ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

চাকরি-বাকরির সাত-পাঁচ

প্রকাশিত: ০৭:১৫ এএম, ১৭ অক্টোবর ২০১৫

আমার পিতা ব্রিটিশ আমলের সরকারি চাকুরে, পাকিস্তান আমলে অবসর নিয়েছিলেন। পিতামহ পেশ ইমাম ছিলেন আন্দরকিল্লাহ শাহী জামে মসজিদের। ইমামতিও অবশ্য চাকুরি। থাকতেন জায়গির। বাবা বিবাহ-সূত্রে শহরে এক খণ্ড জমির মালিক হয়েছিলেন আজ থেকে আশি বছর আগে। তিনিই প্রথম এই বংশে শহরে আবাস পত্তন করলেন। তবে পিতামহকে ধরে আমি তৃতীয় প্রজন্মের নাগরিক। শিক্ষক ও সাহিত্যিক হিসেবে বাবার যোগাযোগ ছিল কলকাতা ও ঢাকায়। গ্রামের সঙ্গে আত্মিক যোগ কমে এসেছিল। তার ওপরে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের দুঃসময়ে পরিবার যখন গ্রামে তখন আমাদের এক ভাই মাত্র দু’বছর বয়সে সামান্য কৃমি উতলা হয়ে মারা গিয়েছিল। সন্তানের মৃত্যু বাবাকে ভীষণ আঘাত করেছিল। সেই থেকে গ্রামে বসবাস, এমনকি আমাদের রাত কাটানো নিয়েও তাঁর উৎকণ্ঠা ছিল বাড়াবাড়ি রকমের। গ্রামে রাত কাটাতে আমাদের আরেক দুঃসময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল। একাত্তরের শুরুতে লাগাতার গ্রামে ছিলাম প্রায় চার মাস, তখন নিজ গ্রামেও কিছুদিন ছিলাম- প্রায় পরবাসীর মতই।

বাবা ছিলেন এক ভাই, তিন বোন সংসার নিয়ে গ্রামেই থিতু বহুকাল। তাঁদের গ্রামীণ সংস্কারাচ্ছন্ন জীবনে বাবার জন্যে তেমন মানসিক প্রসাদ ছিল না, তবে কর্তব্য পালনে পরাক্সমুখ ছিলেন না তিনি। এদিকে আমাদের মাতুলকুলের বহর ছিল বিশাল- চাচাত, জেঠাত মামা-খালা মিলে দুই ডজনের কম হবে না। তাদের গ্রামের বাড়ি শহরের প্রান্ত ঘেঁষেইে ছিল এবং পরিবারের অভিভাবক আমাদের নানা কথাসাহিত্যিক মাহবুব-উল আলমের বদলির চাকুরির সূত্রে মাতুলরা বরাবর শহুরে। তাঁদের অনেকেই সমবয়েসি হওয়ায়, নিত্য সান্নিধ্যে থাকায় এবং এঁরা ছোটবড় সকলেই স্বভাবগতভাবেই আমুদে প্রকৃতির হওয়ায়, আমাদের শৈশবের পরিমণ্ডলে এঁরাই ছিলেন প্রধান চরিত্র। আমরা মামা-খালা ভাগ্নে-ভাগ্নি মিলে বিরাট দঙ্গল মজা করেই শৈশব এবং কৈশোরেরও অনেকখানি কাটিয়েছি।

এই পরিবেশে বড় হয়ে জীবনের লক্ষ্য হিসেবে বড় জোর স্বাধীন কোনো পেশার কথা ভাবা যেত, ব্যবসা নয়। তবে ছোটবেলায় অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় দূরপাল্লার ট্রাক চালক হওয়ার কথা ভেবেছি কখনও। সপ্তম  শ্রেণিতে একবার একটি ছক পূরণ করতে গিয়ে স্বাধীন পেশা আইনজীবী হওয়ার আকাক্ষা ব্যক্ত করেছিলাম। শিক্ষার উচ্চ পর্যায়ে পৌঁছুতে পৌঁছুতে বাবার মত অধ্যাপনা পেশার কথাই ভেবেছি সম্ভবত। তবে জোরালো এবং স্পষ্টভাবে কোনো পেশাগত লক্ষ্য আমার জীবনকে চালিত করে নি।

এর কারণ কলেজে ঢুকে ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিলাম। সেটা আমাকে শিক্ষাঙ্গনের গণ্ডি ছাপিয়ে দেশ ও জনমানুষের ভাবনায় টেনে নিয়ে গেল। সেই থেকে আমার বিবেচনার মধ্যে দেশ ও মানুষ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠল। মানুষের কল্যাণ, ভবিষ্যত, দেশের রাজনীতি, বিশেষত তৎকালীন ক্ষমতাসীন আইউবশাহীর রাজনীতির হালচাল ও গতিপ্রকৃতি বোঝার গুরুত্ব অনুভব করলাম। সংগঠন ও সাংগঠনিক কাজে বেশ জড়িয়ে পড়েছিলাম তখন।

আবার এই সময়ে সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার ঝোঁকও তৈরি হচ্ছিল। বছর দুয়েক পরে সহপাঠী কবি আলতাফ হোসেন এবং বয়োজ্যেষ্ঠ কিন্তু বন্ধু হয়ে ওঠা সদ্য অধ্যাপনায় যোগ দেওয়া কবি মোহাম্মদ রফিকের সান্নিধ্যে লেখা ও সাহিত্যপাঠের ঝোঁক প্রবল হয়ে উঠল। তার সাথে আলতাফের কল্যাণে রবীন্দ্রসঙ্গীত এবং উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শোনারও অভ্যাস তৈরি হয়ে গেল।

একটা টানাপোড়েন তৈরি হল মনের মধ্যে। সাহিত্য ও সঙ্গীতের যে অবাধ অসীম আনন্দময় এক শাশ্বতের জগত আছে তার সাথে যেন রাজনীতির সাংগঠনিক দায় আর নানা কৌশলী পদক্ষেপকে খণ্ডিত ও তাৎক্ষণিকের দায় বলে মনে হল, মানিয়ে নেওয়া কঠিন হচ্ছিল। ঐ বয়সে এসব ভাবনা সংবেদনশীল মনে ব্যাপক আলোড়ন চালায়, গভীর নৈতিক দ্বন্দ্বের সূচনা করে এবং মারাত্মক মানসিক সংকটে ফেলে দেয়। একা একাই এ টানাপোড়েন বহন করতে হয়েছে। তখনকার মতো সাংগঠনিক রাজনীতি থেকে সরে এসেছিলাম। তবে, মুক্তিযোদ্ধারা যেমন বলেন অস্ত্র জমা দিলেও ট্রেনিং জমা দেই নি, আমিও তেমনি সংগঠন ছেড়েছি বটে কিন্তু রাজনীতির বোধ কখনও ছাড়ি নি। রাজনীতিই প্রথম আমাকে শিখিয়েছে নিজের গণ্ডিকে বাড়িয়ে বাড়িয়ে দেশ ও মানুষকেও তাতে অন্তর্ভুক্ত করে নিতে। এরকম অন্তর্ভুক্তি আরও বাড়িয়েছে আমাদের বামপন্থার রাজনীতির তৎকালীন সংস্কৃতি। তাতে স্বদেশ ও বিশ্ব, শিল্পকলা ও সংস্কৃতি, সমকাল ও ভবিষ্যত, ঐতিহ্য ও সম্ভাবনা, নান্দনিক রুচি ও বৈজ্ঞানিক যুক্তিবিবেচনা, মননশীলতা ও বিনোদন ইত্যাদি মানবজীবনের ইতিবাচক সব উপাদান ছিল বিবেচনা ও চর্চার অন্তর্ভুক্ত। এর সাথে সাহিত্য ও সঙ্গীতের আগ্রহ আমার চেতনার জগতে নতুন মাত্রা যোগ করেছিল।

তখন, সম্ভবত তখনই, চাকুরি আর কাজের পার্থক্য সম্পর্কে ধারণা হচ্ছিল। খুব গুছিয়ে হয়ত ভাবনাটা আসে নি, কিন্তু চাকুরি যে নেহায়েৎ ব্যক্তিগত বিষয়, জীবনধারণ ও সংসার প্রতিপালনে সীমাবদ্ধতা তা বেশ বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু সম্ভবত তখন এটুকুই। চিন্তাজগতের সংকট কাটিয়ে জীবনকে বোঝা, জীবনের নানান বাঁকের সাথে পরিচিত হতে থাকা এবং উপভোগের আনন্দে মেতে ছিলাম তখন। জীবনের কাজ, জীবনসাধনার মত ধারণা রবীন্দ্রনাথের লেখা, বিশেষত তাঁর শান্তিনিকেতন, ধর্ম ও সাধনার মত বাণী-প্রধান লেখার সূত্রে তৈরি হচ্ছিল। মুক্তিযুদ্ধ এই যাত্রাপথে একটা ছেদ টানল- সাময়িকভাবে। তখন পাকিস্তানি সামরিক বাহিনি, তাদের এদেশীয় দোসর এবং সরকারের অত্যাচার-মিথ্যাচার একদিকে তটস্থ রেখেছে আমাদের আর অন্যদিকে স্বাধীনতার স্বপ্ন, মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় কিন্তু ভয়ঙ্কর বাস্তবতা, শত্রুর দখল থেকে স্বদেশকে মুক্ত করার জরুরি তাগিদ এবং জয়  ও পরাজয়ের তীব্র দ্বন্দ্ব আমাদের ব্যতিব্যস্ত রেখেছিল। এই টানাপোড়েনে যুদ্ধ ও জয় ছাড়া আর কিছুই ভাবার অবকাশ ছিল না।

যুদ্ধ এক কঠোর ভয়ঙ্কর তীব্র বাস্তবতা, কিন্তু স্বাধীনতা এমনই এক অজেয় দুর্বার স্বপ্নময় ভালোবাসা যা এই বাস্তবেরও সব দেয়াল গুঁড়িয়ে দিতে সক্ষম। তেইশ বছরের তরুণ এই ভয়ঙ্কর সুন্দর বাস্তবতা আর বেপরোয়া প্রেম স্বাধীনতার দ্বিচারী সওয়ারি হয়ে নতুন দেশে নতুন দিনে নানান চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি এসে দাঁড়াল।

২.
স্বাধীনতার ছায়াসঙ্গী হল স্বপ্ন, সে স্বপ্ন ভীষণ সংক্রামক, বেপরোয়াভাবে উস্কানিমূলক, ছোটবড় কাউকেই রেয়াত দেয় না, সব্বাইকে টেনে নামায় অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলার চ্যালেঞ্জের সামনে। সদ্য স্বাধীন দেশে চারিদিকে শুরু হল নতুন নতুন উদ্যোগ। ভাগ্য পরিবর্তনের উচ্চাশায় নেমেছে অনেকেই, তবে বেশির ভাগের মাথায় ছিল দেশ, মানুষ, ভবিষ্যত- কিছু করা দেশের জন্যে।
শিক্ষিত বাঙালি মাত্রেরই লেখার বাতিক থাকে- কেউ কবি-লেখক হতে চান, কেউ বা সাংবাদিক। পত্রিকা বেরুতে থাকল অনেক। চট্টগ্রাম থেকেও অমর বাংলা, দেশবাংলা, নয়াবাংলা, সেই সঙ্গে স্বাধীনতা। স্বাধীনতার প্রকাশক আবদুল্লাহ আল হারুন চৌধুরী। এই আওয়ামী লীগ নেতা পারিবারিকভাবেই প্রগতিশীল মানুষ, সাংস্কৃতিক কাজকর্মে বরাবর যুক্ত ছিলেন। সম্পাদক হিসেবে বসালেন জ্ঞাতি ভাই একুশের প্রথম কবিতা কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি-র রচয়িতা কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরীকে। তাঁকে জানতাম চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের এককালের প্রধান সংগঠক হিসেবে। তাঁর বাড়িতে একবার নাটকের মহড়া দিয়েছিলাম আমরা।

এসএসসি পরীক্ষার পরবর্তী অবকাশে ১৯৬৫ সনের এপ্রিল-মে মাসে ডা. কামাল এ খানের পরিচালনায়। এই পত্রিকায় যোগ দিয়েছিল সহপাঠী সৈয়দ শফিক উদ্দিন আহমদ। ভালো সংগঠক, বন্ধুবৎসল, ভালো মানুষ। তার ডাকে আমিও যোগ দিলাম কাগজে, সহকারী সম্পাদক হিসেবে। সেই আমার সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয় লেখায় হাতেখড়ি- জানুয়ারির বাহাত্তরে। তখন চব্বিশে পা রেখেছি। সম্পাদকীয় লেখায় মাঝে মাঝে বিরতি পড়লেও উপসম্পাদকীয় লেখা চলছেই, কখনও প্রায় বিরতিহীন, প্রতি সপ্তাহেই লিখেছি, আর লিখে চলেছি আজ তক। এই আমার প্রথম চাকুরি- সম্ভবত মাইনে সাড়ে তিনশ’র মত ছিল। নানা সাহিত্যিক মাহবুব-উল আলম ছিলেন সম্পাদক। অবসর নেওয়ার পরে নিজেই প্রকাশ করেছিলেন দৈনিক জমানা। দুই মামা সায়ফুল আলম আর মঈনুল আলম ছিলেন ঢাকার কাগজের প্রতিনিধি, রিপোর্টার। তাই বলা যায় সাহিত্যের মত সাংবাদিকতাও আমার উত্তরাধিকারে ছিল।

তবে সেবারে দ্রুতই আমার চাকুরির অবসান হল। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল আমাদের অনার্স পরীক্ষার একটি পেপার বাকি থাকতেই। ঘোষিত হল, ঐ সাতটির ওপর ফলাফল হবে। দ্বিতীয় শ্রেণিতে দ্বিতীয় হলাম- সেকালে ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম শ্রেণি ছিল দুর্লভ ব্যাপার। বন্ধু দিবাকর প্রথম হয়েছিল। আমি আর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ করতে চলে এলাম মার্চে। পরের বছর এপ্রিলে এমএ পরীক্ষা দিয়ে চট্টগ্রাম ফিরে এসে বাবার চিঠি হাতে ওমরগণি এমইএস কলেজের অধ্যক্ষের সাথে দেখা করলাম। তখন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ বাংলার আজিজুল বারী, জানালেন আমার মেজ ভাইয়ের সহপাঠী এবং বাবার ছাত্র ছিলেন। ইংরেজির শিক্ষক, একরকম লুফেই নিলেন, বেতন সাড়ে তিনশই, বাড়তির জন্যে নাইট কলেজে পড়ানোর সুযোগের কথা বললেন। পিছপা হলাম না। আমার চেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ আর সমবয়সীদের শিক্ষক হয়ে গেলাম। বাড়তি জুটল মাসে দেড়শ টাকা। সেই ১৯৭৩ সনে পাঁচশ টাকার বাজার দর বেশ ভালো। তখন বন্ধুদের মধ্যে আমিই উপার্জন করছি। বাড়িতেও কোনো খরচ দিতে হয় না। ফলে বই কেনা, গানের রেকর্ড কেনা, বন্ধুদের নিয়ে খাওয়া এবং ঘোরাঘুরিতেই টাকা খরচ হত বেশি।

ঐ সময় আমাদের শৈশব-কৈশোরের নেতা মামা সবিহ উল আলম চট্টগ্রামে চারুকলা কলেজ গড়ে তোলার কাজে হাত দিয়েছেন। তিনি খবর পাঠালেন ইংরেজি পড়ানোর জন্যে যোগ দিতে, সঙ্গে বাংলার জন্যেও একজনকে নিয়ে আসতে। বলা যায়, নাচতে নাচতে গিয়ে হাজির হলাম, সঙ্গে নিয়ে গেলাম বন্ধু আলতাফকে, বাংলার শিক্ষক পদের জন্যে। জানা গেল, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এসএসসি পর্যায়ে প্রি-ডিগ্রির প্রথম বর্ষ চালু হবে মাত্র। তাই আপাতত খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবেই যোগ দেওয়া যাবে। তথাস্তু, লেগে গেলাম কাজে। যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের আর কোনো প্রতিষ্ঠান নেই তাই এর সিলেবাসও আমাদেরই তৈরি করতে হবে।

মনে আছে ইংরেজিতে প্রিয় কবি রিলকে ও ইয়েটস-এর কবিতা ঢুকিয়েছি, গদ্যে অস্কার ওয়াইল্ড, আন্তোন চেখভের গল্প দিয়েছি। বাংলায়ও সেভাবেই পছন্দের লেখা থেকে বেছেছি। তখন খুব পছন্দের একটি গল্প ছিল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পথে-বিপথে বইয়ের একটি গল্প। মনে হল চারুকলার ছাত্রদের জন্যে ভালো খোরাক হবে। নন্দলাল বসুর প্রবন্ধ, রবীন্দ্রনাথের গল্প আর সৌন্দর্য বিষয়ক প্রবন্ধ। কবিতায় সম্ভবত শামসুর রাহমানের বন্দী শিবির থেকে বইয়ের কাক কবিতাটা নিয়েছিলাম। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ তো ছিলেনই, শক্তি-আল মাহমুদও নিয়েছিলাম সম্ভবত।

দু’ বছর পরে কলেজ বড় হয়েছে, প্রথম ব্যাচ প্রি-ডিগ্রি শেষ করে ডিগ্রি প্রথম বর্ষে উঠেছে, তাদের নন্দনতত্ত্ব পড়াতে হবে। মামার খুব ভরসা ছিল আমার ওপর। দায়িত্বটা আমাকেই দিলেন, আর বড় হতে থাকা কলেজের উপাধ্যক্ষের দায়িত্ব নিয়ে পূর্ণকালীন স্থায়ীপদে যোগ দিতে বললেন। চ্যালেঞ্জটা নিয়েই নিলাম। ছেড়ে দিলাম ওমরগণি কলেজের কাজ। কিছু পাওনা বাকি থেকে গেল।

তখনও কলেজের পরিবেশ একেবারেই ইনফর্মাল, গাছতলায় ক্লাস নিতাম। নতুন বিষয়ের নাম দিয়েছি কান্তিবিদ্যা। বাংলাদেশে কোথাও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এস্থেটিকস পড়ানোর এই হল শুরু। সিলেবাস আমিই করেছিলাম। তত্ত্বকথার কচকচির দিকে না গিয়ে আমি বেছে নিয়েছিলাম একদিকে অবন ঠাকুর-রবীন্দ্রনাথের ধারাটি, অর্থাৎ শিল্পকলা ও সৌন্দর্য নিয়ে মুক্ত আলোচনার ধারা আর অন্যদিকে হাবার্ট রিড, লরি বেইটস, গমব্রিখের মত পশ্চিমা শিল্প সমালোচকদের মননশীল বিশ্লেষণী ধারার সমন্বয়ের ওপর। একদিকে ছাত্রদের অনুভূতি ও কল্পনার ব্যাপ্তি ও গভীরতা বাড়িয়ে তাদের ভাবনা যেন সংবেদনশীলতায় প্রগাঢ় হয়ে ওঠে সে চেষ্টা করেছি।

অন্যদিকে চেষ্টা ছিল যেন ছাত্রদের পর্যবেক্ষণ ও তলিয়ে বিচারের ক্ষমতা এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যাতে শিল্পের নিষ্ক্রিয় দর্শক থেকে তারা সক্রিয় সমঝদারে উন্নীত হওয়ার মত সামর্থ্য অর্জন করে। তাতে কতটুকু সার্থক হয়েছি জানি না, কিন্তু বুঝতে পারতাম ওরা ক্লাসটা উপভোগ করছে, আর আজ চল্লিশ বছর পরেও যখন দেখি তাদের অনেকেই সেইসব দিনের কথা স্মরণ রেখেছে তখন কিছুটা যে সফল হয়েছিলাম তা বুঝতে পারি, বুঝে স্বস্তি অনুভব করি। কেউ কেউ এখনও দেখা হলেই তাদের শিল্পবোধ তৈরির পিছনে এই ক্লাসের ভূমিকার কথা বলে। এক ছাত্রী সবচেয়ে বড় স্বীকৃতি দিয়েছিল। এই অকালপ্রয়াত প্রতিভাময়ী ছাত্রীটি ছিল অস্থির এবং তার বর্তমান বাস্তবতা নিয়ে বরাবর অতৃপ্ত। ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পাল্টেছে অনেক। আমার কাছে পড়েছে বছর দুই। ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্রী, বাংলা জানে কম, অবন ঠাকুর-রবীন্দ্রনাথ পড়ার অভ্যাসই ছিল না। আমাদের কলেজে এসেছিল ঢাকা আর্ট ইন্সটিটিউট (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি) আর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করে, এক রাশ অসন্তুষ্টি আর বিদ্রোহী মেজাজ নিয়ে। ওর সঙ্গে ছিল আরও দু’জন ছেলে সহপাঠী। এরকম বিদ্রোহী অসন্তুষ্ট তরুণদের মন জয় করা একটা বাড়তি চ্যালেঞ্জ ছিল আমার জন্যে। তবে ওরা কলেজ থেকেই ডিগ্রি শেষ করেছিল। পরে ছাত্রীটি শান্তিনিকেতন, বরোদা এবং শিকাগোতেও পড়েছে, কিন্তু তার নাকি আমার পড়ানোটাই মনে হয়েছে সবচেয়ে ভালো, তার ছবি আঁকার কাজে লেগেছে।

ঐ সময় কলেজের ছাত্রদের সাথে মিশেই কাটিয়ে দিচ্ছিলাম সময়। ওদের নিয়ে নাটক করেছি- রবীন্দ্রনাথের শেষের রাত্রি গল্পের নাট্যরূপ দিয়ে একবার, একবার রক্তকরবীর অংশবিশেষ, আরেকবার ভ্যান গঘের জীবন নিয়ে আর্ভিং স্টোনের লেখা বই লাস্ট ফর লাইফ অবলম্বনে আমার লেখা নাটক জীবন মানেই তৃষ্ণা- পুরো আড়াই ঘণ্টার নাটক। খুব জমেছিল থর্নটন ওয়াইল্ডারের নাটক এ হ্যাপি জার্নির আমার করা বাংলা রূপান্তর সুখযাত্রা। পুরো নাটকটাই স্বামী-স্ত্রী আর পুত্র-কন্যার গাড়িযাত্রার ওপর। চারটা ফোল্ডিং চেয়ার দিয়ে গাড়ি বানিয়েছিলাম। মামা-মামি হয়েছিল স্বামী-স্ত্রী এবং কলেজের ছাত্রছাত্রী নেওয়াজ আর রীতা হয়েছিল তাদের ছেলেমেয়ে। বড় বোনের ভূমিকায় ছিল শারমিন (এখন শিল্পী আবুল বারক আলভীর স্ত্রী।) আমার বিবেচনায় এ নাটকের উপস্থাপনা ছিল খুবই আধুনিক। কলেজের তৎকালীন ভবনের বারান্দা আর সামনের বাড়ির রাস্তাটা মঞ্চ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল।

কিন্তু পরের বছর চারুকলা কলেজে হঠাৎ করে অভাবনীয় এক গোলমাল শুরু হল অধ্যক্ষকে সরানোর জন্যে। আমার প্রিয় মানুষ, তার ওপর মামা- খুবই নাজুক অবস্থা হল আমার জন্যে। মামা কলেজটা নিজ সন্তানের মত যত্নে সর্বস্ব দিয়ে গড়ে তুলেছিলেন। শিক্ষক ও ছাত্ররা ছিল ছোট ভাই আর সন্তানের মত। সেই শিক্ষকরা প্রায় একাট্টা হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে লাগল, আর ছাত্রদের একটা অংশও বৈরি শিক্ষকদের পক্ষে চলে গেল। গভীর বেদনা ও কষ্টে মামা সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। আমাকে অনুরোধ করলেন তাঁর চলে যাওয়ায় বাদ না সাধার জন্যে। মামার মনের অবস্থা দেখে এ অন্যায় কাজ নীরবে হতে দিলাম এবং যাতে তিনি ঝামেলা ছাড়া সহজেই চলে যেতে পারেন তাই রাজি হলাম ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব নিতে। এভাবে ১৯৭৬ এর মাঝামাঝি আমি সাতাশ বছর বয়সে একটি কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্বে নিয়োজিত হলাম।

দায়িত্ব নিলেও মনে মনে ঠিক করেছি যেখানে এত অন্যায় কাজ হয়েছে সেখানে বেশি দিন থাকব না। প্রথম সুযোগেই ছেড়ে দেব। সুযোগ এলো পরের বছর- নভেম্বর নাগাদ ছেড়ে দিলাম চারুকলা কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের পদ। তবে ছাত্রদের জন্যেই এস্থেটিকস পড়ানো আরও কিছু দিন চালিয়ে গেলাম।

৩.
না বেকার থাকতে হয় নি। নভেম্বরেই হঠাৎ একদিন ওয়াহিদভাই- দেশের বরেণ্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সঙ্গীতজ্ঞ ওয়াহিদুল হক- চট্টগ্রামে একেবারে বাড়িতে এসে হাজির। কী ব্যাপার? না, একটা ইংরেজি কাগজ বেরুবে চট্টগ্রাম থেকে, সেটার দায়িত্ব নিয়ে এসেছেন। সঙ্গে নিয়ে এসেছেন স্ত্রী ফ্লোরা আর পুত্র এষণকে। আমি বললাম, কাজ করব। উনি বললেন, তোমাকে সঙ্গে চাইতে তো এসেছি। ডিসেম্বরেই যোগ দিলাম আনোয়ারুল ইসলাম ববির প্রকাশিতব্য ইংরেজি দৈনিক ডেইলি লাইফে। আবারও সহকারী সম্পাদক, সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয় লেখার দায়িত্ব। এবারে ইংরেজিতে, বেতন ছ’শ।

নিশ্চিত হলাম বেকার হতে হচ্ছে না। সাতাত্তরের ফেব্রুয়ারিতে বিয়ে করেছি। যদিও চাকুরির জন্যে সেটাকে শর্ত হিসেবে কখনও মানি নি তবুও সংসার প্রতিপালন বলে কথা। চাকুরির প্রসঙ্গে দুটি কথা বলে নেওয়া ভালো। তিয়াত্তরের গোড়ায় পড়ালেখা শেষ করলেও তখন তো সদ্য স্বাধীন দেশটি, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটি গড়ে তোলার কাজের কথাই মাথায় ঘুরেছে। ভাবতাম, আমার মত সুযোগপ্রাপ্ত বাড়ির ছেলেও চাকুরিতেই নিজেকে সঁপে দিলে তো হবে না, দেশের কাজ দশের কাজ কে করবে? তখন বলতাম, আমাদের মত পরিবারের শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা যদি দেশ গড়ার কাজে না লাগে তাহলে তাদের জন্যে সেটা স্বার্থপরতার ব্যাপার হবে, মানুষ হিসেবে বরাবর ছোট হয়ে থাকবে। বলতাম, মানুষের পাঁচ মৌলিক চাহিদার যে কোনো একটিতে, ব্যক্তিগত জীবনের বাইরে গিয়ে, সেবা দেওয়া উচিত, নয়ত ঠিকঠাক মানুষ থাকা সম্ভব নয়। কোনো না কোনোভাবে জীবনে স্বার্থের কালিমা লাগবেই। তখনই ভেবেছি আমার তেমন কাজের ক্ষেত্র হবে শিক্ষা।

শিশুদের নিয়ে কাজ শুরু করি পঁচাত্তর থেকে। তা-ই ক্রমে বড় আকার নিয়ে শিশুপ্রতিষ্ঠান ফুলকির মাধ্যমে শিশু শিক্ষার ক্ষেত্রে একটা ভূমিকা পালন করছে। চাকুরির ক্ষেত্রে দ্বিতীয় ধারণাটি একটু মজারই বলা যায়। একটু হালকা চালে বলতাম, এক চাকুরি বেশিদিন করব না, পাঁচ বছরের বেশি নয়, কারণ এর চেয়ে বেশি হলে সংশ্লিষ্ট অফিসে কায়েমি স্বার্থের অংশ হয়ে যেতে হয়। কথাটা হয়ত কেউই তেমন সিরিয়াসলি নেন না, আমি কিন্তু ভিতরে ভিতরে এমনটাই বিশ্বাস করতাম। সম্ভবত এখনও করি।

এ কথাটাও বলে রাখি, আমি যেসব চাকুরি করেছি তখন পর্যন্ত সবই এক অর্থে ইনফর্মাল গোছের, নিজেদের তৈরি করা চাকুরি। একে কি ঠিক চাকুরির মর্যাদা দেওয়া যায়? বাবা একদমই পারতেন না। আমাদের বাড়িতে জোর খাটানোর রেওয়াজ নেই, কিন্তু মতামত দেওয়া আর সমালোচনার রেওয়াজ ভালোই ছিল। বাবা তাঁর বন্ধুদের বলতেন, ও এখনও ঠিক কিছু করে না। তখন কিন্তু আমি একটি কলেজের অধ্যক্ষ- চারুকলা কলেজ হোক না বেসরকারি, কলেজ তো। উনি চাইতেন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেই। বাবা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সেই ১৯৭৩ থেকেই মাঝে মাঝে এ প্রস্তাব ও চাপ এসেছে। কিন্তু বাবা উপাচার্য বলে ওখানে চাকুরিতে ঢুকতে আমার বাধো বাধো ঠেকতো। তাই প্রায়ই একটু হাল্কা চালে বলতাম, না এটা নীতিগতভাবে ঠিক হয় না। শুভানুধ্যায়ীরা বোঝাতেন, তুমি তো দরখাস্ত করে ইন্টারভ্যু দিয়ে তোমার যোগ্যতা প্রমাণ করেই আসবে। আমি রাজি হতাম না। বাবা একবার আনিস স্যারকে দিয়েও বলালেন। উনি মৃদুভাবে বলেছিলেন, তুমি এলে আমরা খুশি হব। আবার আমার প্রাক্তন শিক্ষক ও চট্টগ্রাম কলেজের ডাকসাইটে অধ্যক্ষ প্রফেসর মোজাফফর আহমদ-  তখন উনি অবসর নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন পড়াতেন, ফোনে চেপে ধরেছিলেন, বলেছিলেন এটাই উপযুক্ত সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার। তারপর ইংরেজি প্রবচন দিয়ে বলেছিলেন ইউ মাস্ট স্ট্রাইক দ্যা আয়রন হোয়েন ইট ইজ হট। অত্যুৎসাহী অধ্যাপক হায়াৎ হোসেন রীতিমত ফর্ম নিয়ে এসে ওঁর স্টাইলে চাপ দিয়েই বলেছিলেন।

তবুও আমি দ্বিধা কাটাতে পারিনি। আমাকে প্রথাগত কোনো প্রতিষ্ঠানের আনুষ্ঠানিক চাকুরি একেবারেই আকৃষ্ট করে নি কখনও। নিশ্চিত বাঁধা জীবন আমার মনে হাঁপ-ধরানো অনুভ‚তি নিয়ে আসতো। বন্ধুদের বলতাম, এখন বাংলাদেশে সব প্রতিষ্ঠানই ক্ষয়িষ্ণু, বড় প্রতিষ্ঠানে যুক্ত হয়ে একজন ব্যক্তি কিইবা আর করতে পারে? তাকেও বরং ক্ষয়ের শিকার বা অংশীদার হতে হবে। আমি এত সহজে গতানুগতিক পথে বশ্যতা মানতে রাজি নই। স্বাধীনতার পর থেকে ভিতরে ভিতরে আমার মনপ্রাণ মুখিয়ে ছিল দেশ পুনর্গঠনের কাজে অংশ নেওয়ার জন্য। কিন্তু তখন সর্বত্র এমনভাবে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ জাঁকিয়ে বসেছিল যে তাতে অন্যদের জন্যে অংশগ্রহণের কোনো সুযোগ ছিল না। খুবই হতাশ বোধ করে ছটফট করছিলাম। এ সময়ে এমএ তে একদমই পড়াশুনা করি নি। আমার মনে হচ্ছিল না, সিলেবাসে বাঁধা বিষয় নিয়ে ছাত্র-পড়ানোর জন্যে আমার ঐ সময়কার মন তৈরি ছিল। জেনে বুঝে তো আর অসফল হওয়ার জন্যে কোনো কাজ করা যায় না। আমি আনন্দ পাচ্ছিলাম চারুকলা কলেজে এস্থেটিকস পড়িয়ে, আমরা যে বিষয়টির নামকরণ করেছিলাম কান্তিবিদ্যা। তা পড়াতে গিয়ে খোলামেলা পরিবেশে খোলা মনে মুক্ত আলোচনার যে ধারা তৈরি করেছিলাম তাতে ছাত্ররা এবং আমি নিজে, এবং কর্তৃপক্ষও অর্থাৎ সব পক্ষই খুশি ছিলাম।

যা হোক, ওয়াহিদ ভাইয়ের নেতৃত্বে ডেইলি লাইফ প্রকাশিত হল আটাত্তরের জানুয়ারি থেকেই। ওয়াহিদ ভাইয়ের সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা আমার চেতনা ও চিন্তার জগৎকে অনেক প্রসারিত করে দিল। উনি সংবাদপত্রের এবং মুদ্রণের খুঁটিনাটি সব বিষয়ই জানতেন। আদতে কোন বিষয়ে যে ওঁর আগ্রহ নেই, জানা-বোঝা নেই, তাই ভেবে আমরা অবাক হতাম। তখন থেকে বহুকাল আমরা ওঁর মুগ্ধ শ্রোতা। রবীন্দ্রসঙ্গীতের এবং সঙ্গীতের গভীর রসের সন্ধানও তাঁর সূত্রে পেতে থাকি। অফিসে বসে বসে ধৈর্য ধরে আমাদের সবার ভুল শোধরাতেন আর নিজে প্রচুর লিখতেন। তাঁর কাজ দেখে দেখে সম্পাদনা শিখেছি, অন্যের আপাত তুচ্ছ লেখা যত্ন করে খুঁটিয়ে পড়ার অভ্যাসটা আয়ত্ব করেছি। কাউকেই, যে দৃশ্যত অযোগ্য তাকেও, অবহেলা না করে শেখানোর চেষ্টা করে দেখা উচিত বলে ভাবতে শিখেছি। তাতে ছোটবড়, যোগ্য-কমযোগ্য, মেধাবী-বোকাসোকা নানা জাতের মানুষের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক দাঁড়িয়ে যায়।

ওয়াহিদ ভাইয়ের আরেক বাতিক ছিল দলেবলে হৈ হৈ করে বেড়াতে বেরুনো। ডেইলি লাইফ অফিস ছিল সদরঘাটে, কর্ণফুলির পারে। ব্যাস, প্রায়ই দল বেঁধে সাম্পানে চেপে নৌবিহারে মেতেছি আমরা। এ সময়ে রাতজাগা, ওয়াহিদ ভাইয়ের দেখাদেখি যেকোনো অবস্থার সাথে মানিয়ে নেওয়ার অভ্যাস রপ্ত করার চেষ্টা করেছি। উনিই জানালেন, নিউজপ্রিন্টে দারুণ উম পাওয়া যায়। শীতকালে অফিসে ঘুমোতে হলে গায়ে দেওয়ার জন্যে কাঁথার বিকল্প হিসেবে একেবারে মোক্ষম।

সে বছরই জুলাই মাসে সম্ভবত ওয়াহিদ ভাইয়ের সাথে ববির সম্পর্কে চ‚ড়ান্ত ফাটল ধরলো। আগেও খুঁটিনাটি সমস্যা হচ্ছিল, কিন্তু ববি তখনই ওঁকে হারাতে চায় নি। নিজে যেচে মিটিয়েছে সমস্যা। কিন্তু এবার সে-ই যেন বেঁকে বসল। ওয়াহিদ ভাই দেখলাম ক্রুব্ধ, বিধ্বস্ত- এরকম চেহারা ওঁর দেখিনি আগে। বললেন রিজাইন করব। ওটাই যেন আমাদের জন্যেও নির্দেশ হিসেবে এলো। আমরা এগারজন ওঁর চ্যালা এক কথায় রিজাইন দিয়ে বসলাম।

ওয়াহিদ ভাই এবং আমাদের পদত্যাগকে ইস্যু করে চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়ন আন্দোলনের কথা ভেবেছিল। কিন্তু কার্য ক্ষেত্রে দেখা গেল, ওয়াহিদ ভাই ছাড়া আমরা নবিশ সাংবাদিকরা কেউই ইউনিয়নের সদস্যও নই। আমাদের জন্যে ওরা আন্দোলন করলেও তার আইনগত ভিত্তি থাকবে না। অর্থাৎ তাতে ববিকে চাপে ফেলা যাবে না, ও নিজে থেকে আপোস না করলে সমস্যা মিটবে না।

শেষ পর্যন্ত চাপও তৈরি করা যায় নি, ববিও আপোস করে নি। তবে আমাকে একান্তে ডেকে ববি বারবার বলেছিল, মোমেন তুমি কেন ছাড়ছ, তোমার সঙ্গে তো আমার কোনো সমস্যা নেই। তখন তো ওয়াহিদ ভাইয়ের ভাগ্যের সাথে আমাদের ভাগ্যকে জড়িয়ে নিয়েছি। ফলে ববির নরমকথায় চিড়ে ভেজে নি। আগের মতই এখানেও কিছু পাওনা ফেলে চলে এসেছি। এদিকে তার আগেই এই চাকুরির ওপর ভরসা করে শীলাকে নিয়ে নিজেদের স্বতন্ত্র সংসার পেতেছি, রহমতগঞ্জে ছাদের ওপর ছোট্ট দুই রুমের ঘর। বেতন ছ’শ, বাড়িভাড়া চারশ। এর সঙ্গে ছিল ফুলকি থেকে শীলার দেড়-দু’শ টাকা আর আর্ট কলেজ থেকে কান্তিবিদ্যা পড়ানো বাবদ আমার দেড়-দু’শ টাকা। ফলে বাঁধা চাকুরি ছেড়ে একটু বিপদেই পড়লাম। তবু বলব না, ঝোঁকের মাথায় চাকুরি ছেড়েছি। ওয়াহিদ ভাইয়ের কল্যাণে আমার ঐ চাকুরি পাওয়া, ফলে আমি মনে করেছি ঐ চাকুরির ক্ষেত্রে নৈতিকভাবে আমার একটা দায় থেকে যায় ওঁর কাছে। ওঁর অসম্মান আমার গায়েই লাগে, মনে হল ওঁকে যে মালিক চাকুরি করতে দেয় না, তার সাথে আপোস করে থাকার মধ্যে যে গ্লানি তা আমি বইতে পারব না। ফলে ডেইলি লাইফ ছাড়া ব্যতীত আমার সামনে আর কোনো পথ ছিল না।

তবে সাথে সাথেই সামনে তৈরি হয়ে গেল অন্য একটি সম্ভাবনা, লোভনীয় স্বপ্ন। ওয়াহিদ ভাইকে সামনে রেখে চট্টগ্রাম থেকে একটি বাংলা দৈনিক বের করার প্রস্তাব দিলেন অনেকেই। ওয়াহিদ ভাইও তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে যে নতুন নিরীক্ষা চালাচ্ছিলেন তাতে তখনই ক্ষান্তি দিতে চাইলেন না। তা আরেকটু চালিয়ে যেতে চাইলেন। ফলে উনিও এ প্রস্তাব কাজে পরিণত করার জন্যে চট্টগ্রামে থেকে যাওয়ার চিন্তাই করলেন।

এ নিয়ে অনেকেই দৌড়ঝাঁপ শুরু করলেন। কিন্তু তখন জিয়ার সামরিক শাসন। সামরিক স্বৈরাচারের কঠিন ফাঁসে  হাঁসফাঁস করছে তখন সংবাদপত্র ও মুক্তচিন্তা। সামরিক শাসনের ফাঁক গলে ডিক্লারেশন বের করা যে বেশ অবাস্তব কল্পনাই তা তখন প্রয়োজনের চাপে আমরা কেউই গুরুত্ব দিয়ে ভাবি নি। একইভবে ফ্লোরার ওপর নির্ভর করে ব্যক্তিগত জীবনের নিরীক্ষাও ওয়াহিদ ভাইয়ের জন্যে সম্ভবত অবাস্তব চিন্তাই ছিল। ফ্লোরাকে নিয়ে তাঁর পক্ষে শান্তি স্বস্তিতে সংসার করা ছিল প্রায় অসম্ভব। জিয়ার শাসনদণ্ড গলে ওয়াহিদ ভাইয়ের জন্যে পত্রিকার ডিক্লারেশন আদায় যেমন ছিল অসম্ভব তেমনি ফ্লোরার সাথে তাঁর গুছিয়ে ঘর করা ছিল অসম্ভবের পায়ে মাথা কোটা। তখনকার মত পত্রিকা হল না, ওয়াহিদ ভাইয়ের এ সংসারে ভাঙনও ঠেকানো গেল না। ভয়ঙ্কর হিংসাত্মক কিছু ঘটার আশংকায় আমরাও কেউ চাই নি এ সম্পর্ক উনি আর এভাবে টানুন।

তবে সেই বাংলা পত্রিকার স্বপ্ন- যেটি হবে আধুনিক রুচিশীল পত্রিকা, চট্টগ্রামকে কালোপযোগী মানে তার সার্বিক অগ্রবর্তিতাসহ প্রতিনিধিত্ব করবে, সেটি শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়েছিল। কেবল ততদিনে আরও সাত বছর অতিবাহিত হয়েছে। ওয়াহিদ ভাইয়ের কিন্তু এ জীবনে আর সংসার করা হয় নি, যদিও সাংবাদিকতায় ফিরতে পেরেছিলেন কয়েক বছরের জন্যে। দৈনিক পূর্বকোণ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৬ সনের ফেব্রুয়ারিতে। সেই সাথে শুরু আমার চাকুরি জীবনের পরের পর্ব।

লেখক : কবি, চিন্তাবিদ

এইচআর/এমএস