একটি আত্মহত্যা
ডা. তনুশ্রী ডাকুয়া
পোস্টমর্টেম ঘরে রিয়াদের ডেডবডিটা কাটা-ছেড়া চলছে। ওর একটুও ভালো লাগছে না দেখতে। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। ইস, কেমন ঘ্যাচাত ঘ্যাচাত করে কাটছে। কিন্তু কী আশ্চর্য! ওর একটুও ব্যথা লাগছে না!
- দেখছোস রমিজ, কী সুন্দর রাজপুত্তুরের মতন চেহারা। ঘনকালো কোঁকড়ানো চুল। গায়ের রংটাই বা এতো সুন্দর কিভাবে!
- হ, ঠিকই কইছো মিয়া। পুরুষ মানুষ এতো সুন্দর হইতে পারে জানা ছিল না।
- জীবনে অনেক মানুষ কাটছি। কিন্তু এতো মায়া কখনো হইছে বইলা মনে অয় না।
পোস্টমর্টেম ঘরে লাশকাটার এই মানুষগুলোর কথা ভালো লাগছিল না রিয়াদের। কেমন একটা গন্ধ লাগছিল। ‘এর চেয়ে বাড়ি থেকে ঘুরে আসি। মাকে যে বড় দেখতে ইচ্ছা করছে।’ চলে এলো রিয়াদ বাড়ি, বাড়িটা কেমন যেন হাহাকার করছে। মা কোথায়... এই তো মাকে দেখতে পেয়েছে। ওর আত্মাটা বের হওয়ার আগে এই মুখটাই বারবার মনে পড়ছিল।
- রিয়াদ ও রিয়াদ, বাপ আমার। একটা বার ফিরে আয়... কী করেছি বাপ আমি? কই গেলি? আয় আয়...
গুনগুন করে গান ধরেছে মা, আর কাঁদছে-
ওর মনে হচ্ছে, ওর মা বুক চাপড়াতে চাপড়াতে ভেঙেই ফেলবে। নাহ, মাকে থামানো দরকার।
- মা, এই যে আমি। কেঁদো না তো। জানো না, তোমার চোখের জল আমায় কতো কষ্ট দেয়।
গলাটা ওর আটকে আসে। কিন্তু হায়, ওর কথা তো ওর মা শুনতে পাচ্ছে না!
ভাইটা কোথায় ওর, ছোট্ট ভাই তুলতুল! বলেছিল, এবার ভার্সিটি বন্ধ হলে কাগজের অরিগামি নিয়ে আসবে আসার সময়। কতগুলো অরিগামি বানিয়েছিল। এই যাহ, আনাই তো হয়নি ওগুলো। রুমে পড়ে আছে। আনাটা উচিত ছিল।
ভাইটা বাবার পাশে বসে আছে।
- বাবা, মা এতো কাঁদছে কেন? ভাইয়া কি মায়ের সাথে আড়ি নিয়েছে? আসবে না বাড়ি? কিন্তু আমার ভাইয়া তো কারো সাথে আড়ি নেয় না!
কোনো কথা বলছে না বাবা। মনে হচ্ছে, কথা বলতে পারছে না!
কত রাগী বাবা! কত ভয় পেত। এখনো মনে আছে, একটু অনিয়ম করলে কেমন বকা দিত। বাবাকে আজ বড্ড অসহায় লাগছে! কিন্তু সবাই আমায় ভুল বুঝছে। ভাবছে, আমি সুইসাইড করেছি!
ছোটবেলা থেকেই একটু বেশি সরল-সহজ ও। কারো সাথে তেমন মিশতো না। মা-ই ছিল সবকিছু। অবশ্য ভাইটা আসার পরে একটা খেলার সাথী হয়েছিল। ভীষণ মেধাবী ছিল রিয়াদ। ‘একটা মানুষ কীভাবে বইয়ের সাথে এতো সময় কাটাতে পারে’ বলে ওর ক্লাসমেটরা হাসত। এসএসসি, এইচএসসি পাসের পরে পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে ভার্সিটিতে ভর্তি হলো। বাবা-মায়ের ইচ্ছা ছিল ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হোক। কিন্তু ওর টান মহাকাশের উপরে। নতুন কিছু করার ইচ্ছা ওর, গবেষণা করবে সে। সেই থেকে বাইরে থাকা।
বেশ ভালোই কাটছিল দিন। একটা মেয়ে বন্ধুও হয়েছিল। অসম্ভব সুন্দরী। মা ছাড়া কোনো মেয়ে ওকে ভালোবাসে এটা ও জানতো না। এখন বুঝতে পারছে। অনিতা। অনেক ছেলেই পেছনে পড়েছিল ওর। তা নিয়ে মাথা ব্যথা ছিল না। অনিতা তো বন্ধু ওর, তাই না? আর হ্যাঁ, নিশম মোটেও পছন্দ করতো না ওকে। বারবার হুমকি দিত। ‘অনিতার সাথে অতো কি তোর হ্যাঁ? খুব ফুসকা খাওয়া তাই না? আর ঘাসের মধ্যে বসে অতো কি তোদের? পড়াশোনা করো না কি অন্য কিছু, আমরা বুঝি না মনে করছোস? ওর সাথে ফের যদি দেখি, এমন জায়গায় পাঠামু। কেউ টেরও পাবে না। তোর মতন বলদের গলায় অনিতাকে তো মুক্তার মালার মতো লাগে।’
অনেক খারাপ লেগেছিল সেদিন। অনিতাকে কত বলেছিল, যেন না মেশে ওর সাথে। তা-ও ও শুনলো না! একদিন সবার সামনে নিশম ওকে থাপ্পড় দিয়েছিল। রুমে এসে দরজা দিয়ে খুব চেষ্টা করেছিল সুইসাইড করার। কতো সময় ওই ঘুরতে থাকা ফ্যানের দিকে তাকিয়ে ছিল। ওর সাথে রাখা মায়ের একটা ওড়না দিয়ে ফাঁস দেবে ভেবেছিল! কিন্তু ওর মায়ের কথা মনে পড়ে গেল যে, ওই রাগী বাবাটা! জানতে পারলে ওকে যে আর বাড়িতেই ঢুকতে দেবে না! ওর ভাইকে যে অরিগামি বানিয়ে দেওয়া হবে না! অনিতার কথা যে মনে পড়ছিল না একদম তা কিন্তু নয়! কী নিষ্পাপ হাসি! যাহ, ওর সব খারাপ লাগা, অপমানবোধ কই গেল! পারল না তো মরতে!
অনিতার সাথে খুব একটা মিশতো না আর। আসলেই এড়িয়ে যেত। অনিতা কতবার বলেছে, ‘নিশমের জন্য আমার সাথে কথা বলছো না? তাই না?’ ও এড়িয়ে গেছে তখনো। রিয়াদ জানতো নিশম খুব ভালো ছেলে। না, হিরোইন না। আরও কীসব খেতো। আচ্ছা, সব বড়লোকের ছেলেরা তো এমন নয়, নিশম এত উদ্ধত কেন!
একদিন পড়ছিল মহাকাশ নিয়ে একটা লেখা। ইস! ও যদি মহাকাশে ঘুরে বেড়াতে পারতো! দরজায় কে ধাক্কা দিচ্ছে? ওর রুমমেটরা তো সুন্দরবন গেছে। ২ দিনে ফেরার কথা না! খুলেই দেখি। ‘নিশম তুমি?’ হাতে একটা জুসের গ্লাস। ও আবার এগুলো খাওয়া শুরু করেছে কবে!
- ভেতরে আসতে বলবে তো না কি?
- ও হ্যাঁ, অবশ্যই এসো।
- আসলে আজ অনিতার সাথে কথা বললাম। শুধু শুধুই তোমারে কত কি না বলেছি। কত অপমান করেছি। তোমার তো কোন দোষ নাই। আমি জানি, তুমি ওকে ভালো-টালো বাসো না। কিন্তু ও তোমাকে ভীষণ ভালোবাসে। আর এ-ও বলেছে, যেভাবেই হোক তোমায় না কি এই পড়াশোনার গণ্ডি থেকে বাইরে আনবে।
লজ্জায় সাদা মুখখানা লাল হয়ে যাচ্ছে ওর। ভাগ্যিস, মা দেখেনি!
রিয়াদ এক মুহূর্তেই অনিতাকে নিয়ে কত কী যে ভেবে ফেলেছিল! নিশম যে এতো বদলে গেছে তা ভেবেও খুব আনন্দ হচ্ছিল ওর।
- রিয়াদ, আমি তাই ভেবেছি সব শত্রুতা শেষ। মিষ্টি মুখ করাবো তোমাকে। তুমি তো জুস খুব পছন্দ করো। নাও আমি খাইয়ে দিচ্ছি।
রিয়াদ কিছু বলার আগেই নিশম ওর মুখে ঢেলে দিলো কতকটা।
কেমন ঝাঁপসা দেখছে কেন ও? নিশম কেমন পৈশাচিকভাবে শব্দ করে হাসছে! একি ওর আত্মাটাও তো বের হয়ে যাচ্ছে!
এখন তো ও মহাকাশে ঘুরছে। কিন্তু ও তো এভাবে ঘুরতে চায়নি! কতো ভেবেছিল, মহাকাশ বিজ্ঞানী হবে। আর হলো না! একটা জিনিস কিন্তু খুব মজার। ও সব দেখতে পাচ্ছে! নিশম ওর মোবাইলটা নিলো। একি! অনিতা ওকে ফেসবুকে যে আইডিটা খুলে দিয়েছিল, তাতে ঢুকে একটা সুইসাইড নোট লিখে পোস্ট করে দিলো! কী বুদ্ধি ছেলেটার! হাতে লিখলে যে হ্যান্ডরাইটিং মিলতো না! শুধু ভালো কাজে ব্যবহার করলো না!
হায় হায়, ওর বডিটা বাড়ি পৌঁছে গেছে। হয়তো পুলিশও ভাববে ও সুইসাইড করেছে! হয়তো নিশমের কিছু হবে না! একটু পরেই তো ওকে নতুন ঘরে যেতে হবে। বেশি সময় নেই হাতে। এই প্রথমবার অনিতাকে যে ওর দেখতে ইচ্ছা করছে খুব।
সাদা শাড়ি পরিয়ে শুইয়ে রেখেছে হসপিটালের বেডে। চুলগুলো কেমন মুখের সামনে এসে পড়েছে। মুখটা ভালো দেখা যাচ্ছে না! ডাক্তাররা বলাবলি করছে, ভীষণ মানসিক আঘাত পেয়েছে ও। এখন না কি কোমাতে আছে।
- ইস, কী খারাপ আমি! আমার জন্যই অনিতার এই অবস্থা। ওহো, হাতে বেশি সময় নেই। চুলটা সরিয়ে মুখটা একটু দেখতে চাই।
চুল সরাতেই মনে হলো পরম শান্তিতে চোখটা বন্ধ করে নিলো অনিতা!
কেমন ঠান্ডা ছোঁয়া পেলো রিয়াদ ওর ঘাড়ে। একি অনিতা যে!
- তুমিও চলে এসেছো সবাইকে ছেড়ে অনিতা।
- চুপ! একটাও কথা না। এই মেঘের মধ্যেই সুন্দর একটা বাড়ি বানিয়ে থাকবো তুমি আর আমি। বলো না রিয়াদ, ভালোবাসি।
- ভালোবাসি অনিতা, সত্যিই অনেক বেশি ভালোবাসি।
লেখক: এমবিবিএস (ঢামেক), ইন্টার্ন চিকিৎসক, ঢামেক হাসপাতাল, ঢাকা।
এসইউ/এমকেএইচ