প্রথম চিঠি
এ কে এম গোলাম কাওসার
রাজীব ট্রাংকের মধ্যে কিছু পুরোনো ছবি খুঁজছিল। ছবিগুলো ওর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তের, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের। ছবিগুলো লেমিনেটিং করা আছে। রাজীব ছবিগুলো এস্তোনিয়ায় নিজের সঙ্গে করে নিয়ে যাবে। ও এস্তোনিয়ান ইউনিভার্সিটি অব লাইফ সায়েন্সে এগ্রি ফুড বিজনেস ম্যানেজমেন্টে মার্টার্স প্রোগ্রামে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। অক্টোবর থেকে ক্লাস শুরু। কালকের পরদিনই ফ্লাইট। ব্যাগ গোছানো চলছে। ছোট বোন, মা আর প্রিয়তম স্ত্রী খুব সাহায্য করছে। বিয়ের বয়স বেশি দিন হয়নি। গত সপ্তাহে ওরা প্রথম বিবাহবার্ষিকী পালন করেছে। পরিবারের সবার মন খারাপ। তারপরও ওকে বিদায় দিতে হবে, উচ্চশিক্ষার হাতছানি এসেছে। রাজীব স্মৃতিস্বরূপ পারিবারিক কিছু ছবির সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি ছবি নেবে। ছবিগুলো খুঁজতেই একটা পুরোনো মানিব্যাগের দিকে ওর চোখ যায়। হাতে নিয়ে দেখে সেই পুরোনো মানিব্যাগ, যেটা চাঁদনী উপহার দিয়েছিল। সাথে সাথে ওর মনে হলো মানিব্যাগের ভেতরে একটা চিঠিও থাকার কথা। একটু খুঁজতেই মানিব্যাগের মিনি পকেটে চিঠিটি পাওয়া গেল। লালচে রং ধারন করেছে, বহু দিনের পুরোনো তো। এটি ছিল ওর জীবনের প্রথম প্রেমের চিঠি। যে চিঠির উত্তর কখনোই দেওয়া হয়নি। প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে একবার চিঠিটি পড়তো। আবার খুব যত্নে রেখে দিতো মানিব্যাগের মিনি পকেটে।
চিঠিটি দিয়েছিল চাঁদনী। চাঁদনী রাজীবের জীবনের এক অতি গুরুত্বপূর্ণ অতীত। ওরা একে অপরকে খুব ভালোবাসতো। চাঁদনী ছিল রাজীবের শক্তি, সাহস ও প্রেরণার উৎস। রাজীব বলতো, চাঁদনীকে দেখলেই কিংবা কথা বললেই ও শক্তি পায়, সকল ক্লান্তি দূর হয়। যে মেয়ে সারাদিন টিউশনি করে, পারিবারিক দায়িত্ব পালন করেও ভালো রেজাল্ট করতে পারে, সে অবশ্যই প্রেরণা। দুজনার মধ্যে বোঝাপড়াটা খুব ভালো ছিল। চাঁদনী প্রায়ই রাজীবকে বলতো, আমি তোমাকে পুরাটাই পড়তে পারি, তুমি আমার কোন কথায় কী ভাবতে পারো, তুমি আমার কোন কথায় কী উত্তর দেবে, কোন কথায় তুমি কষ্ট পাবে, কোন কথায় তোমার ভালো লাগবে- সব আমি জানি। রাজীবও চাঁদনীর মুখের দিকে তাকালে সব বুঝতে পারতো, চাঁদনীর মন ভালো কি খারাপ, সে কি কোন কিছু গোপন করছে বা বলতে চাইছে না- সব। সবই ঠিকঠাক ছিল, কিন্তু একসাথে থাকা হয়নি ওদের। ওদের মধ্যে ধর্মের অদৃশ্য দেয়াল ছিল, যে দেয়াল ওরা কেউ ভাঙতে পারেনি। অনেকবার ভাঙার চেষ্টা করেও পারেনি। দুজনের সুখের জন্য দুই পরিবারের অনেকগুলা মানুষকে ওরা কষ্ট দিতে চায়নি। বিদেশে গিয়ে একসাথে থাকারও পরিকল্পনা ছিল ওদের। সব পরিকল্পনা কি আর আলোর মুখ দেখে? চাওয়া আর প্রাপ্তি মিলে যাওয়া কি এতোই সহজ? দুজন দুদিকে চলে গেছে। ভিন্ন ভিন্ন সংসার হয়েছে ওদের। দুজনই ভালো আছে। একসাথে থাকা হয়নি ঠিকই, কিন্তু ভালোবাসা কমেনি। এখনো ওরা পরস্পরকে ভালোবাসে। ভালোবাসলেই কি পেতে হবে? না পেয়ে মনে হয় ভালোই হয়েছে। পেলে হয়তো ভালোবাসাটা কমে যেতো। যে কোন জিনিস পাওয়ার পর তার মূল্য কমে যায়। না পাওয়ার কষ্ট থেকেই হয়তো আজও ভালোবেসে যেতে পারছে।
চিঠিপ্রাপ্তির দিনটি ছিল ২০০০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বরের দুপুর সোয়া ১টা কি দেড়টা। ওইদিন সকাল থেকেই রাজীব-চাঁদনীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মিলনায়তনে স্টেজে নাচের রিহার্সেলে ব্যস্ত ছিল। রিহার্সেলটা হচ্ছে ২৬ সেপ্টেম্বরের অনুষ্ঠানকে ঘিরে। অনুষ্ঠানে ওদের মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদ থেকে পাসকৃত প্রাক্তন গ্রাজুয়েটরা আসবে। অনুষ্ঠানে দুটি অংশ থাকবে। প্রথম অংশে থাকবে আলোচনা সভা, যেখানে প্রাক্তনরা তাদের সফলতার গল্প শোনাবে। যা বর্তমানদের জন্য অনুপ্রেরণা হবে। দ্বিতীয় অংশে থাকবে সাংস্কৃতিক আচার। প্রায় এক সপ্তাহ যাবৎ অংশগ্রহণকারী ছাত্রছাত্রীরা ক্লাসরুমে রিহার্সেল করেছে। পরদিন যেহেতু মূল অনুষ্ঠান মিলনায়তনে হবে, সেজন্য মিলনায়তনের স্টেজে রিহার্সেল করে নিজেদের অবস্থান ঠিক করে নিচ্ছে। সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর থেকে এটা ওদের দ্বিতীয় অনুষদীয় অনুষ্ঠান। আর একবছর পরই অনার্স শেষ। তাই রাজীব-চাঁদনীসহ ওদের ব্যাচের প্রায় সবাই স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করছে। চাঁদনী একটা দেশাত্মবোধক গান ‘মাঠের সবুজ থেকে সূর্যের লাল, বাংলাদেশের বুক এতই বিশাল’-এ প্রায় বিশজনের সাথে কোরাস কোরিওগ্রাফি করছে। চাঁদনীদের কোরিওগ্রাফিতে নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া ভালোই হয়েছে। সাংস্কৃতিক পর্ব এই দেশাত্মবোধক গান দিয়েই শুরু হবে। আর রাজীব একটি আসামীয় গান ‘উখা উখা সিরিসের নিচে চায় গাচ, মোর গয়রাম তুলিছে কাঁচা কাঁচা পাত’-এ চার জনের সাথে কোরাস কোরিওগ্রাফি করছে। এদের কোরিওগ্রাফিটাও ভালোই মিলেছে।
রাজীব ২৫ সেপ্টেম্বরের সেই ব্যস্ত দুপুরে রিহার্সেলের ফাকে ক্ষণিক বিশ্রাম নিচ্ছিল। এমন সময় চাঁদনী রাজীবকে ডাকল একটুখানি মিলনায়তনের বাহিরে কথা বলবে বলে। চাঁদনীর ডাকার ভঙ্গি খুব অদ্ভুত, কখনো রাজীবের নাম ধরে ডাকতো না। ওর নাকি নাম ধরে ডাকতে ভালো লাগে না। ‘ওই’ বলে ডাকতো সবসময়। এতে অবশ্য সমস্যাও হতো বেশ। রাজীবের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সময় লাগতো চাঁদনীর। নিজে যখন পারতো না, তখন বন্ধুদের বলতো, ওকে একটু ডেকে দাও। যা হোক রাজীব চাঁদনীর ডাক পেয়ে ক্লান্ত ভঙ্গীতে বাহিরে যেতে থাকলো। আর ভাবতে থাকলো কী এমন জরুরি কথা যে বাহিরে গিয়ে বলতে হবে? ভেতরেও তো বলতে পারতো। দুজনার মধ্যে ভাব-ভালোবাসাটা তখনো কেবল শুরুর দিকে। পরস্পরের প্রতি অধিকার খাটানো এতোটা প্রবল হয়নি। এখনো দুজন ভাবছে, কী করবে, এগোবে না পেছাবে, ধর্মের বাঁধা কিভাবে টপকাবে?
চাঁদনী মিলনায়তনের মূল গেট থেকে একটু সরে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে ছিল। সেদিন সে পড়েছিল গোলাপি রঙের একটা থ্রি-পিস। গোলাপি রঙে ওকে খুব সুন্দর দেখায়। রাজীব সাধারণত একটু আধুনিক ঘরানার মেয়ে পছন্দ করে। টপ-জিন্স পরা মেয়ে ওর খুব পছন্দ। কিন্তু চাঁদনীর প্রতি দিনে দিনে মায়া বাড়ছে, ওর সবকিছুই ভালো লাগতে শুরু করেছে। চাঁদনীর দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গী দেখে বোঝা যাচ্ছিল ও আসলেই গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলবে। রাজীব খুব আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল, সিরিয়াস কিছু বলবা নাকি, বলো? চাঁদনী গম্ভীর ভাব নিয়ে থাকার চেষ্টা করল কিন্তু পারল না। অবশ্য রাজীবের সাথে সবসময়ই তাই হয়। ও যে কোন সিরিয়াস কথা খুব হালকাভাবে নেয়। আর সিরিয়াস কথা নিয়ে এমনভাবে ফাজলামি করে যে হাসি পায় আবার মাঝেমধ্যে মেজাজও গরম হয়। ওকে আবেগের কথা বলে লাভ হয় না, একটা অট্টহাসি দিয়ে সব উড়িয়ে দেয়। আজকে যেহেতু ব্যপারটা খুব গুরুত্বপূর্ণ, তাই কোন ধরনের ঝুঁকি না নিয়ে চাঁদনী বলল, সে মুখে বলতে পারবে না, লিখে দেবে। বলেই ব্যাগে হাত ঢুকাতে ঢুকাতে আরেকটু দূরে গেল। রাজীব দেখতে পাচ্ছিল, চাঁদনী ব্যাগ থেকে একটা কলম বের করল। একটা খাতাও বের করল। খাতা-কলম সবসময়ই ওর ব্যাগে থাকে, লেখাপড়ায় মনোযোগী ছাত্রী বলে কথা। মিলনায়তনের দেয়ালে খাতাটা ঠেস দিয়ে কিছু একটা লিখল। লেখা শেষ করে পৃষ্ঠাটি ছিড়ল। তারপর লাজুক ভঙ্গীতে ধীরে ধীরে আসল। রাজীবের হাতে চিঠিটা দিয়ে বলল, এখন পড়বে না, হলে গিয়ে পড়বে, পড়ার পর কালকে উত্তর চিঠিতে লিখে দেবে। রাজীব কি আর কথা শোনার ছেলে? কোন অনুরোধের তোয়াক্কা না করে, আরে কী এমন সিরিয়াস জিনিস এখনই পড়ি- বলতে বলতে চিঠিটা খুলে পড়া শুরু করল। খুব অবাক কাণ্ড, চিঠিটার মধ্যে একটি মাত্র বাক্য লেখা- ‘আমি যদি সব ছেড়ে তোমার কাছে চলে আসি, তুমি কি আমায় গ্রহণ করবে?’
চাঁদনীর এক বাক্যের চিঠি পড়ে রাজীবের মাথায় যেন বাজ পড়ল। কানে যেন কিছুই শুনছে না, কালা হয়ে গেছে, মুখ দিয়েও কথা বের হচ্ছে না, বোবা হয়ে গেছে। প্রচণ্ড অসহায় লাগছে ওর, মনে হচ্ছে হাত-পায়ে কোন শক্তি নেই। চিঠি থেকে কোনরকম মাথা উঠিয়ে চাঁদনীর দিকে তাকাতেই দেখে, চাঁদনীর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে, চাঁদনী কাঁদছে। রাজীব অসহায়ের মতো শুধু জিজ্ঞেস করে, তুমি কি পারবে চাঁদনী সব ছেড়ে আমার কাছে আসতে? তুমি তো পরিবারের বড়। চাঁদনী প্রচণ্ড রাগে চিৎকার দিয়ে বলে ওঠে, তুমি জাস্ট বল, ইয়েস অর নো? রাজীব কিছুই বলতে পারে না, মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। চাঁদনী কোন উত্তর না পেয়ে দ্রুত হলের দিকে হাঁটা দেয়। রাজীব চাঁদনীর চলার পথের দিকে তাকিয়ে থাকে, চাঁদনী অনবরত ওড়না দিয়ে চোখ মুছছে। রাজীবের তাকিয়ে থাকা ছাড়া বিশেষ কিছু করার নেই। সে জানে, চাঁদনী কখনোই সব ছেড়ে চলে আসতে পারবে না, এটা তার সাময়িক আবেগ।
হঠাৎ পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে স্ত্রী বলল, এরকম খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে আছো কেন, খাবে এসো। রাজীব যেন সম্বিৎ ফিরে পেল। ইতস্তত হয়ে উত্তর দিলো, যাও আসছি। রাজীব খেয়াল করল, সে আসলেই খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে আছে। চিঠির কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে সেই ২৫ সেপ্টেম্বরে হারিয়ে গিয়েছিল, বুঝতেই পারেনি। সে তো এখন বাস করছে বর্তমানে। ২০১৯ সালের ১ সেপ্টেম্বরের সন্ধ্যারাতে। রাজীব চিঠিটি আবারও খুব যত্নে মানিব্যাগের মিনি পকেটে ভরে ট্রাংক বন্ধ করে দিলো। ট্রাংক বন্ধ করে রাজীব বুঝি তার স্মৃতিগুলোকে বন্ধ করতে চাইল।
পাশের ঘর থেকে ডাক আসছে, ওই খেতে আসো। রাজীব চমকে ওঠে, ‘ওই’ বলে কে ডাকে? চাঁদনী? না, কেউ ডাকেনি। রাজীব কি এখনো অতীতেই আছে?
লেখক: সিনিয়র লেকচারার, এক্সিম ব্যাংক কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ।
এসইউ/এমকেএইচ