ফকির ইলিয়াস এর কবিতা
এক.
এসব ব্রাত্যকথা ভেবে
জীবন আদিষ্ট থাকে সনাতন লৌহনৃত্যঘুমে। জাগার যৌবন নিয়ে
উনুনের উদর থেকে তাকিয়ে দেখে ইস্পাতের সহস্র সবুজ। কী এক
তন্দ্রার আলো, ছুঁয়ে আছে সমুদ্র নোলক! এসব ব্রাত্যকথা ভেবে
কলমও লিখে রাখে নম্বরবিহীন খাতার জবানী। আদৌ সুড়ঙ্গ নেই।
তবুও যেন পাতালের পদরেখা এসে শেষ হয়েছে এই নিরক্ষর পথে।
আর যারা রেখেছে স্বাক্ষর,তারা সবাই জীবনকে অচেনা ভেবে পাড়ি
জমিয়েছে আগুনের দেশে।
কামারের স্মৃতি এর আগেও বহুবার পরখ করেছে ইস্পাত এবং আগুনের
সখ্যতা। আঁচের ভবিষ্যত জীবনী পড়ে জেনেছে পোড়ার পরিণাম। বিবিধ
উত্থান শেষে কীভাবে ঘরে উঠে ভাদ্রের ফসল। অথবা কতোটা বিশ্বাসে
প্রেমিকা মাথা রাখে উদ্বাস্তু প্রেমিকের বুকে, খুঁজে নিতে আদিম অন্তর।আর
কবিও কামার হয়ে বার বার আঁকতে চেয়েছে সেইসব সারস সময়। ফুল ও
ফুলকির উড়ার নিয়ম। ফুঁ দিয়ে সরাতে চেয়েছে শব্দের বিরহ।
পরাস্ত নিয়তি হায় ! ছায়াপ্রধান সূর্য সরাতে বার বার ঘুমে থেকে যায় ।
দুই.
কয়েকটি ভোরের ইতিহাস
আমাদের আলোচনা চলছিল ঘরের সমুদ্রসীমা নিয়ে। আর কীভাবে
বৃষ্টি গড়িয়ে পড়বে পাতার চালায়,তা নিয়েও ভাবিত ছিলাম আমরা
তবে এভাবে ঘর বদলে বাধ্য হবো,তা কখনো কল্পনায় ছিল না।
কয়েকটি ভোরের ইতিহাস'ও এর মধ্যে পড়ে নিয়েছিলাম আমরা।
সূর্য উঠে কাকে প্রথম স্পর্শ করে, কোনো পতাকা মোড়া সকালে
একজন যোদ্ধাকে কীভাবে সমাহিত করা হয় এর দৃশ্যাবলি'ও খুব
কাছে থেকে দেখে নিয়েছিলাম । একটি রুমাল উড়াতে উড়াতে।
পোড়া ঘর, বিচ্ছিন্ন আগুনের ঘ্রাণ রেখে যাবার পরও মানুষ সেই
ভিটেয় দাঁড়ায়। কিছু পায় কী না জানি না, তবে অন্যমনস্ক হয়ে
চুম্বনে সিক্ত করে কালের নজর। তারপর বদলে দেবার অথবা
বদলে যাবার প্রস্তুতি নেবার জন্য মুছে দেয় জীবনের শেষ আঁধার ।
তিন.
মনমলাটে জমা কালের বিদ্যুত
খেলে যাই বৃষ্টির ধূপছায়া নিয়ে। মনমলাটে জমা কালের বিদ্যুৎ।
ঝলকে উঠি ,ঝলসাতে চাই বিপুল সবুজে সবুজে। আবার বাইবো
নৌকো ,আবার ভেসে যাবো অক্ষর সায়রে।
মেলে যাই প্রাণপত্র । পাতা ও পতংগের চারপাশে ডানার উড়াউড়ি।
পালক রেখে যাই , দেখে যাই চিত্রল রাতের ভ্রমণ। আমিও পর্যটক
ছিলাম পূর্বজনমে,আরেক ইবনে বতুতা।ভ্রমণের চারপাশে মেলে ধরে হাত।
ঢেলে যাই অশ্রু ধারাপাত। ধূপমলাটে আঁকি বিন্যস্ত প্রভাত ।
চার.
বেদনার শিল্পস্রোত
আমার মনে হয় তুমি ভুল করেই আমার বাড়ির দিকে
আসছো মেঘ। আমার মনে হয়, তুমি না চিনেই আমার
হাতে রাখছো হাত , প্রিয় শালিক ! আমি তো কেবল
গ্রহণেই ভাসতে চেয়েছি , আর শিল্পস্রোত গুলোকে
তুলে রাখতে চেয়েছি নবীনার চুলের খোঁপায়,ভুলে।
কিছু নীলিমা নুয়ে পড়েছিল যেদিন আমার জানলায়
আমার মনে হয় , ঠিক তার দুদিন আগে তুমি রেকি
করে গিয়েছিলে আমার মনবাড়ি । খোলাপায়ে স্পর্শ
করেছিলে রক্তবারুদ । ঝরতে চেয়েছিলে নাকি ঝরাতে,
এমন যোগাংকের জল নিরূপণে আমাদের আরেকবার
বসা দরকার বঙপো উপকূলে।
তুমি কি আবার আসবে?
পাঁচ.
সূত্রমুখের দিকে
অনাগত ভোর দেখে সাজাও এই বিপুল মহল
কাছে রাখো সেই জ্যোতি-যেভাবে আঁকে কেউ ছবি
কিংবা রবি'র দেশে যে মানুষ আগামীর খোঁজে
রাখে জমা জল-ঝড়, মিলনের কামনা প্রবল।
জগত'ই মূল মঞ্চ- ভালোবাসা রেখে-দেখে সব
পাখি কিংবা তৃণলতা সাক্ষী থাকে নীরব বলয়ে
আর থাকে যে সবুজ চিরকাল স্মৃতিঝর্ণা হয়ে
কিনারের কাছে গেলে,দেখা মিলে কিছু অনুভব।
পরিপূর্ণ কেউ নয়, কিছু নয়- বৃত্ত ভাঙা শুধু
যারা পারে কাছে যেতে,তারাই তো মহান ঋতুতে
এঁকে রাখে রঙ আর ক্যানভাসের বিবর্ণ শরীর
হয়তো অন্য কারো হাতে তুলে, দেবে বলে পথে।
মিলনই মুহূর্তময়, মিলনেই প্রজন্মের ছায়া-
যার হাতে এ পৃথিবী,রাখে মায়া আর প্রতিমায়া।
এইচআর/এমকেএইচ