ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

মাটির হৃৎপিণ্ড

প্রকাশিত: ০৬:৫৯ এএম, ০৬ অক্টোবর ২০১৫

নিস্তব্ধ রাতের নক্ষত্রের মতো দু’চোখে কোন ঘুম নেই। এই ব্যস্ত জনপদের কোলাহলেও আমার কোন ব্যস্ততা নেই। পাখিদের ঠোঁটে, চিত্রল প্রজাপতির পাখায়, ফুলেদের সুবাসে, গাছেদের ডালে ডালে, সবুজ পাতায় পাতায়, মেঘেদের বৃষ্টি হয়ে, বাতাসের গায়ে গায়ে আমার কণ্ঠ, বুকের ঘ্রাণ ছুঁয়ে যাক তোমার মাটির হৃৎপিণ্ড।

তোমার শূন্যতায় আমার হৃদয় যেমন হয়েছে ব্যাকুল, অবিকল আমার শূন্যতায়, তুমিও কী হয়ে ওঠো ব্যথাতুর?
কতদিন যে হলো তোমাকে দেখি না। সেই কবে তোমাকে ছেড়ে এই বিদেশের মাটিতে মাকে চিকিৎসা করাতে এসেছি।

বেনাপোল-পেট্রাপোল থেকে যশোর রোডের বুক পেরিয়ে প্রথম যখন কলকাতায় এসে পৌঁছি, সেদিনই তোমাকে খুব করে টের পাই। তোমার অস্তিত্ব আগে কখনোই এমন করে বুকের ভেতরে টের পাইনি।

একটু পর পরই তোমার কথা মনে পড়ে। তখন বুকের ভেতরের লাল হৃৎপিণ্ডটা দলা পাকিয়ে কেবল মোচড় দিয়ে ওঠে।

আমি একটু সুযোগ পেলেই কলকাতার ছোট বড় সড়কগুলোর অলিগলি, বিমানবন্দর, সল্টলেক, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, ধর্মতলা, হাওড়া রেলস্টেশন, অজানা অচেনা স্থাপনা দেখতে বেরিয়ে পড়ি। সবকিছুই আমার কাছে নতুন অভিজ্ঞতা। নতুন ধরনের এক অনুভূতি। মন্দ লাগে না। আবার তোমাকে ছেড়ে খুব বেশি ভালোও লাগে না। এভাবেই কাটতে থাকলো আমার রাত, আমার দিন।

প্রথম যেদিন আমাদের গাড়িটি কলকাতা শহরে এসে ঢুকলো, তখন আকাশ জুড়ে সেকি তুমুল বৃষ্টি। কলকাতা বিমানবন্দর এলাকায় আসতেই ঝর ঝর করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। মার্বেলের মতো বৃষ্টির ফোটা কী আর সহজে থামে? অবিরাম সে ঝরে চলেছে।

বৃষ্টির রিমঝিম রিমঝিম শব্দ আমার কানে বেশ লাগলেও এক সময় আমি খুব বিরক্ত হয়ে যাই, যখন দেখি পুরো সড়ক বৃষ্টির জলে থই থই।

অবশ্য যখন পেট্রাপোল পাড় হয়ে যশোর রোডের বুকের উপর দিয়ে ধাই ধাই করে ছুটছিলাম তখন থেকেই দেখছিলাম আকাশ জুড়ে মেঘের লুকোচুরি খেলা। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুরো শহরটা বদলে গেল।

আমরা কলকাতার বুক জুড়ে শুয়ে থাকা সড়কগুলো ধেয়ে ধেয়ে যেদিকেই যাই, দেখি সবগুলো সড়কের বিটুমিন ঢালা ইট পাথর বৃষ্টির জলে ডুবে গেছে। যখন বালিগঞ্জের ভারত সেবাশ্রম সংঘে এসে পৌঁছাই, তখন বৃষ্টি বেশ কমে গেছে। ট্যাক্সি থেকে নেমেই দেখি একটি কাঠবাদাম গাছ বেয়ে বেয়ে কয়েকটি কাঠবিড়ালী মনের সুখে ছুটোছুটি করছে। যেন বৃষ্টির জলে স্নান করেও তাদের মন ভরেনি, তাই এখনো ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতেও ভিজছে।  

আমারতো সবকিছুই নতুন অভিজ্ঞতা, নতুন অনুভূতি মন্দ লাগছে না। আমি যেখানেই যাই তোমাকে মনে পড়তেই হয়। যার সাথেই কথা বলি তোমাকে মনে করতেই হয়।

আমি মহাবিপদে পড়ে গেলাম। আরে বাবা আমি যখন এতো বছর তোমার বুকের উপরে ধীরে ধীরে মানুষ হয়ে উঠছিলাম, তখনতো এতোবার তোমাকে এমন করে অনুভব করতাম না।

এমন করে আমার মনে তোমার শূন্যতা এসে জুড়ে বসত না। এভাবেই তুমিহীন কলকাতায় কেটে গেল আমার কিছু রাত কিছু দিন। এরপর কোন একদিন সন্ধ্যায় মাকে নিয়ে কলকাতার বাংলার আকাশ, বাংলার বাতাস, বাংলার গাছপালা ঘরবাড়ি ছেড়ে যাই।

হাওড়া রেলস্টেশন থেকে তামিল নাড়ু প্রদেশের ভেলোরের কাঠপাডি স্টেশনের ট্রেনে চেপে রওনা হই। তামিল নাড়ুতে ট্রেনে চেপে যেতে সেকি একটু আধটু পথ!

সেই পশ্চিমবঙ্গ, ঊড়িষ্যা, অন্ধ্র প্রদেশ, তেলেঙ্গানা হয়ে তামিল নাড়ু। ট্রেনেই ঘুমিয়ে, জেগে, বসে থেকে কাটিয়ে দেই দুই দিন, এক রাত। সময় কী আর এতো সহজে শেষ হয়।

ভারতে কত কিছুই না দেখার আছে। স্বর্ণমন্দির, জলকান্তস্বরের মন্দির, রামেশ্বরম, তিরুপাতি, কন্যাকুমারী, তাজমহল, দার্জিলিং, কাশ্মীরের স্বর্গীয় প্রাকৃতিক রূপ আরো কত কত নাম না জানা মুগ্ধময় আকর্ষণ।

এসব দর্শনীয় স্থানগুলো ভেতরে ভেতরে দেখার প্রবল আগ্রহ আমার মনে উঁকি ঝুঁকি মারছিল। নতুন কোন কিছু দেখা-জানা কারো কাছে খারাপ লাগে, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যায় না।

দিনের আলোতে ট্রেনে চেপে ভেলোর শহরে যাওয়ার এই দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে আমার তেমন কষ্টই হয়নি। সূর্যের আলো যখন পৃথিবীর এই অর্ধেক অংশে ঝলমলে আলোর বিকিরণ ছড়িয়ে আলোময় করে রেখেছিলো, তখন একটুও খারাপ লাগেনি।

ঊড়িষ্যা, অন্ধ্র প্রদেশের বুকে শুয়ে থাকা রেল লাইনের উপর দিয়ে আমাদের ট্রেন ছুটে চলেছিল, তখন দুই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সবুজ পাহাড়, নদী, ফসলের মাঠের ছুটে চলা দৃশ্য, তোমার কথা বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছিল।

এমনিতেই পাহাড় দেখা আমার অনেক দিনের পুরনো শখ। আমি কত বার মেঘ ছুঁই ছুঁই করা সবুজে ঢাকা পাহাড় দেখতে রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ির উঁচু-নিচু পাহাড়ি সর্পিল পথের বুকে ছুটে বেরিয়েছি। সেই সব ছুটে বেড়ানোর দিনগুলো কখনো হিসেব করে রাখিনি।

অবশ্য পাহাড় দেখার প্রবল নেশা ফাইজুল ভাই আমার মাথায় প্রথম ঢুকিয়েছিল। পুরো নাম ফাইজুল শরীফ। সে আমার এলাকার বড় ভাই। বয়সে আমার দশ কিংবা পনের বছরের বড় হবে।

হঠাৎ একদিন আমি ও সে একটি চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্চিলাম। চা খেতে খেতে সে আমাকে বললো, ‘চল, জয়ন্ত। আমরা বান্দরবানে পাহাড় দেখতে যাই।’

ফাইজুল ভাইয়ের কথা শুনে আমি প্রায় চমকে যাই। আমি খুব আগ্রহ নিয়ে তাকে বলি, ‘হুম। ভাই চলেন একটু ঘুরে আসি। দেশের আনাচে-কানাচে ঘুরে না বেড়ালে দেশটাকে চিনবো কিভাবে বলেন?’
‘চলো, দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য প্রাণভরে উপভোগ করা দরকার।’

একদিন সন্ধ্যায় আমরা পাহাড় দেখতে রওনা দিলাম। আগে কোনদিনই আমি পাহাড় দেখিনি। আমার ভেতরে পাহাড় দেখার সেকি উন্মাদনা!

তখন শীত। কখনো কখনো দিনের আলোতেও সূর্যের দেখা মেলে না। সেদিন সন্ধ্যার আগেই প্রকৃতির শরীর জুড়ে কুয়াশা চাদর মুড়ি দিতে শুরু করে। শুধু কী কুয়াশার আবরণ? সেই সাথে হালকা বাতাস শরীর জুড়ে শীত আরো জেকে বসেছে।

আমরা বান্দরবানের পাহাড়ের বুকে হারিয়ে যাই। সে কী বড় বড় উঁচু-নিচু পাহাড়! যেদিকে দু’চোখ যায় সেদিকেই শুধু পাহাড় আর পাহাড়। পাহাড়ের গা ঘেঁষে ঘেঁষে মেঘের হাতছানি।

বান্দরবানের সবুজ পাহাড়, মেঘ, বগালেক, নীলাচল, নীলগিরি, স্বর্ণ মন্দির দেখে আমার সে কী ভীষণ মুগ্ধতা।

বান্দরবানের স্বর্ণ মন্দির নাম হলেও আসলে মন্দিরটি সত্যিকারের স্বর্ণ দিয়ে বানানো নয়। পুরো মন্দিরটির গা জুড়ে সোনালি রঙের প্রলেপ দেওয়া। যা দেখলে সত্যিই মন ভালো হয়ে যায়।

সেই যে ফাইজুল ভাইয়ের সাথে আমার পাহাড় দেখা শুরু- আমার সেই নেশা আজো কাটেনি, ক্রমশ সে আরো বেশি নেশাতুর হয়ে ওঠে।
 
আমি ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি। ট্রেন ছুটে চলছে। ট্রেনের জানালা দিয়ে কত রকমের মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য একটার পর একটা চোখের সামনে আসছে। পাহাড়ের পরে পাহাড়, নদী, ফসলের মাঠ, পাখিদের ব্যস্ততা সব কিছুই চোখের সামনে ভেসে উঠছে।কিন্তু তাতে আমার কোন ভাবেই মন ভরে ওঠে না। বুকের ভেতরে তোমার জন্য কেমন যেন একটা শূন্যতা অনুভব করছি।

ট্রেনের কামরাতেই এক যাত্রী আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করছে, ‘ভাইয়া, আপ কাহাসে আয়া?’
আমি বলি, ‘আই কামস ফরম বাংলাদেশ।’
‘ওহ। বাংলাদেশ! ইউ আর বেঙ্গলী?’
আমি বুক টান টান করে বলি, ‘ইয়েস। আই অ্যাম বাংলাদেশি অ্যান্ড বেঙ্গলী। আপ কাহাসে আয়া, ভাইয়া?’
‘মে ব্যাঙ্গালোর সে আয়া।’
‘ওহ। ব্যাঙ্গালোর। ক্যাপিটাল সিটি অব কর্ণাটক।’
‘ইয়েস, ভাইয়া। ইউ গোয়িং টু ব্যাঙ্গালোর?’
‘নেহি নেহি ভাইয়া। উই আর গোয়িং টু ভেলোর।’
‘আচ্ছা, আচ্ছা। মেডিকেল ট্রিটমেন্ট।’
আমি মাথা দুলিয়ে বোঝালাম আমরা মেডিকেল ট্রিটমেন্ট করার জন্যই ভেলোর যাচ্ছি।

আমার বুকের ভেতর অস্থির অস্থির লাগে। মনে মনে নিজের কাছে প্রশ্ন করি-‘আমি কোথায় যাচ্ছি, সেখানে কারো সাথে কি আমি বাংলায় কথা বলতে পারবো না।’- কথাগুলো ভাবি আর আফসোস করতে থাকি।
 
এভাবেই একদিন-দুইরাত শেষে আমি তামিলনাড়ুর ভেলোর শহরে পৌঁছে যাই। শত শত মাইল পাড়ি দিয়ে যখন ট্রেন থেকে মাটিতে পা দেই, তখনই আমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে থাকি।

ভাবতে থাকি কতশত হাজারো মানুষ এই শহরে আসছে। কেউ আসছে স্বর্ণ মন্দির দেখতে অথবা কেউ চিকিৎসা করাতে আসছে। আমি অবশ্য মাকে চিকিৎসা করাতে নিয়ে এসেছি।

অনেক দিন ধরে আমার মা ইউরিনের অসুখে ভুগছে। শুনেছি এখানে আধমরা মানুষও নাকি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যায়। আমিও সেই আশায় এসেছি।

ভারতের মানুষ, ভারতের বাইরের মানুষ। এই যেমন আমি। সেই বাংলাদেশের মাদারীপুর শহর থেকে রওনা হয়ে কলকাতা, ঊড়িষ্যা, অন্ধ্র প্রদেশ, তেলেঙ্গানা, তামিলনাড়ুর বুকজুড়ে কত কিছুই না দেখতে দেখতে এসে পৌঁছলাম।

এখানে আসার পরদিন থেকেই কোমড়ে গামছা বেঁধে আমি মায়ের চিকিৎসার জন্য নেমে পড়ি। প্রায় প্রতিদিনই মাকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে ভেলোর শহরের সিএমসি হাসপাতালের এই বিল্ডিং-সেই বিল্ডিং, সেকেন্ড ফ্লোর, থার্ড ফ্লোর শুধু মেডিকেল টেস্টের জন্য বিচরণ করতে থাকি।

এখানে চিকিৎসা পদ্ধতির সবকিছুই কত সুন্দর করে রাখা হয়েছে। সিএমসি হাসপাতালে নানা রকমের ভাষাভাষি হাজার হাজার রোগী চিকিৎসা করাচ্ছে, অথচ কারো মুখে কোন অভিযোগ শুনিনি। কিছু কিছু অভিযোগ হয়তো থাকতে পারে। তা অন্তত এখনো এই আমি শুনিনি।

অথচ প্রিয় বাংলাদেশ। তোমার বুকে লাখ লাখ গড়ে ওঠা হাসপাতালে এমন চিকিৎসা পদ্ধতি এখনো তৈরী করতে পারোনি। আমি জানি হয়তো একদিন তোমার বুকে সবই হবে।

কখনো কখনো মায়ের মেডিকেল টেস্ট করানোর ফাঁকে ফাঁকে যেসব দিন কোন কাজ থাকত না, সেসব দিনে মাকে নিয়ে শহরের কাছাকাছি কোন মনোমুগ্ধকর পরিবেশে বেরিয়ে পড়তাম।

তবে ভেলোরে এসে স্বর্ণ মন্দিরটি দেখে আমরা খুব অবাক হয়ে যাই। এতো দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা যে, খালি চোখে এক মিনিট মন্দিরের দিকে তাকিয়ে থাকাই খুব কষ্টকর।মন্দিরের আলোকচ্ছটায় চোখ ধরে যায়। সূর্যের প্রখর আলোয় চোখ ঝাপসা করে ফেলে। পুরো মন্দিরটি দেখলেই বুঝতে পারা যায় কতটা গভীর মমতা ও শ্রদ্ধায় মন্দিরটির ডিজাইন করা হয়েছে।

এতসব দৃষ্টিনন্দন চোখ জুড়ানো, মন ভোলানো নিঃসর্গ দেখার পরেও আমার মন ভরেনি। একদিকে মায়ের জন্য দুশ্চিন্তা অন্যদিকে তোমার কথা। তোমাকে ছেড়ে তো মাসের পর মাস এভাবে কোনদিন বিদেশে থাকিনি।

মেডিকেল টেস্ট করাতে করাতে মায়ের ইউরিন ব্লাডারে ধরা পড়লো যে, মূত্রথলিতে টিউমার হয়েছে। অপারেশন করে তা ফেলে দিতে হবে। মাকে সুস্থ করে তুলতে আমিও রাজি হয়ে গেলাম।
 
একদিন খুব ভোরে অপরাশেন হয়ে গেল। আমি ভেবেছি- যাক বাবা শেষ পর্যন্ত মায়ের অপারেশনটা ঠিকঠাক ভাবে হয়েছে তো। ডাক্তাররা অপারেশন শেষে টিউমার থেকে মাংসের দলা কালেক্ট করে বায়োপসি রিপোর্ট করতে ল্যাবে পাঠালো।

এখানে এসেছি এক মাস হয়ে গেছে। তোমার কাছে মাকে নিয়ে ফিরে যাওয়ার জন্য আমার মন ব্যাকুল হয়ে উঠেছে।

মনে পড়ে ঢাকা শহরের বুকে দাঁড়িয়ে থাকা গণতন্ত্রের দৃষ্টিনন্দন প্রতিকৃতি সংসদ ভবন, মুঘলদের ইতিহাস বহন করে চলা লালবাগ কেল্লা, শহীদ মিনার, সাভারে আকাশ ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে থাকা স্মৃতিসৌধ, রায়ের বাজারের বধ্যভূমি।

কুয়াশার ভোরের ঘাসে লেপ্টে থাকা জ্বলজ্বলে শিশির বিন্দু, বসন্তের বাগানে দোয়েলের শিস, কোকিলের গান গাওয়া। বাতাসে ভেসে আসা বিল-বাওরের ফুটে থাকা শাপলা-পদ্মের ঘ্রাণ।

মনে পড়ে যায় পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, আড়িয়াল খাঁ নদীর উত্তাল ঢেউ, শঙ্খচিল, গাঙচিলের ওড়াউড়ি, নদীর বুকে বয়ে চলা পালতোলা নৌকা, সহজ সরল গ্রামের বধূর স্নিগ্ধ হাসি, বাতাসে শ্বেতশুভ্র কাশফুলের দোল, বিল-বাওরে সাঁতরে বেড়ানো বাঁলিহাস, পানকৌড়ি, ধবল বক আর ডাহুক পাখির আনাগোনা, নদীর জলে অবাধ্য কিশোরদের খেলা, ফসলের মাঠে সোনালি ধানের সারি সারি আটি মাথায় কৃষকের হেঁটে চলা।

এই প্রবাসের পথেঘাটে কত কী চোখে পড়ে। কিন্তু প্রিয় বাংলাদেশ, তোমার চেয়ে কোন কিছু বেশি ভালো লাগেনি।
 
একদিন ডাক্তার আমাকে ডেকে বললো, ‘মিস্টার জয়ন্ত, আপনার মায়ের শরীরে ক্যান্সার বাসা বেঁধেছে। শুধু তার ইউরিন ব্লাডারেই নয়, যে সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ মানুষের পুরো শরীরকে বাঁচিয়ে রাখে, সেই কিডনি, হার্ট, ফুসফুসে ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়ে এখন সে রক্তের ভেতরে প্রবাহিত হচ্ছে। আপনার মা ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে একদিন মারা যাবেন।’ ডাক্তারের মুখ থেকে এমন কথা শুনবো, সেটা কখনোই প্রত্যাশা করিনি।

কথাগুলো শুনে আমি কিছুক্ষণ বোবা হয়ে যাই। বুকের ভেতরে হা-হা-কার করে ওঠে। আমি টের পেলাম আমার চোখ দুটো ভিজে উঠছে। মায়ের কথা ভাবতে ভাবতে আবারো তুমি চোখের সামনে ভেসে ওঠো। এবার আর তোমার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য আর ঐহিত্য চোখের সামনে ভেসে ওঠে না।

শুধু ভেসে ওঠে তোমার হৃৎপিণ্ড জুড়ে গড়ে তোলা রাষ্ট্রযন্ত্রগুলো, মায়ের শরীরের মতই ক্যান্সারে ছড়িয়ে গেছে। প্রিয় বাংলাদেশ তুমিও এখন মায়ের মতো ক্যান্সারের রোগী হয়ে গেছো।

আমি হাসপাতাল থেকে বের হয়ে আসতে থাকি কিন্তু আমার পা কিছুতেই চলতে চায় না। মনে হচ্ছিল, আমার পা কে যেন পিছন থেকে টেনে ধরেছে।

এসইউ/এইচআর/এমএস