ভিডিও EN
  1. Home/
  2. সাহিত্য

লেখকের সবচেয়ে বড় পুরস্কার পাঠকের ভালোবাসা: মোস্তফা কামাল

সাহিত্য ডেস্ক | প্রকাশিত: ০২:১৩ পিএম, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক মোস্তফা কামাল। পেশাগত জীবনের বাইরে লেখালেখিই তাঁর একমাত্র আরাধ্য। ১৯৮৪ সালে ছড়া-কবিতা লিখে সাহিত্যাঙ্গনে পদযাত্রা। এরপর সাহিত্যের প্রায় সব শাখাতেই তাঁর অবাধ বিচরণ। ইংরেজি সাহিত্য ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন। ১৯৯১ সাল থেকে নিয়মিত লেখালেখি ও সাংবাদিকতায় যুক্ত হন। তিনি দৈনিক সংবাদ ও প্রথম আলো পত্রিকায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।

বর্তমানে দৈনিক কালের কণ্ঠর নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে কাজ করছেন। সম্পতি তাঁর ‘জননী’ উপন্যাসটি লন্ডন থেকে ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়েছে। তারও আগে ভারতের নোশনপ্রেস থেকে বেরিয়েছে তিনটি উপন্যাসের ইংরেজি সংকলন ‘থ্রি নভেলস’। তাঁর লেখালেখির শুরুর গল্প, সাংবাদিকতা এবং সাহিত্যের নানা ক্ষেত্রে লেখার বিস্তার ইত্যাদি বিষয়ে কথা হয়। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মাসউদ আহমাদ

আপনার প্রথম উপন্যাস ‘পাপের উত্তরাধিকার’। আপনি তো লেখালেখি শুরু করেছিলেন ছড়া দিয়ে, কথাসাহিত্যের ভুবনে আত্মপ্রকাশ করলেন কীভাবে?

মোস্তফা কামাল : আমার প্রথম লেখাটি ছড়া, এটি ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত হয় বরিশালের ‘প্রবাসী’ নামের পত্রিকার সাহিত্য পাতায়। ছড়াটির নাম ছিল মেঘনা। মেঘনা নদীর ভাঙন নিয়ে ছিল সেটি। লেখাটি প্রকাশিত হলে খুব উৎসাহ পাই এবং আমার মাকে দেখাই। মা খুব খুশি হন এবং আমাকে আশীর্বাদ করেন যে, তুই নিয়মিত লেখ। একদিন তুই অনেক বড় হবি। তারপর থেকে আমি নিয়মিত লিখি। কবিতা ও ছড়া পাঠাই। কখনো ছাপা হয়, কখনো হয় না। তখন থেকেই স্বপ্ন দেখি যে, আমি লেখকই হব। এরপর আমি বরিশালের স্থানীয় পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হই। নানা ধরনের সামাজিক ঘটনা ও বিষয় নিয়ে পত্রিকায় লিখতে থাকি। তারা পছন্দ করে এবং প্রকাশ করে।

এভাবে আমার পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হওয়া। বিষয়টা নেশার মতো ছিল, এমন নয়। কিন্তু ভালো লাগতো। পরে স্কুলজীবন শেষ করে আমি ঢাকায় আসি। ঢাকায় এসে আমার ভাবনাগুলো দানা বাঁধতে শুরু করে যে, আমি লেখক হব এবং পেশা হিসেবে সাংবাদিকতাকে বেছে নেব। তখন আমি এক বন্ধুর সঙ্গে শওকত আলী স্যারের কাছে যাই। তাঁর ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ পড়ে আমি মুগ্ধ ছিলাম। অসাধারণ তাঁর সেই উপন্যাসটি। এছাড়াও তিনি দারুণ গল্প লেখেন। তাঁকে তখন একরকম আইডল ভাবতে শুরু করেছি।

স্যারের কাছে গিয়ে বললাম, স্যার, আমি তো লেখালেখি করতে চাই, তা কোন পেশা বেছে নিলে আমার জন্য ভালো হয়? তিনি তখন টিকাটুলির ওদিকে থাকতেন। স্যার বললেন, তুমি যদি লেখালেখি করতে চাও, শিক্ষকতা পেশাকে গ্রহণ করতে পারো। এই পেশাটি তোমার জন্য ভালো হবে বলে মনে করি। আমি বললাম, যদি সাংবাদিকতা পেশা গ্রহণ করি? আমার তো এদিকেই ঝোঁক। স্যার বললেন, এটাতে তোমার অনেক সময় নষ্ট হবে। তবে তুমি চাইলে করতে পারো। পরে আমার নিজেরই মনে হলো, সাংবাদিকতা পেশাটিই আমার জন্য উপযুক্ত হবে।

লেখকই হতে চান- এটা সিরিয়াসলি কখন ভাবলেন?

মোস্তফা কামাল : প্রথম যখন লিখতে শুরু করি, তখন থেকেই ভাবনাটি ছিল। কিন্তু ঢাকায় এসে সিরিয়াসলি ভাবতে থাকি যে, আমি লেখকই হব। তখন নিয়মিত লেখার চেষ্টা করছি। জাতীয় কবিতা পরিষদে যাই। বইমেলায় ঘুরি। সাহিত্যিকদের সঙ্গে মিশি। এবং ভাবতে থাকি যে, আমাকে দিয়ে অন্য কিছু হবে না। আমি লেখালেখিই করব এবং আমার পেশা হবে সাংবাদিকতা। পরে আমি সাপ্তাহিক রোববার পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হই। তারও আগে সাপ্তাহিক ঢাকা এবং পূর্বাভাস পত্রিকায় কাজ করি। পেশা হিসেবে আমার জীবন তখনো শুরু হয়নি। কিন্তু রোববারে নিয়মিত রাজনৈতিক বিষয়ে লিখি। রিপোর্টিং করি। ওখানে একজন আমাকে বলল, আপনার সঙ্গে তো মিশু সাহেবের ভালো পরিচয় আছে।

আপনি তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। পরে আমি শুটিং বিষয়ক একটি প্রতিবেদন লেখার কাজে শুটিং ক্লাবে যাই। ওখানে গিয়ে পরিচয় হয় আলতামাশ কবির মিশুর সঙ্গে। দৈনিক সংবাদের এখন যিনি সম্পাদক; তখন তিনি ছিলেন নির্বাহী সম্পাদক। যে কোনো কারণেই হোক তিনি আমাকে পছন্দ করলেন এবং শুটিং নিয়ে ইত্তেফাকের তরুণ কণ্ঠে প্রকাশিত লেখাটি দেখে খুশি হলেন। পরে বললেন যে, তুমি এসো। কথা হবে।

রোববারের যিনি আমাকে মিশু সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে বলেছিলেন, তিনি সংবাদেও কাজ করতেন। তিনি বললেন যে, আপনি এখানে বসে কী করেন? সংবাদে যান, ওখানে আপনি ভালো করতে পারবেন। তিনি আসলে প্রুফ রিডিংয়ের কাজ করতেন। ঐ সময়ে পরিচয় হয় মতিউর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে, তিনি তখন বাংলাবাজার পত্রিকার সম্পাদক। তিনিও বললেন, এসো। কাজ করো। তখন একদিন আমার এক সুহৃদ এলেন বাদশাহ নামে। তিনি জীবনবীমায় কাজ করতেন এবং হাত দেখতেন। প্রফেশনাল না, কিন্তু ভালোই দেখতেন।

তিনি আমার হাত দেখে বললেন যে, আপনি সাংবাদিকতায় ভালো করবেন। আপনি দৈনিকে ঢোকেন না কেন? তখন আমি বললাম, আমার কাছে তো দুইটা অফার আছে একটা হচ্ছে বাংলাবাজার পত্রিকায় এবং অন্যটি সংবাদে, কোনটায় যাব বলেন? তিনি বললেন, সংবাদে ঢোকেন। আমি মিশু সাহেবের সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি বললেন যে, কালই জয়েন করেন। পরদিন আমি সিভি নিয়ে গেলাম, তিনি সঙ্গে সঙ্গে আমাকে নিয়োগপত্র দিয়ে দিলেন।

সংবাদে কী হিসেবে জয়েন করলেন?

মোস্তফা কামাল : সংবাদে আমি যোগ দেই স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে, কিন্তু নানা ধরনের কাজ করি। কখনো পলিটিক্যাল বিট করি, কখনো চিফ রিপোর্টার আমাকে সচিবালয়ে পাঠায়। এভাবে কাজ করি। তখন আহমদুল কবীর সম্পাদক, বজলুর রহমান ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক। একদিন মিটিংয়ে সম্পাদক বললেন যে, আমাদের তো ডিপ্লোম্যাটিক বিট খালি, ওখানে কেউ নেই। কে এটা করতে পারবে? আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। আমি তখন একেবারে নতুন। তিনি অত্যন্ত রাশভারী স্বভাবের মানুষ। বললেন যে, তুমি পারবে? আমি আÍবিশ্বাসের সঙ্গে বললাম, পারব। তিনি বললেন, ঠিক আছে। তাহলে তুমি কাল থেকেই শুরু করো। আমি কাজ শুরু করি এবং লাকিলি কিছু ভালো রিপোর্ট পেয়ে যাই। এভাবে লেখালেখি ও সাংবাদিকতা একসঙ্গে চলতে থাকে।

শহীদ আসাদকে নিয়ে যে আপনার বই বের হয়, সেটা কি সাংবাদিকতার সুবাদেই?

মোস্তফা কামাল : সেই সময় আমি শহীদ আসাদকে নিয়ে আমি বেশ কিছু ধারাবাহিক রিপোর্ট করি। পত্রিকায় প্রকাশের পর বেশ সাড়া পাই। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক সাখাওয়াত আলী খান স্যার আমার লেখাটি পছন্দ করেন। তিনি ছিলেন আসাদ পরিষদের সভাপতি। আমার সেই লেখার সূত্রে তাঁর সাক্ষাৎকারও নিয়েছিলাম। তিনি একদিন বললেন, আমরা তোমার লেখাগুলো দিয়ে বই করব। পরে আমি আসাদের গ্রামের বাড়ি নরসিংদীতে যাই এবং বিভিন্ন লাইব্রেরিতে যাই। হোমওয়াকং ও ফিল্ডওয়ার্ক করে ভালোভাবে পাণ্ডুলিপিটি তৈরি করি। আমার তো ধারণাই ছিল না যে বই হবে। পরে ‘আসাদ থেকে গণ-অভুত্থান’ নামে, বইটি বের হয় এবং বেশ সাড়া ফেলে।

কিন্তু মৌলিক লেখক হিসেবে আপনার প্রেরণা ও যাত্রাটা কখন শুরু হলো?

মোস্তফা কামাল : ১৯৯১ সাল থেকেই আমি নিয়মিত লিখতে শুরু করি। বই প্রকাশিত হয়েছে পরে, কিন্তু আমি নিয়মিত লিখি। প্রতিদিনই লিখি। আমি বাবার অনুরোধে বিসিএসের ফরম তুলেছিলাম, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরীক্ষা দেইনি। ইনফ্যাক্ট, আমার স্বপ্ন ও ব্রতই ছিল যে, আমি লেখকই হব। অন্য কোনো কিছু আমাকে দিয়ে হবে না। এ বিষয়ে আমাকে নানা ধরনের সমস্যায়ও পড়তে হয়েছে। খুব একটা সাপোর্টও পাইনি। কিন্তু আমার মা ছিল একমাত্র প্রেরণা। তিনি আমাকে খুব উৎসাহিত করতেন। প্রথমদিকে মা ছাড়া আর কেউ আমার লেখা নিয়ে মূল্যায়ন বা সাপোর্ট করেনি। মা বলতেন, ও অনেক বড় লেখক হবে এবং নাম করবে। মা সবসময়ই পাশে থেকেছেন। মায়ের প্রেরণা আমার জীবনের বড় পাথেয় হয়ে ছিল এবং এখনো আছে।

সম্প্রতি আপনার দুটি উপন্যাসের ইংলিশ ভার্সন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রকাশিত হয়েছে। এ বিষয়ে আপনার সংক্ষিপ্ত অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা জানতে চাই?

মোস্তফা কামাল : আমার লেখালেখি জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় ঘটনা। দীর্ঘ লেখকজীবনে এটাকে আমি এক ধরনের প্রাপ্তিও মনে করি। যে প্রাপ্তিটা বাংলাদেশের অনেক বড় পুরস্কারের চেয়ে সুন্দর এবং গৌরবের। এখানে দুটি উপন্যাস বলতে, প্রথমটি ছিল ‘থ্রি নভেলস’ এবং আর একটি ‘দ্য মাদার’। থ্রি নভেলস বেরিয়েছে ভারতের নোশানপ্রেস থেকে। এখানে মোট তিনটি উপন্যাস আছে- প্রথমটি ফ্লেমিং ইভেনটাইড, যা ‘বারুদপোড়া সন্ধ্যা’ নামে প্রকাশিত হয় অনন্যা থেকে। পরের উপন্যাস ‘হ্যালো কর্ণেল’ প্রকাশিত হয় অবসর প্রকাশনা সংস্থা থেকে। এবং তৃতীয় উপন্যাসটির নাম ‘তেলবাজ’, এটিও অনন্যা থেকে প্রকাশিত হয়। তিনটি উপন্যাসই আমার প্রিয়। তিনটি বইকে একত্রে নামকরণ করা হয়েছে ‘থ্রি নভেলস’। আর একটি বই হচ্ছে ‘দ্য মাদার’। এটি আমার ‘জননী’ উপন্যাসের ইংরেজি সংস্করণ।

‘জননী’ও আমার খুব প্রিয় একটি উপন্যাস। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় পার্ল পাবলিকেশন্স থেকে। লন্ডনের অলিম্পিয়া পাবলিশার্স থেকে বেরিয়েছে। বছর খানেক আগে আমি উপন্যাসটির সিনফসিস পাঠিয়েছিলাম। পরে অলিম্পিয়া পাবলিশার্স আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং বলে যে, তোমার এই বইটি অন্য রকম লাগছে। তুমি আমাদেরকে এর ম্যানস্ক্রিপ্ট পাঠাও। ছয় সপ্তাহ পরে তাদের এডিটোরিয়্যাল বোর্ডের যিনি প্রধান, তিনি আমাকে বড় একটি চিঠি লেখেন এবং জানান যে, তারা বইটি প্রকাশ করতে চায়। অত্যন্ত গোছানো ও পরিকল্পিতভাবে তারা কাজটি করেছে।

একজন লেখকের যে রাইট রয়্যালটি, স্বত্ব, সম্মান- সমস্ত কিছু তাতে উল্লেখ করা আছে। সবকিছুই হয়েছে আন্তর্জাতিক কাঠামোতে। বই প্রকাশের আগেই সব বিষয়ে লেখককে তাঁরা অবহিত করেন এবং লেখকের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেন। দুটো বইই নতুন পাঠক ও নানা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। একজন লেখক হিসেবে এটা আমার জন্য অত্যন্ত আনন্দের বিষয়। কোনো লেখকের লন্ডন থেকে বই বের হওয়া বিশেষ করে বাঙালি লেখকের, এটা বিরল। বড় ঘটনা। আমি খুবই আনন্দিত। বইটি বাংলাদেশের বাজারে খুবই শিগগিরই চলে আসবে।

আমাদের এখানে সাহিত্যের জনপ্রিয় ও সিরিয়াস ধারা হিসেবে দুটি টার্ম প্রচলিত আছে। অনেক সময় জনপ্রিয় লেখককে হালকা লেখক বিবেচনা করা হয়। আপনি একই সঙ্গে জনপ্রিয় ও সিরিয়াস ধারার লেখক। এই বিষয়টি কীভাবে বিবেচনা করেন?

মোস্তফা কামাল : আমি মনে করি না যে সাহিত্যে জনপ্রিয় ধারা এবং সিরিয়াস ধারা বলে কিছু আছে বা থাকা উচিত। এই বিষয়টি কয়েক বছর আগে কিছু লেখক উপস্থাপন করার জোর চেষ্টা করেছিলেন। তাহলে রবীন্দ্রনাথকে আমরা কী বলব? তিনি তার সময়ে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ছিলেন। কিংবা নজরুল? তাঁকে আমরা কী বলব? একই সঙ্গে তারা জনপ্রিয় এবং সমালোচিতও ছিলেন। আজকে যদি আমরা পেছন ফিরে তাকাই, যারা সমালোচনা করেছিল, তারা কোথায় আর রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল কোথায়? তাঁদের লেখা পড়তে গেলে মনে হয়- কত প্রাসঙ্গিক এবং জীবন্ত। জীবনঘনিষ্ঠ। আমি যেটা বলতে চাই, জীবনঘনিষ্ঠ এবং ভালো লেখা ছাড়া কোনো লেখার মূল্য নেই।

ভালো লেখা ছাড়া কোনো লেখা শেষ পর্যন্ত টিকবে না। কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাবে। ঠিক এ বিষয়েই দৈনিক কালের কণ্ঠে একটি কলাম লিখেছি। তবে হ্যাঁ, কোনো লেখকের সব লেখাই ভালো হবে বা টিকে থাকবে- এমন নয়। কারণ অনেক সময় দ্রুত লেখার কারণে কোনো লেখকের লেখা ঝুলে যেতে পারে। সে জন্যই তো বলা হয়- কোনোটা ডানহাতের লেখা বাঁ হাতের লেখা। কিন্তু লেখকমাত্রই তার সেরা লেখাটা লেখার চেষ্টা করেন। এখন কেউ যদি প্রেমের উপন্যাস লেখেন, তাহলে তো সেটা অগ্নিকন্যার মতো সিরিয়াস কিছু হবে না। ওটা তো ভালোবাসার উপন্যাস, টিনএজ ছেলেমেয়ের মন ও চাওয়া-পাওয়ার গল্প নিয়ে লেখা।

একজন লেখকের নানা ধরনের লেখা থাকবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভালো লেখাটাই টিকে থাকে। অনেকে কম লিখবেন, আবার কেউ বেশি লিখবেন। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস কম লিখেছেন, কিন্তু যা লিখেছেন, সলিট লিখেছেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েই লিখেছেন যে, তিনি একটা চিলেকোঠার সেপাই বা খোয়াবনামা লিখবেন। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েই লিখছি যে, নানা ধরনের লেখা লিখব। আমি প্রতিদিন লিখি। কাজেই প্রতিদিন লিখলে তো বেশি লেখা হবেই। লেখাটা খুব ভেতরের বিষয়। কারণ যে কেউ ইচ্ছে করলেই লেখক হতে পারে না।

সাহিত্য পুরস্কার নিয়ে সম্প্রতি আপনার একটি কলাম প্রকাশিত হয়েছে। লেখক নন, লেখাই বিবেচ্য হওয়া জরুরি; কিন্তু পুরস্কারের ক্ষেত্রে লবিং ও ব্যক্তিগত সম্পর্ক গুরুত্ব পাচ্ছে। এটা তো প্রকৃত সাহিত্য ও সাহিত্যিকের জন্য বেদনার। এর সমাধান কী?

মোস্তফা কামাল : খুবই ভালো প্রশ্ন। বিষয়টি সত্যি বেদনার। সাম্প্রতিক কালে আমরা এমনটাই দেখে আসছি, যেমনটি তুমি বলেছ। ভালো লেখকরা পুরস্কার পাননি, এমন নয়। অনেক ভালো লেখক লেখার স্বীকৃতি হিসেবে পুরস্কার পেয়েছেন। কিন্তু এখন যেটা দেখছি, বাংলা একাডেমি তার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করেছে। অনেক সময় দেখা যায়, লবিং করে অনেকে পুরস্কার পেয়ে যায় এবং পরবর্তীতে অনেক লেখক সেই পথ অবলম্বন করেন। ফলে সিরিয়াস যারা লেখক তারা আহত হন। তাদের জন্য এটা বেদনাদায়ক।

সঠিক সময়ে মূল্যায়ন না করে মরণোত্তর পুরস্কার দেওয়া হয়, যা একদমই কাজের জিনিস বলে মনে হয় না। পুরস্কার পেতেই হবে, এমন নয়। পুরস্কার এক ধরনের প্রেরণা দেয়। কিন্তু লেখকের সবচেয়ে বড় পুরস্কার হচ্ছে পাঠকের ভালোবাসা। তবে আমি মনে করি, ভালো লেখকের পুরস্কার পাওয়া উচিৎ। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে ভালো লেখককে খুঁজে তাকে পুরস্কৃত করা।

আপনার প্রকাশিত বইগুলোর মধ্যে অন্যতম ‘জননী’ উপন্যাস, এটির কথা বেশি শোনা যায়। এ উপন্যাসটি লেখার ভাবনা ও প্রেরণা কীভাবে পেয়েছিলেন?

মোস্তফা কামাল : মাকে নিয়ে আমি বেশ কিছু উপন্যাস পড়েছি দেশের এবং দেশের বাইরের। অনেকে মাকে নিয়ে ভালো উপন্যাস লিখেছেন। ম্যাক্সিম গোর্কী লিখেছেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, শওকত ওসমান, আনিসুল হক প্রমুখ লেখক লিখেছেন। কিন্তু সত্যিকার অর্থে মধ্যবিত্ত পরিবারের বেড়ে ওঠা, লড়াই ও ভাঙন ও চালচিত্রকে উপজীব্য করে মাকে নিয়ে তেমন উপন্যাস আমি পাইনি। আমি আমার নিজের মাকে দেখেছি।

মধ্যবিত্ত পরিবারে মায়ের যে ত্যাগ ও নীরব লড়াই, সেটাই এখানে ধরতে চেয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের পরে দেশটা কীভাবে এগিয়েছে এবং মধ্যবিত্ত একটি পরিবার শূন্য থেকে কীভাবে চ‚ড়ায় পৌঁছেছে. সেটাই আমি ধরতে চেয়েছি। দেশের আর্থসামাজিক বিবর্তন এবং পরিবারের উত্থান ও এগিয়ে যাওয়া- এগুলো আমাকে খুব স্পর্শ করেছিল। এই চিন্তা থেকেই মূলত উপন্যাসটি লিখেছি। মায়ের যে অবদান ও ভূমিকা-সেটা তো আসলে আমরা মনে রাখি না বা মনে করি না। সেই বিষয়গুলো ধরতে চেয়েছি।

‘জননী’ লিখতে কতদিন লেগেছিল?

মোস্তফা কামাল : লেখাটি লিখতে অনেক দিন লেগেছে। কারণ একটানা এটা লেখা হয়নি। লিখেছি, আবার ভেবেছি। নতুন করে ভেবেছি। হাজার হোক মা তো। কোন বিষয়ে নজর দিতে হবে, কীসে জোর দিতে হবে। এগুলো নিয়ে গবেষণা করেছি।

আপনি লেখালেখির শুরুতে নিয়মিত গল্প উপন্যাস লিখেছেন। পরে আপনার কলমে রম্য, হাসির গল্প-উপন্যাস, রহস্য-সায়েন্স ফিকশন, নাটক ও রাজনৈতিক কলাম বেরিয়েছে। এই যে বিভিন্ন শাখায় অভিযাত্রা- এর পেছনে কী অভিপ্রায় কাজ করেছে?

মোস্তফা কামাল : ছড়া দিয়ে আমি লেখালেখি শুরু করি, কিন্তু ক্রমশ আমি নিজের ভেতরে এমন আশাও লালন করি যে, কেবল ছড়া-কবিতার মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখতে চাই না। আমি গল্প উপন্যাস সায়েন্স ফিকশন ভৌতিক উপন্যাস ছোটদের লেখা- সবই লিখতে চাই। এভাবে সাহিত্যের নানা মাধ্যমে আমার লেখাটাকে আমি বিস্তৃত করেছি। আর শুরু থেকেই আমার একটা প্রবণতা ছিল- নিজেকে ভাঙা এবং নানাভাবে কাজ করা। সেই মনোভাব থেকেও এমন ঘটতে পারে। আমি মনে করি, নিজেকে ভাংতে হবে। আমি চেয়েছি নানা ধরনের লেখা লিখতে, যাতে পাঠক আমাকে নানাভাবে খুঁজে পান।

শুরুর দিকে না হলেও এখন কিশোরদের জন্যও নিয়মিত গল্প উপন্যাস লিখছেন। কোন ভাবনা থেকে শুরু করলেন?

মোস্তফা কামাল : শিশু-কিশোরদের জন্য আমি প্রথম সায়েন্স ফিকশন লিখি ২০০৫ সালে। এর আগে আমি ছোটদের জন্য গল্প লিখেছি, কিন্তু তখনো বই আকারে প্রকাশ করিনি। প্রথমে তো বড়দের জন্য লিখেছি, সত্য। কিন্তু সচেতনভাবে ছোটদের জন্য লিখতে শুরু করি একটি ঘটনার পর। সেই ঘটনাটি আমার মনে খুব রেখাপাত করে।

একবার বইমেলায় আমি একটি স্টলে বসে আছি। তখন একজন কিশোর আমার একটি বই দেখিয়ে বলল, এই লেখকের আমাদের জন্য লেখা কোনো বই নেই? বিষয়টি আমাকে নাড়া দেয়। তখন আমি বিষয়টি নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবি যে, শিশু-কিশোরদের জন্য লিখব। ছোটরা তো বিনোদনের জন্য ভালো কিছু পায় না। তাদেরও তো মনের তৃষ্ণা আছে। চাওয়া আছে।

প্রথমদিকে রাজনৈতিক ঘটনা ও ভাবনা নিয়ে কলাম লিখতেন, পরে উপন্যাসও লিখতে শুরু করেন। ‘জিনাত সুন্দরী ও মন্ত্রিকাহিনি’ বা ‘বারুদপোড়া সন্ধ্যা’- এ পর্বের উপন্যাস। এর নেপথ্যকথা বলুন?

মোস্তফা কামাল : উপন্যাসে অনেক ভালো বিষয় থাকে, বা ভালো বিষয় নিয়ে উপন্যাস লেখা হয়। কিন্তু এরচেয়ে ভালো বিষয় কমই আছে, যেগুলো রাজনৈতিক কলাম হিসেবে লেখা হয়। বারুদপোড়া সন্ধ্যায় আমি দেখাতে চেয়েছি- এরশাদের আমলের ঘটনা। তখন একটি ছেলে পুলিশি হেফাজতে মারা যায়। নির্যাতিত হয় খুব। কিন্তু আমি আমার উপন্যাসে দেখিয়েছি যে, মারা যায়। তখন একজন জামায়াত ভাবধারার মন্ত্রী ছিল।

যেটা আমরা মুক্তিযুদ্ধের পরে কল্পনাই করিনি, সেই ঘটনাই ঘটল? এটা আমাকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। তখন জামায়াত ক্ষমতায় নয়, তারা বিএনপির সঙ্গে জোট বেঁধে রাজনীতি করছিল। তারা নির্বাচন করেছে, ক্ষমতায় এসেছে এবং প্রভাব বিস্তার করেছে। ফলে ঘটনাটি আমার মনে খুব দাগ কাটে। তখন এই উপন্যাসটি লেখার প্রেরণা পাই। লেখার জন্য এটা আমার কাছে ভালো বিষয় মনে হয়েছে। শুধু রাজনৈতিক প্রবন্ধ নিবন্ধ লিখে এমন একটি ঘটনা শেষ হয়ে যাবে? না।

মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। সেই ঘটনা ও সময়ের প্রেক্ষাপটে লিখেছেন ‘জনক ও জননীর গল্প’ উপন্যাস। এ নিয়ে আর কোনো লেখা কি লিখছেন?

মোস্তফা কামাল : মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমি কিছু কাজ করেছি। কিছু গল্প লিখেছি। ‘জনক ও জননীর গল্প’ আমার একটি দীর্ঘ উপন্যাস। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ ঘটনা। কেবল কিছু প্রবন্ধ ও ইতিহাস দিয়ে এই ঘটনা ধরা সম্ভব নয় বলে আমি মনে করি। আরো বড় পরিসরে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গল্প উপন্যাস লেখার ইচ্ছে আছে।

আপনি বিচিত্র বিষয় ও ভাবনাকে উপজীব্য করে গল্প উপন্যাস লেখেন; তরুণদের সুখ-দুঃখ নিয়ে লিখেছেন ‘ব্যাচেলর’, ‘পারমিতাকে শুধু বাঁচাতে চেয়েছি’ বা ‘চাঁদের আলোয় চেরাগ আলী’ প্রভৃতি উপন্যাস। লেখায় বিষয়বৈচিত্র্যের ভাবনা নিয়ে কিছু বলুন?

মোস্তফা কামাল : প্রথম থেকেই আমি সচেতনভাবে নির্দিষ্ট গণ্ডিতে আটকে না থেকে নানা বিষয়ে এবং নানা ধরনের লেখা লিখতে চেয়েছি। সমাজে নানা অসঙ্গতি, সমস্যা ও গল্প থাকে, যেটা অনেক সময় পত্রিকার কলামে বলা যায় না। তখন গল্প উপন্যাস বা সায়েন্স ফিকশন রহস্য উপন্যাস বা কখনো রম্য লেখার মাধ্যমে তুলে আনতে হয়। যেমন একবার এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিল এক লেখককে, সমাজে আমরা এত অনাচার ও ঘটনা দেখি, সেগুলো তো সব সময় পত্রিকায় আসে না।

সেগুলো যায় কোথায়? লেখক উত্তর দিয়েছিলেন, এগুলো লেখকের মাথায় ভর করে। তারপরে? তারপর লেখক তার সৃজনশীল লেখায় সেসব ঘটনা ও গল্প তুলে আনেন। যে দেশে এসব ঘটনা ঘটে এবং পত্রিকায় তা আসে না, সেখানে লেখকরা লেখার রসদ বেশি পান বলে আমার ধারণা। সমাজের নানা অসঙ্গতি ও ঘটনার আমিও একজন চরিত্র- ফলে নিজেকে কোনো না কোনোভাবে সম্পৃক্ত বোধ করি, যেগুলো আমাকে লেখক হিসেবে স্পর্শ করেছে।

প্রত্যেক লেখক ও শিল্পীর স্বপ্নের সৃষ্টি বলে একটা ব্যাপার থাকে, যে সৃষ্টি তাকে অনেকদনি বাঁচিয়ে রাখবে। আপনি কি সেই স্বপ্নের লেখাটি লিখতে পেরেছেন?

মোস্তফা কামাল : ভালো লেখার স্বপ্ন সব লেখকেরই কমবেশি থাকে। তিনি নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যান। আমি আমার শ্রেষ্ঠ লেখাটি লিখতে পেরেছি তা না বলে এভাবে বলতে পারি, সেই স্বপ্নময় লেখার চেষ্টা করেছি। এখনো করে চলেছি। সেই চেষ্টার অংশ ধরা আছে আমার জননী উপন্যাসে, কিংবা জনক ও জননীর গল্প বা আমার তিন খণ্ডের ট্রিলজির মধ্যে। বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ কালপর্বটি নানা কারণে নানাভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

দেশভাগ কেন এবং কীভাবে ঘটেছিল? মুক্তিযুদ্ধ কেন অনিবার্য হয়েছিল? দেশটা কীভাবে স্বাধীন হলো? বঙ্গবন্ধু কীভাবে অবিস্মরণীয় নেতৃত্ব দিয়ে দেশটাকে সংগঠিত করলেন, মানুষকে ভালোবাসলেন, মানুষ তার নামে জীবন দিতে পিছপা হয়নি এবং তিনি চূড়ান্তভাবে দেশটা স্বাধীন করলেন- এসব ঘটনা ও ইতিহাস এবং ইতিহাসের চরিত্রদের নিয়ে আমি লিখেছি অগ্নিকন্যা, অগ্নিপুরুষ ও অগ্নিমানুষ উপন্যাস। এগুলো আমার স্বপ্নের লেখা। এসব লেখার পেছনে আমার দীর্ঘদিনের সাধনা, পরিশ্রম ও স্বপ্ন জড়িয়ে আছে। শত শত বই পড়তে হয়েছে। নানাভাবে নিজেকে গড়তে ও ভাঙতে হয়েছে। এমন আরো অনেক লেখার জন্য আমার পরিকল্পনা আছে। তো আমি মনে করি, এগুলো আমার সেই স্বপ্নছোঁয়া লেখা।

লেখালেখি নিয়ে আপনার নতুন ভাবনা ও পরিকল্পনার কথা কিছু বলুন?

মোস্তফা কামাল : আমি আরো বড় কাজ করতে চাই। ইতিহাসের নানা সময় ও শাসককে নিয়ে ব্যতিক্রমী লেখা লিখতে চাই। নবাবদের নিয়ে কাজ করতে চাই। যেগুলো নিয়ে খুব একটা লেখা হয়নি। আমার পড়াশোনা ও প্রস্তুতি চলছে। আমার আসলে লেখার জায়গা নেই। জায়গা নেই বলতে, সবসময় তো বাসায় লিখতে পারি না। অফিসের কাজে অনেকটা সময় দিতে হয়। ফলে যখন লিখি, নিবিষ্ট হয়ে যাই। গাড়িতে করে যাচ্ছি, গাড়ি চলছে কিনা, রাস্তায় কি জ্যাম? পথে কোনো গণ্ডগোল হচ্ছে? কিছুই আমাকে স্পর্শ করে না। দুই পায়ের উপর ল্যাপটপ রেখে আমি লেখায় ডুবে যাই। সময় পেলেই পড়ার চেষ্টা করি এবং লিখে যাই।

পাঠকের অনুরাগকে কীভাবে দেখেন? পাঠকের মুগ্ধ প্রতিক্রিয়া বা কড়া সমালোচনা পেলে কী বোধ করেন?

মোস্তফা কামাল : পাঠকের অনুরাগ তো খুবই ভালোলাগে। পাঠকের ভালোবাসা ও অনুরাগই লেখকের সবচেয়ে বড় পাওয়া। আর সমালোচনাকেও আমি ইতিবাচক হিসেবে গ্রহণ করি। গঠনমূলক সমালোচনা অবশ্যই ভালো। কোনো কোনো পাঠক আবার এত এগ্রেসিভ থাকেন, তাদের মন্তব্য আহত করে। তবুও আমি তা নিতে জানি। এগুলো আমাকে সমৃদ্ধ করে। কারণ সব ধরনের পাঠকই তো থাকবেন। আবার মুগ্ধ পাঠকও অনেক আছেন। একবার এক বয়স্ক ব্যক্তি বইমেলায় আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। তাঁর বয়স প্রায় আশি হবে। তিনি জননী উপন্যাস পড়ে আমার সঙ্গে দেখার বাসনা করেছিলেন।

বইমেলায় পার্ল পাবলিকেশন্সে ঘটনাক্রমে আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম। তিনি আমাকে পেয়ে আমার হাতটি ধরলেন এবং শক্ত করে ধরে রাখলেন অনেক সময়। আমি বললাম, আমার কোন বই পড়েছেন? তিনি বললেন, আপনার দুটো উপন্যাস আমি পড়েছি- জননী এবং পারমিতাকে শুধু বাঁচাতে চেয়েছি। আমি বললাম, কেমন লেগেছে? তিনি বললেন, ক্লাসিক। অসাধারণ। ওই বছরই আরেকজন তরুণ পাঠক পেয়েছিলাম, তরুণ পাঠক। যিনি আমার প্রায় সব বইই কিনেছেন এবং তার ফেসবুক পেজে সব বইয়ের ছবি ও তথ্য দিয়েছেন। এমন ঘটনা যখন ঘটে, মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। আমি মনে করি, লেখক হিসেবে এটা অত্যন্ত আনন্দের।

আপনার লেখার ভুবনে নিমগ্ন হলে পাঠকের কোন প্রত্যাশা পূরণ হতে পারে?

মোস্তফা কামাল : পাঠক কী চায়, সেটা আমি সবসময় বিবেচনায় রাখি না। আমার নিজের ভাবনা ও সৃজনশীলতাকে গুরুত্ব দিয়ে থাকি। পাঠকের সন্তুষ্টির কথা মাথায় না রেখে, যেহেতু আমি একজন ক্রিয়েটিভ মানুষ হিসেবে, আমার রুচিবোধ আছে, চিন্তা ও দর্শন আছে, লেখার মাধ্যমে আমি আমার ভেতরের ভাবনা ও দর্শনকেই তুলে ধরি। আর আমি তো আমার রুচিবোধের বাইরে যাব না।

পাঠকের পছন্দের কারণে সবসময় প্রেমের উপন্যাসই লিখে যাব, সেটাও মনে করি না। বিভিন্ন ধরনের লেখার মাধ্যমে আমি বিচিত্র পাঠকের মনের ভেতরে একটা চিন্তার জায়গা তৈরি করতে চেষ্টা করি। মানুষ ও সমাজের নানা ঘটনা ও গল্প বলতে চেষ্টা করি, যেটা দিয়ে পাঠক সম্পৃক্ত বোধ করতে পারে। সেখানে সুখ আছে, বেদনা আছে- ইতিবাচক গল্পও থাকবে।

আপনি কি তরুণদের লেখা পড়েন? তরুণদের মধ্যে কাদের লেখা আপনার ভালোলাগে?

মোস্তফা কামাল : নাম বলতে চাই না। কিন্তু আমি প্রচুর পড়ি। পড়ার চেষ্টা করি। কবিতা গল্প উপন্যাস- তরুণদের নানা ধরনের লেখা পড়ি। তাদের ভাবনা ও সৃজনশীলতা বোঝার চেষ্টা করি। তারা কী নিয়ে লেখে এবং তাদের ভাবনার জায়গাটা বোঝার চেষ্টা করি। আমি এখনো মনে করি না যে, আমি একজন খুব প্রবীণ বা সিনিয়র লেখক। আমি নিজেকে এখনো তরুণ লেখকই মনে করি। তবে আমার চেয়ে বয়সে কম যারা, তাদের লেখার জায়গাটা মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করি। তরুণদের মধ্যে অনেকে ভালো লেখেন। দেশ ও সমাজ নিয়ে তারা ভাবেন, এসব আমাকে মুগ্ধ করে।

পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত লেখক সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত ছিলেন। আপনি দেশের শীর্ষ দৈনিকের নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে কাজ করছেন; এ পেশা কি লেখার জন্য সহায়ক, নাকি অন্য সব পেশার মতো এটিও একটি সাধারণ পেশা?

মোস্তফা কামাল : আমি তো বলি সহায়ক। কারণ আমি আমার জীবন থেকে বলতে পারি, আমি অনেক উপন্যাস লিখতে পেরেছি, সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত আছি বলেই। বই পড়ে মানুষ ও সমাজ সম্পর্কে সবটুকু জানা হয় না। দেশ ভ্রমণ করলে, মানুষের কাছে গেলে লেখার অনেক রসদ পাওয়া যায়। নতুন মানুষ, সংষ্কৃতি ও জীবনাচরণ সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। যেটা অন্য কোনোভাবে পাওয়া সম্ভব নয়। লেখকরা নিজের ভেতরের ভাবনা ও কল্পনা থেকেই লেখেন। কিন্তু ভ্রমণের অভিজ্ঞতা তাকে সমৃদ্ধ করে। কাজেই এই পেশাটি আমাকে বরং সমৃদ্ধ করেছে।

সময় ও রাজনৈতিক বৈরী হাওয়ার কারণে অনেক সময় সাংবাদিকরা সত্য বা বাস্তবচিত্র লিখতে পারেন না। লিখলেও বিপত্তির মুখে পড়তে হয়। একজন মৌলিক লেখক হিসেবে আপনি কি তেমন সমস্যা বোধ করেন?

মোস্তফা কামাল : সমাজের অনেক ঘটনা ও রাজনৈতিক অনাচার সাংবাদিকরা অনেক সময় লিখতে পারেন না। তারা সেসব আড়াল করেন। মৌলিক লেখককরা সেসব তাদের সৃজনশীল লেখায় ব্যবহার করেন। তুমি জানো যে, আমি পত্রিকায় কলাম লিখি রঙ্গব্যঙ্গ নামে। সেখানে একটি লেখার জন্য আমি মামলা খেয়েছি। আমাকে হুমকি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমি পিছপা হইনি। লেখক হিসেবে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি আমার দায়বদ্ধতা আছে। শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা আছে। কিন্তু আমি কোথায় বিপ্লবী হই- কোথাও কোনো অন্যায় হলে বা কোনো নিপীড়ন ঘটলে। সেই জায়গায় তো আমাকে বাধা দেওয়া যায় না। লেখক হিসেবে আমি সেই বিষয়গুলো না লিখে পারি না।

লেখকের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও বিবেচনা যদি তার লেখায় প্রতিফলিত হয়, তাহলে সার্বিকভাবে সমাজ ও মানুষকে দেখার ক্ষেত্রে কোনো ব্যত্যয় ঘটতে পারে কি?

মোস্তফা কামাল : পারে। কারণ লেখকের লেখাটা অনেক শক্তিশালী। লেখাটা রাষ্ট্রের অনেক জায়গায় প্রভাব ফেলে। ভূমিকা রাখে। লেখার জন্য সমাজেও প্রভাব ফেলে। কিন্তু একজন লেখকের জন্য স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব বিষয়ে কোনো আপোস করা উচিৎ নয়। জঙ্গিবাদ বা ধর্মীয় উগ্রবাদ প্রশ্নে কোনো লেখকের সাপোর্ট করা উচিৎ নয়। লেখক সর্বজনীন। কাজেই কোনো ধর্মকেই তিনি খাটো করে দেখতে পারেন না। দল মত ধর্ম সবার কথা মাথায় রেখে তিনি লিখবেন। কারো মনে তিনি আঘাত দেবেন না। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মনেও তিনি আঘাত দিতে পারেন না।

সাংবাদিকতা বিষয়ে আপনার ভবিষ্যৎ ভাবনা ও স্বপ্নের কথা জানতে চাই।

মোস্তফা কামাল : আমি তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশের নাগরিক। এখানে নানা ধরনের সংকট আছে। এখানে মানবাধিকারের সংকট আছে, গণতন্ত্র, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সংকট আছে। এখানে নিষ্ঠুরতা আছে, দুর্নীতি ও জঙ্গিবাদ, মাদকের বিস্তার আছে। মাদকের কারণে সমাজে নানা কুপ্রভাব পড়ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অব্যবহার আছে। এগুলো থেকে আমি সোচ্চার ও সচেতন থাকতে চাই। যে কোনো অন্যায় ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে কাজ করে যেতে চাই। আমি অবহেলিত ও নির্যাতিতদের পাশে থাকতে চাই। আমি মনে করি, সংবাদপত্র এক্ষেত্রে সমাজে ও রাষ্ট্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।

ইতিবাচকভাবে সংবাদপত্র নানাভাবে কাজ করতে পারে। আমাদের রাজনৈতিক শক্তি যেখানে ব্যহত ও ব্যর্থ হয়, সংবাদপত্র সেখানে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারে। আমি এই পত্রিকা দিয়ে, আমার সাংবাদিকতা ও লেখালেখি দিয়ে সেই কাজটিই করে যেতে চাই। সুসাংবাদিকতা আমার ব্রত। ন্যায়, নৈতিকতা এবং সততা আমি প্রতিষ্ঠা করতে চাই। কালের কণ্ঠ দলনিরপেক্ষ সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর যেন হয়ে ওঠে, সেই লক্ষে কাজ করে যেতে চাই। কোনো মানুষ যেন অন্যায়ভাবে কষ্ট না পায়। মানুষের অধিকার ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে যেন ভূমিকা রাখতে পারে, সেই চেষ্টা অব্যাহত রাখতে চাই।

এইচআর/আরআইপি

আরও পড়ুন