অবশেষে ফিরে এলে
বোরহানের আজও তাড়াতাড়ি বাসায় ফেরা হচ্ছে না। গত কয়েকদিন ধরে পরিকল্পনা করেছিলো আজ তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বাসায় ফিরবেন। বাসায় তার একগাদা কাজ জমা হয়ে আছে। কম্পিউটারের টেবিলটায় ধুলোবালি জমে আস্তরণ পড়েছে। গত দুই সপ্তাহ জামা-কাপড় পরিষ্কার করা হয়নি। বিছানাও অপরিষ্কার। সব মিলিয়ে নিজের রুমটা বোরহানের কাছে সিটি কর্পোরেশনের ডাস্টবিন মনে হচ্ছে।
বোরহান হিসেব করে দেখেছেন অফিস থেকে বসের কাছে বলে চারটায় বের হবেন। এরপর বাসায় ফিরে রাত ১০টা পর্যন্ত কাজ করতে পারলে বাসার সব কাজ শেষ করতে পারবেন। আজকে এই কাজ করতে না পারলে আগামী এক সপ্তাহেও এই কাজের গায়ে হাত দিতে পারবে না। কারণ এবারে ছুটির দিনেও তাকে অফিস করতে হবে।
বোরহান অফিস থেকে বের হয়েছেন সত্যি, তবে বাসায় ফিরতে পারেননি। বাসায় ফিরতে না পারার কারণ হচ্ছে সুজন তালুকদার। অফিস থেকে বের হয়ে যখনই বাসে উঠতে যাবেন ঠিক তখনই সুজন তালুকদারের ফোন।
সুজন তালুকদার বোরহানের খুব ঘনিষ্ঠজন। যদিও তিনি কোনো আত্মীয় নন। কর্মসূত্রে ঢাকায় এসে তার সাথে পরিচয়।
সুজন তালুকদার খুবই সজ্জন মানুষ। তিনি বোরহানকে ঢাকায় স্থায়ী হতে অনেক সাহায্য করেছেন। এমনকি চাকরি জীবনের শুরুর দিকে দু-একটি চাকরির জন্য সুপারিশও করেছেন।
পঞ্চাশ টাকা, একশ টাকা, পাঁচশ টাকা- এমন করে সময়ে-অসময়ে বোরহান কত টাকা যে নিয়েছেন সুজন তালুকদারের কাছ থেকে তার কোনো হিসেব নেই। সুজন তালুকদারের কাছে টাকা কিংবা অন্য কিছু চাইলে কখনো বোরহানকে খালি হাতে ফেরাননি। সাধ্যমতো দিতে চেষ্টা করেছেন। কবে পরিশোধ করবে তাও বোরহানের কাছে কখনো জানতে চাননি সুজন তালুকদার।
এমনকি বোরহানও আজ পর্যন্ত তা পরিশোধ করেনি। অবশ্য কয়েকবার পরিশোধ করতে চাইলে সুজন তালুকদার বোরহানকে অভিভাবকসুলভ ধমক দিয়েছেন। সব মিলিয়ে সুজন তালুকদারের কাছে বোরহানের অপ্রতিশোধ্য ঋণ রয়েছে। তাই বোরহান কখনোই সুজন তালুকদারের কথা ফেলতে পারেন না। বরং তার কোনো কাজ করে দিতে পারলে নিজেকে কিছুটা হালকা ও ঋণমুক্ত মনে করেন।
ফোনে সুজন তালুকদার বোরহানকে জানালেন,-
: বোরহান আপনি যেখানেই থাকেন না কেন বিশ্ব রোডের ওখানে আপনাকে যেতে হবে। সেখানে ফাহাদ অটো মোবাইল কারখানায় যাবেন। কারখানায় রাজিব নামে একটি ছেলের সাথে দেখা করেন। ও আপনাকে আমার গাড়ির কভার দেবে। আমি সকালে গাড়ি ওয়াশ করিয়েছি ওখানে। কিন্তু ভুলে গাড়ির কভারটা ফেলে এসেছি। আপনি ওখান থেকে কভারটা নিয়ে আমার বাসায় পৌঁছে দেবেন। আমি ব্যস্ততার কারণে যেতে পারছি না।
বোরহান অফিস থেকে বের হয়ে বিশ্ব রোডের বাসে উঠলেন। ফাহাদ অটো মোবাইল কারখানা থেকে গাড়ির কভার নিয়ে ধানমন্ডির বাসে উঠলেন।
বাসে সিট পেলেন না বোরহান। অগত্যা দাঁড়িয়ে রইলেন। প্রতিদিন সন্ধ্যায় অফিস ফেরত মানুষের মধ্যে বাসে এরকম দাঁড়িয়ে থাকা গা সওয়া বিষয় বোরহানের কাছে।
কিছুক্ষণ পর- ‘এই যে হ্যালো’!
নারী কণ্ঠের ডাক। এদিক ওদিক ঘাড় ফেরাতেই বোরহান দেখতে পেলেন মেয়েটি তাকে উদ্দেশ্য করে ডাকছে।
-এখানে বসতে পারেন। একটি সিট আছে।
এই বলে মেয়েটি সিটে রাখা তার ব্যাগটি তুলে নিলেন। বোরহান মেয়েটির পাশে বসলেন।
-থ্যাঙ্কস ম্যাডাম।
-ওয়েলকাম।
তবে মেয়েটি ওয়েলকাম বলেছেন কেমন একটা অস্বস্তি নিয়ে। তা বোরহান চোখ দেখে বুঝতে পেরেছেন। বোরহান বুঝতে পেরেছেন ম্যাডাম বলাতে মেয়েটি খুশি হননি। আসলে বোরহান অপরিচিত বা বোন টাইপের মেয়েদের ম্যাডাম বলে সম্বোধন করে, তা বোরহানের বয়সে অনেক ছোট হলেও। কিন্তু অনেক মেয়ে ম্যাডাম সম্বোধন শুনলে নিজেকে বয়স্কা মনে করেন। বোরহান পরিস্থিতি বুঝতে পেরে এবার বললেন,-
-অনেক খুশি হলাম। আপনি ডাক দিয়ে না বসালে আমার পুরো পথ দাঁড়িয়ে যেতে হতো।
বোরহান সিটে বসার কিছুক্ষণ পর তার হাতে একটা বই বের করে পড়তে শুরু করেছেন।
-বাহ দারুণ তো এতো ভিড়ের মধ্যেও আপনি বসেই পড়তে শুরু করেছেন। খুব ভালো, খুব ভালো! তবে জানেন তো এতো কম আলোতে পড়লে চোখে অনেক বড় সমস্যা হয়।
এ কথা শুনে বোরহানের ভালোই লেগেছে। কারণ এমন করে কেউ তাকে বলেনি কখনো। বোরহান মেয়েটির কথায় মুগ্ধ হয়ে গেল।
-আমি আসলে পড়তে ভালোবাসি।
-হুম। তা আমি বুঝতে পেরেছি।
মেয়েটি চটপট করে কথা বলে। অপরিচিত কোনো মেয়ে বোরহানের সাথে এমন করে কথা বলেনি কখনও। বোরহান মেয়েটির চটপটে স্বভাব দেখে বিস্মিতও বটে।
-আপনি সব সময়ই এমন করে বই পড়েন?
মেয়েটি আবার বোরহানের কাছে জানতে চাইলেন।
মৃদু এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বোরহান জবাব দিলো,-
-সব সময় কী আর বই পড়ার সুযোগ আছে। কত শত কাজের ব্যস্ততায় দিন চলে যায়, মন চাইলেও সব সময় বই পড়া যায় না। তবে হাতে কোনো কাজ না থাকলে আমি বই নিয়ে বসে পড়ি। সময়টা ভালোই কেটে যায়। কোনো কাজ ছাড়া থাকতে আমার মোটেই ভালো লাগে না। একটু ফ্রি থাকলেই নানা ধরনের দুশ্চিন্তা মাথায় এসে ভর করে। তখন অস্থির হয়ে যাই। তাই বইয়ের মাঝে ডুবে থাকলে সময়টা কোন ফাঁকে কেটে যায় টেরই পাই না।
-তাই বুঝি সব সময় একটা বই সঙ্গে রাখেন?
-শুধু বই নয় পড়ার যে কোনো কিছু হলেই হলো। এই যেমন ধরুন ম্যাগাজিন, পত্রিকা, বই এর যে কোনো একটি হলেই হলো। আমি যে কোনো বিষয় হলেই পড়তে পারি।
মেয়েটির সাথে কথা বলতে বলতে বাস খামারবাড়ি এসে গেছে। বোরহান বুঝতে পারলো মেয়েটি মনে হয় খামারবাড়ি নেমে যাবেন।
-আচ্ছা আপনি কোথায় নামবেন?
বোরহান জানতে চায়।
-আমি ধানমন্ডি ৩২ নেমে যাবো, আপনি?
-আমি খামারবাড়ি নেমে যাবো। আচ্ছা যদি কিছু মনে না করেন আপনার ফোন নাম্বারটি দেবেন?
-অফকোর্স।
এই বলে বোরহান তার ভিজিটিং কার্ডটি দিলেন। দিয়ে বললেন-
-শেষের নাম্বারটি সব সময় খোলা থাকে।
কার্ডটি হাতে নিয়ে মেয়েটি দ্রুত পায়ে খামারবাড়ি নেমে গেলেন।
গাড়ি ধানমন্ডির দিকে ছুটছে। বোরহান বই খুলে পাঠে মন দিয়েছেন। কিছুক্ষণ পড়ার পড়ে আর তার পাঠে মন বসছে না। মেয়েটির কথা মনে পড়ছে। বোরহান ভাবছে আমাদের নাম পরিচয় কিছুই জানা হলো না। এর মধ্যেই মেয়েটি ফোন নাম্বার চাইলো আর আমি তা অমনি দিয়ে দিলাম। বিষয়টি নিয়ে বোরহান গভীর ভাবনায় ডুবে গেলেন।
প্রায় এক সপ্তাহ হয়ে গেল। মেয়েটি ফোন করছে না যেভাবে আগ্রহ নিয়ে মেয়েটি ফোন নাম্বার নিয়েছে তাতে বোরহানের মনে হয়েছে মেয়েটি খুব তাড়াতাড়ি ফোন দেবেন। কিন্তু ফোন না দেয়াতে বোরহান কিছুটা হতাশও হয়েছেন।
আজ বোরহানের অফিসে সাপ্তাহিক মিটিং ছিল। প্রতি মিটিং ঘণ্টা খানেকের মধ্যে শেষ হয় কিন্তু আজ প্রায় দুই ঘণ্টা লেগেছে। মিটিং শেষ করে ডেস্কে ফিরে এসে দেখে ফোনে সাতটা মিসড কল।
বোরহান সাতটা মিসড কল দেখে অবাক হন। এতগুলো মিসড কল বিগত কয়েক বছরে আর কখনো আসেনি। মিসড কল দেখে কিছুক্ষণ পর আবার আনন্দিতও হন এই ভেবে যে সেই মেয়েটি মনে হয় কল দিয়েছিলো। মিসড কল থেকে করে দেখে দুটি অচেনা নাম্বার। প্রথম কলটি ব্যাক করলো বোরহান। কল দিয়ে জানতে পারলেন এটি একটি ফার্মেসির নাম্বার। তার মা ভীষণ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। বোরহানের ছোট ভাই শিহাব এই ফার্মেসিতে ওষুধ কিনতে এসেছিল। শিহাবের ফোনে ব্যালেন্স ছিল না। তাই ফার্মেসির ফোন দিয়ে বোরহানকে মায়ের অসুস্থতার কথা জানানোর জন্য কল দিয়েছিলো শিহাব। এরপর দ্রুত শিহাবকে ফোন দেন বোরহান।
শিহাব জানায় মায়ের অবস্থা মোটেও ভালো না। স্ট্রোক করেছে কখন কী হয় বলা যায় না। মায়ের মুখ দেখতে চাইলে এখনই রওনা দেয়ার জন্য কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে শিহাব।
বোরহান অফিস থেকে তাৎক্ষণিকভাবে বের হয়ে রওনা দেন। পথিমধ্যে বোরহানের ফোনে অজানা নাম্বার থেকে একটি কল আসে। এবার বোরহান মনে করেছে এই ফোন বোধহয় বাসে বসে পরিচয় হওয়া মেয়েটি দিয়েছে। কিছুক্ষণ পর আবার ভাবছে অন্য কোনো উটকো ঝামেলার ফোনও হতে পারে। মায়ের অসুস্থতার কারণে বোরহানের মনটা মোটেই ভালো নেই। তাই অপরিচিত কোনো নাম্বারের কল ধরবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
বোরহান খুলনা সদর হাসপাতালে এসে মায়ের চিকিৎসার সার্বিক খোঁজ-খবর নিলেন। হাসপাতালে দুদিন থাকার পর মায়ের শারীরিক কিছুটা উন্নতি হয়েছে।
বোরহান মাকে বাড়িতে রেখে বিকেলে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন। কিন্তু বোরহানের মা বাঁধ সাধলেন।
-বাবা আর একটা দিন থেকে যা। তুই থাকলে আমার অনেক ভালো লাগবে। মায়ের অনুরোধে আরও দুদিন বাড়িতে থাকার সিদ্ধান্ত নিলো বোরহান। কিছুক্ষণ পরে অফিসে ফোন দিয়ে দুদিনের ছুটি মঞ্জুর করিয়ে নিলেন।
বিকেলে খেয়ে বারান্দায় শুয়ে আছেন বোরহান। শুয়ে শুয়ে ফেসবুকিং করছিলেন। হঠাৎ তার মা পানের থালা নিয়ে বিছানার পাশে বসলেন। ‘বাবা পান খাবি’- এই কথা বলে বোরহানের পিঠে হাত রাখলেন মা। বোরহান মায়ের পানের থালার দিকে তাকিয়ে কিছুটা বিরক্ত হয় বলেন,-
-মা তুমি এখনো পান খাওয়া ছাড়তে পারোনি। ডাক্তার না তোমাকে কতবার পান খেতে নিষেধ করেছেন।
মা মৃদু হেসে জবাব দেন,-
-না বাবা, আমি এখন আর খাই না। মেহমান কিংবা কাজের লোকজন দিয়ে বাড়িতে কাজ করালে তাদের একটু-আধটু দিতে হয়। তুই তো আগে একটু আধটু পান খাইতি। এখন একটু দেবো? খাবি?
বোরহান মায়ের কথায় আর রাগ করে থাকতে পারেন না।
-মা তুমিও একটু খাও, আমাকেও একটু দাও। আর আমারে কথা দাও আজ থেকে আর পান-জর্দা খাবে না!
পান মুখে দিতে না দিতেই বোরহানের ফোনে কল আসে। ফোন হাতে নিয়ে আবার রেখে দেন বোরহান। ফোন বেজেই যাচ্ছে। বোরহান ধরছেন না। বাজতে বাজতে ফোন কেটে গেছে। কিছুক্ষণ পর আবার কল আসে। একই আননোন নাম্বার দেখে ফোন ধরছেন না বোরহান। ফোন বাজতে দেখে বোরহানের মা বলছেন,-
-তোর মোবাইল তো বেজেই যাচ্ছে। ধর। কথা বল। দ্যাখ ফোন কে দিয়েছে।
মায়ের কথায় ফোন রিসিভ করলেন বোরহান।
-হ্যালো, কে বলছিলেন?
অন্যপ্রান্ত থেকে জবাব আসে,-
-... নূপুর?
বোরহান আবার জানতে চান,-
-... কোন নূপুর?
একটু হেসে বোরহান বললেন,-
-হুম চিনতে পেরেছি। যদি কিছু মনে না করেন তাহলে একটা কথা বলতাম। ... আমি আমার মায়ের অসুস্থতার কারণে বাড়িতে এসেছি। আমি ঢাকায় এসে আপনাকে ফোন দেই?
এই কথা বলে বোরহান ফোন রেখে দিলেন।
বোরহান ফোন রাখতেই মা কৌতূহলমাখা কণ্ঠে বললেন,-
-বাবা কোন নূপুর?
হেসে বোরহান জবাব দেন,-
-বললে তুমি কী তারে চিনবা?
মায়ের কৌত‚হল যেন আরো বেড়ে যায়।
-তারপরও বল বাবা। শুনি।
-মেয়েটার বাড়ি নেত্রকোনা। আমাদের অফিসের কাজে নেত্রকোনা গিয়েছিলাম। সেইখানে মেয়েটি ট্রেনিং নিতে এসেছিল। ওখানে বসেই পরিচয়। এরপর প্রায়ই আমাকে কল দেয়। এক পর্যায়ে আমি বিরক্ত হয়ে আর ফোন ধরি না। এখন একেক দিন একেক নাম্বার থেকে ফোন দেয়।
বোরহানের মা মৃদু হেসে বলেন,-
-মেয়েটা তোরে কল দেয়, কথা বলবি। সমস্যা কী। কথা বলতে তো আর টাকা পয়সা লাগে না!! শুনবি কী বলতে চায় মেয়েটা।
কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বোরহান বলে,-
-বলবে আর কী! তোমরা যে গলার ফাঁস আমায় পরানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছো, সেই ফাঁস নিয়ে ঐ সব মেয়েরা ঘোরে। আমাকে পরাবে।
বোরহানের এই কথা শুনে তার মা হাসতে হাসতে মুখে কাপড়ের আঁচল দিয়ে ঢেকে বললেন,-
-মেয়েটি দেখতে কেমন?
বোরহান বিরক্তির ভঙ্গিতে জবাব দেয়,-
-ক্যান, মেয়েটিকে তোমার পুত্রবধূ করতে চাও মা?!! মা তোমরা আমারে পাইছো কী! খালি বিয়া বিয়া বিয়া! যেখানে যাই বিয়া। যে ফোন দেয় খালি বিয়ার কথা জিজ্ঞেস করে। ... এখনো বিয়ে করছি না ক্যানো? কবে করবো? হাজারো প্রশ্ন। অনেক হইছে মা এখন তোমরা বাদ দাও এসব।
বোরহানের এই কথা শুনে তার মা কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বললেন,-
-শারমিন তোর সাথে অমন করেছে তাতে কী হয়েছে! দুনিয়াতে আর কোনো মেয়ে নাই? একা একা আর কতকাল এভাবে থাকবি। একটা সময় বুঝবি, একটি জীবন একা একা থাকা কতটা জ্বালার। একাকিত্ব মানুষকে কতটা পোড়ায়। তোর বাবা মারা গেছে আজ পাঁচ বছরের বেশি। এই পাঁচ বছরকে আমার পঞ্চাশ বছরের চেয়ে বেশি মনে হয়েছে।
এই কথা বলে বোরহানের মা আঁচলে চোখ মোছেন। মুখ চেপে হাউ মাউ করে কান্না শুরু করেছেন।
এবার বোরহান মাকে জড়িয়ে ধরে বুকে টেনে নেন। সান্ত্বনা দেন।
-মা তুমি এমন করে কাঁদলে আমি সহ্য করতে পারি না। আমার কী মনে কষ্ট কম বলো মা। এই বলে বোরহান কেঁদে দেন। ঘরের মধ্যে পিনপতন নীরবতা।
চোখ মুছতে মুছতে বোরহান জবাব বলেন,-
-আমার আর কিছু বলার নেই মা। তোমরা যা ভালো মনে করো তাই করো। আমি সব মেনে নেবো। তোমরা এখন মেয়ে দ্যাখো। যে মেয়ে এনে দেবে তাকেই মেনে নেবো। আমি সেই মেয়েকেই পছন্দ করবো। আমার আর ব্যক্তিগত কোনো পছন্দ অপছন্দ নেই। পৃথিবীর কোনো কিছুর প্রতি আমার আর আগ্রহ নেই। মোহ নেই। তোমাদের সুখেই আমার সুখ। আমি তোমাদের জন্যই বেঁচে আছি, নইলে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার স্বাদ আমার হারিয়ে গেছে।
মা-ছেলের কথোপকথনে ঘরের পরিবেশ ভারী হয়ে এসেছে। ছেলের এমন কথা শুনে মায়ের মন আরো বিষাদে ভরে গেছে। বোরহানের মায়ের দু’চোখ থেকে অঝোরে জল ঝরছে।
কান্না জড়ানো কণ্ঠে বলছেন,
-আমি বুঝতে পেরেছি তুই এখনও ভুলতে পারো নাই শারমিনকে। আমি শিহাবকে দিয়ে খোঁজ নিয়ে দেখছি। শারমিনেরও বিয়ে হয়নি। শারমিনও ঢাকাতে থাকে। সেখানে লেখাপড়া করছে। চাকরির জন্য নাকি অনেক লেখাপড়া করতেছে।
তুই শেষবারের মতো শারমিনের সাথে দেখা কর। এমনও তো হতে পারে- শারমিনও তোর জন্য অপেক্ষা করছে।
-না, মা তুমি আর আমারে শারমিনের সাথে দেখা করতে বলবা না। আমারও তো আত্মসম্মান বোধ আছে। আর নিজেকে এত অপমানিত করতে ভালো লাগে না।
- এ কেমন কথা বলছো বাবা? তুই যাকে এত পছন্দ করো, ভালোবাসো, তার সাথে মান অভিমান থাকতে পারে। কিন্তু তাকে ঘৃণা করা যায় না। তো সে অপমান করতে পারে, তাই বলে তুই তাকে ঘৃণা করতে পারো না। তোর এই কথা শুনে মনে হচ্ছে শারমিনের প্রতি তোর আর ভালোবাসা নেই।
বোরহান কিছুটা অভিমানে আরও কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বলে,-
-মা আমি ওকে ঘৃণা করি। ওর কথা আমি এখন আর মনেও করি না।
এই বলে বোরহান কান্না শুরু করে দেয়। বোরহানের কান্না দেখে তার মা সান্ত্বনা দিতে যায় না। অথচ ছেলের চোখের জল দেখলে বোরহানের মা কখনোই স্থির থাকতে পারতেন না। সান্ত্বনা না দিতে এসে বরং তার মা অন্য রুমে চলে যান। এবং বোরহানের মা যেতে যেতে বলেন- কাঁদুক! ভালোবাসার জন্য বেশি করে কাঁদুক। চোখের জলেও মাঝে মাঝে সুখ মেলে।
পরের দিন বোরহান ঢাকায় ফিরে আসেন। ঢাকায় আসার পর তার মায়ের কথাগুলো মনে পড়লো। বোরহান ভাবছে প্রেম ভালোবাসা নিয়ে মা এমন গভীর অনুভূতির কথা কোথায় পেলেন। মায়ের এমন কথায় বোরহান শারমিনের প্রতি আর ভালোবাসার টান নতুন করে অনুভব করছেন। শারমিনের প্রতি রাগ, এতদিনের বুকের মাঝে চেপে রাখা অভিযোগ, অভিমান ভুলে যান বোরহান। সে সিদ্ধান্ত নেয় শারমিনের সাথে আবার যোগাযোগ করবে।
ফোনে সার্চ দিয়ে দেখলো শারমিনের নাম্বার নেই। কিছুটা হতাশ হলেন বোরহান শারমিনের নাম্বার না পেয়ে। এরপর ফেসবুকে শারমিনের আইডিও খুঁজলো পেলো না। শারমিন বোধ হয় ব্লক করে দিয়েছে-এমনটা ভেবেছেন বোরহান। ব্যর্থ হয়ে বোরহান সিদ্ধান্ত নেয় বাড়িতে মায়ের কাছে ফোন দেবে। শারমিনের ফোন নাম্বার ও ঢাকার ঠিকানা মাকে সংগ্রহ করে দিতে বলবে। মাকে বললে ছোট ভাই শিহাব সংগ্রহ করে দেবে। শিহাবের সাথে শারমিনের খালাতো ভাইয়ের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে বোরহান আবার চিন্তা করে মায়ের কাছে এমনটা বলা কী ঠিক হবে! মায়ের কাছে বলবে কী না এ জন্য সময় নেন বোরহান।
আজ বোরহান অফিসে পুরনো একটি ফাইল ঘাটছিলো, সে সময়ে ফোনে একটা কল আসে। আননোন নাম্বার দেখে বোরহান লাইন কেটে দেন। কাজ শেষে বোরহান ফোন ব্যাক করে।
-হ্যালো, কে বলছিলেন? ফোনের ও প্রান্ত থেকে জবাব এলো
-এতদিন পর তাহলে ফোন ব্যাক করার মতো সময় হলো?
বোরহান কথার মাঝে অভিযোগ ও অভিমানের সুর অনুভব করলেন। কিন্তু বুঝে উঠতে পারছে না ফোনটা কে করেছে। তবে কিছুটা চেনা চেনাও লাগছে। আবার মেয়ে কণ্ঠ শুনে বোরহান নিজের ধারণা ও অনুমাননির্ভর কিছু বলতেও চাচ্ছেন না।
-আচ্ছা কে বলছেন প্লিজ!
-ও, আচ্ছা... তাহলে আমার কণ্ঠও তাহলে ভুলে গেছেন বুঝি।
বোরহান একটু আমতা আমতা করে বললেন-
-না মানে ঠিক ধরতে পারছি না।
-আমি নীলিমা।
নাম শুনে কিছুটা থমকে যায় বোরহান।
-সরি, কোন নীলিমা?
-এবার দৃঢ় কণ্ঠে জবাব দেন,-
-ফারজানা আক্তার নীলিমা।
এমন জবাব শুনে রাগ করেছে না বিরক্ত হয়ে কথা বলেছে তা বুঝতে পারছেন না বোরহান।
- ফারজানা আক্তার নীলিমা-চিনতে পেরেছেন এবার?
এমন অকপট জবাব শুনে কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় বোরহান।
ফোনের এ প্রান্তে বসে মাথা চুলকাতে চুলকাতে বোরহান বলে-
- না, মানে আমি আসলেই চিনতে পারছি না।
-ওহ! চিনবেই বা কী করে। সেদিন তো আমার নামই জানতে চাননি।
বোরহান কথা বলছেন আর ক্রমশ বিস্মিত হচ্ছেন।
-প্লিজ বলুন আপনি কে?
একটু লাজুক হেসে জবাব দেয়,-
-বললাম তো আমি নীলিমা।
-একটু পরিষ্কার করে বলেন,- কোন নীলিমা?
বোরহানের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে নীলিমা আবার প্রশ্ন করে-
-আপনি কী আগামীকাল ফ্রি আছেন?
বোরহান জবাব দেয়,-
-কালকে আমার সাপ্তাহিক ছুটি। সারাদিন ফ্রি আছি বলতে পারেন। বিকেলে একটা অনুষ্ঠানে যেতে হবে।
-গুড, সকাল ১০টার দিকে ফার্মগেট কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনের সামনে আসবেন। আমি একটা অনুষ্ঠানে অংশ নিতে সেখানে যাবো। সঙ্গে আপনার সাথে দেখাও হয়ে যাবে।
বোরহান কোন বাক্য ব্যয় না করে জবাব দেন,-
-আচ্ছা, আসবো।
বোরহান এই কথা বলতেই মেয়েটি বাই বাই বলে ফোন কেটে দেন।
ফোন কেটে দেয়ার পরে বোরহান একটু দ্বিধা দ্বন্দ্বে পড়ে যান। নীলিমাকে বোরহানের চেনা চেনা লাগছে। আবার পুরোপুরি চিনতেও পারছেন না। আবার এদিকে নীলিমার সাথে দেখা করার কথাও দিয়ে ফেলেছেন।
এবার নীলিমার পরিচয় স্পষ্ট করে জানতে আবার ফোন হাতে নেন বোরহান। ভাবছে ফোন দেবে কী না। কিছুক্ষণ ভেবে ফোন দেন বোরহান। নীলিমা ফোন রিসিভ করে না। একবার ফোন দিয়ে আর ফোন দেয় না বোরহান।
পরের দিন সকাল ১০টায় ফার্মগেট আসেন বোরহান। এসে ফার্মগেট পার্কের কোণে বসে থাকে। সাড়ে ১০টার দিকে নীলিমা ফোন দেয় বোরহানকে। ফোন পেয়ে বোরহান ছুটে যায় কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনের দিকে। কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে পৌঁছার কিছু আগে বোরহান দেখতে পায় একটি মেয়ে কৃষ্ণচূড়া ও পলাশ ফুলের তোড়া নিয়ে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে সামনে ছোট দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বোরহান মেয়েটিকে দেখে থমকে দাঁড়ায়। সে মনে মনে ভাবে এই মেয়েটি হবে হয়তো।
মেয়েটি তার ব্যাগ থেকে ফোন বের করে দেবে। ফোন দিয়ে মেয়েটি ফোন যখন কানের কাছে নেয়, তখনই বোরহানের ফোন বেজে ওঠে।
বোরহান ফোন হাতে নিয়ে দেখে এটি নীলিমার ফোন। রিসিভ করে কথা বলে বোরহান। দেখতে পায় সত্যিই ফুলের তোড়া হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটিই তার সাথে কথা বলছে।
বোরহান সাথে সাথে কল কেটে দিয়ে বোরহানের সামনে এসে দাঁড়ায়।
-আপনি নীলিমা?
প্রশ্নের জবাব না দিয়ে মেয়েটি পাল্টা প্রশ্ন করে।
-আপনি শেখ বোরহান?
বোরহান সান গ্লাস খুলতে খুলতে জবাব দেয়,-
-হ্যাঁ, আমি বোরহান।
এরপর বোরহান বলেন,-
-আপনাকে আমার চেনা চেনা লাগছে।
ফুলের তোড়া হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে মেয়েটি বললেন-
-চেনা চেনা লাগবেই তো। বলেন তো কেন আমাকে চেনা চেনা লাগছে? কোথায় বসে আমাদের দেখা হয়েছিল?
বোরহান লাজুক হেসে জবাব দেয়,-
-আমাকে আর লজ্জা দিয়েন না প্লিজ। আসলে মনেই করতে পারছি না।
নীলিমা হেসে হেসে জবাব দেয়,-
-আপনি এতো ভুলোমনা। ও মাই গড! আমাদের বাসে বসে দেখা হয়েছিল।
- ওহো। কী সাংঘাতিক! আমি এই ব্যাপারটা বেমালুম ভুলে গেছি। এভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলবেন! চলেন আমরা কোথাও গিয়ে বসি।
এই কথা শোনার পর নীলিমা ফুলের তোড়া বোরহানের দিকে বাড়িয়ে বললেন,-
-এক্সকিউজ মি, আমি একটা ফোন দেবো। ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে নিই।
নীলিমার হাতে ফুলের তোড়া দেখে বোরহান ভাবে এটি বোধহয় তার জন্য এনেছে। কিন্তু তোড়াটি হাতে দেয়ার স্টাইলে তো এমনটা মনে হলো না।
নীলিমা ফোনে কথা বলছে। বোরহান অন্যদিকে তাকিয়ে রয়েছেন। ফোনালাপ শুনে বোরহান বুঝতে পারলেন তার সাথে আরও একজন আছেন। তিনি অন্য কাজে গেছেন। তাকে সংসদ ভবনের কর্নারে খেজুর বাগানের রোজ চায়নিজ কর্নারে যেতে বলেছেন নীলিমা।
ফোনে কথা শেষ করে বোরহানকে বলল,-
-চলেন সামনের দিকে আগাই।
বোরহান নীলিমা ধীরে ধীরে হেঁটে রোজ চায়নিজ কর্নারে গিয়ে বসলো।
বসতেই বোরহান খাবারের মেন্যুর দিকে ইশারা দিয়ে নীলিমাকে বলেন,-
-আপনার পছন্দের কী আছে অর্ডার করুন। আমার খুব খিদে পেয়েছে।
নীলিমা হেসে জবাব দিলেন-
-বাহ! আমার গেস্ট তো ভালোই। হোস্টের কাছে খেতে চাচ্ছে!
-আসলেই আমার খুব খিদে পেয়েছে। তাই আর তর সইছে না।
নীলিমা বললেন,-
-কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করুন। আমার সঙ্গী আসুক, নইলে আমাকে এই নিয়ে ধুয়ে-কুটে একাকার করে ফেলবে।
বোরহান নীলিমার কথার মাঝে ওয়েটার সামনে এসে দাঁড়ালো। বোরহান হোটেল বয়কে একটা কফির অর্ডার করলো। কফি খেতে খেতে ফেসবুকে নিমগ্ন হয়ে পড়েছেন বোরহান।
এদিকে কিছুক্ষণের মধ্যে নীলিমার সঙ্গী চলে এসেছেন।
-বসো, বসো, শারমিন বসো।
‘শারমিন’ নাম শুনেই বোরহান ফেসবুকের নিমগ্নতা থেকে চোখ তুলে তাকিয়ে শারমিনকে দেখে বিস্ময়ে ডুবে যান। বোরহান মুহূর্তের মধ্যেই স্তদ্ধ হয়ে যান। এখানে শারমিন এলো কী করে। স্বপ্ন দেখছে না কী, কিছুই বুঝতে পারছে না।
শারমিন একটি ফুলের তোড়া বোরহানের দিকে এগিয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে নীলিমার আনা ফুলের তোড়াও। এগিয়ে দেয়।
শারমিন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। রোজ চায়নিজ কর্নারজুড়ে যেন পিনপতন নীরবতা নেমে আসে।
এই গল্পটি জাগো নিউজের ঈদ সংখ্যা ২০২১ এ প্রকাশিত হয়েছে। ঈদ সংখ্যাটি পাওয়া যাচ্ছে অথবাডটকমে।
এসএইচএস/এমকেএইচ