মুক্তিযুদ্ধে দোভাষী কবি গোপীচাঁদের অবদান অনস্বীকার্য
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি মণিপুরীসহ নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর রয়েছে অকৃত্রিম ভালোবাসা। এই ভালোবাসা ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে এবং থাকবে। মুক্তিযুদ্ধে দোভাষী কবি গোপীচাঁদের অবদান অনস্বীকার্য।
মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক দোভাষী কবি গোপীচাঁদ সিংহ একাত্তরের অগ্নিঝরা দিনে তার রচিত গণসংগীতেই বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা আখ্যা দিয়েছেন। এর প্রামাণ্য দলিল সেই সময়ে প্রকাশিত ‘বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ পুস্তিকা’। অথচ বাংলাদেশের স্থপতিকে সরকার জাতির জনকের স্বীকৃতি দিতে সময় লেগেছে দীর্ঘ ৪০ বছর।
জাতির জনকের জন্মশতবার্ষিকী মুজিববর্ষ উপলক্ষে দোভাষী কবি গোপীচাঁদ সিংহের হস্তলিখিত পান্ডুলিপিসহ ‘বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ’ গ্রন্থের পুন:প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় বক্তারা এসব বলেন।
শনিবার সন্ধ্যায় গোপীচাঁদ-নেম্বী মেমোরিয়াল একাডেমি আয়োজিত আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার কালারায়বিল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে।
সভা শুরুর আগে মঞ্চে স্থাপিত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ও প্রয়াত এ কবির প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সূচনা করেন গোপীচাঁদ-নেম্বী মেমোরিয়াল একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও প্রয়াত কবি গোপীচাঁদ সিংহের সহধর্মিনী নেম্বী দেবী ও তার পরিবারের সদস্যরা।
১৯৭১ সালে প্রথম প্রকাশিত ‘বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ’ গ্রন্থের সম্পাদক ও প্রকাশক শিক্ষাবিদ সুরেন্দ্র কুমার সিনহার সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন গবেষক ও লেখক ড. সেলু বাসিত, মুখ্য আলোচক ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আলমগীর স্বপন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে গবেষক ও লেখক ড. সেলু বাসিত বলেন, গোপীচাঁদ সিংহের মতো দেশপ্রেমী মুজিবভক্তরা মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করেছেন বলেই মণিপুরী, চা শ্রমিকসহ সর্বস্তরের মানুষ সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ, জীবন উৎসর্গেও পিছিয়ে থাকেননি। শহীদ হয়েছেন গিরিন্দ্র সিংহ, সার্বভৌম শর্ম্মা, ভুবেন সিংহসহ আরও অনেকে।
একাত্তরের অগ্নিঝরা দিনে গণসংগীত রচনা ও নিজ সংগীত দল নিয়ে প্রত্যন্ত এলাকার সর্বস্তরের মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করতে দোভাষী গীতিকবি গোপীচাঁদ সিংহের রয়েছে বিরাট অবদান। তার ‘বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ’ গ্রন্থটি মহান মুক্তিসংগ্রামে নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর ভূমিকার এক অকাট্য দলিল। পুস্তিকাটি পৌঁছে দেয়ার পর বঙ্গবন্ধু তাকে সম্মাননাও জানিয়েছিলেন।
আলোচনা সভার মুখ্য আলোচক ড. আলমগীর স্বপন বলেন, একাত্তরের অগ্নিঝরা দিনে প্রত্যন্ত এলাকার জন্ম নেয়া গীতিকবি গোপীচাঁদ সিংহ গণসংগীত রচনা, সংগীতদল নিয়ে পরিবেশন, মুক্তিযুদ্ধে নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীসহ সর্বসাধারণকে উদ্বুদ্ধকরণ ইতিহাস হয়ে থাকবে। তার এমন কর্মকান্ড দেশ-জাতির জন্য নিবেদিত হতে শেখাবে আগামী প্রজন্মকে।
মুক্তিযোদ্ধারা বলেন, মুক্তিযুদ্ধ করতে গীতিকবি গোপীচাঁদ সিংহের এমন সাহসী ভূমিকার কথা এখনও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিচারণে উঠে আসে। এমন ত্যাগী, দেশপ্রেমী, মুজিবপ্রেমীদের স্মৃতি রক্ষায় উদ্যোগ নেয়ার মুজিববর্ষই মুখ্য সময়।
আলোচনা সভায় ঘোষণা দেয়া হয় মুজিববর্ষ থেকে দেশপ্রেমী, মুজিবপ্রেমী গীতিকবি গোপীচাঁদ সিংহের জন্ম-মৃত্যুবার্ষিকী জাতীয়ভাবে পালনের। মণিপুরীদের জাতীয় সংগঠন মণিপুরী সমাজকল্যাণ সমিতির কেন্দ্রীয় সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আনন্দ মোহন সিংহ এ ঘোষণা দেন।
প্রয়াত গীতিকবি গোপীচাঁদ সিংহের দুই পুত্র ধীরেন্দ্র কুমার সিংহ ও সংগ্রাম সিংহের পরিচালনায় আলোচনা সভায় বক্তব্য দেন- লেখক ও গবেষক ড. রণজিত সিংহ, কবি ও নাট্যকার, মণিপুরী থিয়েটারর সভাপতি শুভাশিস সিনহা, লেখক ও গবেষক আহমদ সিরাজ, মণিপুরী সমাজকল্যাণ সমিতি কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আনন্দ মোহন সিংহ, মণিপুরী আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সমরজিত সিংহ, বাংলাদেশ মণিপুরী যুবকল্যাণ সমিতির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ সিংহ উপস্থিত ছিলে।
মণিপুরী তথ্য ও গবেষণা সংস্থা পৌরির সাধারণ সম্পাদক সুশীল কুমার সিংহ, বীর মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রী সিংহ, প্রয়াত গীতিকবি গোপীচাঁদ সিংহের অন্যতম সহচর ওস্তাদ গীতশ্রী চন্দ্র মোহন সিংহ, নিরঞ্জন দেব, রাজনীতিক ও সমাজসেবী হাবিবুর রহমান চৌধুরী, সাংবাদিক শাব্বির এলাহী, হিন্দু বৌদ্ধ খৃস্টান ঐক্য পরিষদ, কমলগঞ্জ উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক নিরঞ্জন দেব। আলোচনা সভায় মণিপুরী ভাষার প্রখ্যাত কবি ব্রজেন্দ্র কুমার সিংহ, সাংবাদিক ইসহাক কাজলসহ প্রয়াতদের স্মরণে নীরবতা পালন করা হয়।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করতে ও স্বাধীনতা অর্জনের প্রারম্ভে প্রত্যন্ত এলাকায় সংগীতদলের পরিবেশিত ও গোপীচাঁদ সিংহের রচিত গণসংগীত নিয়ে প্রকাশিত বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ পুস্তিকাটি সম্পাদনা করেছেন লেখক ও গবেষক ড. সেলু বাসিত। একুশে বইমেলায় স্টল নম্বর ৩২৯ ও ৩৩০ শব্দকোষ প্রকাশনীতে পাওয়া যাচ্ছে।
এমআরএম/এমএস