তিনটি বছর হয়ে গেল তিনি নেই
সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী আজ। দেশবরেণ্য এ লেখক ২০১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ৮২ বছর বয়সে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। কবির ইচ্ছানুযায়ী জন্মশহর কুড়িগ্রামের সরকারি কলেজ মাঠে তাকে বিশেষ মর্যাদায় দাফন করা হয়।
সৈয়দ শামসুল হকের বাংলা সাহিত্যের প্রায় সবগুলো শাখায় ছিল সাবলীল বিচরণ। তিনি প্রায় সবগুলো শাখায় নিজের দক্ষতা ও পারদর্শিতার পরিচয় দিয়ে ছিলেন। তাই উনাকে অভিহিত করা হয় বাংলা সাহিত্যের একজন ‘সব্যসাচী লেখক’।
ঢাকা ও কবির জন্মস্থান কুড়িগ্রামে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন যথাযথ মর্যাদায় দিনটি পালনের জন্য কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। প্রকাশনা সংস্থা বেঙ্গল পাবলিকেশনস প্রকাশ করেছে তার অপ্রকাশিত দীর্ঘ কবিতা নুন-পূর্ণিমা এবং সৈয়দ হকের অনুবাদগ্রন্থ আফ্রিকান ও অন্যান্য কবিতা। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি 'সৈয়দ শামসুল হক তৃতীয় প্রয়াণ বর্ষ স্মরণার্ঘ্য' শিরোনামে সন্ধ্যা ৭টায় জাতীয় নাট্যশালায় মঞ্চায়ন করবে সৈয়দ শামসুল হক রূপান্তরিত উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের বিশ্বখ্যাত নাটক হ্যামলেট।
এদিকে কবির জন্মস্থান কুড়িগ্রামে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন তার সমাধিতে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন, আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে।
বাংলা সাহিত্যের এ মেধাবী কবি ২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এর আগে তিনি প্রায় ৪ মাস লন্ডনের চিকিৎসাধীন ছিলেন। ফুসফুসের সমস্যা দেখা দিলে ২০১৬ সালের ১৫ এপ্রিল তাকে লন্ডন নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষার তার ফুসফুসে ক্যান্সার ধরা পড়ে।
কবিতা, উপন্যাস, নাটক, ছোটগল্প, চলচ্চিত্র, গান, অনুবাদসহ সাহিত্যে-সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার সাবলীল লেখালেখির জন্য তাকে ‘সব্যসাচী’ লেখক বলা হয়ে থাকে। তার লেখকজীবন প্রায় ৬২ বছরব্যাপী বিস্তৃত। সৈয়দ হক ১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর কুড়িগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
তার প্রথম লেখা একটি গল্প, যা ১৯৫১ সালে ফজলে লোহানী সম্পাদিত ‘অগত্যা’ নামে একটি ম্যাগাজিনে ছাপা হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে তার প্রথম উপন্যাস ‘দেয়ালের দেশ’ প্রকাশিত হয় ১৯৫৬ সালে ১৯৬৬ সালে মাত্র ২৯ বছর বয়সে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন তিনি। বাংলা সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৮৪ সালে তাকে একুশে পদক এবং ২০০০ সালে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করে সরকার।
তিনি ১৯৫৯ সালে মাটির পাহাড় চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লেখেন। এরপর ‘তোমার আমার’, ‘শীত বিকেল’, ‘কাঁচ কাটা হীরে’, ‘পুরস্কার, ‘বড় ভাল লোক ছিল’সহ আরও বেশ কিছু চলচ্চিত্রের কাহিনী, চিত্রনাট্য ও সংলাপ লেখেন। ‘বড় ভাল লোক ছিল’ও ‘পুরস্কার’এ দুটি চলচ্চিত্রের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন।
চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লেখার পাশাপাশি তিনি চলচ্চিত্রের জন্য গানও রচনা করেছেন। এখানেও তিনি সফল হয়েছেন এবং পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।
তিনি ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে লন্ডন চলে যান এবং সেখানে বিবিসির বাংলা খবর পাঠক হিসেবে কাজ করেন। তিনি ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসর্মপণের খবরটি পাঠ করেছিলেন। পরে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৮ পর্যন্ত বিবিসি বাংলার প্রযোজক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
সৈয়দ হকের উপন্যাসের মধ্যে ‘এক মহিলার ছবি’, ‘অনুপম দিন’, ‘সীমানা ছাড়িয়ে’, ‘নীল দংশন’, ‘স্মৃতিমেধ’, ‘মৃগয়া’, ‘এক যুবকের ছায়াপথ’, ‘বনবালা কিছু টাকা ধার নিয়েছিল’, ‘ত্রাহি’, ‘তুমি সেই তরবারি’, ‘কয়েকটি মানুষের সোনালী যৌবন’, ‘নির্বাসিতা’, ‘খেলারাম খেলে যা’, ‘মেঘ ও মেশিন’, ‘ইহা মানুষ’, ‘বালিকার চন্দ্রযান’, ‘আয়না বিবির পালা’ প্রভৃতি। তার কাব্যগ্রন্থের মধ্যে ‘বৈশাখে রচিত পঙ্ক্তিমালা’, ‘বিরতিহীন উৎসব’, ‘প্রতিধ্বনীগণ’, ‘পরানের গহিন ভিতর’ উল্লেখযোগ্য।
কবির সম্পর্কে জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের আবেগ-অনুভূতি-বিকার সবকিছুই খুব সহজ কথা ও ছন্দে সৈয়দ হক তার লেখনীতে তুলে এনেছেন। তিনিই প্রথম নতুন উদ্দীপনায় মধ্যবিত্তের কথা ভালো করে বললেন এবং মধ্যবিত্ত জীবনের বিকারকেও তুলে ধরলেন। তার আগের বড় লেখকেরা সবাই গ্রামকেন্দ্রিক উপন্যাস বা গল্প লিখেছেন। কিন্তু তিনি তার রচনায় সমসাময়িক বাংলাদেশকে তুলে এনেছেন।
নাট্যব্যক্তিত্ব নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু বলেন, নাট্যকার হিসেবেও সৈয়দ হক ছিলেন দারুণ সফল। বিশেষ করে তার রচিত দুটি কাব্যনাট্য ‘নুরলদিনের সারাজীবন’ এবং ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ বাংলা নাটকে একটি বিশেষ স্থান দখল করে রয়েছে।
এনএফ/এমকেএইচ