জীবনানন্দের কবিতায় ঋতুকন্যা হেমন্ত
ঋতুবৈচিত্র্যের বাংলাদেশে কার্তিক-অগ্রহায়ণ হেমন্তকাল। কুয়াশাচ্ছন্ন সকাল। মিষ্টি রোদের আদর। জ্যোৎস্না-প্লাবিত রাত। পাতাঝরা বৃক্ষের নৃত্য। এসব ঋতুকন্যা হেমন্তের বৈশিষ্ট্য। আর এসব বৈশিষ্ট্য নাড়া দিয়েছে প্রকৃতির কবি, নিসর্গের কবি, রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশকে। অন্য কোনো কবির কাব্যে হেমন্ত এলেও জীবনানন্দের মতো কেউ আবেগতাড়িত করতে পারেনি আমাদের।
প্রকৃতির নিয়মে শরতের সাদা মেঘের ভেলা উড়িয়ে হেমন্ত নিয়ে আসে হিম হিম মৃদু কুয়াশার স্তর। চারিদিকে নতুন ধানের মিষ্টি গন্ধ। শীতের আগমনী বার্তা। কৃষিনির্ভর আমাদের জনজীবনে হেমন্ত আনন্দ-বেদনার কাব্যের মতো। শুরুতে অভাব-অনটন, শেষটায় সমৃদ্ধির সোনালি উদ্ভাস। আবহমানকাল থেকেই হেমন্ত মানেই কৃষকের মুখে অনাবিল হাসি। ধান কাটা-মাড়াই নিয়ে পরিতৃপ্তির ব্যস্ততা। চলতে থাকে নবান্নের পিঠা-পায়েসের আয়োজন।
এসব আপামর খেটে খাওয়া মানুষের সংস্কৃতি। আর সে সংস্কৃতি ও আবেগকে কাব্যিক স্বীকৃতি দিয়েছেন জীবনানন্দ দাশ। তিনি ষোলোআনা হেমন্তপ্রেমী কবি। তাঁর কবিতায় হেমন্ত, প্রকৃতি আর আত্মমগ্ন একে অন্যের পরিপূরক হয়ে উঠেছে। জীবনানন্দের কবিতায় হেমন্ত প্রসঙ্গে মূল্যায়ন করতে গিয়ে কবি নরেশ গুহ লিখেছেন, ‘জীবনানন্দের কবিতা পড়তে পড়তে অজান্তে কখন আমরা সেই রূপসী হেমন্তের প্রেমে পড়ে যাই। ভেবে অবাক লাগে, কৃষির সোনার কৌটোতে আমাদের প্রাণের ভ্রমরটি যদিও ভরে রাখা আছে তাহলেও ফলন্ত ধানের ঋতু হেমন্তের গাথা বাংলা কবিতায় একরকম ব্যতিক্রম বললেই চলে। শুধু কি দৃশ্যের? গন্ধের, শস্যের, আলস্য-পূর্ণতা-বিষাদের করুণতামাখা লাবণ্যময়ী ঋতু হেমন্ত।... হেমন্তের গভীর গম্ভীর রূপ কীটস-এরও প্রাণ ভুলিয়েছিলো। শেষ পর্বে জীবনানন্দের কাব্যে যখন জন্মান্তর ঘটছে, হেমন্ত তখনো তাঁর উপকরণ হয়ে ছিল, তার ব্যবহার যদিও তখন ভিন্ন। হেমন্ত প্রথমত শস্যের, তৃপ্তির, বিরতির ঋতু।’
শস্যভরা ঋতুকে সবচেয়ে বেশি মহিমান্বিত করেছেন জীবনানন্দ দাশ। কবি হেমন্তকে দেখেছেন প্রেমে-কামে, দেহে-দেহহীনতায়, সৃষ্টিতে, তৃপ্তিতে, বিরহে, বিরতিতে। ‘পিপাসার গান’ কবিতায় লিখেছেন, ‘এদেহ অলস মেয়ে/পুরুষের সোহাগে অবশ/চুমে লয় রৌদ্রের রস/হেমন্ত বৈকালে/উড়ো পাখপাখালির পালে/উঠানের পেতে থাকে কান, শোনে ঝরা শিশিরের ঘ্রাণ/অঘ্রাণের মাঝরাতে।’
কাব্যিক দৃষ্টিভঙ্গিতে হেমন্ত এক অপরূপা সুন্দরী। ঋতুকন্যা হৈমন্তীর প্রেমে হাবুডুবু খায় পুরো প্রকৃতি। কবির চোখে হেমন্ত কী অসাধারণ, ‘প্রথম ফসল গেছে ঘরে/হেমন্তের মাঠে মাঠে ঝরে শুধু শিশিরের জল;/অঘ্রানের নদীটির শ্বাসে/হিম হয়ে আসে/বাঁশপাতা-মরা ঘাস-আকাশের তারা!/বরফের মতো চাঁদ ঢালিছে ফোয়ারা!/ধানক্ষেতে-মাঠে/জমিছে ধোঁয়াটে/ধারালো কুয়াশা!’
হেমন্তের গভীর গম্ভীর রূপ কবির প্রাণ ভরিয়েছিল। শিশির-কুয়াশা মিশ্রিত হেমন্ত ঋতু তাকে আকৃষ্ট করত। এই ক্ষণস্থায়ী ঋতুকে জীবনানন্দ নতুন করে অবলোকন করেছিলেন। কবি হৃদয়ের গোপন ভালোবাসার আর্তি এই হেমন্ত ঋতু। তাই কেবল জীবনানন্দের কাব্যেই হেমন্ত পেয়েছে শীর্ষস্থান। তার প্রতিটি কবিতায় রূপায়িত হয়েছে হেমন্তের অপরূপ বৈশিষ্ট্য– শিশিরের শব্দ, ধূসর কুয়াশা, মেটে জোছনা, মাঠ পাড়ের গল্প। তাইতো কবির ভাষায়, ‘অঘ্রাণ এসেছে আজ পৃথিবীর বনে/সে সবের ঢের আগে আমাদের দুজনের মনে/হেমন্ত এসেছে তবু।’ হেমন্ত বিষণ্ণতার ঋতু তারপরও হেমন্ত ধরিত্রীর অন্তরঙ্গ সহচরী। হেমন্ত ভরে তোলে গৃহভাণ্ডার।
কবির চোখে হেমন্ত শষ্যের ঋতু, তৃপ্তির ঋতু। ‘হেমন্তের ধান ওঠে ফলে/ দুই পা ছড়ায়ে বোসো এইখানে পৃথিবীর কোলে।’ জীবনানন্দ ছাড়া আর কে উচ্চারণ করতে পারেন এমন কথা? ‘যখন ঝরিয়া-যাবো হেমন্তের ঝড়ে/ পথের পাতার মতো তুমিও তখন/ আমার বুকের’ পরে শুয়ে রবে?’
বাংলা কবিতার বিপুল ভাণ্ডার থেকে তুলে আনা পঙ্ক্তিমালা পর্যালোচনা করলেই দেখা যাবে, হেমন্তকে কবিতার ঋতু করে তুলেছেন একান্তভাবে জীবনানন্দ। তাঁর কবিতায় ‘ধান কাটা’, ‘নবান্ন’, ‘ইঁদুর’, ‘শালিক’, ‘লক্ষীপেঁচা’, ‘নির্জন স্বাক্ষর’, ‘কার্তিকের নীল কুয়াশায়’ প্রভৃতি শব্দ ও শব্দবন্ধ হেমন্তের চিত্র এমনভাবে তুলে ধরে যে, জীবনানন্দ পাঠ করলে পুরো হেমন্তের চিত্রই ফুটে ওঠে।
হেমন্ত এলে বাংলার ঘরে ঘরে আশ্বিনের ভাত কার্তিকে খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। আশ্বিনের শেষদিন রান্না করা ভাত রাতে পানি দিয়ে ভিজিয়ে রাখা হয় কার্তিকের প্রথম দিন খাওয়ার জন্য। এটা গ্রামবাংলার এক ধরনের সংস্কৃতি। একটি প্রবাদ আছে, ‘আশ্বিনের ভাত কার্তিকে খায়, যেই বর মাঙ্গে সেই বর পায়।’ এই চিরাচরিত নিয়মের মধ্যদিয়ে স্বাগত জানানো হয় হেমন্তকে। কবি স্বাগত জানান তাঁর কাব্যসম্ভার সহযোগে।
শরতের মন্দমধুর হাওয়া, কাশের গুচ্ছ, সাদা জোছনার পালে ভাসতে ভাসতে আসে হেমন্ত। তবে অনেকেই হেমন্তকে রিক্ততার ঋতু বলে থাকেন। কার্তিক-অগ্রহায়ণ দুই মাস ঋতুকন্যার দুঃখঝরা দিন। কারণ হেমন্তের শুরু কার্তিক মাস ফসল তোলার পূর্ব মাস। যার কারণে কৃষকের ঘরে খানিকটা অভাব থাকে বৈকি? আর তাই এই কার্তিককে ‘মঙ্গার মাস’ বলেও অনেকে আখ্যায়িত করেন। কিন্তু কার্তিকের শেষক্ষণে হরিৎ শস্যক্ষেত্র ধীরে ধীরে হরিদ্রাবর্ণ ধারণ করে। চাষির চোখের স্বপ্ন একেকটি ধানের গোছা পাকা ধানের ভারে যেন নুয়ে পড়ে। তখন প্রকৃতির শোভা অপরূপ সুন্দর দেখায়।
কবি বলেছেন, ‘হেমন্ত ফুরায়ে গেছে পৃথিবীর ভাঁড়ারের থেকে:/কোথাও বা সৃষ্টির অন্ধকার রহস্যের সঙ্গে বিজড়িত করেছেন তাকে:/আজকে মানুষ আমি তবুও তো-সৃষ্টির হৃদয়ে/হৈমন্তিক স্পন্দনের পথের ফসল।’
অগ্রহায়ণের প্রথম দিন থেকে ধান কাটার মৌসুম শুরু হয়। গ্রামের ঘরে ঘরে ফসল তোলার আনন্দ। নতুন ধানের গন্ধে অন্যরকম আবহাওয়া বইতে থাকে। ধান ভানার গান ভেসে বেড়ায় বাতাসে, ঢেঁকির তালে মুখর হয় বাড়ির আঙিনা। নবান্ন আর পিঠেপুলির আনন্দে মাতোয়ারা হয় সবাই।
ঋতুকন্যা হেমন্তে গ্রীষ্ম ও শরতের প্রকৃতি ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়। কঠিন সূর্য বনভূমি ও জলাধারে তাপ বিকিরণ প্রত্যাহার করে নেয়। মধুর বাতাস ও সবুজ বনানী ক্রমেই ভিন্ন রূপ ধারণ করে। যৌবনের জলতরঙ্গ নৃত্যময় হয়ে ওঠে হেমন্ত সমীরণে। হেমন্ত আসে, মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়। প্রকৃতি ঝরাপাতার গান শোনাতে থাকে। ফসলের মৃত্যু ঘোষিত হলেও প্রকৃতির গালিচায় বাদামি, লাল, সোনালি পাতার রাশি। ঝরাপাতার শব্দ ও হেমন্তের রং প্রাণিত করে কবিদের।
শুষ্ক কঠিন প্রকৃতির পরিপূর্ণ রিক্ততা ও দিগন্তব্যাপী সুদূর বিষাদের প্রতিমূর্তি নিয়ে নিঃশব্দ চরণে হেমন্তের যেমন আগমন ঘটে তেমনি বাঙালির ঘরে ঘরে সোনার ফসল দান করে রিক্ততার মধ্য দিয়ে শিশিরের মত নিঃশব্দ চরণে বিদায়ও গ্রহণ করে এই ঋতু। জীবনানন্দের ভাষায়, ‘আমি সেই সুন্দরীরে দেখে লই-নুয়ে আছে নদীর এ পাড়ে/বিয়োবার দেরী নাই- রূপ ঝড়ে পড়ে তার/শীত এসে নষ্ট করে দিয়ে যাবে তারে।’ হেমন্তের পরিণতি শীতের আগমনী গান। কুয়াশার চাদরে ঢাকা বাংলার আরেক ঋতু শীতের দরজা খুলে দিয়ে আসে হেমন্তের বিদায়ের পালা। আর হেমন্তের দুঃখঝরা দিনে কেবলি মনে পড়ে জীবনানন্দকে।
এসইউ/এইচআর/এমএস