ছন্দে বাঁধা
চিঠিটা খুলে পড়ছে আর হাসছে রাকিব। এ নিয়ে ২৫টি চিঠি পড়া হল তার। যে লিখেছে এই চিঠিগুলো- তার নাম ছন্দা। প্রায় তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে ছন্দার চিঠি পড়ছে রাকিব। আসলে এগুলোকে চিঠি বললে ভুল হবে। বলা যায় বিভিন্ন আকারের চিরকুট। চিরকুট এজন্যই যে, এগুলো ছন্দা বইয়ের ভেতরে লিখে দেয় আর সে বই ও চিরকুট পড়ে রাকিব। অথচ কোনোদিন তাদের দেখাই হয়নি।
রাকিব পেশায় ব্যবসায়ী। ঢাকার বাংলামোটর এলাকায় টাইলসের ব্যবসা আছে তার। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ব্যবসা। দাদার ছিল- সেটা বাবা দেখে বড় করেছেন আর রাকিব এখন তা নিষ্ঠার সঙ্গে দেখাশোনা করছে। নিজেও হয়ে উঠেছে একজন পাকা ব্যবসায়ী। যদিও বাবার অসুস্থতার কারণে এইচএসসির পর আর পড়াশুনা করা হয়নি তার। ধরতে হয়েছে পরিবার ও ব্যবসার হাল। চার ভাই-বোনের মধ্যে বড় সে। ছোট ভাই রাফি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, বোন রিমি ও রুমা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। মানে বাড়ন্ত ভাইবোনদের জন্য তরুণ রাকিব চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
তারপরও নিজেরতো কিছু চাওয়া-পাওয়া আছে। সেই চাওয়া-পাওয়া টুকু আর কিছু নয়। রাকিবের অভ্যাস একটাই সন্ধ্যায় একটু করে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে ঘুরে আসা। আর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কাছেই হওয়ায় আরো সুবিধা। প্রতিদিন অন্তত এক ঘণ্টা সেখানে সময় কাটায় সে।
প্রথমদিকে বন্ধু-বান্ধব থেকে বিচ্ছিন্ন রাকিব অনেকটা একা হয়ে যায়। তবে বইয়ের মতো সুন্দর বন্ধু আর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মতো উপযুক্ত জায়গা পেয়ে সে এখন পরিতৃপ্ত। কাজের ফাঁকে এইটুকু সময় সে নিজের মতো করে কাটায়।
মজার ব্যাপার হলো প্রথমদিকে সেখানে গিয়ে চরম বিরক্ত হতো সে। বিভিন্ন ধরনের পাঠকও দেখতে পেত। কিছু পাঠক যেন একেবারেই নির্দিষ্ট। প্রতিদিন গিয়ে একজন বয়োজ্যেষ্ঠ পাঠককে দেখতো রাকিব। লোকটার যেন আর কোনো কাজ নেই। শুধু সেখানে গিয়ে বসে বসে বই পড়া ছাড়া। আর কিছু তরুণও ছিল যারা নিয়মিত আসে সাথে কাগজ কলম নিয়ে আসে, কি যেন লিখে নিয়ে চলে যায়। কিছু কিছু পাঠক মাসে সপ্তাহে আসে বই দেয়া-নেয়ার কাজ সেরে চলে যায়। মাঝে মাঝে সময় পার করে বই ফেরত দিতে আসায় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মৃদু বাকবিতণ্ডা হয়। আবার কখনো বই রাখার জন্য বেশি সময় চেয়ে আবদার। আরো কিছু পাঠক আছে মাদ্রাসা ছাত্র। আগে মোল্লারা কেবল মসজিদেই থাকতো এখন বিভিন্ন ধরনের বই পড়ে!
মাঝে মাঝে কিছু শুশ্রী তরুণীরও লাইব্রেরিতে আনাগোনা আছে। তরুণ রাকিবেরও ভালো লাগে- তাকিয়েও তৃপ্তি পায়। তবে প্রণয়ঘটিত বিষয় তার মনকে আকৃষ্ট করে না মোটেই। কেবল ব্যবসা আর মনের আনন্দে একটুখানি সময় পার করতেই ভালোবাসে সে। মাঝে মাঝে শিশু-কিশোরদের দেখেও পুলকিত হয়।
এভাবেই সময় কাটাতে কাটাতে একসময় নিজেরও পড়ার অভ্যাস গড়ে ওঠে। সন্ধ্যায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের লাইব্রেরিতে বসে এ বই সে বই নেড়েচেড়ে দেখে। আর দু’ একটা বই সদস্য হিসেবে নেয় পড়তে- যেগুলো কেবল বাসায় নিয়েই পড়ে সে। রাতে খেয়ে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত পড়তো সে।
একদিন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের লাইব্রেরিতে নিজের পড়ার জন্য বই খুঁজছে রাকিব এমন সময় খেয়াল করলো একটি বইয়ের উপরের দিকের কোণায় একটা কালো দাগ টানা। যা খুবই চিকন একটু মন দিয়ে খেয়াল না করলে বোঝা যায় না বিষয়টা। বইটা হাতে নিল রাকিব নাম; ‘অর্ধেক নারী তুমি অর্ধেক ঈশ্বরী’ বইটার কয়েকটা পৃষ্ঠা ওল্টালো সে। ভেতরে একটা চিরকুট পেলো। সেখানে লেখা :
‘বইটি পড়ে বিমোহিত হলাম। লেখকের সঙ্গে পরিচয় ছিল না। তবে এই প্রথম পরিচয়েই পাঠক-লেখকের একটা পরিণয় হল। বাংলা সাহিত্যে এমন সুন্দর উপন্যাস আছে জানতাম না। প্রেম-ভালবাসা মিশ্রিত চমৎকার একটা দৃশ্যপট এঁকেছেন লেখক। আমি বিমোহিত হলাম।’
ছোট্ট এ চিরকুটের নিচে ছোট করে নাম লেখা; ছন্দা। বইটি রাকিব নিজের জন্য নেয় তবে তার আগে চিরকুটটা পকেটে পুরে নেয়। বইটা পড়ে রাকিবও মুগ্ধ হয়। বড় ভাল লাগে তার। এরপর এভাবেই এক সপ্তাহ বা দুই সপ্তাহ পর পর ছন্দার চিরকুটসহ বই সে পেয়ে যায়। এবার রীতিতে বদল ঘটিয়েছে সে নিজে; চিরকুটটা খুলেও দেখে না। আগে বইটা পড়ে তারপর পড়ে চিরকুটটা। এতেই দারুণ স্বাদ পায় সে। এভাবেই নিজের সাড়ে তিন বছরের বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র যাওয়া আসার মধ্যে তিন বছর ধরে ছন্দার পছন্দের বই পড়ছে সে। ছন্দার ছন্দে বাঁধা পড়েছে সে।
প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে যাওয়া-আসা আর তিন বছর ছন্দার সঙ্গে একইসূত্রে গাঁথা তার পড়াশুনা। ছন্দা পড়ে যে বই রেখে দেয় সেটাই সে নিয়ে পড়ে। বিষয়টা হয় সবার অগোচরে এমনকি ছন্দারও! এভাবেই তার অনেক বই পড়া হল। ছন্দারই পছন্দের প্রায় ৩০টিরও বেশি বই পড়া হয়েছে চিরকুটসহ। প্রতিটা বই ছিল অসাধারণ। বাস্তবে ছন্দার অদৃশ্য সহযোগিতায় সে বেশ ভালো ভালো বই এমনকি অনেক লেখকের সঙ্গেও পরিচিত হয়েছে। একা পড়লে হয়তোবা নানান বই পড়া হতো তবে এমন সুন্দর আর না চাইতে পরিকল্পিত কিছু পড়া হতো না। ছন্দা নিজের অজান্তেই রাকিবকে সমৃদ্ধ করেছে জ্ঞানে। তাই ছন্দা রাকিবের উত্তম বন্ধু।
একটা বই শেষ করার পর আজ চিরকুটটা হাতে নিল রাকিব। এই প্রথম চিরকুট পড়ে হতাশ হলো সে। চিরকুটের নিচে লেখা; ‘হয়তবা আর কয়েকটা বই পড়েই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সাথে সম্পর্ক শেষ হবে। তারপরও এ বইটার বিষয়ে নিজের ছোট্ট একটা অনুভূতি রেখে যাচ্ছি।...’
রাকিব কিছুটা বিমর্ষ হল। যদিও কখনো ভাবেনি ছন্দাকে দেখার কথা। এদিকে আজ প্রথম বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে একজনের সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে তার। বই খুঁজতে গিয়ে ধাক্কা লাগে মেয়েটির সঙ্গে অমনি বাক-বিতণ্ডা। জিন্স ফতুয়া পড়ুয়া আধুনিকা মেয়েটি তাকে মোটামুটি ভালোই কথা শুনিয়ে দিয়েছে। ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকা ছাড়া রাকিবের আর কিছুই করার ছিল না।
এভাবেই অসংলগ্ন কিছু কথা ভাবছিল সে। আজ মা এলো তার রুমে। মা সাধারণত রাতে তার রুমে আসে না। মাকে দেখে সে খুশিই হল।
মা, তুমি এতরাতে রুমে?
এলাম ছেলের রুমে কি আসবো না? অন্ধকারে মাথার পাশে কেবল ছোট্ট একটা টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়েছিস কেন?
কেন আসবে না। অবশ্যই আসবে। বস আমার পাশে। তোমার সঙ্গে খুব একটা কথাইতো বলা হয় না। আর লাইট। টাইলস এর শো-রুমে শতশত লাইটের আলো। আর বাসায় এসেও আলো ভালো লাগে না।
মা তার পাশে বসলো। বসে বললো; পড়ালেখা করতে না পেরে তোর মনে অনেক কষ্ট, তাইনা বাবা?
না কষ্ট কেন। পড়ালেখাতো আমি করছি। এই দেখনা নিয়মিত এটা ওটা পড়ি।
বাবা তোকে একটা কথা না বললেই নয়। তোর মত বয়সে সবাই বিয়ে-শাদি করে। তোর কি এ বিষয়ে কোনো চিন্তা নেই। আর নিজের পছন্দ থাকলে বল, তোর পছন্দে আমরা অমত করবো না।
মা, আসলে ওই বিষয়টা নিয়ে আমার ভাবাই হয়নি। আর ব্যবসার বাইরে আমি অন্য কিছু নিয়ে ভাবিওনি। দেখনা কয়েক বছরেই আমাদের টাইলস সারা বাংলাদেশে বিক্রি হচ্ছে। দেশের এমন কোনো বিভাগীয় শহর নেই যেখানে আমাদের শো-রুম নেই। ব্যবসাতো অনেক এগিয়েছে।
তারপরও বাবা, আমি দোয়া করি ব্যবসায় আরো উন্নতি হোক। তোর বাবার অসুস্থতার পর তুই যোগ্য বড় ছেলের মতই ব্যবসা দেখেছিস। উন্নতিও করেছিস আরো করবি। কিন্তু নিজের বিষয়টা ভাববি না। তুইতো আমার দায়িত্ববান ছেলে। নিজে বিয়ে করবি ছোট ভাই-বোনদের বিয়ে দিবি। সবইতো তোকে ভাবতে হবে বাবা। রাফি-রিমির পড়াশুনা শেষ হচ্ছে দুই এক বছরের মধ্যে। রুমাও রিমির মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স করছে। তোর সবচেয়ে ছোট বোনটা এবার থার্ড ইয়ারে উঠলো। তাই সবইতো তোকেই ভাবতে হবে।
রাকিব আসলে কয়েকটা বছর বইয়ের ঘোরে ছিল। খেয়ালই করেনি এসব বিষয়। ভাই-বোনগুলো সুবোধ ছেলে-মেয়ের মতো পড়াশুনা করে গেছে। ভাইয়ের পেছনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে টাকা খরচ করতে হয়েছে। তবে দুই বোনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। বাবার অসুস্থতার পর ভাই পড়াশুনা ছেড়ে সংসারের হাল ধরেছে। এটা বোঝার মতো বয়স তাদের সবারই হয়েছে। যদিও ব্যবসা সমৃদ্ধি লাভ করেছে তারপরও ভাই নিজের সব স্বার্থ ত্যাগ করে তাদের জন্য সবকিছু করেছে ভেবে তারা সবাই নিজের জীবনটা গুছিয়েই রেখেছে। কেউ এলোমেলো করেনি। তবে ওরা সবাই এখন যথেষ্ট বড়। ওদের বিষয়টা ভাবতে হবে।
কিরে তুই কি ভাবতে শুরু করলি?
ওহ, মা রাত অনেক হল। তোমাকে কথা দিলাম এবার আমি বিষয়টা নিয়ে ভাববো।
মা হেসে চলে গেল। বুঝতে পেরেছে ছেলে এবার ভাববে।
সব বিষয় ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লো রাকিব।
সকালে পরিবারের সবাই একই সাথে নাস্তা করে। অসুস্থ প্যারালাইজড বাবাও এসময় তাদের সাথে থাকেন। যদিও এখন তিনি অনেকটা সুস্থ তবুও আগের মত হাঁটা-চলা করতে পারেন না। তারপরও ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে একটি হুইল চেয়ারে বসেন।
রাকিব আজ তার সবচেয়ে ছোট বোন রুমাকে জিজ্ঞেস করলো; কিরে তুই বিয়ে করবি?
রুমাতো অবাক, সেই সঙ্গে বাসার সবাই! রুমা বললো কি বলছো ভাইয়া, আমার আগে সিরিয়াল তিনটা সিরিয়াল।
রাকিব তৎক্ষণাৎ জবাব দিলো; ওই জন্যেইতো ছোটটাকে দিয়ে শুভকাজ শুরু করতে চাচ্ছি। তোরা সবাই বড় হয়েছিস।
সবাই হেসে উঠলো। রিমি বললো; ভালোই বলেছো ভাইয়া। শুরুটা ওকে দিয়েই করা যায়।
রাফি বললো; আমি বুঝলাম না সিরিয়াল ব্রেক করার কি হল। ভাইয়া শুরু করুক তারপর...।
তাদের মা বললো; রাকিব অনেক কর্তব্য দেখিয়েছিস। এবার আর ওসব দেখাতে যাস না। তোকে দিয়েই সব শুরু হবে।
ওদের বাবা অসুস্থতার কারণে কথা বলতে তোতলান। তারপরও বললেন, ব-ব-ব ড় দি-দি-দি য়ে শু-শু-শু রু।
এসময় তাদের বাসার কাজের মহিলাটা বললো; আমিও তালাক দিয়া আর একখান বিয়া করমু।
সবাই হেসে উঠলো। রাকিবের মা জিজ্ঞেস করলো; কিরে নুপুর তোর আবার কি হলো।
সে জবাব দিল, আর কইয়েন না মা। নিজ এলাকা রংপুরে বিয়া করছিলাম। খালি পিডায়। বাপ না কওন পর্যন্ত পিডাইতে থাকে। কি যে জ্বালা! নেশাখোর স্বামী।
তুই মারের চোটে স্বামীকে বাপ ডাকিস? বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো রাকিবের মা।
আর কইয়েন না মা। বাপ ডাকলে যদি মাইর থামায় তো বাপ ডাকমু নাতো কি!
সবাই হো হো করে হাসতে শুরু করলো। এসময় রিমি বলে উঠলো; মা তোমাকে বলাই হয়নি। আমার রংপুরের এক বান্ধবী আজ আসবে। ও যদিও আমার সিনিয়র আপু মাস্টার্স শেষ করেছে গত বছর। এবার বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে টিকে রংপুর কারমাইকেল কলেজের শিক্ষক হয়েছে। বাসাও রংপুরে ভালই হয়েছে। ও সেখানেই চলে যাবে। তার আগে কয়েকদিন এখানে থেকে যাবে। হল ছেড়ে দিয়েছে। তাই আমিই আসতে বলেছি।
কে তানিয়া?
হ্যা, মা।
বেশতো ওতো আগেও এসেছিল। আসবে থাকবে আমি কি নিষেধ করেছি। ওতো প্রায়ই আসে।
না মা তারপরও তোমাকে জানিয়ে রাখলাম।
খাওয়া শেষ করে সবাই যার যার মতো উঠে গেলো।
রাকিব শো-রুম ও অফিসের কাজ শেষ করে রাত ৯টার দিকে বাসায় ফিরলো। দরজা বাসার বুয়া খুলে দিল। তবে ড্রয়িং রুমে কেবল একা একটা মেয়ে বসে টিভি দেখছে। মেয়েটা ওকে দেখে উঠে দাঁড়ালো। দু’জনেই বেশ বিব্রত।
রাকিবের মনে হল মেয়েটা পরিচিত। তবে হিসাব মেলাতে পারছে না। কোথায় দেখেছে মনে করতে পারছে না।
এমন সময় রিমি এল ড্রয়িংরুমে। ভাইয়া এসেছিস। ও ওর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেই। ও তানিয়া আপু। আমার দুই বছরে সিনিয়র তবে আমাদের সম্পর্ক বন্ধুর মতোই। ও বাসায় প্রায়ই আসে তবে তোর সঙ্গে বোধহয় পরিচয় হয়নি। সকালে ওর কথাই বলেছিলাম।
রাকিব হাসিমুখে বললো; ও ঠিক আছে পরে কথা হবে। এই বলে সে নিজের রুমের দিকে রওয়ানা হলো। ভাবলো বাসায় প্রায়ই আসে এজন্যই পরিচিত মনে হলো।
এরপর রাতে সবাই একসাথে খেলো। খাওয়ার সময় সবাই অনেক গল্প করলো। তানিয়াও বেশ কথা বলছে। ও আগে এসেছিল তাই বাসার সবার সঙ্গে বেশ ভাব হয়েছে। রাকিবও স্বাভাবিক।
তানিয়া, রংপুরে যাচ্ছো কবে?
এইতো আগামী সপ্তাহে ভাইয়া। তারপরের সপ্তাহে আবার জয়েন করতে হবে। জবাব দিল তানিয়া।
যাক রংপুরে পরিচিত মানুষ পাওয়া গেল। সামনের মাসে একটু রংপুর যাবো। দেশের প্রায় সব কয়টা বিভাগীয় শহরেই আমাদের শো-রুম আছে। তবে রংপুর আর ময়মনসিংহে করা হয়নি। রংপুরে জায়গা নেয়া হয়েছে। কি যেন নাম ও হ্যা টাউন হলের কাছে। আগামী মাসে ওটা চালু করবো ভাবছি তাই রংপুর যাবো। আসলে সেখানে কখনো যাওয়া হয়ে ওঠেনি। তোমাদের বাড়িটা যেহেতু ওখানেই তাই ভালই হলো পরিচিত কিছু লোক মিলবে। নতুন জায়গা।
তানিয়া বললো, বেশতো ভাইয়া আমাদের বাড়িটা ধাপ এলাকায়। ওখানেই আমরা জন্মেছি বড় হয়েছি। আর আপনি যে লোকেশন বললেন, ওটা আমার কলেজ যাওয়া-আসার মাঝেই পড়বে। আমার বাবাও রংপুর জিলা স্কুলের শিক্ষক। কয়েক বছর পর অবসরে যাবেন। আমার ছোট ভাইটাও রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে সেকেন্ড ইয়ারে।
শুনে রাকিব বেশ খুশি হল। আসলে পুরোটাই ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে।
রুমা হঠাৎ প্রশ্ন করে বসলো; আপু তোমাদের এলাকার পুরুষরা নাকি বউকে খুব পেটায়। আর বাবা বলে না ডাকা পর্যন্ত পেটানো বন্ধ করে না!
বিব্রত তানিয়া জিজ্ঞেস করলো- তোমাকে কে বললো?
আমাদের বুয়া। ও তো তোমাদের এলাকার। ও কাল সকালে আবার আসবে। দিনে দু’বার আসে। সকালে আর রাতে। রাতে অবশ্য দেরিতে যায় পাশের বস্তিতেই থাকেতো। তবে আজ আগেই চলে গেছে। বললো রুমা।
রিমি নিজেও বিব্রতবোধ করে বললো; কি সব উল্টা-পাল্টা প্রশ্ন করিস তুই?
রুমার সোজা জবাব; বাঁচতে হলে জানতে হবে। যদি রংপুরে আমার বিয়ে হয়?
সবাই একসাথে হেসে উঠলো।
তবে তানিয়া জবাব দিলো; আসলে দরিদ্র লোকের সংখ্যা বেশি। আর তাদের মাঝে এসব বদগুণ থাকতেই পারে। মানুষ শিক্ষিত না হলে সে আর কেমন হতে পারে বলো।
এবার কথা বললো রাফি; বললো আপু রংপুরের মেয়েরা কেমন হয়?
জবাব রুমাই দিল। বললো; ক্যানরে তুইও চান্স নিবি নাকি? আহা ওরা যদি পুরুষ পেটাতে পারতো। তাহলে তোকে একটা আমি রংপুরের মেয়েই জুটিয়ে দিতাম। তোকে পিটিয়ে মডার্ন থেকে ম্যাংগো পিপল বানিয়ে দিতো।
ম্যাংগো পিপলটা আবার কি রাকিবই জিজ্ঞেস করলো হেসে।
রুমার পাল্টা জবাব, কি আবার আমজনতা। ওতো আর আমজনতা না আল্ট্রা মডার্ন।
সবাই হো হো করে হাসতে শুরু করলো।
মা সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বললে। খাওয়া গলায় লাগবে তোরা খাওয়ার সময় হাসিস না।
রাফি কেবল চোখ বড় বড় করে রুমার দিকে তাকিয়ে রইলো। তবে রুমা নির্বিকার। তার দিকে তাকিয়ে নিজের ভ্রূ নাড়ালো দুইবার।
ধীরে ধীরে সবার খাওয়া শেষ হলো। সবাই উঠে গেল।
রাকিবও রুমের দিকে হাঁটা দিল। মনে ছন্দার ভাবনা।
এদিকে রিমি আর তানিয়া রুমে খোশগল্পে মশগুল। তানিয়াকে কিছুটা বিব্রত দেখে রিমিই প্রশ্ন করলো; তুমি কি খাবার টেবিলের কথাগুলো নিয়ে মন খারাপ করেছ।
কই? নাতো, বরং আমি অন্য একটা কারণে বিব্রত।
অন্য আবার কি এমন ঘটনা ঘটলো।
রাকিব ভাইয়াকে আমি একদিন খুব অপমান করেছিলাম। অনেক বকেছিলাম।
মানে কি? ভাইয়াকে তুমি কোথায় পেলে?
আরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে আমার সঙ্গে বইয়ের র্যা কগুলোর ফাঁকে ধাক্কা লেগেছিল। আর আমিও ঝেড়ে দিয়েছি!
ভাইয়া কি ওখানে যায়? ওর কি বই পড়ার অভ্যাস আছে? আমিতো কিছুই জানি না।
ওই একদিনই আমার সঙ্গে তার দেখা হয়। সেদিন আমাকে কিছুই বলেনি। স্যরি বলেছিল আমি পাত্তা দেইনি।
তুমি অতিমাত্রায় প্রতিবাদী। যাহোক অমন না হলে আমার সাথে তোমার বন্ধুত্বও হতো না। একটা বখাটেকে নিজ হাতে পিটিয়ে একদিন আমাকে রক্ষা করেছিলে। সেদিনতো ভালই ছিলে। আমার ভাইটাকে ঝাড়ি দিতে গেলে কোন দুঃখে। আর সেইবা সব চেপে তোমার সঙ্গে আলাপ করছে। কারণটা কি?
দূর তুমি যে কি ভাবনা। আমার মনে হয় উনি অমনোযোগী। আর এখনতো চোখে চশমা লাগাই, সালোয়ার পড়ি। সেদিনতো জিন্স ফতুয়া ছিল। তাই বোধহয় চিনতে পারেনি।
যাক ভালো চেপে যাও। আমিও চেপে গেলাম। আর কোথায় একজন বিসিএস ক্যাডার আর কোথায় আমার ইন্টার পাস ব্যবসায়ী ভাই।
রিমির কথা শেষ হতে না হতেই রুমা ঘরে এলো। সে বললো; আপু তুই এভাবে বলতে পারলি। ভাইয়া আমাদের জন্যইতো পড়াশুনা করেনি। আর তুই অকৃতজ্ঞের মতো উল্টো-পাল্টা কথা বলিস। ও এখন কোটিপতি। ব্যবসা যেভাবে গুছিয়ে নিচ্ছে তাতে আমি বলে দিলাম; আমার ভাই বাংলাদেশের একজন বড় ব্যবসায়ী হবে।
রুমার একনাগারে কথা শুনে রিমি তানিয়া দু’জনেই হতবাক। রিমিতো কি বলবে বুঝতে পারছে না।
তানিয়া হেসে হেসে বললো; নারে ভাই তোমাদের ভাইকে নিয়ে আমার কোনো আপত্তি নেই। তবে যদি বিয়েটা আগে থেকে ঠিক না থাকতো তাহলে একটা ভালো মানুষ হিসেবে তার কথা ভাবতে সমস্যা ছিলনা। আর উনি যেভাবে বড় ব্যবসায়ী হচ্ছেন তাতে অনেক বড় মাপের মেয়েকেও বিয়ে করতে পারবেন সন্দেহ নেই।
রুমা হেসে ফেললো। তাহলে কাকে নিয়ে তোমাদের আলোচনা?
এবার রিমি বললো; জানিস ভাইয়া নাকি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে যায় বই পড়ে। তানিয়া আপু দেখেছে।
তাই নাকি? ভাইয়ার টেবিলে আমি দুই একদিন বই দেখেছিলাম। আর হাতেও দু’একবার দেখেছি। কথা তাহলে ঠিক। ভাইয়া তাহলে ব্যবসা আর বই এই দুই নিয়ে মজেছে। এজন্য আমাকে বিয়ে দিতে চায়!
না ভাইয়া বই পড়ে এটা শুনে আমি যেমন খুশি তেমন কিছুটা কষ্টও পেলাম। ও আমাদের জন্য এত কিছু করেছে। আর কোনোদিন ওকে একটা বইও উপহার দিলাম না। বললো রিমি।
দূর আমি ভাবছি ওর পেছনে একটা মেয়ে লাগিয়ে দিয়ে বিয়ে দেব। তাহলে সংসারে জড়িয়ে যাবে। আর আমাকে বিয়ে দিতে চাবে না। জবাব দিল রুমা।
সবাই হেসে উঠলো। এমন সময় মা রুমে এলো। তোরা ঘুমাবি না? প্রশ্ন করলেন তিনি।
রিমি বললো, ঘুমিয়ে পড়ছি মা। তুমি ঘুমাও।
মা চলে যেতে যেতে বললেন। ঘুমিয়ে পড়। অহেতুক রাত জাগিস না। দিনেওতো গল্প-গুজবের সময় পাবি।
মা চলে গেলে রিমি বললো; পাবো মা তবে রাতের মতো মজা হবে না। সবাই হাসতে শুরু করলো।
অন্যদিকে রাফি ল্যাপটপ নিয়ে নিজ ঘরে ব্যস্ত। মা-বাবা ঘুমানোর পথে। রাকিব নিজের ঘরে বসে বই পড়ছে আর সেই ছন্দার কথা ভাবছে। বইটা শেষের পথে। বোধকরি লাইব্রেরিতে ছন্দার পছন্দের পড়া শেষ বই এটি। বইটির নাম ‘ওঙ্কার’। সেই প্রথম ছন্দার পছন্দ অনুযায়ী যে লেখকের বই পড়েছিল এটাও একই লেখকের বই।
আজব ছন্দ ছন্দার। যদিও শেষ দেখা আর হবে না। তাই রাকিব ভাবছে এই চিরকুটই হয়তবা শেষ চিরকুট। তবে ছন্দার পছন্দের যতগুলো বই সে পড়েছে। নিজেই নিজের একটা সুন্দর পথ করে নিয়েছে।
চিরকুটটাতে আজ বিশেষ কোনো লেখা নেই। শুধু লেখা ‘এটা যেনো বিন্দুর মধ্যে সিন্ধু।’ রাকিব চিরকুটটা চিরকুটের স্তুপে অর্থাৎ তার ড্রয়ারে রেখে শুয়ে পড়লো।
কয়েকদিন আবারো কাজের ব্যস্ততা। তারপর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে যাওয়ার অভ্যাস ছাড়েনি রাকিব। বাসায় যে বইটা পড়ে সেটা আলাদা থাকে। তবে ওখানে গিয়ে এটা ওটা বই দেখে। মোটামুটি সাড়ে তিন বছরে সে পুরো লাইব্রেরিটা সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি করে ফেলেছে। কোথায় কোন বই আছে তা অনায়াসেই বলে দিতে পারে সে।
প্রায় এক সপ্তাহ রাতে বা সকালে বাসার লোকদের সঙ্গে খেতে বসতে পারেনি রাকিব। সকালে বেরিয়েছে তাড়াতাড়ি রাতেও ফিরেছে দেরিতে। আজ সকালে খেতে বসে রিমিকে জিজ্ঞেস করলো; কিরে তানিয়া কই?
তানিয়া আপুতো গত সপ্তাহেই চলে গেছে আর কলেজেও জয়েন করেছে। ও বলেছে রংপুরে গেলে যেন ওদের বাসায় ওঠ।
খাওয়ার টেবিলে রুমা বললো; তুমি কি আমার বিষয়টা বুঝবে না ভাইয়া। কেন ডিসক্রিমিনেশন করছো; রাফি ভাইয়া যদি অমন ভালো একটা অ্যানড্রয়েড ফোন ব্যবহার করে তাহলে আমি কেন পারবো না?
রাকিব হেসে ফেললো। এমন একটা সামান্য জিনিস চাইবি তা না দেয়ার কি হল। আমিতো তোকে অনেক বড় জিনিস দিতে চেয়েছি।
রিমি বুঝতে পেরে মিটমিটিয়ে হাসতে শুরু করেছে। রাফিও হাসছে। তবে রুমা বললো, তো জলদি দাও।
মা হাসতে হাসতে বললেন, ও তো তোকে বর দিতে চায় নিবি?
রুমা এই প্রথম লজ্জিত হলো।
সবাই হাসতে শুরু করলো। রাকিব বললো, কোনো চিন্তা করিসনা আগামী মাসে আমাদের রংপুর শো-রুমের উদ্বোধন। ওটা সেরে এসেই তোকে তোর পছন্দের সেট কিনে দেব। আচ্ছা তোর সেকেন্ড সেমিস্টারের রেজাল্ট কি?
না দেবে বলো, তাই বলে রেজাল্ট জিজ্ঞেস করতে হবে।
তুই রেজাল্ট খারাপ করবি না এ বিশ্বাস আছে। তো বল সেদিন কেন রাস্তায় আমার শার্ট ধরে টেনেছিলি?
এবার রাফি আগ্রহী হলো। রিমিও বললো; রাস্তায় শার্ট ধরে টেনেছে মানে কি?
এরই মাঝে মা বলে উঠলেন, কি বলিস রাকিব ও রাস্তায় তোর শার্ট ধরে টেনেছে?
রুমার মেজাজ চড়ে গেল। রেগে বললো, শাহবাগের রাস্তা ক্রস করবো দু’পাশেই প্রচণ্ড গাড়ির চাপ পার হতে পারছি না। এমন সময় দেখলাম একজন ছেলে পার হচ্ছে সাথে আরো কয়েকজন আছে। ছেলেটাকে ভালো মনে হলো তাই শার্টের হাতা টেনে ধরলাম। হাত কি আর ধরা যায়! রাস্তা পার হওয়ার পর দেখলাম ভাইয়া। ভাইয়াও বললো কিরে হাতটা ভালো করে ধরবি না। শার্ট ধরে টানাটানি করছিস কেন?
সবাই হেসে উঠলো। কেবল মা গম্ভীর। রাকিব রাস্তা পার হওয়ার সময় তুই তাহলে বেশি সাহস দেখাস। যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে।
ভারি পরিবেশ দেখে রাকিব বললো, আচ্ছা মা এখন থেকে খেয়াল করে চলবো। আর তোমার মেয়েদেরও একটু খেয়াল করে চলতে বলে দিও। এই বলে সে হাসতে হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেলো।
সব মিলে দিন ভালোই কাটছে রাকিবের। এখন সে নিজের আনন্দের উপায় বই পড়ারও একটা ছন্দময় ধারায় চলে এসেছে। পরিবার পরিজনও ভালোই চলছে। ছোট ভাই-বোনেরা নিজেদের মতো করেই মানুষ হচ্ছে। তারও ব্যবসা প্রসারিত হচ্ছে।
এরই ফাঁকে রংপুর গিয়ে নিজের নতুন শো-রুম উদ্বোধন করলো। কয়েকদিন সেখানে থেকে ঢাকার পথে রওয়ানা হলো। পথে একটা অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন এলো। ফোন দিয়েই অভিমানের সুরে ওপাশ থেকে একটা নারী কণ্ঠ শোনা গেল; এলেন না যে?
রাকিব বিব্রত হয়ে বললো; আপনি সম্ভবত ভুল নম্বরে ফোন করেছেন। আমারতো কোথাও যাওয়ার কথা ছিলনা।
ওপাশে এবার রাগ; আমি রিমির কাছ থেকে নম্বর নিলাম। আপনার কি মনে নেই বলেছিলেন রংপুরে এলে আমাদের বাসায় আসবেন। আজবতো!
রাকিব পড়লো মহাবিপাকে বুঝতে পেরেছে যে মেয়েটা কে। তবে নাম মনে করতে পারছে না। তাই বললো; আমি ফোন রাখছি। আপনি নম্বরটা চেক করে আবার ফোন দিন।
ফোন কেটে গেলো। রাকিব এবারের মতো বাঁচলো। কয়েক মিনিট ভাবার পর রিমিকে ফোন দিল। রিমি ফোন ধরেই, রেগে বললো; তুই নিজেকে ভাবিস কি ভাইয়া? তানিয়া আপু ফোন দিলো আর তুই ওকে চিনতেও পারছিস না। ও তো আমাকে ফোন দিয়ে বললো আমি নাকি ওকে ভুল নম্বর দিয়েছি। সে কি রাগ ওর।
নারে চিনতে পেরেছি। তবে নামটা মনে ছিলো না। তাইতো তোকে ফোন দিলাম।
ওহ নামই ভুলে গেছিস! তাহলে ওদের বাসায় যাওয়ার বিষয়ে আর কি মনে রেখেছিস।
রাগ করিস না আমি ওকে ফোন দিচ্ছি।
বেশ কয়েক মিনিট পর ফোন দিল তানিয়াকে। তানিয়া ফোন রিসিভ করে হেসে বললো; ভাইয়া মানুষ এত আত্মভোলা হয়। আপনি কেবল ব্যবসা ছাড়া আর কিছু বোঝেন না। আরো কিছু কথা আর কুশল বিনিময় শেষে ফোন রেখে দিলো রাকিব। এরপর বাসে ঘুমিয়ে পড়লো।
ওদিকে রিমি আর তানিয়ার ফোনালাপ শুরু হলো ফের। আচ্ছা রিমি ভাইয়ার কি আর কোনো কাজ নেই? খালি ব্যবসা ছাড়া আর কিছু ভাবে না। বিয়ে দিসনা ক্যানো তোরা।
আপু তোমার যদি বিয়ে ঠিক না থাকতো তাহলে তোমাকেই ভাবী বানাতাম। কি আপত্তি ছিল?
তানিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, বিয়েটা ভেঙে গেছে।
কী বল কেন?
আসলে ওই ছেলেটা কয়েকবছর আগে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে আমার মতোই টিকে। এরপর অধঃপতন। রাজশাহীর এক সরকারি কলেজে জয়েন করে। কি আর বলবো ছাত্রীদের নাকি বেশি নম্বর দিতো ব্যবহার করে। কিছু ছাত্রীও আবার কেবল বেশি নম্বরের আশায় সব দিতো। আর এখন এসব বিষয়কে ছেলে খেলাই মনে করে সবাই। তবে এক মেয়ে তার ফাঁদে পা দেয়নি বলে নানান কৌশলে তাকে ফাঁদে ফেলে। এমনকি বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে। পরে মন ভরে গেলে মেয়েটির সাথে খারাপ আচরণ শুরু করে। এক পর্যায়ে ছাত্রীটি মামলা করে। আর সেইসঙ্গে পূর্বের সব বিষয়ও প্রকাশ পায়। আমার বাবাও বিষয়টা জানতে পেরে বিয়ে ভেঙে দেয়। আমি পুরো বিষয়টা জানি অনেক পরে।
কি বলো আপু। অনেক বড় বাঁচা বেঁচেছো! শালা যদি বিয়ের পর অমন করতো। যাহোক ভালো পাত্র দেখে বিয়ে করো এবার। আর আমার ভাইতো; ছন্দায় মজেছে। কে যে এই ছন্দা কিছুই বুঝছি না। ছন্দার একপাল চিরকুট দেখলাম ভাইয়ার ড্রয়ারে। তবে প্রেমের না। বইয়ের উপর লেখা শর্ট নোট।
কি বলিস তুই? কয়টা চিরকুট?
এই বিশ-ত্রিশটার মতো।
তুই কি বুঝিসনি ওগুলো কি বা কার?
না তো কার আবার। হবে কোনো মহারানীর। এই মেয়েগুলোও যা একটা নিরীহ ছেলে পেলেই নাকে দড়ি দিয়ে টানতে চায়। যত্তসব...
চুপ কর। বাজে বকিস না। কিছুইতো মনে থাকে না। আমিই ছন্দা। মনে নেই তোর আমার ডাক নাম ছন্দা। তানিয়া আফরীন ছন্দা।
ওমা তাইতো ওই লেখাগুলো তো তোমারই ছিল। তাইতো বলি পরিচিত কেন? তুমিইতো কোনো বই পড়ে তার ভেতর ছোট্ট একটা চিরকুট লিখে রাখতে। আর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বইয়েও একইসঙ্গে একটা পাতলা দাঁড়িও দিতে। মানে আমার ভাই তোমার পেছনে ছুটছে। আর বুঝতেও পারেনি ওটা তুমি!
দূর তুই এভাবে বলছিস কেন? ভিন্ন ব্যাপারওতো হতে পারে।
তাও ঠিক। আপু সত্যি যদি ও তোমার মানে সেই ছন্দার প্রতি দুর্বল থাকে কি করবে তাহলে?
তোকে সাইজ করবো। তোর গুষ্টি উদ্ধার করবো।
মানে কি?
মানে তোকে ননদ বানাতে আমার আপত্তি নেই। দাঁড়া আমার আর একটা নম্বর থেকে আজ রাতে তোর ভাইকে জব্দ করবো। রাখি পরে কথা হবে।
আর কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে নিজের অন্য নম্বর থেকে রাকিবকে ফোন দিল ছন্দা। ফোন দিয়েই বললো ক্যামন আছেন?
রাকিব গাড়িতেই ঘুমাচ্ছিল। এবার সুবোধ ছেলের মতো বললো। ভাল আছি। আবার ফোন দিলে কেন তানিয়া রাত ২টা বাজে।
তানিয়া! এটা কে? আপনার বউ আছে নাকি? সর্বনাশ।
রেগে উঠলো রাকিব। রাত ২টা কি দুষ্টামির সময় তানিয়া ফোন রাখো।
তানিয়া আবার কে? দূর কত ভেবে ফোন দিলাম। ঠিক আছে রাখি আমি তানিয়া নই ছন্দা।
ঠিক আছে রাখো। বলে নিজেও রেখে দিল রাকিব। যত্তসব জঞ্জাল বলে সিটে হেলান দেবে এই সময় নামটা মনে হলো; ছন্দা ছন্দা মানে ছন্দা! ঝটপট নম্বর মেলালো সে না তানিয়া ছন্দা এক নয়। দূর কেন যে এবার বেশি চালাকি করতে গেলাম। এই বলে আবার নম্বরটিতে ফোন দিলো সে। বন্ধ পেলো। এবার তানিয়াকেই ফোন দিয়ে বসলো। রিং হলো দুই বার।
তানিয়া প্রচণ্ড ঘুম জড়িত কণ্ঠে বললো; ভাইয়া এত রাতে কোনো সমস্যা?
না না রিমির নম্বরে দিতে গিয়ে তোমার কাছে চলে গেছে, স্যরি। এবার সে বুঝলো বোকামি হয়ে গেছে। তানিয়া ছন্দা এক নয়!
এদিকে তানিয়া তথা ছন্দা আর রিমির ফোনালাপ অব্যাহত রয়েছে। দু’জনেই হেসে অস্থির। বেশ কিছু সময় পর দু’জনেই ঘুমিয়ে পড়লো।
ভোরবেলা বাসায় এসে পৌঁছালো রাকিব। পৌঁছার পর টানা দুপুর পর্যন্ত ঘুমালো সে। দুপুরে খেয়ে আবারো ঘুমিয়ে পড়লো। বিকেলে উঠে একটু শো-রুম ও অফিস থেকে ফিরে এলো আবার বাসায়। সন্ধ্যার আগ থেকে আবারো ছন্দার ভাবনা।
রুমে একা একা বসে ভাবছিলো সে। এসময় রিমি এলো। বেশি একটা ভনিতা না করে সে বললো; ভাইয়া তুই কাল অত রাতে তানিয়া আপুকে ফোন দিলি কেন? তুইকি ওকে পছন্দ করিস নাকি?
রাকিব অপরাধীর মতো বললো; নারে তেমন কিছু না। আসলে আমি অন্য আরেকজনকে ভেবে ওকে ফোন দিয়েছিলাম। এবারতো ওদের বাড়িতে যাওয়া হলো না। এরপর ওর বিয়ের খবর পেলে বলিস; তোকে সাথে নিয়েই যাবো।
আচ্ছা সেদিন তোর ড্রয়ারে দেখলাম অনেকগুলো চিরকুট। সবগুলোই একজনের। কে এই ছন্দা? মিটমিটিয়ে হেসে জিজ্ঞেস করলো রিমি?
রাকিব এমনিতেই কিছুটা বিপাকে পড়ে আছে। তাই রিমিকে সব খুলেই বললো। নিজেও হালকা হলো।
সব শুনে রিমি শুধু বললো; আগে বললি না কেন? দরকার হয় আমি খুঁজে বের করতাম ছন্দাকে। আর কিছু না বলে সে হাসতে হাসতে বের হয়ে গেল।
রাতে খাওয়ার টেবিলে রিমি সবাইকে লক্ষ্য করে হাসতে হাসতে বললো; তোমরা দিন ঠিক করো আমি ভাইয়ার জন্য পাত্রী ঠিক করেছি।
রুমা বললো; তুই আবার পাত্রী পেলি কই?
মাও বললেন, খাওয়ার সময় ফাজলেমি বাদ দে। খেয়ে ঘুমাতে যা। রাকিবও ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো।
রিমি বললো; আমি সত্যি বলছি পাত্রী তানিয়া আপু।
সবাই একসাথে বলে উঠলো, তানিয়া!
এবার রাকিব ক্ষেপে উঠলো; তুই কি শুরু করলি বলতো। কাল রাতে না হয় ভুল করে ওর নম্বরে কল চলে গেছে। তাই বলে এভাবে বললি।
রিমি হেসে বললো; তুমি ওকে ফোন দিলে কিছুই বলতাম না। তবে তুমিতো ফোন দিয়েছ ছন্দাকে। তাইনা?
রাকিব বিষম খেল। মা ঝটপট তাকে পানি দিলো। তিনি রেগে যাচ্ছিলেন।
এমন সময় রিমি বলে উঠলো; একটা সহজ বিষয়কে এভাবে জটিল করোনা ভাইয়া। যে ছন্দাকে তুমি আসলে চেনইনা সে ছন্দা আর কেউনা। তানিয়া আফরীন ছন্দা।
রাকিব হাসলো; তুই চুপ করবি। নামের শেষে ছন্দাটা লাগিয়ে দিলেই হলো। রাখ এসব, খেয়ে ঘুমাতে যা। আর সবাইকে বলে দিস- ছন্দা কে আর তার সাথে আমার কি সম্পর্ক। বিশ্বাস করে আর তোকে কোনো কথা বলবো ভেবেছিস। এই বলে সে খাওয়া শেষ করে চলে গেলো।
রাতটা লাজুকতা আর ভাবনা নিয়েই কাটালো রাকিব। পরদিন কাজে গেলো তবে মন নেই কাজে। বিকেল হতেই ছুট দিল বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে। সেখানে গিয়ে আজ আর বই খুঁজলো না। লাইব্রেরিয়ানদের একটা নম্বর বলে বললো, আমার কাজিনের এক বছরের চাঁদাটা নিয়ে নিনতো।
লাইব্রেরিয়ান কার্ড বের করে বললো; উনিতো ইতোমধ্যে চার মাস পার করেছেন। দিন ভালোই হলো।
তাই নাকি? বলে রাকিব কার্ডটা হাতে নিলো। নামটা দেখে হাসলো। তবে অন্যদের বুঝতে দিলো না। রশিদটা নিয়ে বাসার দিকে চলে গেলো।
বাসায় ঢুকে রিমিকে ডাকলো। রিমি হাসতে হাসতে এসে বললো; কিছু বলবি?
রাকিব; রশিদটা ওর হাতে তুলে দিল।
রিমি বললো; যার রশিদ তাকে দে। আর এটা কই পেলি?
নগদ টাকা দিয়ে নিলাম। তুই ঠিকই বলেছিস। তানিয়াই ছন্দা। টাকা দেয়ার ছলে জানলাম।
যাক কৌশলী হতে পেরেছেন তাহলে। পেছন থেকে বললো ছন্দা।
রাকিব অবাক ও লজ্জায় যেনো দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। তুমি কখন এলে? তোমার কি ঢাকা আসার কথা ছিলো।
রিমি বললো; এসব ভনিতা বাদ দে। সন্ধ্যায় বিয়ে করবি না কটাদিন দেরি করবি? সামনের সপ্তাহ থেকে নায়েমে ওর ট্রেইনিং। আজ সকাল ১১টায় ও এসেছে আর সঙ্গে বাবা-ভাইকেও নিয়ে এসেছে। আর আমাদের কথামতো এখানেই উঠেছে। মা-বাবাও কথা পাকা করেছে। তুই চাইলে আমি বলি- বিয়ে তুলে আনার কাজ পরে সারা যাবে দিনক্ষণ দেখে। আর সব কাজ আজই সারি।
রাকিব বললো; শুভ কাজে দেরি করবি? এই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে সে নিজের রুমের দিকে হাঁটা দিলো।
ছন্দাও লজ্জায় মাথা নিচু করে চুপ করে বসে থাকলো। সন্ধ্যায় ঠিকই বিয়ের বাদ্য বাজলো।
এইচআর/আরআইপি