রথম স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া বিবাহ করলে আইনের প্যাঁচে পইড়া জীবন তুষ হয়ে যাবে।
তাজুল মাজুলের কথায় সমর্থন জানানোর পরক্ষণে নূরুদ্দিন সাহেব মুচকি হেসে বললেন-
: এইটা কোনো সমস্যাই না। আইন আমার সামনে হাজির হওয়ার আগেই তাকে আমি কতল করে ফেলব।
চিন্তিত মুখে তাজুল বলল-
: বুঝলাম না!
নূরুদ্দিন সাহেব জানালেন, তিনি পদেরা বেগমকে তালাক দিয়ে দেবেন।


শ্বশুরের ফ্ল্যাট থেকে তাজুল যখন দোতলায় গেল, তখন তার বিধ্বস্ত চেহারা। তালাকের কথায় ভীষণ ভয় পেয়েছে সে। বিষয়-বৃত্তান্ত সব শুনে পদেরা বেগম তাজুলকে বললেন-
: তুমি যে কী খাইয়া ইঞ্জিনিয়ার হইছ, তা আল্লাহ রাব্বুলই জানেন। সে তার পরিকল্পনা পেশ করল আর তুমি সবকিছু শুইনা গাধার বাচ্চার মতো কান নাড়তে নাড়তে চইলা আসলা?
ঢোক গিলে তাজুল বলল-
: আমার কী করণীয় ছিল?
পদেরা বেগম রাগে ফেটে পড়লেন। বললেন-
: কী করার ছিল মানে! তুমি প্রতিবাদ করো নাই কেন? তোমার শ্বশুর আরেকটা বিবাহ করার পর সেই বউ যদি ছেলে সন্তান জন্ম দেয়, তাইলে আমার চার মেয়ে আর তোমাদের ভবিষ্যৎ কী হবে একবার ভাইবা দেখছ? তখন স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পত্তির মালিক হবে সেই ছেলে। তোমরা পাইবা ঘোড়ার আন্ডা।
শাশুড়ির ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে তাজুল বাসায় গেল না। সোজা মাজুলের বাসায় হাজির হল। তাজুলকে দেখে অবাক হয়ে মাজুল বলল-
: দুলাভাই, আপনে!
: আসতে বাধ্য হইলাম।
: কী জন্য বলেন তো!
: শাশুড়ি আম্মার কথা শুইনা ভয় পাইয়া গেছি।
: লেডি মুরুব্বি কী বলছেন?
: লাভের গুড় পিঁপড়ায় খাওয়ার দুঃসংবাদ দিছেন।
: বুঝলাম না।
: শাশুড়ি আম্মা বলেছেন, বুুুুড়া মিয়া পুনর্বিবাহ করার পর সেই স্ত্রীর গর্ভে যদি পুত্রসন্তান জš§ লাভ করে, তাইলে আমাদের ভাগ্যে ঢাকা শহরের বুকে ছয়তলা বাড়ি, নিউমার্কেটের দোকান আর অন্যান্য বিষয়-সম্পত্তির কিছুই জুটবে না।
: তিনি সঠিক কথা বলছেন।
পকেট থেকে রুমাল বের করল তাজুল। মুখ ও কপালের ঘাম মুছে মাজুলের কাছে জানতে চাইল
: আইচ্ছা, তোমার ডাক্তারি বিদ্যা কী বলে আমারে বোঝাও। শ্বশুর আব্বার কি এই বয়সে সন্তান উৎপাদনের ক্ষমতা অটুট আছে?
: না থাকার তো কোনো কারণ দেখতেছি না।
মাজুলের কথা শুনে তাজুল আর্তনাদ করে উঠল। বলল-
: হায় আল্লাহ! এখন উপায়?
দু’চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ ঝিম মেরে থাকার পর মাজুল বলে উঠল-
: একটা উপায় অবশ্য আছে।
: কী?
: ভুলাইয়া-ভালাইয়া যদি তারে ভ্যাসেকটমি কইরা ছাইড়া দেওন যায়; তাইলে একটা সমাধান হয়।
মাজুলের এ বুদ্ধি তৎক্ষণাৎ খারিজ করে দিয়ে তাজুল বলল-
: দুরউ মিয়া! তুমি কি তারে ছাগলের বাচ্চা পাইছ- ঠ্যাং চাইপ্যা ধইরা অপারেশন সম্পন্ন করবা? তারে অপারেশন টেবিল পর্যন্ত লইয়া যাওয়ার যুক্তিসঙ্গত একটা কারণ তো দেখান লাগবে? তার চাইতে একটা কাজ করলে কেমন হয়?
বুকভরে লম্বা শ্বাস নিয়ে মাজুল জানতে চাইল-
: কী কাজ?
: আমরা অপজিসন সাইডে চিন্তা করতে পারি। ধরো, পাত্রী হিসেবে এমন একজনরে নির্বাচন করলাম, যার মেনাপোজ স্টেইজ অলরেডি শুরু হইয়া গেছে; তাইলেই আর কোনো রিস্ক থাকে না।
মাথা নেড়ে দ্বিমত পোষণ করে মাজুল বলল-
: আপনের কী মাথা খারাপ হইছে দুলাভাই! ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যাওয়া বয়স্ক একজন মহিলাকে কেন তিনি বিবাহ করবেন?
: কারণ, তার বয়স পঞ্চাশের ওপর।
: দুলাভাই! আপনের কী জানা আছে- এই বয়সের নওশারা কমবয়সী মেয়েদের প্রতি অতিমাত্রায় দুর্বল থাকে।
: কও কী!
আঙুলে তুড়ি বাজিয়ে মাজুল বলল-
:ইয়েস! তারা চায় নরম কাদামাটি; যাতে ডলা মাইরা যেমন খুশি মূর্তি বানানো যায়। পাকা বেল তারা চায় না।
মাজুলের কথা শুনে তাজুলের চোয়াল ঝুলে পড়ল। সে ফ্যাসফ্যাসে গলায় জানতে চাইল-
: এখন তাইলে করণীয় কী?
: টাইম দেন। ঠান্ডা মাথায় চিন্তা কইরা দেখি, কী করা যায়...

চিন্তা করার কথ বলে মাজুল তিনদিন পার করে দিল। এর মধ্যে খবর এলো, নূরুদ্দিন সাহেব আগামী সপ্তাহে পাত্রী দেখতে কিশোরগঞ্জ যাচ্ছেন। খবর শোনার পর তাজুল আর এক মুহূর্তও দেরি করল না। স্ত্রী কোহিনূর বেগমকে সঙ্গে নিয়ে মাজুলের বাসায় চলে এলো।
মাজুলের বাসায় পৌঁছার পর তাজুল ও মাজুল দম্পতি মিটিংয়ে বসল। দুই চোখ বন্ধ করে আধশোয়া ভঙ্গিতে সোফায় বসে থাকা তাজুলের চেহারা দেখে মনে হচ্ছে, মারাত্মক রকমের ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে সে। কিছুক্ষণ ইতস্তত করার পর মাজুল তাকে ডাক দিল-
: দুলাভাই; ও দুলাভাই!
মাজুলের ডাক শুনে তাজুল চোখ না খোলেই ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ছড়া কাটল-
: স্বপনে খাইলাম আমি কত মাংস-পোলাও-ছানা;
স্বপন ভাঙ্গলে দেখি মুখে পুইল্যা একখান ত্যানা!
বুঝলা মাজুল, এক লোক স্বপ্নে মুরগি-পোলাও, ছানা-পায়েস সহযোগে হেভি একটা খাওন দিয়া টিস্যু পেপারে মুখ মোছার সময় তার ঘুম ভাইঙ্গা গেল। তখন সে দেখল- টিস্যু পেপার মনে কইরা যে জিনিস দিয়া সে মুখ মুছতেছিল, সেইটা আসলে ছেঁড়া একটা ত্যানা। নাউ উই আর রিচড দিস সেকশন। ছেঁড়া ত্যানা ছাড়া আমাদের ভাগ্যে মনে হয় আর কিছু জুটবে না!
তাজুলের কথা শুনে তাকে অভয় দেয়ার সুরে মাজুল বলল-
: দুলাভাই! আপনে অনেক বেশি টেনশন করতেছেন। শ্বশুর আব্বা বিবাহ করবেন, তারপর আমাদের নতুন শাশুড়ি সন্তান জন্ম দিবেন এইটা মোটামুটি একটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তাছাড়া এইখানে আরও একটা ফ্যাকড়া আছে। সন্তান ছেলে না হইয়া মেয়েও তো হইতে পারে।
মাথা ঝাঁকিয়ে তাজুল বলল-
: ইউ আর রাইট; তা হইতে পারে। কিন্তু যদি ছেলে হয়? তুমি আমার হাতে একটা লটারির টিকিট ধরাইয়া দিবা; আর সেই টিকিট পকেটে রাইখ্যা নোজভ্যালিতে মাস্টার্ড অয়েল দিয়া আমি নিশ্চিন্তে নিদ্রা যাব এতটা বেক্কল আমারে ভাবলা কী কইরা?
বিজ্ঞের মতো মাজুল বলল
: বর্তমান হাইটেক যুগে এ সমস্যারও সমাধান আছে।
: কী রকম?
: আমার হবু শাশুড়ি আম্মা সন্তানসম্ভবা হওয়ার পর পরিবারের একজন ডাক্তার সদস্য হিসেবে আমি তার স্বাস্থ্য পরীক্ষার দায়িত্ব নেব। তারপর এক ফাঁকে ভ্রূণ পরীক্ষা কইরা যদি দেখি সেইটা ছেলে, তাইলে অ্যাকশনে যাব। আর যদি দেখি মেয়ে, তাইলে কোনো সাউন্ড দেব না।
বিস্মিত হয়ে তাজুল জানতে চাইল-
: ভ্রূণের বিরুদ্ধে অ্যাকশন?
: জি।
তাজুল এক ঝটকায় উঠে বসল। তারপর চোখ বড় করে জানতে চাইল
: কীভাবে!
মাজুলের মুখে যুদ্ধজয়ের হাসি ঝিলিক দিল। মশা তাড়ানোর ভঙ্গিতে সে বলল-
: পরিকল্পিত অ্যাবরশনের মাধ্যমে। আজকাইল এইটা পান্তাভাতের সঙ্গে পেঁয়াজ খাওয়ার মতন হরদম ঘটতেছে।
এসময় বুয়া এসে জানাল, টেবিলে খাবার দেয়া হয়েছে।


খাওয়ার ব্যাপারে তাজুলের মধ্যে কোনো আগ্রহ দেখা গেল না। যেন অনেক দূর থেকে কেউ কথা বলছে, এমন সুরে সে বলল
: আমার ক্ষুধা-তৃষ্ণা সব বাষ্প হইয়া উইড়া গেছে। আমি খাব না; তোমরা খাও।
মাজুল ও মাজুল পত্নী শাফিনূর বেগমের পীড়াপিড়িতে তাজুল শেষ পর্যন্ত খাবার টেবিলে গিয়ে বসল। খাওয়ার এক পর্যায়ে হঠাৎ তাজুলকে প্রবলবেগে মাথা নাড়তে দেখে শাফিনূর জানতে চাইল
: কী সমস্যা দুলাভাই! রান্না ভালো হয় নাই?
শাফিনূরের কথায় ধাতস্থ হল তাজুল। বলল-
: না, না; রান্না অতি চমৎকার হইছে। আমি অন্য সাইডে চিন্তা করতেছিলাম।
তাজুল মাজুলের দিকে তাকাল। মাজুল জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই সে বলল
: একটু আগে যে পরিকল্পনার কথা তুমি শোনাইলা মাজুল; তোমার পক্ষে সেইটা বাস্তবায়ন করা অসম্ভব।
মাজুল ভাতের লোকমা মুখে তুলছিল। তাজুলের কথা শুনে তা আর মুখে দেয়া হল না। সে জানতে চাইল
: কেন অসম্ভব দুলাভাই!
খাবারের প্লেটের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর তাজুল বলল-
: জামাই-শাশুড়ি সম্পর্কের কারণে গাইনিকোলজি বিষয়ে তোমার সেবা নিতে আমাদের হবু শাশুড়ি আম্মা ডেফিনিটলি লজ্জাবোধ করবেন। বুঝলা মাজুল; এই ছাতারমাথার প্ল্যান লইয়া বইসা থাকলে চলবে না। নতুন প্ল্যান দরকার।
এসময় শাফিনূর বলল
: আমার মাথায় নতুন একটা প্ল্যান আসছে দুলাভাই। বলব?
তাজুল লাফ দিয়ে উঠল। বলল
: বলবা মানে! আইডিয়ার জন্য রীতিমতো হাহাকার করতেছি। এইটা এখন আমাদের জীবন-মরণ সমস্যা।
শাফিনূর ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি গলায় ঢালল। এরপর বলল
: মুরগির বাচ্চা মুখে নেওয়ার আগেই শিয়ালরে আটকান লাগবে। মুরগির বাচ্চা মুখে ঢুকাইয়া ফেলার পর শিয়ালের লেজ কাইটা দেওয়ার বুদ্ধি বাইর কইরা লাভ নাই।
শাফিনূরের কথায় সায় দিয়ে তাজুল বলল
: তোমার সঙ্গে আমি হানড্রেড পার্সেন্ট একমত। এখন কও, তোমার আইডিয়াটা কী?
আইডিয়া পেশ করার আগে শাফিনূর সবার মুখের দিকে একবার তাকাল। তারপর একটু সময় নিয়ে বলল
: আমরা আব্বার কাছে একজন জ্যোতিষী পাঠাব। জ্যোতিষী আব্বার হাতের রেখা গণনা কইরা বলবে, আপনের দ্বিতীয় বিবাহ নিষিদ্ধ; নিষেধ অমান্য করলে বাসর রাতে লখিন্দরের মতো নিশ্চিত মৃত্যু।
তাজুল সঙ্গে সঙ্গে শাফিনূরের পরিকল্পনা বাতিল করে দিয়ে বলল-
: আমরা জ্যোতিষী পাঠাব আর শ্বশুর আব্বা সেই জ্যোতিষীর সামনে হাত পাইত্যা বইসা পড়বেন, এইটা তুমি ভাবলা কী কইরা!
এসময় নতুন কিছু আবিষ্কারের উত্তেজনা নিয়ে তাজুলের স্ত্রী কোহিনূর বলল-
: আমরা যদি আব্বার ফ্ল্যাটের সামনে আমরণ অনশন ধর্মটের আয়োজন কইরা তারে বিবাহের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের শর্ত দেই, তাইলে কেমন হয়?
নিচের ঠোট কামড়ে ধরে তেরছা চোখে তাজুল স্ত্রীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর মাথা নেড়ে বলল-
: তোমার আইডিয়াটা চমৎকার। তবে এর একটা দুর্বল পয়েন্ট আছে। অনশন আন্দোলন করতে গেলে বিষয়টা এক কান-দুই কান কইরা দশ কান হবে। এমনকি এইটা মিডিয়াতেও চইলা যাইতে পারে। ঘরের কথা পরেরে জানাইয়া প্রেস্ট্রিজ কানা করা উচিত হবে না।
হঠাৎ মাজুলকে খুবই উত্তেজিত মনে হলো। বাম হাত তুলে সে ঘোষণা দিল-
: দুলাভাই! আমার মাথায় একটা বুদ্ধি আসছে।
: কী বুদ্ধি?
: বুদ্ধিটা হইল শ্বশুর আব্বারে পাগল ঘোষণা করা। তার পাগল হওয়ার কাহিনি শোনার পর আমি ওভারসিওর, কোনো ভদ্রলোক তার কাছে মেয়ে দিবে না।
: তোমার কথা যদি পাত্রীপক্ষ বিশ্বাস না করে?
: বিশ্বাস করানোর বন্দোবস্ত করব।
: কীভাবে?
: নেক্সট টাইম শ্বশুর আব্বার কাছে যাওয়ার সময় একটা কৌট্টার মধ্যে কইরা কিছু মৌমাছি লইয়া যাব। তারপর চুপিচুপি আবছেআব কৌট্টার মুখ খুইলা দিব। ব্যস! ঘরের মধ্যে হঠাৎ একঝাঁক মৌমাছি দেইখা শ্বশুর আব্বা দৌড়াদৌড়ি শুরু করতেই আমি আমার মোবাইল ফোনের মাধ্যমে গোপনে তার সেই ড্যান্সিং মুডের ছবি ভিডিও কইরা ফেলব। এরপর পাত্রীপক্ষের সামনে সেই ভিডিও শো কইরা বলব দেখেন, পাগল কেমনে নাচে!
চিন্তিত মুখে তাজুল বলল
: কিন্তু মৌমাছি তুমি পাইবা কোথায়?
তাজুলের কথা শুনে মাজুল তুড়ি বাজাল। বলল
: মৌমাছি জোগাড় করা ওয়ান-টু’র ব্যাপার। ঢাকা শহরে কিছু মানুষ বালতির মধ্যে মৌমাছির চাক রাইখা ঘুইরা ঘুইরা মধু বিক্রি করতেছে এই দৃশ্য কি আপনের চোখে পড়ছে?
: পড়ছে।
: এইরকম এক মধু বিক্রেতার সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। বুদ্ধি কইরা তার মোবাইল নম্বর রাইখা দিছিলাম। এখন এইটা কাজে লাগাব। তারে ফোন কইরা মধুর বদলে মৌমাছি সাপ্লাই দিতে বলব। হাঃ হাঃ হাঃ।
মাজুলের কথায় শাফিনূর দ্বিমত পোষণ করল। হাত নেড়ে নেড়ে বলল
: এইটা কোনোমতেই সম্ভব নয়।
তাজুল মাজুল দুজনেই একসঙ্গে হাহাকার করে উঠল। বলল
: কেন সম্ভব নয়!
লম্বা দম নিয়ে শাফিনূর বলল
: আইজ আব্বারে পাগল ঘোষণা করলে দুইদিন মানুষ আমাদের বলবে, পাগলের গোষ্ঠী। এরপর নিজের মেয়ের বিবাহের সম্পর্ক করতে গেলে লোকজন যদি বলে পাগলের গোষ্ঠীর সঙ্গে আত্মীয়তা করব না; তখন কী করব? এর চাইতে বরং আরেকটা কাজ করার কথা বিবেচনায় নেওয়া যাইতে পারে।
পিঠ চুলকাতে চুলকাতে তাজুল জানতে চাইল
: কী কাজ?
: বেনামে আব্বার কাছে পত্র প্রেরণ কইরা যদি হুমকি প্রদান করা হয় বিবাহের নাম মুখে আনলেই জীবন সংশয়।
তাজুলের খাওয়া তখনও শেষ হয়নি। শাফিনূরের কথা শুনে সে খাবার মাখানো হাতেই তুড়ি বাজাতে বাজাতে চিৎকার করে বলল
: ইউরেকা! ইউরেকা...
শাফিনূরের আইডিয়া তাজুল গ্রহণ করেছে ভেবে খুশি হয়ে সে জানতে চাইল
: কী ইউরেকা, দুলাভাই?
তাজুলকে খুবই উৎফুল্ল দেখাচ্ছে। শাফিনূরের দিকে চেয়ে সে বলল
: তুমি হুমকির কথা বলতেছিলা না? তোমার হুমকির প্রদানের আইডিয়াটা আমার খুবই পছন্দ হইছে। তবে এইখানে সামান্য একটু কারেকশন আছে। হুমকিটা ইনডাইরেক্ট না দিয়া ডাইরেক্ট দেওন লাগবে।
তাজুলের কথা শুনে অবাক হয়ে শাফিনূর জানতে চাইল
: ডাইরেক্ট মানে? আপনে নিজে যাইয়া তারে হুমকি দিয়া আসবেন নাকি?
শাফিনূরের কথায় হো-হো করে হাসতে থাকে তাজুল। অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে সে বলল
: আরে না! আমি কোন একাব্বর যে, আমার কথা শুইন্যা শ্বশুর আব্বা কাপড় নষ্ট কইরা ফেলবেন? কাপড় নষ্ট করার করার জন্য সলিড একাব্বর প্রয়োজন।
আলোচনায় স্থির হলো, এলাকার ভয়ংকর মাস্তান পিস্তল হারেজকে নূরুদ্দিন সাহেবের কাছে পাঠানো হবে। পিস্তল হারেজ নূরুদ্দিন সাহেবের কাছে গিয়ে যদি বলে, স্টপ ম্যারেজ; তাহলে সেকেন্ড টাইম বিবাহের নাম উচ্চারণ করার সাহস পাবেন না তিনি।


পরদিন সন্ধ্যার ঠিক আগে তাজুলের ফোন পেল মাজুল। সালাম দিয়ে মাজুল বলল-
: দুলাভাই...
ফূর্তিমাখা গলায় তাজুল বলল-
:শোন মাজুল, পিস্তল হারেজের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য লোক লাগাইয়া দিছি। বলছি টাকা যা চায়, তাই দেওয়া হবে। টাকা কোনো সমস্যা না। আশা করতেছি, আইজ রাতেই রেজাল্ট পাব।
:তার কোনো প্রয়োজন নাই দুলাভাই।
অবাক হয়ে তাজুল জানতে চাইল
:কেন!
:শাশুড়ি আম্মা ব্যাকগিয়ার মারছেন!
:এইটা কী ধরনের শব্দ?
:অ্যাপ্রোপ্রিয়েট শব্দ দুলাভাই! ব্যাকগিয়ার বলতে আমি বুঝাইতে চাইতেছি উনি রণাঙ্গন থেইকা পিছু হটছেন।
:বুঝলাম না!
উত্তর দেয়ার আগে গলা ছেড়ে হাসল মাজুল। তারপর বলল
:পাত্রী দেখতে যাওয়ার বিষয়টা ফাইনাল হইয়া গেছে শোনার পর শাশুড়ি আম্মা দোতলার হিজরতি জীবনের অবসান ঘটাইয়া আইজ বিকালে নিচতলায় পদার্পণ করছেন।

এই গল্পটি জাগো নিউজের ঈদ সংখ্যা ২০২১ এ প্রকাশিত হয়েছে। ঈদ সংখ্যাটি পাওয়া যাচ্ছে অথবা ডটকমে।

এসএইচএস/এমকেএইচ