ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

১৫তম নজরুল সম্মেলন এবং আমি

প্রকাশিত: ০৩:৩৮ এএম, ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫

বাসা আর কাজের জায়গা- এই হলো আমার সারা মাসের যাতায়াতের দিনপঞ্জি। আমার ঘোড়া নাই, গাড়ি নাই, দাওয়াত করার মানুষের সংখ্যাও অঙ্গুলিমেয়। এখানে আমাকে চেনে-জানে কড়ে আঙুলে গোনা কয়েকজন। এদের কয়েকজন আমার পুরোনো পরিচিত, বাকিরা নতুন। নতুনেরা আমাকে দেখে, ভাবে এই বয়স্ক লোকটা কে? কি করে? আগে তো দেখিনি...ইত্যাদি।

যাহোক, মাসের শনিবার ও রোববারগুলো লস এঞ্জেলেসের বাঙালিদের জন্য অনুষ্ঠানে যোগ দেবার দিন। পারিবারিক বা সামাজিক, সাংস্কৃতিক আলোচনা অনুষ্ঠান করার দিন। কাজের দিনগুলোতে তারা কোনো অনুষ্ঠান করেন না বা করতে পারেন না। সময়ের অভাব, বলা যেতে পারে কাজ করার পর আর কোনো অনুষ্ঠানে যোগ দেবার মন-মেজাজ থাকে না। তাই এই দুটোদিন সবাই দাওয়াত রক্ষায় কিংবা কোনো অনুষ্ঠানে যোগ দিতে উদগ্রীব থাকেন। অথবা বলা যায় তাদের মানসিক ও নৈতিক স্ক্যাজিউল থাকে শনি/রবির জন্য। আরা সে-রকম কোনো বালাই নেই। আরা কোনো স্ক্যাজিউল নেই। তবে, কখনো-সখনো কেউ যদি দাওয়াত করেন, আমি বলি ভাই শনিবার হলে আমার পক্ষে তা রক্ষা করা সহজ। তারাও বোঝেন, অন্যদিনগুলোর সমস্যা কোথায়।

আমাকে সাধারণত কেউ ডাকেন না। কারণ আমার রাইড নাই। ফলে এইরকম একজন খোঁড়াকে এড়িয়ে চলাই শ্রেয় বিবেচনা করেন অনেকেই। তবে কেউ কেউ তো ব্যতিক্রম থাকেনই। সেই রকম একজন জাহিদ হোসেন পিন্টু। তিনি ৩/৪ মাস আগেই একদিন ফোনে বলে রেখেছিলেন যে নজরুল কনভেশনে আপনাকে আসতে হবে। তো, সেই অনুষ্ঠানেই গিয়েছিলাম আমি ২৯ ও ৩০ অাগস্ট। ১৫তম উত্তর আমেরিকা নজরুল সম্মেলন ২০১৫’ আয়োজন করেছিলো বাংলাদেশ একাডেমি অব লস এঞ্জেলেস। কনভেনর ছিলেন পিন্টু। অনুষ্ঠানস্থল ছিলো বার্নসডাল গ্যালারি থিয়েটার, হলিউড বুলেভার্ড, লস এঞ্জেলেস। দুদিন ধরে অনুষ্ঠান, অনেক মানুষের পার্টিসিপেশন। এর মধ্যে আমি যাদের সাথে ছিলাম তারা হলেন ড. সুলতান আহমেদ, তিনি ওয়াশিংটন থেকে এসেছেন। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকে কাজ করতেন, এখন অবসরজীবন। ওয়াশিংটন ডিসি থেকে আরও একজন এসেছিলেন, তিনি আনিস আহমেদ। কাজ করেন ভয়েস অব আমেরিকায়। যৌবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। তারপর বিবিসি হয়ে এখন ভয়েস অব আমেরিকা ‘ভোয়া’তে। আর আমি তো বাংলাদেশের একজন, এখানে এসে ফেঁসে গেছি বলা যেতে পারে।

আমার এবং আমাদের প্রিয় কবি  এবং জাতীয় কবি নজরুল সম্পর্কে আলোচনাই আমার এবং আনিস সাহেবের প্রধান কাজ। আনিস আহমদ হোমওয়ার্ক করে এসেছেন। পেপার তৈরি করে নিয়ে এসেছেন,‘ভিন্নতায় অভিন্ন দুই সাহিত্যিক’ শিরোনামে। রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুলকেই উপাত্ত করেছেন এই রচনায়। তিনি সেটা উপস্থাপন করলেন। অধ্যাপনা করতেন তা বোঝা গেলো, তার বলার ভঙ্গি দেখে। সুলতান সাহেব শুভেচ্ছা বক্তব্য দিলেন। আমি নজরুল সম্পর্কে বলতে বলতে চলে গেলাম একেবারে গোড়ার প্রশ্নে। জাতীয় কবিকে দেশের সাধারণজনেরা কি চেনেন? তারা কি নজরুলের রচনা পড়েছেন? তারা পড়বেন কেমন করে? তারা কি সাক্ষর? পড়াশোনো করে আমাদের মতো ‘শিক্ষিত’? না তাদের একটি বড়ো অংশই সাক্ষর নন, শিক্ষিত হওয়া তো দূরের কথা। দেশের ৩৫ হাজার গ্রামে কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয় আজো নেই। তারা প্রতিদিনই বঞ্চিত হচ্ছে তাদের রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক অধিকার থেকে। আর সেই বঞ্চনা দিয়ে চলেছে দেশের সরকারগুলো। তাদের পবিত্র দায়িত্ব হচ্ছে অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান, চিকিৎসার মতো মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা। কিন্তু স্বাধীনতাউত্তর কাল থেকে কোনো সরকারই এই ব্যাপারে তেমন উৎসাহী ছিলো বা এখনও আছে সেটা আমার মনে হয়নি।

তাহলে আমাদের জাতীয় কবি নজরুলকে ওই মানুষদের কাছে পৌঁছাবেন কী করে? অথচ, গাঁয়ের সাধারণ মানুষ নজরুলের মানবিক-মানসিকতায় বিশ্বাসী। তাদেরই প্রাণের কবি তিনি। তিনি সাম্যবাদিই কেবল ছিলেন না, মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ তিনি মানতেন না। সরকারের বোঝা উচিৎ কোন কাজটা আগে করতে হবে, সেটা বিবেচনা করা। বললাম, সরকার বোঝে, কিন্তু করে না। কারণ গ্রামের মানুষেরা যদি শিক্ষা লাভ করে, তাহলে আজকে যে সব মিথ্যাচার চলছে রাজনীতিতে তা আর চলতে পারবে না। সরকারের এই ঔপনিবেশিক মানসিকতাই প্রমাণ করে, তারা উপযুক্ত নন একটি স্বাধীন জাতিকে শোষণহীন উন্নত জীবনে নিয়ে যেতে। আমাদের প্রশাসনিক ব্যবস্থা ব্রিটিশদের পরিত্যক্ত, তাদের ফেলে যাওয়া ভারত শাসনের আইনগুলোই একটু ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে চালু রেখেছে। এটা নজরুলের রাজনৈতিক অভিপ্রায়ের ঘোরতর বিরোধী। দেশে শিল্পসাহিত্যের যেমন তেমন উল্লেখ করার মতো গবেষণা ধারা নেই, তেমনি বৈজ্ঞানিক বা শিল্প বিষয়ক গবেষণাও হচ্ছে না। গবেষণা না হলে সেই জাতি তার ইনোভেশন ধারা হারিয়ে ফেলতে বাধ্য।

তাই কোনো করতালি কিন্তু মেলেনি আমার বক্তৃতার পর। গোটা পঞ্চাশেক মানুষ ওই সুন্দর থিয়েটার হলে বসেছিলেন, তারা শুনেছেন, কিন্তু তাদের বোধে আমার কথাগুলো হানা দিতে পারেনি। কারণ তারা বসেছিলেন মূলত গানের জন্য। একেকজন কুড়ি ডলার দিয়ে টিকিট কেটে ঢুকেছেন, তারা তো গানের বাণী আর সুরে মুগ্ধ হতেই চাইবেন। তো আমরা গান শুনলাম সুজিত মুস্তাফা, ইয়াসমিন মুশতারি, সোমা হাওলাদার, অনুপ বড়ুয়া এবং পিন্টুর সুযোগ্যপুত্র  তমাল হোসেন এবং কয়েকটি দল নাচলেন নজরুলের কবিতার সাথে। অন্তত দুটো নাচের গ্রুপ এসেছিলো লাস ভেগাস থেকে, আর এখানকার একটি গ্রুও নাচ প্রদর্শন করেছে। এটা প্রথমদিনের কথা লিখলাম, দ্বিতীয়দিনের কথা আমি জানি না, যেতে পারিনি।

অনুষ্ঠান কেমন হলো এটা একটা জিজ্ঞাসা থাকেই। পার্টিসিপ্যান্টরা সাধারণত বলেন না যে খারাপ হয়েছে। কিন্তু কিছু কিছু বিরক্তিকর কাজ আয়োজকরা সব সময়ই করে থাকেন। যেমন এবারও সেটা হয়েছে। মঞ্চ সজ্জিতকরণের দায়িত্ব ছিলো পঙ্কজ দাসের ওপর, তিনি তিনটার মধ্যে সেটা শেষ করতে পারেননি। ফলে সেই অসমাপ্ত মঞ্চ ঢেকে দিয়ে শুরু হয়েছে স্ক্যাজিউল নির্ধারিত প্রোগ্রাম। পরে গানের সময় সুন্দর একটা  শোভন ব্যাকগ্রাউন্ড দেখলাম। ভালো লাগলো। অনুষ্ঠানটি যেহেতু নজরুল সম্মেলন, সেখানে আলোচনা অনুষ্ঠানের ওপরই জোর দেয়া উচিত। কিন্তু টিকিট কেটে আসা দর্শক-শ্রেতাদের কথা মনে রেখে আয়োজকরা [এটা সব জায়গায়ই একই রকম] গান-বাজনার দিকেই বেশি ঝোঁকেন। এখানেও তার কোনো ব্যতিক্রম নেই।

প্রকৃত প্রস্তাবে, নজরুলকে যদি জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে হয়, তাহলে তার জন্য একটি কর্ম পরিকল্পনা দরকার। সেটা যেমন উত্তর আমেরিকা থেকেও করা যায়, তেমনি বাংলাদেশ থেকেও। ঠিক এই পরিপ্রেক্ষিত মনে রেখে আমি আমার বক্তব্যে বলেছি, একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য। আমার বক্তব্যের পর প্রোগ্রাম এ্যাডভাইজার মুকতাদির চৌধুরী দর্শক-শ্রোতৃমণ্ডলিকে জানালেন, তারা এই বিষয়টি মাথায় রেখে কাজ করবেন এবং নজরুল সাহিত্যের গবেষণার একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবেন। তুলুক আর না তুলুক, তারা যে তাৎক্ষণিকভাবে সারা দিয়েছেন, সেটাই বা কম কি? আমাদের সরকারগুলো, আমাদের  প্রাজ্ঞ মানুষেরা প্রতিনিয়তই তো নানা রকম ওয়াদা করেন এবং তার বরখেলাপ করেন। এতে দোষ হয়তো হয়, কিন্তু আমাদের মেধাবিরা এটাকে দোষণীয় মনে করেন না। আমি নিজেও তো সেই দলেরই একজন।

তবে, একটা বিষয় আমাকে অবাক করেছে, তাহলে এই লস এঞ্জেলেসে এবং আমেরিকার আরো বহু শহরে বাংলা সংস্কৃতি আর বাংলাভাষাকে নিয়ে প্রণোদনাময় আয়োজন হয়। এটা একটি শুভ লক্ষণ। নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো হলেও এতে আছে প্রাণের টান। আছে দেশ ও জাতিসত্তার প্রতি মমত্ববোধ, আছে আত্মপরিচয়ের একটি মোহন চেতনা। এই টান আত্মার সাথে গাঁথা। একে কি বিচ্ছন্ন করা যায়? যায় না। তাই ছেলেমেয়ে নিয়ে অনেকেই অনুষ্ঠান উপভোগ করতে আসেন। রাত বারোটা পর্যন্ত গান শোনেন। তবে, একটি অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে যে উপদলীয় কোন্দল আর বহুদলীয় দলাদলি হয়, সেটা পরিত্যাগ করাই বাঙালির জন্য শ্রেয়!

লস এঞ্জেলেস, যুক্তরাষ্ট্র

এইচআর/এমএস