বেদেসুন্দরী
বৈশাখের শেষের দিকে নতুন পানি আসতে শুরু করেছে। যৌবনবতী হয়ে উঠছে নদী। তীরবর্তী গ্রামেও নতুন জলের কানাকানি। গল্পের এই নদের নাম আড়িয়াল খাঁ। আড়িয়াল খাঁ নদী নয়—নদ। যদিও একসময়ের খরস্রোতা আড়িয়াল খাঁর বুকজুড়ে এখন বিশাল চর। নদের করালগ্রাসে অনেক ঘর-বাড়ি বিলীন হয়েছে অনেক আগেই। সে অনেক কথা। এখন কথা হচ্ছে—নতুন পানিতে কচি কচি ঘাস হাবুডুবু খাচ্ছে। কাটা ধানের গোড়া তলিয়ে যেতে শুরু করেছে। ক্রমেই বাড়ছে পানি। স্বচ্ছ টলমলে পানিতে হালকা ঢেউয়ের কাঁপন জাগে। রাত গড়িয়ে ভোরের আলো ফুটতেই পানি যেন বেড়ে যায় হাঁটু সমান।
ভাঙনের পর নদের বুকজুড়ে জেগে ওঠা চরের বুকটাও তলিয়ে যেতে শুরু করেছে। বোরো ধান উঠে যাওয়ার পর খা-খা করা চরটা বয়স্ক নারীর শুকনো স্তনের মতো মনে হয়। চতুর্দিক থেকে ঢালু হয়ে উপরের দিকে উঠে নারীর স্তনের মতোই দেখায় চরটি। চারদিকের পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সতেজ হয়ে উঠেছে চরের ঘাস, লতা-গুল্ম। কিছুদিন পরেই চরে নৌকা নামবে। লগিতে নৌকা আটকে মাছ ধরার উৎসব শুরু হবে।
কেমন একটা বর্ষা বর্ষা ভাব এসে গেছে চরজুড়ে। স্তনবৃন্তের মতো একটি ঘর কেবল দাঁড়িয়ে আছে চরের উঁচু স্থানটিতে। সন্ধ্যার পরে যখন প্রদীপের আলো জ্বলে ওঠে; তখন ওটাকে পরীর দ্বীপ বলে মনে হয়। ভরা বর্ষায় থৈ থৈ পানির মধ্যে এক চিলতে আশা নিয়ে জেগে আছে বাড়িটি।
পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নৌকার জোগাড়-যন্তর চলতে থাকে গ্রামজুড়ে। এখানে বৈদ্যুতিক আলো নেই। যোগাযোগের রাস্তা-ঘাট নেই; নৌকাই মানুষের একমাত্র ভরসা। বৈশাখের এই শেষ সময়টায় চলতে থাকে বর্ষা যাপনের প্রস্তুতি। ক্ষরা মৌসুমে খসখসে ভূমি থেকে যে ফসল মেলে, তা জিইয়ে রেখেই চলে কৃষকের আগামীর সংসার। বর্ষা এলে হয় পেশার বদল। কৃষিকাজ ফেলে শুরু হয় মাছ ধরা।
পদ্মার অববাহিকায় সৃষ্ট আড়িয়াল খাঁয় মাছও আসে প্রচুর। ইলিশ, বোয়াল, চিতল, আইড় থেকে শুরু করে মলা, ঢেলা, শিং, মাগুর, কালিবাওস, চিংড়ি, পুটি, লাউয়া, টাকিসহ নানান কিসিমের মাছ আসে জেলের জালে। নিম্নবিত্ত শ্রেণির কাজই তখন মাছ ধরা। কিঞ্চিত চাকরিজীবী বা ব্যবসায়ীরা হন সেই মাছের খরিদ্দার। সারারাত মাছ ধরে সকালে গ্রামের শেষ মাথায় বসে অস্থায়ী মাছের হাট। জেলেদের ধরা মাছেই উদরপূর্তি হয় গেরস্থের।
পানিও বাড়ে, মাছও বাড়ে। বাড়ে জেলের সংখ্যাও। রাতের চরটি আলোকিত হয়ে যায় প্রদীপের আলো পেয়ে। হারিকেন বা কেরোসিনের বাতি জ্বলে প্রতিটি নৌকায়। যারা নিরাক চায়; তাদের হাতে থাকে টর্চলাইট। এতো এতো নৌকা থাকার পরেও চরজুড়ে সুনসান নিরবতা। মাঝে মাঝে ঝুপঝাপ শব্দ ছাড়া মানুষের কণ্ঠ তেমন মেলে না। বর্ষা এলেই যেন যৌবন ফিরে পায় চরটি। প্রতিবার একই দৃশ্য চোখে পড়ে সবার। এ যেন ব্যতিক্রম হওয়ার নয়।
নতুন পানির আগমনে তীরবর্তী গ্রামজুড়ে ঠান্ডা বাতাস বইতে থাকে। চরটি যে গ্রামের দখলে তার নাম বেপারিকান্দি। বেপারিকান্দির বাসিন্দাদের ভেঙে যাওয়া ঘর-বাড়িই চর হয়ে ফিরে এসেছে। বর্ষা এলে এই চর আর তাদের দখলে থাকে না। চলে যায় জেলেদের অধীনে। বাড়তি পানিতে তখন মাছ ধরার আয়োজন চলতে থাকে। বেপারিকান্দির অবসর যুবকরা চরের বুকে নৌকা ভাসিয়ে সারারাত মাছ ধরে। কেউবা ভেসাল পেতে বসে। চাই, বইচনা ও দাওইন পাতে কেউ কেউ। গুনার মধ্যে কেঁচো গেঁথে চিংড়ি মাছ ধরে মুলাই শিকদার, রমিজ ঢালিসহ অনেকেই। এই পদ্ধতিকে তারা বলে ‘বররা’। মুলাই শিকদারের বয়স বেড়ে গেছে। এখন ছেলে ধলাই শিকদারই বররা পাতে।
ঘরে বসে খটমট করে বুড়ো মুলাই শিকদার, ‘আরে ওই ধলাই, কদুর লাহান ধলা চামড়া লইয়া ঘরে বইয়া থাকলে অইবো? বাইস্যাকাল আয়া পড়তাছে। ছোরঙ্গাডা এবার ঠিক করতে অয় যে।’ কাশির ধমকে আর বলতে পারে না মুলাই শিকদার। বাবার ক্লান্তি লক্ষ্য করে ধলাই বলে, ‘কিছু কিছু জায়গায় ফাইটা গেছে বাবা। কাঠও তো পইচা গেছে কিছু। কাঠমিস্ত্রি ডাইকা নৌকাডা মেরামত করতে অইবো।’ গলায় আটকে থাকা একদলা শক্ত কফ মাটিতে ফেলে মুলাই শিকদার বলে, ‘যা করন লাগবো করবি। এহনো মোর দিকে চাইয়া থাকলে খাবি কি মাইন্দারের পো।’
বাপের তোড়জোরে নৌকার সংস্কার শুরু করতে হবে। নৌকা বলতে ওই পাতলা একটা ছোরঙ্গা। এ অঞ্চলে নৌকার অনেক শ্রেণিবিভাগ। যার মধ্যে কোষা, ছোরঙ্গা, পানসি, একমালাই আর মাছ ধরার জালটানা নৌকা। কোষা নৌকাটি মোটামুটি সাইজের। গঠন-ধরনও ভিন্ন। তবে ছোরঙ্গা খুবই পাতলা কিসিমের। একজন-দু’জন উঠলেই নড়েচড়ে। ডুবে যাওয়ার ভয় থাকে। পানসি খুব দ্রুত চলে। বেশ লম্বা এবং চোখা টাইপের। একমালাইতে ছই থাকে। বেশ মজবুত হয় এই নৌকা। সবাই যার যার সামর্থ অনুযায়ী নৌকা গড়ে। বর্ষা এলেই খাসেরহাট বা সূর্যমনি বাজারে গিয়ে তারকাটা, কাঠ, পাতাম, আলকাতরা এসব কিনে আনে। সময়মতো চলে আসে কাঠমিস্ত্রিরা।
এলাকার কাঠমিস্ত্রিরা বেশিরভাগ হিন্দু। সাতচল্লিশের দেশভাগের পরও যারা চলে যায়নি; তারা এখন কাঠমিস্ত্রির কাজ করে। গেরস্থের ঘর-দোর, নৌকা, দোকান-পাট মেরামত করেই চলে তাদের সংসার। তাদের মধ্যে পরেশ কুলু, নেপাল ও দুলাল মিস্ত্রির খুব নাম-ডাক। মুসলমানদের মধ্যেও কাঠমিস্ত্রি আছে। তারা মূলত পরেশের সহযোগী হিসেবে কাজ করতে করতে এখন প্রধান মিস্ত্রি। তাদের মধ্যে কোহাই মিস্ত্রী ও লালমিয়া খ্যাতি অর্জন করতে পেরেছে। এই মৌসুমটাতে মিস্ত্রিদের কদরও বাড়তে থাকে।
গ্রামের বেশিরভাগ নৌকাই মেরামত করা হয়ে গেছে। আলকাতরা শুকালেই জলে ভাসানো হবে। মাছ ধরার যন্ত্রপাতিও প্রস্তুত। এমন সময় কোনো একদিন সন্ধ্যায় ঝাঁকে ঝাঁকে নৌকা ঢুকতে দেখা যায় চরে। প্রায় সব নৌকার গড়ন এক। তাদের শৃঙ্খলা মন্দ নয়। সাপের মতো লাইন বেঁধে এগিয়ে আসে নৌকাগুলো। বেপারিকান্দি মসজিদে তখন মাগরিবের নামাজ হচ্ছিল। বাইরে হঠাৎ অনেক হৈচৈয়ের মতো শোনা যায়। নামাজ শেষে বের হয়ে মুসল্লিরা তাকায় চরের দিকে। মুহূর্তেই চরটা ভরে গেছে নৌকায়। বয়স্কমতো আলাই ফকির খিস্তি ছাড়ে— ‘বাইদানিরা আইয়া পড়ছে। খানকি মাগি গো গলার আওয়াজে নমাজ ছুইটা যায়।’ মুলাই শিকদার বলে, ‘এবার তাইলে মাছের গোয়া মারা সারা। বাইদ্যাগুলা জলেও জ্বালাইবো, ডাঙ্গায়ও জ্বালাইবো।’ মক্তবের মৌলবি রবিউল সারেং বলে, ‘মুখ খারাপ কইরা লাভ নাই চাচা। ওগো রিজিক এইখানেই আছে। তাই আল্লাহ ওগো এইখানে পাঠাইছে। ওনারা আমাগো মেহমান। মেহমানরে অসম্মান করতে নাই।’ উপস্থিত কেউ কেউ বলে ওঠে, ‘মৌলবি সাব ঠিকই কইছেন। কই যাইবো বেদেরা? তয় গ্রামবাসীর কিন্তু সাবধানে থাকা লাগবো। ওরা কিন্তু চুরি, বাটপারি থেইকা শুরু কইরা সব ধান্দাই করে।’ মৌলবি সাহেব বলে, ‘হ্যাঁ, তা ঠিকই কইছো। সবাই সাবধানে থাকলেই অইলো।’ মৌলবির এমন কথার পর আর কথা আগায় না। সবাই যার যার বাড়ির দিকে পা বাড়ায়।
পরদিন সকালে ‘আরে ও বিধির কী হইলো?’ ‘আরে দেখবেননি সাপের খেলা?’ ‘মাজা ব্যথা, কোমর ব্যথা- লাগবোনি সিঙ্গা?’ বলে গ্রামে হাক ছাড়ে বেদেনিরা। ছুটে আসে গ্রামের শিশু ও নারীরা। বাড়ির উঠানে সাপের খেলা, সাপ-বেজির লড়াই দেখিয়ে চাল, ডাল, পেঁয়াজ, রসুন, টাকা নিয়ে চলে যায় তারা। কেউ কেউ সিঙ্গা টানে। সারা বছর কাজ করে করে কোমরে, পিঠে, পায়ে ব্যথা হয় অনেকের। তাদের ফুসলিয়ে সিঙ্গা টানে একদল বেদে। নির্ধারিত স্থানে গরুর শিং বসিয়ে মুখ দিয়ে টেনে বিষাক্ত রক্ত শরীর থেকে বের করা হয় বলে এর নাম সিঙ্গা। সিঙ্গার বিনিময়েও তারা চাল-ডালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে যায়। আর এসব কাজ করে মূলত নারীরাই।
বেদে সম্প্রদায়ের একটি মজার ব্যাপার জানা যায় তখন। বেদে সম্প্রদায়ের পুরুষরা সারাদিন নৌকায় বসে থাকে। নারীরা বেরিয়ে পড়ে উপার্জন করতে। পুরুষরা নৌকায় বসে বসে মাছ ধরে বা সন্তান লালন-পালন করে। নারীরাই তাদের কৌশলী বুদ্ধিতে গেরস্থের ঘরে হানা দেয়। ভুলিয়ে-ভালিয়ে উপার্জন করে এনে পুরুষের হাতে তুলে দেয়। সারা বছর তারা ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। এক এলাকায় বেশিদিন থাকে না। তবে বর্ষা এলেই তাদের বেশি চোখে পড়ে।
খুব কম বয়সেই বেদেদের বিয়ে হয়ে যায়। আর ওই বয়সেই স্বামীর সংসারের দায়িত্ব নিতে হয় স্ত্রীকে। তেমনি একজন সুন্দরী। দেখতে মন্দ নয়। বেদে মেয়েরা রংচটা হয়। জন্মের পর থেকেই রোদে পুড়ে কালো হয়ে যায়। চেহারার গড়ন বেশ মানানসই। আকর্ষিত করার মতো দেহ। সরু কোমর দুলিয়ে হেঁটে গেলে সব পুরুষের বুকেই কাঁপন তোলে। হৃদয়ের মাঝে আলাদা শিহরণ খেলে যায়। বেদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত সুন্দর হয়ে জন্মানোর কারণেই হয়তো নাম রেখেছিল সুন্দরী।
ঘাটে ঘাটে ঘুরে সুন্দরী এখন বেপারিকান্দির চরে। স্বামী মাতাল প্রকৃতির। বেদে সর্দারের ছেলে। বসে বসে গাজা খাওয়া আর স্ত্রীকে মারধর করাই তার কাজ। তবুও সুন্দরী দাঁত কামড়ে পড়ে আছে তার নৌকায়। এখানে সর্দারের হুকুমই আইন। প্রতিবাদ করেও লাভ হয় না। অপেক্ষাকৃত অবস্থাহীন বলে মুখ বুজে সইতে হয় সুন্দরীকে।
সারাদিন ঘুরে রাতে নৌকায় ফিরে আসে। চরের বুকজুড়ে এখানে ওখানে বাতির আলো। জেলেদের মাছ ধরার আলাপ-সালাপ। ‘মাছ পাইলিনিরে কফিল?’ প্রশ্নটা ছোড়ে আলাল। ‘ঘাসটা লড়তে দেকলাম। ঝুতিটা দিয়া কোপ মারছিলামও। বালের মাতা ছুইটা গেল মাছটা।’ একটা বিরক্তি ঝারে কফিল। হঠাৎ দূরের এক নৌকা থেকে ভেসে আসে বাঁশির সুর। ‘হালার ধলাই আর সময় পাইলো না। কষ্টের সময় সুর তুইলা কষ্টটা আরও বাড়ায়া দিলো।’ কফিলের কথা শুনে হাসে আলাল। ‘ধলাই আবার কী করলো?’ জানতে চায় আলাল। ‘ওর বাঁশির সুরে আমি আউলা-ঝাউলা হইয়া যাই।’ বলেই নৌকায় জোরে লগি মারে। চলে যায় কিছুটা দূরে।
নৌকায় শুয়ে শুয়ে মনটা কেমন আনচান করে সুন্দরীর। বাঁশির সুর এসে বিদ্ধ করতে থাকে তার বুক। বাঁশির নৌকাটা ওর নৌকা থেকে বেশি দূরে নয়। ইচ্ছে হয়—ছুটে যায় তার কাছে। কিন্তু পারে না। পাশেই গাজার কলকি সাজিয়ে বসে আছে স্বামী। সারি বাধা নৌকা থেকে আলাদা হয়ে গেলেও কেউ না কেউ টের পেয়ে যাবে। সংকোচে কুকড়ে যায় সুন্দরী। তবুও বুকের মধ্যে উথাল-পাথাল ঢেউ। বিস্ময়করভাবে সে লক্ষ্য করে—এমন আনমনা সে জীবনে কখনো হয়নি। তাহলে আজ এই মাঝরাতে কেন? কে এই বাঁশিঅলা। তার ঘুম কেড়ে নিলো? ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে সুন্দরী।
বাঁশি বাজিয়ে ক্লান্ত হয়ে মাছ ধরা শুরু করে ধলাই। মাঝরাতে তার মনে পড়ে নৌকার গলুই ফাঁকা। মাছ ছাড়া বাড়ি গেলে মুলাই শিকদার তাকে ঘরছাড়া করবে। বাপের ভয়ে এবার বররা ফেলে পানিতে। ফেলে বেশিক্ষণ বসতে হয় না। খোট আসে বরশিতে। খোট এলেই বুঝতে পারে ধলাই। কিন্তু বররার পদ্ধতিটা একটু ভিন্ন। বররায় শুধু চিংড়ি মাছ ধরা যায়। একটি গুনায় কেচো গেঁথে গেঁথে একটি মালার মতো বানানো হয়। সেই মালাটা সুতো দিয়ে বেঁধে পানিতে ফেলে। সুতার মাথায় একটি কঞ্চি বাঁধা থাকে। সেই কঞ্চিটা থাকে ধলাইয়ের হাতে। ফলে খোট পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কঞ্চিটা আর নাড়ায় না। নৌকায় রাখা ফেন্নি জালটা হাতে নেয়। ত্রিভুজ আকৃতির বাঁশের সঙ্গে জাল বেঁধে তৈরি হয় ফেন্নি জাল। ফেন্নি জালের হাতলে ধরে একটু দূর থেকে পানিতে তলাতে থাকে। এরপর আস্তে আস্তে কেঁচোর গুনা বরাবর এনে একটানে উপরে তুলে ফেলে। এতে গুনার সঙ্গে থাকা কেঁচো খেতে আসা চিংড়ি মাছ আটকা পড়ে তার ফেন্নি জালে। এভাবেই ফজর পর্যন্ত মাছ ধরে ধলাই। আজান হলে বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। মাঝরাত থেকে ভোর অবধি গোটা বিশেক চিংড়ি নিয়ে ঘরে ফেরে সে।
সকালের আলো ফোটার আগেই ঘুম ভেঙে যায় সুন্দরীর। স্বামী বেচারা পরে পরে ঘুমোচ্ছে। স্বামীর মুখের দিকে তাকাতেই রাতের করুণ সুরটা বুকের মধ্যে আলতো খোচা দিয়ে যায়। ‘অ্যামন পাগল করা সুরে বাঁশিটা কেডায় বাজায়?’ নিজেকেই প্রশ্ন করে সুন্দরী। আবার নিজে নিজেই উত্তর দেয়, ‘আমি কি জানি? মন চাইলে খুঁইজা লইতে পারোস না?’ নিজেই বলে, ‘ছি ছি, তওবা তওবা। আমার তো সোয়ামী আছে। আমি খুঁজুম কোন দুঃখে?’ এবার চুপসে যায় সুন্দরী। ‘সোয়ামী আছে’ কথাটা নিয়ে ভাবতে থাকে। স্বামী তো আছেই। কিন্তু সে কেমন স্বামী? নামেমাত্র স্বামী। কী পেয়েছে তার কাছ থেকে? কিছুই পায়নি। যে কিনা সারারাত গাজা খেয়ে পড়ে থাকে। আর ভাবতে পারে না সুন্দরী। কাজে মন দেয়। সকালের আলো ফুটলেই গ্রামে যেতে হবে। জিনিসপত্র গোছাতে থাকে। তার কাজ- বিছানায় প্রস্রাব করা বাচ্চাদের তাবিজ দেওয়া। তবে গোপন একটি চিকিৎসা সে করে। তা হচ্ছে—অবাধ্য স্বামীকে বশে আনার তাবিজও সে দিয়ে থাকে। এই কাজ করেই দিনশেষে দুই কেজি চাল, আধাকেজি ডাল, কিছু পেঁয়াজ, রসুন, শুকনো মরিচ নিয়ে ঘরে ফেরে। যেদিন কেউ পটে না, সেদিন পেটেও ভাত জোটে না। স্বামীর ওপর ভরসা কী? মাছ যা ধরে; তা বিক্রি করে গাজার পোটলা কিনতেই শেষ। তা-ও আবার মাছ ধরায় অতো মনোযোগীও নয়। মাঝে মাঝেই দাওইন হারায়। বিশ-পঁচিশটি বরশিসহ আস্ত একটা দাওইন গায়েব হয়ে যায়। নেশার ঘোরে হয় কাউকে দিয়ে দেয়, নয়তো বিক্রি করে দেয়। সুন্দরী আবার নতুন করে বানিয়ে দেয়। বরশি-সুতা কিনে আনে। একটা দাওইন বানিয়ে স্বামীর হাতে দিয়ে বলে, ‘আবার কোলোম হারাই ফেললে না খায়া থাকতে পারবেন।’ স্বামী ধমক দেয়, ‘আরে যাহ, আমি কি ইচ্ছা কইরা হারাই? মাছে টাইনা নিয়া গেলে আমি কী করুম?’
সম্পর্কের টানাপড়েনের মধ্য দিয়েই এগিয়ে চলে সুন্দরীর সংসার। মুক্তির কোনো পথ খুঁজে পায় না সে। খুঁজেও কোনো লাভ নেই—জানে সুন্দরী। তবে প্রতি রাতের বাঁশির সুর তাকে উতলা করে দেয়। মনে মনে বাঁশিঅলাকে সে খোঁজে ঠিকই। কিন্তু কোথায় পাবে? কার কাছে জিজ্ঞাসা করবে? গ্রামে ঘুরে ঘুরেও কখনো বাঁশির সুর শুনতে পায় না। কাজে মন নেই তার। গ্রামের পথে পথে হাঁটে আর এদিক-ওদিক তাকায়।
একদিন হাঁটতে হাঁটতে হাওলাদারের ভিটায় পৌঁছে যায় সুন্দরী। ভিটা বলতে কতগুলো আম, জাম, খেজুর গাছ ভরা বাগান। হাওলাদার বাড়ির ভিটা বলেই সবাই হাওলাদার ভিটা বলে। বৈশাখের শেষ সময়টাতে আম পাকতে শুরু করেছে। পাকা আমগুলো হঠাৎ হঠাৎ ধপাস করে পরে। ভিটায় বসে থাকা ছেলেমেয়েরা দৌড়ে কুড়িয়ে আনে। কেটেকুটে ভাগ করে খায়। সেদিনও ভিটায় বসে গল্প করছিল আলাল, ধলাই, কফিলসহ কয়েকজন। সুন্দরী হাঁটতে হাঁটতে তাদের হাসি শুনতে পায়। আলাল বলে, ‘আর যা-ই কস ধলাই, রাইতে তোর বাঁশি না হুনলে মাছ ধইরা যুত পাই না।’ কফিল বলে, ‘তোর বাঁশির সুর হোনতে হোনতে রাইতটারেও ছোড মনে অয়।’ ধলাই কিছু বলে না। উপরের দিকে তাকিয়ে থাকে। একটা উদাস উদাস ভাব ওর মধ্যে লক্ষ্য করা যায়।
ভিটায় ওদের বাঁশি সংক্রান্ত আলাপ শুনে কাছে যায় সুন্দরী। সুন্দরীকে দেখে ওরাও রীতিমত থতমত খেয়ে যায়। সহসা ওরা বেদেদের সঙ্গে মিশতে চায় না। ছলচাতুরির ভয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয়। ভাবে, কোনো ধান্দার জন্যই হয়তো বেদেনি ওদের কাছে এসেছে। ভয় পেয়ে আলাল ও কফিলসহ অন্যরা উঠে চলে যায়। ধলাই কিছুটা আনমনা হয়ে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। ধলাইয়ের নির্লিপ্ততা সুন্দরীকে বিচলিত করে। তবুও বলে, ‘রাইতের বেলা চরের মধ্যে বাঁশি বাজায় কেডা?’ সুন্দরীর এমন কথায় চমকে তাকায় ধলাই। ‘ক্যান? তা দিয়া আপনের কী কাম?’ বলে ধলাই। ‘কাম আছে বইলাই তো জানতে চাইলাম।’ জবাব দেয় সুন্দরী।
আমিই বাজাই। কোনো সমস্যা হইছে?
যাউক, আপনেরে তয় পাওয়া গেল। কিন্তু সমস্যা তো আছেই।
ক্যান, কী সমস্যা?
আপনের বাঁশির সুরে আমার ঘুম আহে না। মনটা ছটফট করে।
আপনে কানে তুলা দিয়া রাইখেন? আর মনডারে নৌকার কাছি দিয়া বাইন্দা রাইখেন।
তা-ও পারমু না।
তাইলে আমি কী করতাম?
আমারে নিয়া পালাইবেন?
সুন্দরীর এমন নির্লজ্জ কথায় থমকে যায় ধলাই। কোনো মেয়ে এতো অল্প সময়েই এমন কথা বলতে পারে? হা করে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। এরপর চকিতে বলে ওঠে—
কন কি? পাগল অইয়া গেলেন নাকি? চিনি না জানি না, তা-ও আবার বাইদা।
বাইদা বইলা কি আমরা মানুষ না? বাঁশির সুরে যদি মনে আগুন ধরে তাতে আমার কী দোষ?
আপনের লগে পালায়া গিয়া আমার কী লাভ?
আপনেরে আমি বসায়া বসায়া খাওয়ামু। কোনো রকম কষ্ট দিমু না। আপনে খালি আমারে মাতাল সোয়ামীর হাত থেইকা বাঁচাইবেন।
ওরে আমার খোদা, আপনের স্বামীও আছে? মজা লন আমার লগে? যেইদিক থেইকা আইছেন, হেইদিকেই যান।
বলেই ভিটা থেকে উঠে বাড়ির পথে পা বাড়ায় ধলাই। সুন্দরী অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে ধলাইয়ের চলে যাওয়ার দিকে।
মাছ ধরতে গিয়ে কাজে মন বসছে না ধলাইয়ের। দুই-তিনটা খোটও মিস হয়ে গেল। মাছ ছাড়া বাড়ি গেলে খবর আছে। বাবার বুকনি নির্ঘাত। বাঁশিও বাজায়নি আজ। সারাদিনই বেদেনির কথাগুলো কানে বেজে ওঠে। একটা অজানা-অচেনা মেয়ে তাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে চায়। কত বড় দুঃসাহস। এর আগেও দু’চারজন বেদেনির হাত ধরে যে গেরস্থরা পালিয়ে যায়নি, তা নয়। তবে সমাজ-সংসার ছেড়ে নৌকার জীবন ভালো লাগে না ধলাইয়ের। ভাবতে ভাবতে বররা উঠিয়ে নৌকায় বসে পড়ে ধলাই। রাতেরও প্রায় শেষ। নৌকার গলুই শূন্য। বাড়িও যেতে ইচ্ছে করছে না। ক্ষণিকেই একটি মেয়ে পুরো উলট-পালট করে দিলো তাকে।
হঠাৎ বেদে নৌকার বহর থেকে চেচামেচির শব্দ আসতে লাগলো। নৌকাগুলো ধলাইয়ের নৌকা থেকে খুব বেশি দূরে নয়। ‘হায় হায় রে, কী করলি সুন্দরী। এইডা তুই কী করলি? কোন দোষে এতো বড় সাজা দিলি।’ কথাগুলো কানে বিঁধলো ধলাইয়ের। কে কাঁদছে এমন করে? ফাঁকা চরে ইথারে ভেসে আসা সেই চিৎকার বুকে কাঁপন ধরায়। প্রতিধ্বনি হয় গ্রামের কিণারে। ধলাই ভাবে, কেউ কি মারা গেল? নাকি আবার পালিয়ে গেল কারো হাত ধরে। বেদেরা এসেছে তো কেবল পনেরো দিন হবে। এর মধ্যে পালিয়ে যাওয়ার মতো কী হতে পারে? আর পালিয়ে গেলে তো ধলাইয়েরই যাওয়ার কথা।
কৌতূহলবশত নৌবহরের দিকে এগিয়ে যায় ধলাই। তখন সকালের আলো লাল হয়ে ফুটে উঠেছে। ধলাইয়ের নৌকা গিয়ে ঠেকে ভিড়ের কাছে। অন্য জেলের নৌকাও ভিড় জমিয়েছে সেখানে। পানিতে নৌকার ভিড় ঠেলে উঁকি মেরে দেখে- সেই মেয়েটি নিথর পড়ে আছে। যে কিনা গতকাল দুপুরে ধলাইকে নিয়ে পালিয়ে যেতে চেয়েছিল। এ সময় কেউ একজন বলছে, ‘সুন্দরী রাইতে ধুতুরা ফুল খাইয়া পৃথিবী ছাইড়া চইলা গেল। একবারও বুঝতে পারলাম না, ক্যান এই কামডা করলো।’ কেউ কেউ বলছে, ‘ধুতুরা না ছাই। ওর বদ-মাতাল জামাইটাই ওরে মাইরা ফালাইছে।’
ধলাইয়ের চোখে ভেসে ওঠে সুন্দরীর মুখ। চোখ ভরা আশা, বুক ভরা ভালোবাসা। মানুষ কত অসহায়। ধলাই ভাবে, রাতে বাঁশির সুর শুনতে না পেয়ে হয়তো বেশি কষ্ট পেয়েছে। লগি ঠেলতে ঠেলতে কোমরে গোজা বাঁশিটা বের করে হাতে নেয়। এক অসহনীয় কষ্ট অনুভূত হচ্ছে তার। আহারে, মেয়েটি সত্যিই বাঁচতে চেয়েছিল। বেদে হয়েছে তো তার কী দোষ? ভাবতে ভাবতে নিজের ওপর রাগে—সুন্দরীকে প্রত্যাখ্যানের দুঃখে বাঁশিটা অনেক দূরে ছুড়ে মারে।
সকালের চিকচিকে রোদের আলোয় জলের ঢেউয়ের তালে তালে ভেসে যায় হন্তারক বাঁশিটি।
এসইউ/এমকেএইচ