ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

পানি পাগলা

সাহিত্য ডেস্ক | প্রকাশিত: ০৩:৫৩ পিএম, ২৪ আগস্ট ২০২০

সালমা সিদ্দিকী

রমিজ তার তিন সহযোগীকে নিয়ে মাজারের চাতালে টাকার বাক্স আগলে বসে থাকতে থাকতে অধৈর্য হয়ে উঠেছে। বাকিরা যেমন তেমন, তার আর তর সইছে না।
-খোনকার সাবে ঘরের ভিত্রে করেডা কী? বাকসো খুইলা সবাইরে কামে আত লাগাইতে কয় না ক্যা এহনও?

প্রতি বৃহস্পতিবার রাতের সাপ্তাহিক জলসায় খোনকার সাব নিজে ঘুরে-ফিরে লোক সমাগম দেখে, পয়সা-কড়ি, মাল-সামানের আনাগোনায় নজর রাখে। জলসা শেষে বয়াতি, নর্তকী বিদায় দিয়েই চেয়ার টেনে বসে বাক্স খোলার হাঁকডাক শুরু করে দেয়। মাজারের পরিচ্ছন্নতা আর পানির বোতল ভরে দেওয়ার দায়িত্বে হিজড়া মিস তামান্না, সে আসর ভাঙার সাথে সাথে ভেতর বাড়িতে ঢুকে বিছানা বালিশ ঝাড়পোছ করে। খাবার সাজিয়ে ঘনঘন তালি বাজাতে থাকে আর বাচ্চু খোনকারের টাকা গোনার তাগাদাও বাড়তে থাকে। শেয়ালের মত ধূর্ততায় দ্রুততম সময়ের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা গুছিয়ে নেয় সে।

আজ নাচ-গান শেষে ভক্ত, দর্শক, পানিপ্রার্থী বিদায় নিয়েছে অনেকক্ষণ। প্রথম বাৎসরিক ওরস বলে লোক সমাগম ছিল প্রচুর। টাকা-পয়সা যে পরিমাণ উঠেছে; তাতে এখন থেকে হাত লাগালেও মাঝরাত পার হয়ে যাবে। আর ছাগল, মোরগ, ফল, তরকারি এসব তো আছেই। অথচ আজকেই কি না এমন ঝিমধরা অবস্থা! পরিস্থিতি এরকম হবে বুঝতে পারলে নর্তকী ছুকরিটাকে বায়নাই করতো না আজ। তখন থেকে আড়ালে দাঁড়িয়ে থেকে বিরক্ত হয়ে সে চলে যাওয়ার কথা বলছে। অথচ এখানে কাজ শুরুর কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। কখন যে বের হতে পারবে কে জানে? খামোখাই পয়সা দিতে হবে মনে হচ্ছে।
-কেইসডা কিছু বুজতাছোস তরা? হেই যে আসরের মাঝখান থিকা উইঠা পানি খাওয়ার কতা কইয়্যা খোনকার সাব ঘরে ঢুকছে, এহন তরি বাইর অওয়ার নাম গোন্দ নাই! দূরো হালায়, বড়লোক মাইনষের ভাউ বুঝনই ঠ্যালা!

বিরক্ত রমিজ বাকিদের বাক্স পাহারায় রেখে মাজারের সামনে থেকে উঠে ভেতর বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। তখনই দেখে ওসি গাফফার হোসেন হন্তদন্ত হয়ে ওদের দিকে আসছে, তার পেছনে মিস তামান্না।
-খোনকার সাবের শহরের বাসার ঠিকানা তোমাদের মধ্যে কে জানো? অথবা ফোন নম্বর? স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে, দারোয়ান যে কারো নম্বর হলেই হবে।

মানিকগঞ্জ শহরের গঙ্গাধরপট্টিতে খোনকার সাবের তিনতলা বাড়ি ওরা সবাই চেনে। গ্রাম থেকে এটা-সেটা দরকারি জিনিস পৌঁছে দিতে নিয়মিতই সেখানে যেতে হয়। ওনার স্ত্রীর ফোন নম্বরও জানা আছে কিন্তু এসময়ে ওসি সাহেবের এমন প্রশ্নে ওরা চারজন নির্বাক মুখে চাওয়া-চাওয়ি করে।

সিংজুরী বাজারের একটু সামনে ‘পানি পাগলার মাজার’ লেখা সাইনবোর্ড ধরে দুইশ গজ এগিয়ে গেলেই বাচ্চু খোনকারের বাড়ি। চারদিকে উঁচু দেয়াল, সুদৃশ্য গেট আর পুরোনো গাছপালায় ছাওয়া সদর-অন্দর মিলিয়ে বড়সড় বাড়িটা অনেক দূর থেকেই তার স্বাতন্ত্র্যের কারণে নজর কাড়ে। আড়ালে-আবডালে মানুষ এতদিন জলিল রাজাকারের বাড়ি বলে ডাকলেও সম্প্রতি পানি পাগলার মাজার বাড়ি হিসাবেই এর নাম ছড়িয়েছে। মরহুম রাজাকার জলিল খোনকারের ছেলে বাচ্চু খোনকার। ষাট ছুঁইছুঁই, ডাকসাইটে লোক। সে চাইলেই মেম্বার, চেয়ারম্যান হতে পারে। কিন্তু না, এসবে তার আগ্রহ নেই। তার ভাষায়,
-বাচ্চু খোনকার চিয়ারমেন অয় না, চিয়ারমেন বানায়।

এ কথার সত্যতাও আছে। যে, যে দলের বা মতেরই হোক না কেন, নির্বাচনের আগে সবাই এসে তার শুভ কামনা প্রত্যাশা করে। সমর্থন পাওয়ার আবদার জানায়। অতীতে দেখা গেছে তার সুনজর পাওয়া প্রার্থীরাই জয়লাভ করে। ফলে এটা এখন রেওয়াজের মতো দাঁড়িয়ে গেছে। এলাকায় কোন গণ্ডগোল, খুনখারাবি হলে অপরাধী ও বিচারপ্রার্থী উভয়েই থানা পুলিশ করার আগে তার কাছে ছুটে যায়। সে যার পক্ষে অবস্থান নেয়, আইন আদালতেও সেইমতে রায় আসে। সদরের উকিল, পুলিশ, হাসপাতাল থেকে গ্রামের বাজার, চায়ের দোকান সর্বত্রই তার একটা বিশেষ পরিচিতি আছে। পছন্দ না করলেও সবাই তার কূটবুদ্ধিকে সমীহ করে চলে। কখন কাকে কোন বিপদে ফেলে দেয় এ কারণে সহজে কেউ তাকে ঘাঁটাতেও যায় না।

নিজে গ্রামের বাড়িতে বসবাস করলেও তিন ছেলে-মেয়েসহ স্ত্রীকে রেখেছে মানিকগঞ্জ, জেলা সদরে। ছেলে-মেয়েদের উন্নত পরিবেশে রেখে ভালো পড়াশোনা, উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতেই এই ব্যবস্থা। গ্রামের রাস্তা-ঘাটও এখন পাকা হয়ে গেছে। মোটরসাইকেল চালানোর জন্য একজন ড্রাইভার আছে তার। যেকোনো দিন ইচ্ছা হলেই বাড়ির উঠান থেকে মোটরসাইকেল স্টার্ট দিয়ে ঘিওর কলেজের পাশের ব্রিজ পার হয়ে বানিয়াজুরীর ভেতরের শর্টকাট রাস্তায় ঘণ্টা দুই সময়ের মধ্যেই পৌঁছে যায় মানিকগঞ্জ গঙ্গাধরপট্টির বাড়িতে। বউ ছেলে-মেয়েদের সাথে দু’এক বেলা কিংবা এক-দুই রাত কাটিয়ে আবার ফিরে আসে সিংজুরী, তার নিজস্ব জগতে।

এখানে অবশ্য তার দেখাশোনারও কোন সমস্যা হয় না। দাওয়াত, মজলিশ, হোটেলের বাইরে যেটুকু যা খাওয়া-দাওয়া, তা বন্দোবস্ত করে মহম্মদ আলি। কল থেকে ওজু, গোসলের পানি তুলে দেওয়া, ঘরদোর পরিষ্কার, টুকটাক বাজার-সদাই সবই সে করে। বাহ্যত বাড়ির পাহারাদার হলেও বয়সে বাচ্চু খোনকারের বছর দশেকের ছোট, বোবা এই মহম্মদ আলিকে সবাই জলিল রাজাকারের জারজ সন্তান বলে কানাঘুষা করে। যুদ্ধের সময় পাশের গ্রাম বাংগালা থেকে ধরে আনা বিমল মিস্ত্রির বউয়ের পেটের ছেলেই নাকি এই মহম্মদ আলি। বউটাকে ধরে এনে পাক আর্মির হাতে তুলে না দিয়ে নিজেই আটকে রেখে ভোগ করেছে। যুদ্ধের পরও নাকি তাকে এই বাড়িতে দেখা গেছে। অবশ্য তার মৃত্যু সম্পর্কে কেউ কিছু বলতে পারে না। যাই হোক, সে আরেক গল্প। সেসব না হয় অন্য আরেকদিনের জন্য তোলা থাক। আমরা বাচ্চু খোনকারের কথায় ফিরে আসি।

এতখানি বয়স হলেও শারীরিক দিক দিয়ে যথেষ্ট শক্ত সামর্থ্যবান বাচ্চু খোনকারের মেয়ে মানুষের প্রতি লোভ নাই। হাজারটা দোষ বলা গেলেও স্ত্রী ভিন্ন দ্বিতীয় কোন নারীকে জড়িয়ে তাকে দুটো মন্দ কথা বলার সুযোগ কেউ পায়নি। তবে মাসে দুই-চার দিন বাজারের হিজড়ার দল এসে খানিকক্ষণ রং তামাশা করে যায়। ওরা এলে খোনকার সাব মহম্মদ আলিকে ঘরে ঢুকতে নিষেধ করে দেয়। মহম্মদ আলিও তার কাজে কর্মে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এতবড় বাড়িটা একা হাতে সামলাতে কত কী-ই না করতে হয়, হাসি-তামাশা দেখে নষ্ট করার মত বিশেষ সময়ও তার থাকে না। তাছাড়া বোবা বলে গ্রামের লোকজনের টিটকারি, বিদ্রুপে একধরনের হীন্মন্যতা থেকে একলা থাকাই অভ্যাসে পরিণত হয়েছে তার। কাজের বাইরে খুব একটা কোথাও যায়ও না। বিশাল বাড়িটাতে সে আছে কী নেই এটাই অনেক সময় ঠাওর করা যায় না।

গতবছর ঠিক আজকের দিনেই হিজড়ার দল এসে সারা দুপুর হৈ হল্লার পর খাওয়া-দাওয়া করে চলে যায়। অন্যান্য দিনের মত তারা চলে যাওয়ার পর সদর দরজায় তালা দিয়ে এসে নিজের নাওয়া-খাওয়া সেরে নেয় মহম্মদ আলি। তারপর আসর ওয়াক্তে কলপাড়ে ওজুর পানি তুলে খোনকার সাবকে ডাকতে বড় ঘরে ঢুকেই হতভম্ব হয়ে পড়ে।

হিজড়াদের দলনেত্রী মিস তামান্নার সাথে খোনকার সাবকে বিছানায় দেখে হাউমাউ করে তার ভাষায় চিৎকার জুড়ে দেয়। মিস তামান্না যে তখনও রয়ে গেছে, এটা সে না জেনেই ঘরে ঢুকেছিল। অপ্রস্তুত বাচ্চু খোনকার ইশারায় তাকে যতই থামতে বলে; সে ততই সর্বশক্তি দিয়ে চেঁচাতে থাকে। উপায়ান্তর না দেখে এক লাফে বিছানা থেকে নেমে মেঝেতে পরে থাকা লুঙ্গিটা কুড়িয়ে কোমরে গিট দিয়ে শক্ত করে পরে নেয় খোনকার সাব। তারপর তাকে টেনে হিচড়ে মাটিতে ফেলে পায়ের তলায় পারা দিয়ে ধরে। গলা বরাবর গোড়ালি আটকে অনবরত মাটির সাথে পিসতে থাকে। কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে খ্যাউ জালে ধরা ট্যাংরা পুঁটি মাছেরা যেমন ডাঙায় তোলার পর কিছুক্ষণ লাফালাফি করে নিস্তেজ হয়ে আসে, বাচ্চু খোনকারের পায়ের তলায় দুর্বল মহম্মদ আলিও তেমনি কতক্ষণ চার হাত পায়ে ছটফট করে অবশেষে নেতিয়ে যায়। মিস তামান্না পা চেপে ধরে রাখে। গোঙাতে গোঙাতে হয়রান হয়ে সে হাতজোর করে, পা দুটো জড়িয়ে ধরে ইশারায় পানি খেতে চায়। বাচ্চু খোনকার লুঙ্গি উঁচু করে তার মুখে পেশাব করে দেয়। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর লুঙ্গির গিট খুলে গলা পর্যন্ত তুলে গা-মাথার ঘাম মুছতে মুছতে সে বিছানায় গিয়ে পা তুলে বসে,
-দেখতে দুব্বল অইলে কী অইবো, হারামজাদার গায় জোর আছে। পাউ দুইডা এক্কেরে ঝিমঝিম করতাছে!

মিস তামান্না ফ্যান ছেড়ে দিয়ে কাছে এসে বসে তার পা টিপে দেয়। বাতাস আর টিপুনিতে শরীরে স্বস্তি ফিরে এলে হাত-মুখ ধুয়ে একগ্লাস পানি খেয়ে নিয়ে ঠান্ডা মাথায় ঘটনাটা ম্যানেজ করে সে। বাজার মসজিদের হুজুরকে ফোনে মহম্মদ আলির মৃত্যুর খবর জানিয়ে বাদ মগরিব জানাজা, দাফনের বন্দোবস্ত করতে বাড়িতে ডেকে পাঠায়। জানাজা শেষে দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত লোকটার আকস্মিক মৃত্যুতে দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে সে জানায় যে, বোবা বলে অসুখ-বিসুখের কথা বলতে পারতো না। তাই চিকিৎসা করানোরও সুযোগ পেল না। এই একটা দুঃখ থেকে গেল তার। উপস্থিত লোকজন এতে সায় দিয়ে রাত বাড়ার আগেই কবর খোড়ায় হাত লাগায়। বাবা জলিল খোনকারের কবরের পাশে নির্ঝঞ্ঝাটেই মহম্মদ আলিকে কবর দেওয়া হয়ে যায়। এই পাপপুরীতে আলো-অন্ধকারে ঘটে যাওয়া আরও অনেক পাপের মতো এই খুনও লোকচক্ষুর আড়ালে মাটি চাপা পড়ে যায়।

সেদিনের পর বাচ্চু খোনকার মিস তামান্নাকে এ বাড়ির বাইরে যেতে নিষেধ করে দেয়। অবশ্য তার দলের অন্যরা যথারীতি আসা-যাওয়া বহাল রাখে। ঘটনার মাসখানেক পরের এমনই একদিন, বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় হিজড়াদের মধ্যে একজন হঠাৎ দেখতে পায় যে, নতুন কবরটার ভেতর থেকে পানি বের হচ্ছে। কৌতূহলে সবাইকে নিয়ে এগিয়ে গিয়ে দেখে পানির কোনো উৎস নেই। অথচ পরিষ্কার সরু প্রবাহে পানি পড়ছে। ভয়ে, বিস্ময়ে তারা দ্রুত সেখান থেকে সরে যায়। তবে রাতের মধ্যেই সিংজুরী বাজারে খবর চাউর হয়ে যায়। পরদিন সকাল থেকে কৌতূহলী মানুষের ভিড়ে খোনকার বাড়ি লোকে লোকারণ্য। ভিড়ের মধ্যে কে যেন গলা উঁচিয়ে বলে,
-ইয়্যা কুনু সাদারণ ব্যাপার না। ইয়্যা ওইলো উপুরালার কুদরতি খেইল! কার ভিত্রে কী আচে কওন তো যায় না! বুবা মানুষডা কেরোর এলেম্যালে আচিলো না। হঠাস কইরা মইরা গ্যালো! ক্যারা কইব্যার পারে, এই পানি নিয়্যাত কইরে খাইলে
অসুক-বিসুকও বালো অইবো মুনে অয়!

সবাই যেন এরকম কিছু একটা শোনার অপেক্ষায়ই ছিল অথবা কথাগুলো যেন উপস্থিত সবারই মনের কথা! মুহূর্তের মধ্যে পানি খাওয়া, বহন করে নেওয়ার জন্য হুলস্থুল বেঁধে যায়। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে, দিন কয়েকের মধ্যেই মুখে মুখে চারদিকে খবর ছড়িয়ে পড়ে,
-খোনকার বাড়ির কবরের ভেতর থেকে কুদরতি পানির নহর বের হয়েছে। এই পানি প্রতিদিন আসর ওয়াক্ত থেকে মাগরিব পর্যন্ত থাকে। আর নিয়ত করে খেলে যেকোনো দুরারোগ্য ব্যাধি, জটিল সমস্যা সব নিরসন হয়ে যায়।

দূর-দূরান্ত থেকে আসা পানিপ্রার্থী মানুষের লাইন ক্রমশ লম্বা হতে থাকে। লোকজন বোতলে পানি ভরে নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি মানত করে টাকা-পয়সা, জিনিসপত্র রেখে যাওয়া শুরু করে। কবর ঘিরে ভিক্ষুক, দর্শনার্থীদের মেলা বসে যায়। লোকমুখে এ কবরের নাম হয়ে যায় ‘পানি পাগলার মাজার’। সামগ্রিক পরিস্থিতিতে শৃঙ্খলা আনার স্বার্থে গ্রামবাসী, পানিপ্রার্থীদের অনুরোধে স্বয়ং খোনকার সাবকে সেখানে হস্তক্ষেপ করতে হয়। সে নাম খোদাইসহ কবর বাঁধাই করে মাজারের জন্য চারজন খাদেম নিয়োগ দেয়। প্রতি বৃহস্পতিবার সাপ্তাহিক জলসার আয়োজন করে। জলসার রাতে মানতের টাকা-পয়সা যা আসে, তা ওই চার খাদেম একটা কাঠের বাক্সে জমা রাখে, সাথে অন্যান্য মাল-সামানও বুঝে নেয়। মিস তামান্নার উপর দায়িত্ব পরে পানিপ্রার্থীদের বয়ে আনা বোতল ভরে তাদের হাতে দিয়ে দেওয়া। এতে হুড়োহুড়ি, ধাক্কাধাক্কি বন্ধের পাশাপাশি উৎসুক মানুষের কবরের খুব বেশি কাছে ঘেঁষাও আটকানো যায়। স্থানীয় পত্রিকার সাংবাদিক, উঠতি নেতা, উকিল, পুলিশ এইসব ব্যক্তিদের মাঝেমধ্যে জলসার রাতে আমন্ত্রণ করে তার পেরেশানি স্বচক্ষে দেখিয়ে দেয় বাচ্চু খোনকার। অবশ্য যাওয়ার সময় অবস্থা বুঝে কাউকে পকেটে কিছু গুঁজে দিয়ে আবার কাউকে মানতের মাল-সামানের কোন একটা হাতে ধরিয়ে খুশি করে দেয় সে। নিজের কাজকর্ম জায়েজ করতে থানার বড়কর্তা থেকে সদরের রাজনীতির উপর মহলসহ সবখানে নিয়মিত খাম পাঠানোর পাশাপাশি এটাও তার একটা কৌশল।

যাই হোক, ছক মতই সব চলছিল। কিন্তু পাশার দান উল্টে যায় এক বছর পর, আজ সন্ধ্যায়। মহম্মদ আলির মৃত্যুর এক বছর অর্থাৎ পানি পাগলার মাজারের প্রথম বাৎসরিক ওরস বলে সকাল থেকেই মানুষের ঢল নামে। দুপুরের পর থেকে চলছিল বয়াতিদের পালাগান। সন্ধ্যায় মিস তামান্নার দলের হিজড়াদের পরিবেশনা আর সবশেষে যাত্রাপালার ছুকরি নর্তকীর বিশেষ ‘ড্যান্স’। মুখে নিরাপত্তার উছিলা দিলেও আসলে যে মোটা আমদানীর গন্ধে ওসি গাফফার হোসেন সন্ধ্যার আগেই হাজির হয়েছে। এ নিয়ে রমিজরা একচোট হাসি টিটকারি সেরে নেয়। জলসা খুব জমে উঠেছে। শরিয়ত-মারেফত পালায় দুই বয়াতির কেউ কাউকে ছাড়ছে না। দোহারদের দুয়োর সাথে সাথে দর্শকরাও তাল দিয়ে, তালি দিয়ে দারুণ সঙ্গত করছে। এরমধ্যে খোনকার সাব হঠাৎ ‘একটু পানি খাইয়্যা আসি’ বলে সবার মাঝখান থেকে উঠে যায়। যেই যায় আর সেই যায়! মাজার প্রাঙ্গণের অনুষ্ঠানাদি শেষ করে বিদায় নেওয়ার সময় কেউ কেউ তাকে তালাশ করে, বলে কয়ে যেতে চায় কিন্তু তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। এভাবে একে একে সবাই চলে গেলে ওসি সাহেব বিরক্ত মুখে উঠে ভেতর বাড়িতে ঢুকে ডাকাডাকি করলেও কোন সাড়া মেলে না।
-আরেহ, লোকটা শূন্যে মিলিয়ে গেল না কি!

এমন সময় মিস তামান্নার গলার আওয়াজ ধরে এগিয়ে গিয়ে দেখে পরিত্যাক্ত, ভাঙাচোরা যে ঘরটাতে মহম্মদ আলি থাকতো; সেখানে খোনকার সাবের সাথে মিস তামান্নার ধস্তাধস্তি চলছে। মিস তামান্না যতই বলছে,
-ছাইড়া দেন, পানি আইনা দিতাছি।
সে ততই শক্ত করে চেপে ধরছে। বলছে,
-পানিতে মুতের গোন্দ ক্যা?
টেনেটুনে উভয়কে বিচ্ছিন্ন করে দূরে সরানোর পর আবার সে মিস তামান্নার দিকে তেড়ে আসে,
-ওই নটি, পানিতে মুতের গোন্দ ক্যা?

ওসি সাহেবের ফোন পেয়ে ভোর ভোর বাচ্চু খোনকারের স্ত্রী, সন্তানরা গ্রামের বাড়িতে পৌঁছায়। তারা এসে দেখে খোনকার সাবকে বারান্দার খুঁটির সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। তার কূটবুদ্ধি ভরা চোখ দুটো ঘোলাটে, শূন্য। সারারাত অনবরত একই কথা বলার ফলে গলাটা ফ্যাঁসফ্যাঁস করছে, মুখে ফেনা উঠে গেছে। তবুও বলে চলেছে,
-পানি খামু, পানি দে। মুতের গোন্দ ছাড়া পানি দে।

এসইউ/এএ/এমএস

আরও পড়ুন