সাদাত হোসাইনের ছদ্মবেশ : মুখোশের আড়ালে মানুষ
অমর একুশে বইমেলায় লাইন দিয়ে বই কেনার প্রবণতা শুরু হয়েছিল হুমায়ূন আহমেদের হাত ধরে। জনপ্রিয়তার উচ্চতম শিখরে পৌঁছে গিয়েছিলেন তিনি। তার মৃত্যুর পরও সে ধারা অব্যাহত রয়েছে। এবার সে ধারায় যুক্ত হয়েছে আরও একটি নাম। তিনি তরুণ লেখক ও নির্মাতা সাদাত হোসাইন। তার প্রথম কয়েকটি বই আলোচনায় না এলেও ২০১৫ সালে আলোচনায় আসে তার উপন্যাস ‘আরশিনগর’। এই উপন্যাসের মাধ্যমে তিনি পাঠকের কাছে পৌঁছে যান। সে ধারাবাহিকতা অব্যাহত আছে এখনও। তার ‘অন্দরমহল’, ‘মানব জনম’, ‘নিঃসঙ্গ নক্ষত্র’, ‘নির্বাসন’, ‘মেঘেদের দিন’, ‘মরণোত্তম’ ও ‘অর্ধবৃত্ত’ এখনো বিক্রির শীর্ষে রয়েছে। তার একটি ব্যতিক্রমী উপন্যাস ‘ছদ্মবেশ’ও বিক্রির তালিকায় শীর্ষে রয়েছে।
একটি দৈনিকের আলোকচিত্রী হিসেবে একটি ফটোগ্রাফির বই ‘গল্পছবি’ দিয়ে সাদাত হোসাইনের যাত্রা শুরু। এরপর লিখেছেন গল্পের বই ‘জানালার ওপাশে’। ক্ষুদ্র কলেবরের উপন্যাস ‘আমার আর কোথাও যাওয়ার নেই’ ও কবিতার বই ‘যেতে চাইলে যেও’ প্রকাশ করার পর বৃহৎ কলেবরের কথা চিন্তা করেন তিনি। সেই চিন্তার ফল তার প্রথম বৃহৎ উপন্যাস ‘আরশিনগর’। সেই আরশিনগরই তাকে সব শ্রেণির পাঠকের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। পরবর্তী বইগুলোও বৃহৎ কলেবরের। মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে কিনে নেয় পাঠক। এর মাঝে আসে কবিতার আরেকটি বই ‘কাজল চোখের মেয়ে’। সবশেষে আসে তার রহস্যোপন্যাস ‘ছদ্মবেশ’। গ্রাম, ইতিহাস কিংবা শহরের যাপিত জীবন নিয়ে উপন্যাস লিখলেও এই প্রথম রহস্যোপন্যাসে হাত দেন সাদাত হোসাইন। এখানেও তার ব্যাপক সফলতা লক্ষ্য করা যায়।
এ জন্য কেউ কেউ তাকে বলছেন ‘ভারস্যাটাইল জিনিয়াস’। বাংলায় যাকে বলে অসামান্য মেধাবী। এই তকমা তিনি অবশ্য এমনিতেই পাননি। মাত্র কয়েক বছরে গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে আরশিনগর ও মানব জনম লিখেছেন। ইতিহাসের আশ্রয়ে লিখেছেন অন্দর মহল। শহরের রুক্ষ্ম কঠিন পরিবেশের সঙ্গে লড়াই করা এক নারীকে নিয়ে লিখেছেন নিঃসঙ্গ নক্ষত্র। এরপর আবার রহস্যঘেরা উপন্যাস ছদ্মবেশ। ফলে অসামান্য মেধাবী তাকে বলাই যায়। কেননা ইতোমধ্যে তিনি তরুণ কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। ফলে পাঠকই তার ‘ছদ্মবেশ’ উপন্যাস পড়ে ‘ভারস্যাটাইল জিনিয়াস’ উপাধি দিয়ে দিয়েছেন।
এতো গেল সাদাত হোসাইন প্রসঙ্গ। এবার আসি রহস্যোপন্যাস প্রসঙ্গে। রহস্যোপন্যাস হচ্ছে—বাংলা সাহিত্যে গোয়েন্দা চরিত্র বা ডিটেকটিভ বলতে সেসব কল্পচরিত্র বোঝায়, যারা রহস্যোপন্যাসে কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে রহস্য উন্মোচন করেন। তারা মূলত সৌখিন গোয়েন্দা, পুলিশ কর্মকর্তা বা গুপ্তচর। রহস্যোপন্যাসের আখ্যানভাগ অতি জটিল ও সর্পিল গতিসম্পন্ন। ঘটনার অভাবনীয় বিন্যাস ও লোমহর্ষক অদ্ভুত কাহিনি সৃষ্টিতে এ শ্রেণির উপন্যাসের কৃতিত্ব। এদের মধ্যে জীবনের কোন গভীর তত্ত্ব বা তথ্যালোচনা থাকে না। জীবনের নারকীয় দিকটিই এতে উদ্ভাসিত হয়।
এ পর্যন্ত সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাকাবাবু, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যোমকেশ বক্সী, সুচিত্রা ভট্টাচার্যের মিতিন মাসি, সমরেশ মজুমদারের অর্জুন, রকিব হাসানের তিন গোয়েন্দা, হুমায়ূন আহমেদের মিসির আলি, মুহম্মদ জাফর ইকবালের টুনটুনি ও ছোটাচ্চু, কাজী আনোয়ার হোসেনের মাসুদ রানা, নীহাররঞ্জন গুপ্তের কিরীটী রায়, সুজন দাশগুপ্তের একেনবাবু ও শেখ আবদুল হাকিমের জাকি আজাদ পাঠকের মন জয় করতে পেরেছে। সে যাত্রায় নতুন করে যুক্ত হয়েছে সাদাত হোসাইনের এসআই রেজা।
‘ছদ্মবেশ’ সাদাত হোসাইনের প্রথম রহস্যোপন্যাস। রহস্যময়তা মানুষের স্বভাবজাত প্রবৃত্তি। সৃষ্টিজগতে রহস্যের অন্ত নেই। রহস্য মানে এক অজানা আকর্ষণ। আকর্ষণ ধরে রাখতে রহস্যের মায়াজালে মানুষকে আটকে রাখতে পছন্দ করে। আমরা কখনো কখনো ভাবি এক, হয় তার উল্টো। খোলা চোখে যা দেখি, অন্তর্চোখে তা দেখি ভিন্ন। মাঝে মাঝে মানুষ স্বার্থেও কারণে কিংবা হিংস্রতার বশবর্তী হয়ে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে মারাত্মক অপরাধ করে ফেলে, মানুষ খুন করে। সাদাত হোসাইনের ছদ্মবেশও একটি খুনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে এগিয়ে যায়। এখানে অপরাধীরা নিজেদের আড়াল করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে আর পুলিশের এসআই রেজাউল হক (এসআই রেজা) খুনের ঘটনায় আসল অপরাধীকে খুঁজে বের করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। কাহিনির কেন্দ্রীয় চরিত্র বলতে আমরা এসআই রেজা এবং কলেজ শিক্ষক লতিফুর রহমানকে ধরে নিতে পারি।
এ মুহূর্তে নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের ‘বৃহন্নলা’ উপন্যাসের কথা মনে পড়ে গেল। এটি মিসির আলি সিরিজের একটি উপন্যাস। মিসির আলি লেখকের কাছে শোনা অতিপ্রাকৃত এক ঘটনার রহস্য উন্মোচনের চেষ্টা করেন। একটি বিয়ে উপলক্ষ্যে লেখক গ্রামের শেষ প্রান্তের সুধাকান্তবাবুর বাড়িতে রাত্রিযাপন করতে যান। সাধু সন্ন্যাসীর মতো দেখতে সুধাকান্তবাবু লেখককে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে ভূতের গল্প শোনান। গল্পটি এমন—সুধাকান্তবাবুর সাথে অনেক আগে এক মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে মেয়েটি সাপের কামড়ে মারা যায়। ফলে সুধাকান্তবাবুর মধ্যে এক তীব্র বৈরাগ্যের জন্ম নেয়। তিনি সারাজীবন বিবাহ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখেন। কিন্তু হঠাৎ বাড়ির সামনের ঝোপে এক গভীর রাতে তিনি এক কিশোরীর লাশ আবিষ্কার করেন। তার মনে হয় কিশোরীর মুখটা তার সাথে যার বিবাহ হওয়ার কথা ছিল, ঠিক তার মুখের মতো। তিনি ভাবেন লাশটা ঝোপে ফেলে রাখলে শিয়াল-কুকুরে দাঁত বসাতে পারে। তাই তিনি লাশটি তার ঘরে নিয়ে আসেন। আর এরপর থেকেই প্রতি রাতে তার সাথে ঘটতে থাকে অতিপ্রাকৃত কিছু ঘটনা। যেমন বাসার চারপাশে মাঝরাতে কারো হাঁটার শব্দ পাওয়া যায়। বাইরে কোথাও বাতাস না থাকলেও তার বাড়ির চালে যেন ঝড় শুরু হয়। লেখক নিজেও ওই বাড়িতে রাতে থাকা অবস্থায় এমন অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। কিন্তু কাহিনির রহস্য অন্য জায়গায়। আসলে ওই কিশোরীকে সন্ন্যাসী সুধাকান্তবাবুই হত্যা করেছিলেন। মিসির আলি সে রহস্য উদঘাটন করেন।
ছদ্মবেশ প্রসঙ্গে বৃহন্নলার গল্প এ জন্যই বলা, সুধাকান্তবাবুর মতোই লতিফুর রহমান দেখতে ধোয়া তুলসির পাতা। গল্পের শেষে অবশ্য তার সে মুখোশ উন্মোচিত হয়ে যায়। কাহিনি শেষ না হওয়া পর্যন্ত কেউ কলেজের অধ্যাপক লতিফুর রহমানকে সন্দেহই করতে পারবেন না। তার নবনির্মিত ঘর থেকে লাশ সরিয়ে ফেলা, স্ত্রীকে ওষুধ দিয়ে দিয়ে পাগল সাজিয়ে রাখা, ছেলের সঙ্গে দুরত্ব তৈরি হওয়ার পেছনে অনেক বেরিয়ে আসে। তবে বৃহন্নলা অতিপ্রাকৃত ধাচের আর ছদ্মবেশ সমসাময়িক ঘটনার আবর্তে এগিয়ে যায়।
ছদ্মবেশের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে—সমকালীন বাংলাদেশে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে হত্যা, রাজনৈতিক কূটচাল, ব্যাংক ডাকাতি বা মাফিয়াদের কঠিন নেটওয়ার্ক চোখে পড়ে। যা বাস্তব ঘটনার বাইরে নয়। ছদ্মবেশ কোন মনগড়া গল্প নয়। ছেলে ভোলানো কল্পকাহিনি নয়। বাস্তবতার নিরীখে আঁকা একটি জটিল সমাজচিত্র। রহস্য উন্মোচনে এসআই রেজাকে ব্যবহার করাও যুক্তিসঙ্গত। বাংলাদেশে ব্যক্তিগত গোয়েন্দা নেই বললেই চলে। সে ক্ষেত্রে পুলিশের উপ-পরিদর্শক রেজাকে এগিয়ে আসতে হয়েছে। আমাদের গল্প-উপন্যাসে পুলিশ বাহিনিকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হলেও ছদ্মবেশে তা পুরোপুরি করা হয়নি। এসআই রেজা একদিকে যেমন রহস্য উদঘাটনে ব্যস্ত থাকেন, অপরদিকে রাজনৈতিক দলগুলোকেও সহজভাবে সামলে চলেন। ঘুষ বা চাঁদার নাম করে টাকা তুলে পাঠিয়ে দেন গ্রামে। সেখানে একটি স্কুল পরিচালিত হয়। সেখানে এক ঝলক রেজার প্রেমিকার সঙ্গে পরিচয় হয় পাঠকের। জনবহুল এ উপন্যাসটি ধারাবাহিক প্রকাশিত হওয়ার দাবিও রাখে। হয়তো ভবিষ্যতে এসআই রেজাকে অন্য কোন মামলা বা খুনের রহস্য উদঘাটনে দেখা যাবে। এমন একটি আশ্বাস আমরা পাই।
উপন্যাসে প্রত্যেকটি চরিত্র নিজ স্বার্থ হাসিলের জন্য মুখোশ পরে আছে। চেনা মানুষও মুহূর্তেই অচেনা হয়ে যায়। হয়ে ওঠে হিংস্র হায়েনার মতো। ভালো মানুষ সেজে থাকা লোভাতুর কিছু চরিত্র, এমন কোনো কাজ নেই, যা করতে পারে না। এখানে এসআই রেজা ও লতিফুর রহমান ছাড়াও চুন্নু মিয়া আর গোলাম মাওলার মতো মানুষের দেখা মেলে। যারা গতানুগতিক রাজনীতির ধারক ও বাহক। দেখা মেলে সন্তানবিচ্ছিন্ন পাগলপ্রায় জননী নাসিমা বেগমের। যিনি এতটা বছর সংসার করেও লতিফুর রহমানের ছদ্মবেশ চিনতে পারেননি। এছাড়া গৃহকর্মী, মুচি ও চায়ের দোকানদারের ছদ্মবেশে মাফিয়া চক্রের সদস্যদের চোখে পড়ে। পুরো কাহিনিটি সাদাত হোসাইন সুনিপুণভাবে সাজিয়েছেন। গল্পের কোথাও কোন গ্যাপ নেই। নেই অসঙ্গতিও। নিটোল পরিষ্কার বর্ণনা পাঠককে টেনে নিয়ে যায় মন্ত্রমুগ্ধের মতো। শেষে লতিফুর রহমানের মতো একজন সম্মানিত ব্যক্তিকে আর শ্রদ্ধা করা যায় না। রহস্যোপন্যাস হিসেবে ছদ্মবেশের সার্থকতা এখানেই। সাদাত হোসাইনের গল্পে প্রেম-ভালোবাসা অনিবার্য। এখানেও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে অপরাপর উপন্যাসের মতো ভালোবাসাই উপজীব্য নয়। এখানে খুন, সংঘাত, জিঘাংসার মধ্যেও অনুর জন্য আনুর (এসআই রেজার পারিবারিক নাম) ভালোবাসা যেন বাড়তি পাওনা।
উপন্যাসের শুরুটা এভাবে—‘বাড়ির নাম ‘অপেক্ষা’। অপেক্ষার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন অধ্যাপক লতিফুর রহমান। তিনি এই বাড়ির মালিক। তার চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। চশমা ছাড়া তিনি খুব একটা ভালো দেখতে পান না, তারপরও চশমার ফাঁক দিয়েই তিনি তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে শেষ মুহূর্তে বাড়ির নামটা আরেকবার দেখে নিলেন। তারপর সন্তুষ্ট গলায় বললেন, ‘এবার ঠিক আছে’।’ এভাবেই এগোতে থাকে কাহিনি। অপেক্ষা নামের এই বাড়ি ঘিরেই রহস্যের দানা বাঁধতে থাকে। শুরুর দিকে লতিফুর রহমানকে খুব স্বাভাবিক মনে হলেও আস্তে আস্তে সে ধারণা পাল্টাতে থাকে।
কাহিনিটি আমাদের চিরচেনা হলেও সাদাত হোসাইনের বিবরণ, শব্দচয়ন, পরিণতি, বিন্যাস ও রহস্য উপস্থাপন নিঃসন্দেহে প্রশংসা পেতে পারে। উপন্যাসে রহস্যের শুরুটা দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন—‘লতিফুর রহমান ঘরের তালা খুলতে গিয়ে সমস্যায় পড়লেন। নতুন তালা লাগিয়েছিলেন প্রতিটি দরজায়। সেই তালা প্রায় আট-দশ দিন খোলা হয়নি বলে শক্ত হয়ে আটকে আছে। অনেক কসরত করে খুলতে হলো তালাগুলো। কিন্তু ঘরে ঢোকার সাথে সাথেই বিকট দুর্গন্ধে লতিফুর রহমানের পেট গুলিয়ে উঠলো। পাকস্থলী যেন উল্টে বের হয়ে আসতে চাইছে।’ এরপর কাহিনি এগোচ্ছে রহস্যের গন্ধ নিয়েই। সঙ্গে একরাশ আতঙ্ক। দেখা যায়—‘তিনি তীব্র আতঙ্ক নিয়ে আরো একবার চোখ মেলে তাকালেন। বাথরুমের মেঝেতে কাঁত হয়ে পড়ে আছে একটা লাশ। লাশটার গলা থেকে মাথাটা প্রায় ছুটে এসে বিভৎসভাবে ঝুলে আছে বুকের ওপর। পচে যাওয়া লাশটার শরীর বেয়ে ভনভন করে উড়ছে মাছি।’
এমন ঘটনা হয়তো নতুন নয়, তবে লতিফুর রহমানের বাসায় লাশ খুঁজে পাওয়া সত্যিই রহস্যজনক। তালাবদ্ধ ঘরে লাশ আসার কারণ তিনিও জানেন না। এমনকি রাতের অন্ধকারে সে লাশ সরানোর বিষয়ে অধ্যাপকের ব্যস্ততাও পাঠকে ভাবিয়ে তুলবে। তবে অধ্যাপকের বাসার সামনে থেকে টু-লেট লেখা প্লেটটি সরানো দেখে হঠাৎ সন্দেহ জাগে রেজার। তার প্রশ্ন এই বাড়ি পুরো তৈরি করার ক্ষমতাও যেখানে অধ্যাপকের নেই; সেখানে নতুন ভাড়াটিয়া আনা বন্ধ করার কারণ কি? এভাবেই সাদাত হোসাইন তার গল্পচাতুর্যে পাঠককে শেষ অবধি নিতে পেরেছেন। রহস্যের শেষ না দেখে হয়তো কোন পাঠকই উঠতে পারবেন না। যেমনটি ঘটেছে আমার বেলায়ও।
একটি উপজেলা শহরের প্রেক্ষাপটে লেখা হয়েছে উপন্যাসটি। উপন্যাসে পুলিশ, স্থানীয় নেতা, মুচি, চা দোকানি, ব্যাংক কর্মকর্তা, গৃহকর্মীসহ নানাবিধ চরিত্রের সন্নিবেশ ঘটেছে। কোন কোন চরিত্র ঘটনার পরম্পরায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। আবার কোন কোন চরিত্র ঘটনার সাথে সাথে নিষ্প্রভ হয়ে গেছে। একটি লাশকে কেন্দ্র করে ঘটনা এগিয়ে গেলেও ব্যাংক ডাকাতির পরিকল্পনা উঠে আসে প্রসঙ্গক্রমে। ভিনগাঁয়ের লোক শ্রমিক সেজে নানাবিধ অপরাধের পরিকল্পনা করতে থাকে। তবে এসবের ভেতরে পুলিশ প্রশাসনকে খুবই ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। রহস্য উন্মোচনকারী এসআই রেজা তাদেরই একজন। তিনি আহামরি সততার বুলি না আওরালেও একেবারে অসৎ নন। তিনি যা কিছু করেন, এলাকার পরিস্থিতি চিন্তা করেই করেন।
মফস্বল শহরে একটি খুনের ঘটনা ঘটলে সবাই প্রতিপক্ষকেই দোষারোপ করে। এ সুযোগে তৃতীয় পক্ষ দিব্যি বগল বাজায়। আর সেখানে যদি রাজনৈতিক হিসেব-নিকেশ থাকে; তাহলে তো মামলাই নড়বড়ে হয়ে যায়। এমন পরিস্থিতিও তৈরি হয় ছদ্মবেশে। কেননা চুন্নু মিয়া রেগে গিয়ে দাবি করে, তার ভাগ্নেকে খুন করেছেন গোলাম মাওলা। তারপর তার লাশ সেখান থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। চুন্নু মিয়ার এমন সন্দেহে পাঠকের দৃষ্টি সরে যেতে পারে। তবে লেখকের সঠিক নিশানায় পাঠক আবার সঠিক দৃষ্টি পেতে পারে। পাঠকের স্বাভাবিক আগ্রহকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে পাঠককেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন—ঘটনাটি এভাবেও ঘটতে পারে। এখানেই সাদাত হোসাইনের কৃতিত্ব। এখানেই তার কাহিনি নির্মাণের যৌক্তিক সফলতা।
মানুষের জীবনের হতাশা, ব্যর্থতা, অপ্রাপ্তি, জিঘাংসা, প্রেম, মোহ, সদিচ্ছা—সবই উঠে এসেছে ছদ্মবেশে। কোন হারিয়ে যাওয়া হিরা বা চুরি যাওয়া মুক্তা উদ্ধারের কাহিনি নয়। বাস্তব জীবনের নানা টানাপড়েনকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে সাদাত হোসাইনের নবীন প্রচেষ্টা। আশা করি তার এ প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। এসআই রেজা আরও জটিল জটিল সমস্যার সমাধান করতে হাজির হবেন আমাদের সামনে। সমাজের কুটিল বিষয়গুলোকে সহজ হাতে মলাটবন্দি করবেন। সাদাত হোসাইনের মধ্যদিয়েই অনন্তকাল বেঁচে থাকবেন এসআই রেজা। পাঠকের ঘরে ঘরে পৌঁছে যাবে ‘ছদ্মবেশ’। মানুষের অন্তরে অন্তরে ঘুরপাক খেতে থাকুক রহস্যের ঘূর্ণি। শুভ কামনা সাদাত হোসাইনের জন্য। শুভ কামনা এসআই রেজার জন্য। খুব শিগগিরই হয়তো আমরা ‘রেজা সিরিজ’র নতুন কোনো কাহিনি হাতে পাবো। সে পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকলাম।
এসইউ/এএ/এমকেএইচ